#দ্বিতীয়_অধ্যায়
(শেষ পর্ব)
খুব মন দিয়ে এতীমখানায় হিসাবের কাজ’টা করে স্নিগ্ধা৷ বাজার খরচ, কাপড় চোপড়, লেখাপড়া বাবদ কত খরচ হলো আর কতো টাকা দাতাদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে মোট কথা আয় ব্যয়ের একদম চুল চেরা হিসাব করে। স্নিগ্ধা বোঝে হিসাবে বেশ গন্ডগোল আছে৷
বিশেষ করে যিনি বাজার করেন, রফিক চাচা অনেক ধুরন্ধর প্রকৃতির লোক। উনি বেশ বেলা করে বাজারে যেয়ে শেষ বাজারের কাঁচা সবজি কম দামে কিনে আনেন কিন্তু বাজারের খাতায় হিসাবের ক্ষেত্রে দাম বাড়িয়েই লেখা। মাছ মাংসের হিসাবে আরো গড়বড়। সাবিকুন নাহার বয়স্ক মানুষ, একা সব সামলাতে পারেন না। এর সাথে রান্নার খালা জরি খালাও জড়িত, স্নিগ্ধা খুব ভালো করেই বোঝে। স্নিগ্ধা এগুলো বেশ শক্ত করে ধরে৷ আগে জানায় সাবিকুন নাহারকে। উনি মনে ভীষণ কষ্ট পান। আহা, মানুষ আর মানুষ নাই। এতীম বাচ্চাগুলোর টাকা, খাবার খেতেও তোদের বাঁধে না!
স্নিগ্ধা আগেই কিছু বলতে নিষেধ করে। সুযোগ বুঝে একদিন পঁচা মাছ কিনে আনলে ছবি তুলে রাখে। এরপর রান্না হওয়ার পরে সেই মাছ এনে সাবিকুন নাহারকে খেতে বলে। সাবিকুন নাহার মুখে দিয়েই বোঝেন খাওয়ার অযোগ্য পঁচা মাছ। অথচ খরচের হিসেবে বড় মাছ হিসেবে বেশ দাম ধরে রেখেছে। সেদিনই রফিক আর জরিকে বিদায় করে দেন। যারা এতিম বাচ্চার খাবারের টাকা চুরি করতে পারে, তারা কখনোই ভালো হবে না৷ বাচ্চাগুলোকে শাসিয়ে রাখতো রফিক আর জরি মিলে। ভয়ে কিছু বলতে পারতো না। স্নিগ্ধা আসাতে ওরা যেন খেয়ে, পরে, দম ফেলে বাঁচতে শিখলো।
স্নিগ্ধার ভালো লাগে, ভীষণ রকম ভালো লাগে এই বাচ্চাদের সাথে মিশতে, ওদের জন্য কিছু করতে পারাকে সৌভাগ্য মনে হয়। বাচ্চারা স্নিগ্ধাকে খুব পছন্দ করে। কেউ খালামণি বলে, কেউ আপু আবার কেউ মা মণিও বলে। যার যা ইচ্ছা৷ সকালে হিসাব দেখা, কি বাজার হলো, রান্না হলো এসব দেখে আর বিকালে ওদের সাথে খেলে, গল্প করে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রী ভর্তি হয়েছে। ভেবে দেখলো এটাই ওর জন্য ভালো হবে। এতীমখানায় কাজও করা হবে পাশাপাশি পড়াও হবে। ওর সার্টিফিকেটগুলো তোলার ঝামেলায় যায় নি। বাবাকে ফোন দিয়েছিলো। বলেছিলো এই ঠিকানায় সেগুলো পাঠিয়ে দিতে। এটুকু উপকার উনি করেছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো কেন স্নিগ্ধা এখানে, কি করছে, কেন করছে – এসব কোন কিছুই উনি জিজ্ঞাসা করেন নি। বরং স্নিগ্ধা যে বাবার বাড়িতে যেয়ে উঠেনি এতেই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন।
