#দ্বিতীয়_বিয়ে
#শারমিন_প্রিয়া
#পর্ব_১
অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ আমাদের। তাই বলে ভালোবাসার কোন কমতি নেই। বিয়ের প্রায় আট বছর হতে চলল। কিন্তু কোন সন্তান নেই আমাদের। সমস্যাটা রাইসার৷ রাইসা আমার স্ত্রী। আমি মাহির।
আমি যে বাবা হতে পারব না রাইসার মাধ্যমে, সেটা অনেক আগে থেকেই জানি। মা-বাবা নিকটাত্মীয় সবাই অনেক জোর করত দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য, আমি করিনি। রাইসা আমার ভালোবাসা। আমি তার মনে কষ্ট দিতে চাই না। আমার লাগবে না বাচ্চা। আমি রাইসাকে নিয়েই এই ছোট্ট জীবন দিব্যি কাটিয়ে দেবো।
মা কিছুদিন পরপর এত প্যারা দেন এ বিষয় নিয়ে। আজ সকালেও নাস্তা করার সময় কর্কশ কন্ঠে ঝাড়লেন আমায়। বললেন, “তুই কী এই বংশের শেষ বাতি হবি? বাচ্চা কাচ্চার দরকার নেই তোর? বুড়ো হলে দেখবে কে? এভাবে সবদিন চলবে না। এখনও সময় আছে। আমাদের কথা শুন। একটা বিয়ে কর। আল্লাহ হয়তো মুখ তুলে তাকাবেন।
আমি কান দিয়ে মায়ের কথাগুলো শুনছি আর চোখ দিয়ে রাইসাকে দেখছি। তার মুখ মলিন। রাইসার মলিন মুখ দেখলেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়। এমন কথা শুনলে কোন স্ত্রীর মুখে হাসি ফুটারও কথা না। রাইসা চলে যায় রুমে। আমিও পিছু পিছু যাই। তার গা ঘেসে বসা মাত্রই সে আমার দিকে ঘুরলো। বলল, ” তোমার মায়ের রোজ রোজ এসব কথা আমি নিতে পারি না। আমার মাথা ধরে। তবে উনি ঠিক কথাই বলেন। একটা বাচ্চার দরকার তোমার। আর কতো অপেক্ষা করবা! ”
“তোমাকে রেখে আমি দ্বিতীয় বিয়ে করব, পাগল হইছো!”
“পাগল হইনি। আমিই বলছি, তুমি আরেকটা বিয়ে করো। বাচ্চা হবে। তোমার শখ পূরণ হবে। বাবা ডাক শুনবে। আমারও শখ পূরণ হবে, মা ডাক শুনবো।”
আমি গম্ভীর হয়ে পড়লাম। কি বলছে কি রাইসা!
অফিস যাওয়ার সময় রাস্তায় দেখি, ছোট্ট একটা মেয়ে তার বাবার কোলে। বাবাকে হুদাই বারবার চুমু খাচ্ছে। বাবা হাসছে, মেয়েও হাসছে। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তাদেরকে দেখলাম। ভেতরে লাগলো আমার। মুখে হাসি ফুটলো। এই প্রথমবার মনে হলো, আমার একটা বাচ্চা থাকলে আমারও এরকম সুখের মুহুর্ত হতো। আমার হুট করে বাবা হওয়ার শখ জাগলো প্রবলভাবে। পরক্ষণেই চোখের সামনে ভাসলো রাইসার মুখ। আবার মনে পড়লো সকালের কথা। রাইসা তো বলছে, বিয়ে করতে। তবে কি করেই ফেলবো! করলেই বা কি! রাইসার প্রতি আমার ভালোবাসা এক বিন্দু ও কমবে না। যাকেই বিয়ে করি না কেন, রাইসার জায়গা কেউই নিতে পারবে না। কখনোই না।
বাসায় ফিরে রাইসার সম্মতি নিয়ে মাকে জানালাম, আমি বিয়ে করব। মা-বাবা অনেক খুশি। সাথে রাইসা ও। আমি তার মুখে হাসি দেখেছি। সে রাতে জানালো, মেয়ে দেখতে বাবা মা আর আমার সাথে সেও যাবে। আমি খুশি হলাম। বললাম, “এটা তো বেশ ভালো। আমার ভালো লাগবে তুমি গেলে। ফ্রেশ লাগবে নিজেকে।”
দুইদিন পর আমরা মেয়ে দেখতে গেলাম।উনিশ কুড়ি বছরের একটা মেয়ে। দেখতে বেশ সুন্দর। মা-বাবা কেউ নেই। আছে শুধু একটা বড় ভাই। বেশ গরীব ও। মায়ের পছন্দ হলো। তারাও রাজি হলো। মেয়েটার নাম রিয়া। রাইসা মেয়েটার সাথে বেশ হাসিমুখে কথা বলছে। আমি বারবার রাইসাকে দেখছি। সে হাসিখুশি থাকলে আমার ভালো লাগে। হাসিমুখ দেখলে মনে হয়, সে যেন সব মন থেকে মেনে নিচ্ছে। আমি ভেতর থেকে রিলাক্স ফিল করি।
বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। আমি গভীর রাতে রাইসার দু’হাত ধরি। বলি, “তোমার খারাপ লাগছে না?”
