#দ্বিতীয়_বিয়ে
#শারমিন_প্রিয়া
#পর্ব_২(শেষ পর্ব)
কখন যে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছি টের পাইনি। রিয়ার ডাকে ঝট করে ঘুম ভাঙে। লাফ দিয়ে উঠি। ঘড়ির কাটায় তখন বাজে সকাল দশটা৷ তাড়াতাড়ি শাওয়ার নিয়ে নাস্তা করতে যাই। রাইসা ও আছে কিচেনে। আমি রাইসার মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। অপরাধবোধ কাজ করছে। রাইসা আমার দিকে না তাকিয়ে চলে গেল রুমে। আমি তড়িৎ গতিতে চেয়ার ছাড়লাম। রিয়া আমার হাত ধরলো। আমি রিয়াকে উপেক্ষা করে রাইসার রুমে গেলাম। আমাকে দেখামাত্র রাইসা হুদাই গুছানো কাপড় আবার গুছাতে লাগল।আমি পেছন থেকে তার হাত ধরে সামনে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “এমনভাবে এড়িয়ে চলছো কেন আমায়?”
সে শুনেও জবাব দিলো না। আমি তার চিবুক ধরে চোখের দিকে তাকালাম। চোখভর্তি পানি রাইসার৷ টলমল করছে। এটা দেখে আমার কলিজা হু হু করে উঠলো। আমি জড়িয়ে ধরলাম তাকে। সে আজ আর আমায় আটকায় নি। শক্ত করে ধরে রাখলো আরও বেশি করে। কান্নায় ভেঙে পড়ল। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। আমি ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। বললাম, “রাইসা এমন করছো কেন? প্লিজ শান্ত হও।”
“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মাহির! আমি ঠিক থাকতে পারছি না।”
” তুমি না বললে কি আমি বিয়ে করতাম। যদি চাও তো এখনি সব ঠিক করে দেবো।”
রাইসা চোখ মুছে। বলে, “না, না। এরকম কিছুই করবে না। দ্বিতীয় বিয়ে করা কোন খারাপ কিছুই না। তোমার বাচ্চা নেই করেছো, আমিও করিয়েছি। আমার কষ্ট লাগবে স্বাভাবিক। লাগার কথাই। এসব ঠিক হয়ে যাবে নতুবা হবে না। তবে রিকোয়েস্ট তোমার কাছে। আল্লাহকে ভয় পেয়ে তুমি রিয়া আর আমার সাথে সমান ব্যবহার করবে। সমান দায়িত্ব পালন করবে। কাউকে কম আসনে বসাবে না।
দেখো আমি এই কষ্ট থেকে রেহাইয়ের জন্য কিন্তু তোমাকে ছেড়ে যেতে পারতাম। কিন্তু যাইনি। আমি তোমাকে এতটাই ভালোবাসি যে, আমি শুধু ইহকালে নয় পরকালেও তোমাকে চাই। তুমিও তোমার দায়িত্ব সমানভাবে পালন করো।”
রাইসার কথা যত শুনছি ততই আমি মুগ্ধ হচ্ছি। আশ্চর্য্য লাগছে। রাইসার জন্য খারাপ ও লাগছে খুব। নিজেকে স্বার্থপর মনে হলো, মনে হলো সে বলতেই কেন বিয়েটা করে ফেললাম। না করলেও পারতাম। মানুষটা কষ্ট পেতো না।
দিন যাচ্ছে, মাস যাচ্ছে। টের পাচ্ছি দিনদিন আমি স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি। রাইসার দেওয়া কথা রাখতে পারছি না। আমি রিয়াতে মজতে লাগলাম। রাতদিন রিয়ার সাথে বেড শেয়ার করছি। রাইসার কথা বললেই রিয়া অন্যরকম বিহেভ করে। কলাকৌশলে তার দিকে আকৃষ্ট করে।আর আমিও তার মধ্যেই ডুবি। রাইসা কেমন আছে, কেমন থাকে, খেলো কি না তার কোনটার খোঁজ রাখি না। রিয়াই পুরো আমিটাকে গ্রাস করে ফেলছে।