শফিকের ঠিকানায় তালাক পাঠিয়ে দিয়েছে। নাহ, তারা কোন খোঁজ নেয় নি। একটা জিডি পর্যন্ত করে নি। উল্টো কেস খাওয়ার ভয়ে হোক কিংবা অপছন্দের লোক চোখ থেকে সরে যাওয়ার কারণেই হোক। যাক সবাই ভালো থাকুক, ভালো পরিবেশে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পেরে স্নিগ্ধার মন বড় হয়ে যায়। সবাইকে ক্ষমা করতে ইচ্ছা করে। বাচ্চাগুলোর জীবনের কষ্টের কথা শুনে নিজের যেন কষ্ট ভুলে যায় স্নিগ্ধা। তবে এটা তো সত্য আর কিছুদিন শ্বশুরবাড়িতে থাকলে ও নিশ্চিত পাগল হয়ে যেতো। সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকা, ঠিক মতো খাবার না, বিশ্রাম না খালি কাজ আর কাজ সাথে চিৎকার চেঁচামেচি, ধমক। কোথাও যেতে দিতো না, যাওয়ার জায়গাও ওর ছিলো না। অতীত মনে হলে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। দ্বিগুণ উদ্যোমে নিজেকে গড়ায় মন দেয়। এতীম খানায় দেখাশোনা বাবদ কিছু টাকা পায় স্নিগ্ধা। থাকা খাওয়া তো সাবিকুন নাহারই দেন আর কাপড় চোপড়ও উনি যা কিনে দিয়েছেন তাতে স্বাচ্ছন্দ্যে আরো বেশ কিছু দিন চলে যাবে। বেতনের টাকা জমিয়ে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড ল্যাপটপ কেনে। অনলাইনে নানান রকম প্রশিক্ষণ নেয়। এছাড়া এতীমখানাতেও একটা প্রজেক্ট আছে, সেখানে একটা এন জিও থেকে মেয়েদের ফ্রি ব্লক বাটিকের কাজ, টেইলারিং এর কাজ শেখায় , স্নিগ্ধা মন দিয়ে এগুলো শেখে।
বছর গড়িয়ে যায়। স্নিগ্ধা এখন আত্মবিশ্বাসী, উদ্যোমী, প্রাণবন্ত একটা মেয়ে। এতীমখানার মেয়েদের সাথে নিয়ে একটা দোকানও দিয়েছে। আশার আলো ভ্যারাইটিজ। সেখানে হাতের কাজের বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করে। যা লাভ হয়, যাদের কাজ তাদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। ওদের টেইলারিং ইউনিটটা বেশ ভালো অর্ডার পাচ্ছে। অল্প মজুরিতে ভালো কাজ হওয়ায় আশেপাশের সবাই এখানে আসে।
এতীমখানায় অনেক সময় দাতারা আসেন, বাচ্চাদের জন্য নানা রকম জিনিস, খাবার, খেলনা নিয়ে আসেন। এমনই একজন শিহাব শাহীন। উনি গত তিন মাস ধরে প্রায় নিয়মিত আসেন। প্রতি শনিবার বিকালে । সাথে প্রচুর খেলনা, রঙ পেন্সিল, চকলেট, কেক। বাচ্চারা তো এখন উনার কাছে নানান জিনিসের আবদার করে। উনি হাসি মুখে সবার আবদার রাখার চেষ্টা করেন। স্নিগ্ধার সাথে পরিচয় আছে কিন্তু উনি যেহেতু প্রতি সপ্তাহে আসেন, স্নিগ্ধা সযতনে ঐ সময়টা বাসায় কাটায়। নতুন কোন গল্পের খোরাক হতে চায় না স্নিগ্ধা। এমনিতে রফিক চাচা আর জরি খালার অনিয়ম ধরাতে তারা যাওয়ার আগে স্নিগ্ধার নামে নানা আজেবাজে কথা ছড়িয়ে গেছে।
সাবিকুন নাহার স্নিগ্ধাকে আপন মেয়ের মতোই ভালোবাসেন। প্রতি রাতে দুই জন দুই এক ঘন্টা করে গল্প করবেই। তেমনই এক গল্পের মাঝে উঠে আসে শিহাব শাহীনের কথা।