সে এক পলক তাকিয়ে চোখ ফেরায়৷ বলে, “আমি অযোগ্য। আমার খারাপ লাগা মানায় না। আমি চাই তোমার মনের আশা পূরণ হোক। ঘর আলো করে একটা বাচ্চা আসুক। তোমার মুখে হাসি ফুটুক, তৃপ্তির হাসি।”
“তুমি কি খুশি এতে মন থেকে? ”
সে হাসে। বলে, “তোমার সুখেই আমার সুখ।”
আমি তাকে জড়িয়ে ধরতে গেলে সে ধড়ফড় করে উঠে। বলে, “ওয়াশরুম থেকে আসছি।”
রাইসাকে আমি এখন বুজতে পারি না। নাকি একটা বাচ্চার লোভে বুঝতে চাচ্ছি না। নিজেকে নিজের কাছে কেমন রহস্য লাগছে।
বিয়ের দিন আসে। আজ দ্বিতীয় বিয়ে আমার। ভাবতেই অদ্ভুত লাগে। রাইসা পরেছে নীল শাড়ি। খোঁপা করা বেলীফুলে দিয়ে। পরী লাগছে তাকে। আবার তার প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করছে নতুন করে। আমাকে সে নিজ হাতে লাল শেরওয়ানী পরিয়ে দিলো। আমি বললাম, “তুমিও আজ লাল শাড়ি পরতে পারতে, ম্যাচ হতো।”
সে চোখ তুলে তাকালো আমার দিকে। বলল, “আরেকজন তো পরবে। তার সাথে ম্যাচ হলেই হলো।”
আমার রাগ হলো। তাকে ঝাপটে ধরে বুকের সাথে মিশালাম, “এমন করে কথা বলছো কেন?”
সে জেদ করলো, “উফ ছাড়ো। আমাকে এত জড়িয়ে ধরলে হবে? নতুনের জন্য অপেক্ষা করো।”
আমার আবারও রাগ হলো, “তুমি না চাইলে আমি এক্ষুনি না করে দেবো। বিয়ে হবে না।”
রাইসা খানিক হাসলো, “আমি চাই তুমি বিয়েটা করো। তোমার স্বপ্ন পূরণ হোক।”
“তাহলে এভাবে ট্যাশ মেরে কথা বলছো কেন?”
” অবাক হচ্ছো নাকি আমার কথায়? এতদিনের সংসার আমার। এত শখের তুমি৷ এতদিনের ভালোবাসা আমাদের। চোখের সামনে সবকিছুতে আরেকজন ভাগ বসাতে চলেছে। এমন কথা বলা স্বাভাবিক নয় কি? আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে তো এতক্ষণে মানসিক হসপিটালে থাকতো। আমি তো ঠাই আছি। চোখের সামনে সব দেখছি। হাসিমুখে মেনে নিচ্ছি।
এত কথা বলার সময় আজ নয়। চলো তো দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
“তুমি কিন্তু আমার পাশে বসবে। বসবে তো রাইসা?”
