#দ্বিতীয়_অধ্যায়
সাবিকুন নাহারের সকালে ঘুম থেকে উঠে একটু হাঁটাহাঁটি করার অভ্যাস। বাড়িতে একাই থাকেন। সাথে কাজের মেয়েটা। হঠাৎ মেয়েটা দৌড়ে আসে ওর কাছে।
– ও খালাম্মা, ময়লা ফেলতে গেট খুলছিলাম। কে জানি আমাগোর দরজার পাশে শুয়ে আছে।
– রাস্তায় তো অনেকেই ঘুমায়, তাদের কেউ হবে হয়তো।
– না খালাম্মা, ভালো ঘরের মাইয়া মনে কয়। আপনি একবার আসেন না।
ছোট্ট একটা ডুপ্লেক্স বাসায় সাবিকুন নাহারের বসবাস। মূল শহর থেকে কিছুটা দূরে, শহরতলীতে। স্বামী গত হয়েছেন। ব্যবসায়ী ছিলেন টাকা পয়সার অভাব নেই। ছেলে মেয়ে দুই জনই দেশের বাইরে সেটেল্ড। সাবিকুন নাহারের সেখানে মন টেকে না। নিয়ম করে বছরে দুই একবার যেয়ে দেখে আসেন।
বাড়ির বাইরে একটা শিউলির চারা আছে একদম গেটের সাথে। আরেকপাশে বাগান বিলাস। মেয়েটা শিউলি গাছের নিচে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে। গায়ের উপর দুই একটা শিউলি পড়ে আছে। চোখ মুখে গভীর ক্লান্তি কিন্তু শিউলি ফুলের মতোই স্নিগ্ধ একটা মুখ।
সাবিকুন নাহার গায়ে হাত দেন। বেশ গরম। হাত দিয়ে আস্তে আস্তে ঝাঁকুনি দিলে লাল চোখ মেলে বসে। ঘোর লাগা দৃষ্টি।
– কি নাম তোমার?
– স্নিগ্ধা। আমি পানি খাবো..
ধরে ধরে বাসার মধ্যে আনেন। দুই দিন তুমুল জ্বরের ঘোরে বিড়বিড় করে বকতে থাকে মেয়েটা।
– আমি ইচ্ছা করে পুড়াই নি। আমার ভুল হয়েছে। ও মা, মা গো আমাকে নিয়ে যাও। আমি আর পারছি না। এমন নানা কথা অস্ফুট স্বরে বলতে থাকে।
তিনদিনের মাথায় জ্বর ছেড়ে দেয়। কিন্তু কিছুই বলে না। চুপ করে থাকে। সাবিকুন নাহারও জিজ্ঞাসা করেন না। জীবনের অনেক ধাপ পার হয়ে এখন শেষ প্রান্তে এসেছেন। নানান মানুষ, তাদের জীবনের দু:খ কষ্ট দেখেছেন। একটা এতিমখানা চালান। স্বামীর অর্থ দিয়ে শুরু করেছিলাম। তার ছেলে মেয়েরা অনুদান দেয়, কিছু ডোনারও ঠিক করে দিয়েছে। মায়ের আনন্দই তাদের আনন্দ। সাবিকুন নাহার জীবন দেখে অভ্যস্ত। বোঝেন মেয়েটা একটা কঠিন ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
স্নিগ্ধাকে সাথে নিয়ে ঘোরেন। একসাথে হাঁটতে যান, খেতে বসেন। মাথা আঁচড়ে দেন, কিছু কাপড় চোপড়ও কিনে দিয়েছেন। এতীমখানায় নিয়ে যান। একা ঘরে ঘুমাতে দেন না। কাজের মেয়েটাকে নিচে বিছানা করে ঘুমাতে বলেন। কিন্তু কিছু জিজ্ঞাসা করেন না। নিজে থেকেই বলার অপেক্ষা করেন। ঠিক মাস দুয়েকের মাথায় স্নিগ্ধা কিছুটা সামলে নেয়। এক বিকেলে চা খেতে খেতে নিজের সব কথা বলে। খুব মন দিয়ে চুপ করে সব কথা শোনেন।
– জীবন এই রকম মা। কখনো কঠিন, কখনো দুর্বোধ্য। তুমি ইচ্ছা করলে শফিক আর ওর মায়ের বিরুদ্ধে থানায় যেয়ে অভিযোগ দিতে পারো। তোমার বাবাকেও ফোন দিতে পারো।
– বাবা অনেক আগেই আর বাবা নেই। সম্পর্ক তো লালন করতে হয় তাই না মা? আপনাকে মা বলতে ইচ্ছা করে, এতিম খানার বাচ্চাদের মতো। আমিও তো এতিম মা।
– অবশ্যই বলবে। এখন বলো কি করতে চাও।
– আমি ওদের বিরুদ্ধে কিছুই করবো না। আমি সব ভুলে যেতে চাই। নতুন করে জীবন শুরু করবো। পড়াশোনাটা আবার শুরু করতে চাই মা। আমাকে কোন কাজ, সে যে কোন কাজের ব্যবস্থা করে দিলে যতো কষ্টই হোক চালিয়ে নিতে পারবো। আপনার কাছে আর কতদিন থাকবো মা।
– মা বললে এভাবে বলতে হয় না। তবে তোমাকে বসিয়ে রাখবো না। এতিমখানায় হিসাব শাখায় একজন দরকার। তুমি আপাতত: সেখানেই বসে কাজ শেখো। আর ভর্তির বিষয়ে কি করা যায় দেখছি। কাগজপত্র তুলতে হবে। আমার এতো বড় বাড়ি, ছেলে মেয়েরা তো আসতেই পারে না। একা দমবন্ধ লাগে, আমার সাথে থাকো সেটাই না হয় তোমার বাড়ি ভাড়া!
– আরেকটা কথা মা। আমি শফিককে তালাক পাঠাতে চাই। যে সম্পর্ক আগেই মনে মনে মরে গেছে, তা টেনে লাভ কি!
হেসে সম্মতি দেন সাবিকুন নাহার। স্নিগ্ধা ঘরে ফিরে আসে। রাতের বেলা চাঁদের আলোয় ঘর ভরে যায়। বাইরে তাকিয়ে এর সৌন্দর্য দেখে। এমন এক রাতে সে ঘোর লাগা মানুষের মতো ঘর ছেড়েছিলো। স্টেশনে যেয়ে ছেড়ে দেয়া এক ট্রেনে উঠে। ভোর রাতে নেমে হাঁটতে হাঁটরে বেহুঁশ হয়ে এখানে পড়ে ছিলো।
জীবন! এক আশ্চর্য জার্নি। ভালো কি মন্দ স্নিগ্ধা জানে না। কিন্তু এটুকু বোঝে, এর নিয়ন্ত্রণ এখন নিজেকেই নিতে হবে। বোকা মানুষের জায়গা এখানে নয়। একটু প্রতিবাদী না হলে টিকে থাকা কঠিন। সাবিকুন নাহার এর মতো মানুষ সবার জীবনে আসে না। ওর সাথে খারাপ কিছুও হতে পারতো। সৃষ্টিকর্তা যখন সুযোগ দিয়েছেন, সেই সুযোগ কাজে লাগাবে। নিজের জন্য, ওর মতো অসহায় মানুষের জন্য। দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করবে। নিজেকে গড়তে হবে, জীবনে হয়তো আরো অনেক শফিক, তার মা বোনের মতো লোকের সম্মুখীন হতে হবে তবে থেমে থাকবে না। ট্রেনের মতো চলতেই থাকবে, গন্তব্যে না পৌঁছা পর্যন্ত।
(চলবে।)