– বুঝলি মা ছেলেটা অনেক দু:খী।
– কেন মা, উনার আবার কি হয়েছে? শুনি তো বেশ ধনী পরিবারের সন্তান। নিজেও ভালো পদে চাকরি করে। তার আবার কি দু:খ।
– দুনিয়াতে শুধু টাকা পয়সার অভাবেই দু:খী হয় না রে মা। আরো কতো দু:খ কষ্ট থাকে উপর থেকে বোঝা যায় না। ছেলেটা যেহেতু নিয়মিত আসে, আমি একবার এই আসা নিয়ে কিছুটা বিরক্ত হয়েছিলাম। বুঝিস তো মেয়েরাও থাকে, আমাকে কত সতর্ক থাকতে হয়৷ তখন ছেলেটা মাথা নিচু করে খুব নরম স্বরে বলে নিজের কষ্টের কথা।
ছেলেটার বাবা বেঁচে নেই। মা বোনের সাথে লন্ডনে থাকেন। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো যাকে, সেই মেয়েটা বিয়ের দুই বছরের মাথায় ছেড়ে চলে গেছে। কারণ, ছেলেটা সন্তান জন্মদানে অক্ষম। ভাই বোনেরা যে যার মতো আছে। নিজের এই অক্ষমতা নিয়ে আর কোন জীবনের সাথে নিজেকে জড়াতে চায় না। এখন বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত। বিশেষ করে পিতৃ মাতৃহীন বাচ্চাদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করে।
এজন্যই বলছি মা, সব কিছু থাকতেও অনেকে দু:খী হতে পারে।
স্নিগ্ধার সত্যি খারাপ লাগে৷ একটা সংসার, দুইটা দুষ্টু মিষ্টি বাচ্চা, সাংসারিক খুনসুটি কে না চায়? স্নিগ্ধাও তো চায়।
– কিন্তু মা, সংসারে বাচ্চা হতেই হবে এই নিয়মই কেন? কত বাচ্চার তো বাবা মা নেই। তাদের বাবা মা হয়েও তো জীবন পার করা যায়। তারাও বাবা মা পেলো আবার সন্তানের সাধও পূরণ হলো।
– বলছিস ঠিক আছে কিন্তু কে মানবে? যে মেয়ে বাচ্চা হওয়াতে সক্ষম সে কী আর অন্যের বাচ্চা পালবে? আর অনেকেই হয়তো বিয়ে করতে চাইবে সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সুযোগ সন্ধানী কেউই হবে৷
স্নিগ্ধা আর কথা বাড়ায় না কিন্তু মাথার মধ্যে এই কথাটা ঘুরতে থাকে। পরের শনিবার দুপুরের পর আর বাসায় আসে না। শিহাবকে ভালো করে দেখতে চায়। আসলে স্নিগ্ধা নিজেও পোড় খাওয়া এজন্য আরেকজনের কষ্ট ও ভালোই বোঝে। দূর থেকে শিহাবকে দেখে বাচ্চাদের সাথে খেলা করতে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়।
হঠাৎ করেই সাবিকুন নাহার অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালে নেয়ার পরে জানা যায় মাইল্ড স্ট্রোক। কিছুদিন পরে সুস্থ হলেও কেমন গম্ভীর হয়ে যান। আগের মতো কথা বলেন না, চুপচাপ থাকেন। অসুস্থতার কথা সন্তানদেরও বলতে চান না। এরপর হঠাৎই একদিন স্নিগ্ধাকে বলে বসেন
– তুই যদি শিহাবের বিষয়টা মেনে নিতে পারিস তা হলে আমি ওর সাথে কথা বলতে পারি। তোর একটা সংসার দরকার।
– এসব কি বলছেন মা আপনি? উনি কেন আমাকে বিয়ে করতে যাবেন আর হঠাৎ করে এসব অদ্ভুত চিন্তা ভাবনা কেন করছেন?