“বসব।”
দাড়াও বলে তার কপালে চুমু খেলাম। রাইসাকে বললাম, “শুভ কাজে যাচ্ছি। তুমিও একটা ভালোবাসার চিহ্ন একে দাওনা, হয় কপালে নয়তো ঠোঁটে।”
সে বলার সাথে সাথে চুমু খেলো। তবে এ চুমুর মধ্যে আমি কোন ভালোবাসা খুজে পেলাম না। নিতান্তই অনিচ্ছায় দিয়েছে, এমনটা মনে হয়েছে।
রাত বাড়ছে। হৈ চৈ কমে গেছে। সবাই ঘুম। রিয়া বউ সাজে বসে আছে বাসর ঘরে। তার জীবনে আজকের রাতটা ভীষণ স্পেশাল। সব মেয়েই তো এই বিশেষ রাতের স্বপ্ন দেখে। রিয়াও দেখেছে।
আমার জীবনে এই বিশেষ রাত অনেক আগেই এসেছে। বুক ধড়ফড় করছিলো সে রাতে। আরও কত কী! আজ দ্বিতীয় বাসর আমার। কত বিচিত্র এ জীবন! একটা সন্তান থাকলে এমন দু’টানার রাত দেখতে হতো না আমার। কি করব কিছুই বুঝতেছি না।
রাত দশটার পর থেকে রাইসাকে ও দেখিনি। জানিনা তার মনের অবস্থা এখন কেমন! আমি তো তাকে অন্য পুরুষের সঙ্গে একসাথে ভাবতেই পারি না। রুহ কেঁপে উঠে। না জানি তার কত কষ্ট হচ্ছে। যতই বাচ্চার শখ থাকুক না কেন, সে রাজি না হলে পারতো। সে রাজি না হলে, আমার বাচ্চার জন্য হাজারও ইচ্ছে থাকলেও দ্বিতীয় বিয়ে করতাম না।
আমি অসহায় হয়ে বারিন্দায় দাড়িয়ে এসব ভাবছি। নিঃশব্দে রাইসা এসে দাড়ালো পাশে। দূরে তাকিয়ে বলল, “রিয়া অপেক্ষা করছে তো। তাকে কোনও শাস্তি দেওয়ার মানে হয় না। এখনি যাও।”
আমি কিছু বললাম না। সে এক প্রকার জোর করে আমাকে রুমের কাছাকাছি দিয়ে দ্রুত পায়ে চলে গেল।
চুপচাপ গুটিশুটি মেরে বসে আছে রিয়া। এখনও বউয়ের সাজেই আছে। আমাকে দেখামাত্র উঠে দাড়ালো। মনে হলো এতক্ষণ সে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো। আমি ঠাই দাঁড়িয়ে রইলাম। অস্বস্তি লাগছে ভীষণ। আড়চোখে এক পলক তাকালাম তার দিকে। মনকাড়া চেহারা। বুঝলাম, বারবার তাকে দেখলে আমি তার মধ্যেই ডুবে যাব। সে কথা বলল, “আজ আমাদের বিশেষ রাত। আপনি এভাবে চুপচাপ থাকলে খারাপ লাগবে আমার। ছোট থেকে মা বাবাহীন বড় হয়েছি। অনেক কষ্ট পেয়েছি। আপনি দূরে থেকে আমাকে আর কষ্ট দিবেন না দয়া করে। আমাকে আপন করে নিন।”
রিয়ার কথাগুলো আমার ভেতরে লাগলো। সত্যিই তো তাকে সবকিছু থেকে বঞ্চিত করার মানে হয় না। আমি সব অস্বস্তি কাটিয়ে রিয়ার কাছাকাছি গেলাম। চোখ আটকে গেলো তার সুন্দর ঠোঁটে। আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। না, এই মুহুর্তে রাইসার কথা আমি আর ভাবছি না। আমি আচমকা ডুব দিলাম রিয়ার সুন্দর দুটি ঠোঁটে। রিয়াও তার দু’হাত দিয়ে আমাকে আরও কাছে টেনে নিলো।
চলমান…..!