এক রাত দুপুরে রিয়া আর আমি একান্ত মুহুর্তে আছি। বাহিরে তুমুল বেগে বাতাস বইছে শাঁ শাঁ করে। জানলার ফাঁক দিয়ে বাতাস পৌঁছে রুমের পর্দা নাড়াচ্ছে এলোপাতাড়ি। এই হঠাৎ আসা খামখেয়ালি বাতাসের বেগ আমার শরীরে পৌঁছাতেই আমি শিউরে উঠলাম। বুকের বা পাশটা তুমুল ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলো। আমার রাইসার জন্য আজ এই মুহুর্তে মন কেমন করতে লাগলো। আমার সহ্য হলো না। জলদি করে উঠতে গেলেই রিয়া আটকালো। আগুন চোখে তাকাতেই সে ছেড়ে দিলো আমায়। আমি দ্রুত পায়ে রাইসার রুমে আসলাম। রুমের ভেতরে কোথাও রাইসাকে দেখলাম না। কান্না এসে জমাট বাধলো গলায়। আমি বেপরোয়া হয়ে তাকে খুঁজতে খুঁজতে পেছন দিকে গেলাম। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম রাইসাকে। আনমনে দাঁড়িয়ে আছে সে। হাত দিয়ে আকাশপানে কি যেন গুনার চেষ্টা করছে। মন খারাপি দখিনা বাতাসে তার চুল নড়ছে এলোপাতাড়ি। শাড়ির আঁচল উড়ছে। দূর থেকে তাকিয়ে বিষাদীনি লাগছে তাকে। আমার ঠিক সাহস হচ্ছে না তার কাছে যেতে। তার প্রতি এত বেখেয়ালি আমি কি করে হলাম?
নিজেকে আর সামলাতে না পেরে কাছাকাছি গিয়ে তার এলো চুলে নাক ডুবালাম। সে মোটেও চমকালো না। আমার স্পর্শ তার চেনা। চোখ বন্ধ অবস্থায় ঘ্রাণ টানতে টানতে জিজ্ঞেস করলাম, “এত রাতে একলা এখানে কি করো?”
সে শান্ত ভঙ্গিতে বলে, “একলা কোথায়? এই যে রাতের আকাশ আমার সঙ্গী। আমি আজকাল রাতগুলো তারা গুনার বৃথা চেষ্টা করে কাটিয়ে দেই।”
“আমি খুব অন্যায় করে ফেলেছি রাইসা!”
সে ধমকায়, “আরে কীসের অন্যায়? কোন অন্যায় করো নি। আমি বহু আগ থেকেই জানি মানুষ এমনি। নতুন পেলে পাল্টে যায়। তবে এত তাড়াতাড়ি পাল্টায় সেটা জানতাম না।
তবু এতে তোমার কোন দোষ নেই। সব আমার কপালের দোষ।”
আমি অনুনয় করলাম, “প্লিজ রাইসা এবারের মতো ক্ষমা করে দাও। কথা দিচ্ছি আর কখনও এমন হবে না।”
“ঠিকঠাক চললে তো ভালোই। ”
জানো একটা খুশির খবর আছে,এই বলে আমি তার পাশাপাশি দাড়ালাম গিয়ে। সে আমার দিকে না তাকিয়েই বলল, “কি?”
আমি অতি উৎসাহ নিয়ে বললাম, “রিয়া প্রেগন্যান্ট। আমি বাবা হতে চলেছি। আর তুমিও মা।”
সে চমকে উঠে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আসে আমার দিকে, “অভিনন্দন মাহির। রিয়ার যত্ন রাখা দরকার এখন বেশি থেকে। ”
“তুমি খুশি তো?”
“খুশি মানে! খুব খুশি। ঘরে একটা বাবু আসবে। ঘর আলোকিত থাকবে। হৈ চৈ থাকবে। খেলবে। ইশ কত মজা হবে।”
সবকিছু ঠিকঠাক চলতে লাগলো। রিয়া রাইসা দুজনের প্রতি আমি সমান দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছি। রিয়া তখন পাঁচ মাসের প্রেগন্যান্ট। কি একটা সমস্যা হয়েছে তার। ভীষণ অসুস্থ সে। রাইসা তার কাছে যাওয়া মাত্রই রিয়া কর্কশ কন্ঠে বলে উঠে, “আপনি আসবেন না আমার সামনে কয়েকদিন। মা বলছেন, বন্ধ্যা কাউকে এ সময় পাশে না রাখতে। তাতে বাচ্চার অমঙ্গল হয়।”
রিয়ার কথায় বড়সড় ধাক্কা খেলো রাইসা। অসহায়ভাবে আমার দিকে তাকালো। বললো, কি বলছে কি মাহির? এসব তো কুসংস্কার!”