– আমার বয়স হয়েছে, আমার কিছু হলে তুই আবার পথে পড়বি৷ একটা সংসার দরকার৷ আমি কয়েকদিন ধরে খুব ভেবে দেখেছি৷ শিহাব যতোই সংসার নিয়ে দ্বিতীয়বার চিন্তা না করুক নিশ্চয় মনের গভীরে একটা সংসারের স্বপ্ন দেখে।
– মা, এটা খুব হ্যাংলামি হয়ে যায়৷ আমি উনার সমস্যা নিয়ে ভাবছি না কিন্তু এভাবে বিয়ের প্রস্তাব দেয়াতে বোঝায় আমি খুব অসহায় উনি ছাড়া আমার উদ্ধার নাই। কিন্তু মা, আমি ইনশাআল্লাহ কিছু না কিছু করে খেতে পারবো। কারো বোঝা হবো না৷ সেই স্নিগ্ধা আমি আর নই, আমি নিজেকে চালাতে সক্ষম।
– শুধু তোর কথা ভাবছি না রে মা। এতীমখানার কথাও ভাবছি। রফিক, জরিদের মতোই লোক এখন সমাজে বেশি৷ বাচ্চাগুলো রাস্তায় না বসে।
– আমি থাকতে তা হতে দেবো না!
– বাস্তবতা কিন্তু বেশ কঠিন। একা যুবতী মেয়ে হয়ে বাচ্চাগুলোকে সাথে নিয়ে লড়াই করা অতোটা সহজ না। ভাবতে পারিস আমি স্বার্থপর। ভেবে নে সেটাই। বাচ্চাদের জন্য স্বার্থপরের মতোই ভাবছি। আমার সন্তানেরা তো আর দেশে এসে দায়িত্ব নেবে না৷ তুই যদি মানতে পারিস তাহলে..
– মা, সন্তান হওয়া না হওয়া আল্লাহর ফয়সালা। আমরা এখানে কতটুকু জানি। আমার ভয় লাগে, উনি আমাকে স্বার্থান্বেষী না ভাবে৷ আত্মসম্মান ছাড়া কি আর আছে বলেন মা?
সাবিকুন নাহার আর কিছু বলেন না। কিন্তু পরের শনিবার ঠিকই শিহাবের সাথে কথা বলেন। প্রথমে শিহাবও অবাক হয় এবং নিজের অক্ষমতার জন্য অন্য একটা জীবনকে জড়াতে দ্বিধা করে৷ কিন্তু সাবিকুন নাহার নাছোড়বান্দা। এতীমখানার স্বার্থে এবং স্নিগ্ধার একটা ভালো জীবনের জন্য উনি কিছুটা চাপই দিতে থাকেন।
শিহাব স্নিগ্ধাকে বহুবার দেখেছে। সাবিকুন নাহারের কাছে ওর জীবনের ঘটনাও শুনেছে। কমনীয় মুখের আড়ালে দৃঢ় চরিত্র। সাবিকুন নাহারই বলেছেন যে শিহাবের ক্রুটির জন্য ওর আপত্তি নেই, আপত্তি সাবিকুন নাহারের অনেকটা এভাবে জোর করাতে।
শিহাব বোঝে এমন জোর করার মতো কোন অভিভাবক তার মাথার উপরে নেই বলেন জীবনটা এমন ছন্নছাড়া। কোন এক অজানা সুখের সন্ধানে রাজী হয়ে যায়।
শিহাবের সাথে খুব সাদামাটা ভাবে বিয়ে হয় স্নিগ্ধার। খুব খুশি হয় সাবিকুন নাহার কিন্তু তার চেয়েও খুশি হয় এতীমখানার বাচ্চাগুলো। খুব প্রিয় দুইজন মানুষের বিয়েতে আনন্দে হাসিতে মাতিয়ে তোলে।
চলবে।