আমি বাচ্চার লোভে রিয়ার কথাকে গুরুত্ব দিলাম। রাইসাকে বললাম, “যা বলছে শুনে নাও না। যাও নিজের রুমে। সত্যি হয়তো কোন বিপদ হতে পারে।”
আমার কথাগুলো শুনে রাইসা এমনভাবে তাকালো আমার দিকে। মনে হলো, এর থেকে আশ্চর্য্যজনক কথা সে জীবনেও শুনেনি। ঝট করে সে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। আমি রিয়াকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
পরদিন সকাল হলো কিন্তু রাইসাকে দেখা গেলো না। না দেখতে পেয়ে খুজতে লাগলাম। পাইনি। অবাক হলাম বেশ। না বলে কোথায় যাবে? তার বাপের বাড়ি কল দিলাম সেখানে নেই। তারপর তার আর আমার পরিচিত সবার কাছে কল করলাম, না, সে কোথাও যায়নি। আমি বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। হলো কি রাইসার? ড্রেসিং টেবিলে চোখ পড়তেই দেখি ছোট্ট একটা চিরকুট রাখা।আমি তাড়াতাড়ি খুলে পড়তে লাগলাম।
তাতে লেখা____ “আমার সব সুখ বিসর্জন দিয়ে তোমার সুখে তোমায় বিয়ে করিয়েছিলাম। কিন্তু কখনও কল্পনা ও করিনি, আমার মূল্য তোমার কাছে জিরো হয়ে যাবে। এতদিন কষ্ট পেলেও নীরবে সয়ে গেছি। কিন্তু আজ আর সম্ভব হয়নি। সহ্যের বাহিরে হয়ে গেছে। এমন ধাক্কা আমি জীবনেও খাইনি। তুমি রিয়ার সামনে আমাকে অপমান করেছো। আমার মূল্য শূন্য সেটা বুজিয়েছো। এটা আমি মেনে নিতে পারিনি। তুমি শিক্ষিত হয়েও এসব কুসংস্কার কথা কীভাবে এসব বিশ্বাস করো অবাক লাগে। যাই হোক, আমি বুজে গেছি তোমার জীবনে এখন আমার আর মূল্য নেই। তোমাদের সামনে আমার আর থাকা সম্ভব না।আমি চলে যাচ্ছি অনেকদূরে। খামাখা খুঁজো না। খুজলেও পাবে না।”
চিরকুট হাতে স্তব্ধ হয়ে বসে পড়ি মেঝেতে। শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এমন অবস্থা। রিয়া এসে আমাকে তুলে। বলে, “এতো আপসেট হওয়ার কিছু নেই।উনি চলে আসবেন দেইখো।”
প্রথমবার রিয়াকে আমার খুব ঘৃণা লাগলো। রিয়ার মনোভাব আর রাইসার মনোভাব সম্পূর্ণ আলাদা।
বহু খুজেও রাইসার কোনও খোঁজ পাইনি। ইতিমধ্যে আমার একটা মেয়ে হয়। তার নাম রাখি রাইসার নামের সাথে মিল রেখে ‘রাইমা’। রিয়াকে এখন অসহ্য লাগে আমার। তার কারণেই রাইসা আজ দূরে।কোথায় আছে, কেমন আছে সেটাও জানিনা।
এমন কোন দিন নেই, এমন একটা রাত নেই যে, রাইসার জন্য আমার মন কাঁদে না। মাঝেমধ্যে বাচ্চাদের মতো কান্না করি। মনে প্রশ্ন জাগে, যে রাইসা আমাকে এতো ভালোবাসতো, সেই রাইসা কীভাবে এতদিন আমার থেকে দূরে আছে। নাকি যে ভালোবাসতে পারে, সে প্রয়োজনে সব করতে পারে!
আমার এখন একটিবার চিৎকার করে রাইসাকে বলতে ইচ্ছে করে, বাবা হওয়ার আনন্দের থেকে তোমার সাথে সারাজীবন একসাথে থাকার লোভ বেশি আমার। কিন্তু তুমি বুজোনি। হয়তোবা বুঝাতে পারিনি।
আমি অপেক্ষায় থাকব তোমার ফিরে আসার। অন্তত একবার আমার সামনে এসো রাইসা। তোমার অভাব যে এতটা যন্ত্রণার হবে, আমি কল্পনা করিনি। এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
_______সমাপ্ত________