দ্বিতীয় অধ্যায় পর্ব-০১

0
6

#দ্বিতীয়_অধ্যায়

– ইশ দুধটুকু ফেলে দিলে? কেন চুলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে না?

– ছিলাম তো আম্মা, কিন্তু মিতু আবার ডাক দিলো। ওর কোন ড্রেস নাকি পাচ্ছে না। এসে দেখি দুধ উপচে পড়ে গেছে৷

– চুপ করো মুখে মুখে তর্ক করো না।

চুপ হয়ে যায় স্নিগ্ধা। ওর চোখ জুড়ে পানি টলমল করে। শুনতে পায় শাশুড়ি জোর গলায় ওর শ্বশুরকে বলছে – আজ আর দুধ খেতে হবে না। তোমার আদরের বউমা দুধ ফেলে দিয়েছেন।

এ যেন নিত্যদিনের ঘটনা। কোন এক অজানা কারণে বিয়ের পর থেকেই স্নিগ্ধার শাশুড়ি ওকে সহ্যই করতে পারে না। স্নিগ্ধার এ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। ওর স্বামী আর শ্বশুর পছন্দ করে এনেছে। শাশুড়ির নাকি মত ছিলো না। কারণ, স্নিগ্ধার মা নেই ঘরে সৎ মা।

বুক ঠেলে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে স্নিগ্ধার৷ কিছু কিছু মানুষের জীবন’টা বুঝি এমনই হয়। অন্ধকার, এতোটুকু আলো নেই। সেই ক্লাস নাইনে থাকতে মা ছেড়ে চলে গেলো, জীবনের সব আনন্দ ভালোবাসা সব যেন সাথে করে কবরে নিয়ে গেলো। বাবা আর কি করবে নানান চাপে কিংবা প্রয়োজনে বিয়ে করলেন। না, সৎ মা নির্যাতন করে না। উনি উনার মতো থাকে। স্নিগ্ধা যে একটা মানুষ, তা যেন উনার চোখেই পড়ে না। দিন দিন কেমন যেন অপাংক্তেয় লাগতো স্নিগ্ধার। মনে হতো, এই পৃথিবীতে ও যেন সবার উপরে বোঝা।

তারপর কোন রকম এইচ এস সি পাশের পরেই বিয়ে। চেহারা মোটামুটি সাথে অল্প বয়সের একটা কমনীয়তা – পার হয়ে যায় বিয়ে নামক পুলসিরাতে!

কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে যে হাবিয়া দোজখ অপেক্ষা করছে ঘূর্ণাক্ষরেও বোঝে নি স্নিগ্ধা। এক শাশুড়ির শাসনে অতিষ্ট স্নিগ্ধা। সাথে ননদের নানা বাহানা। আচ্ছা ও তো আর জোর করে এদের ঘরে ঢুকে পড়ে নি! তাহলে কেন এতো বিদ্বেষ! মাঝে মাঝে ওর শ্বশুর আর স্বামীর উপর রাগ হয়। শাশুড়ির পছন্দ না জেনেও কেন ওকে টেনে আনলো? না হয় আরো খারাপ জায়গায় বিয়ে হতো আর না হয় হতোই না কিন্তু এই যে প্রতিনিয়ত উঠতে বসতে কথা শোনা এর থেকে তো বাঁচতো!

এসব ভাবতে ভাবতে হাতের কাজ সারতে থাকে স্নিগ্ধা। রান্নাঘর, চুলা, থালাবাটি সব ধুয়ে মুছে চকচক করে ঘরে এসে বসে। ইশ! সারাদিন চুলটা শুকানোর সময়টা পায় নি। চুলের মধ্যে কেমন ভেজা ভেজা আর গন্ধ লাগছে। বারান্দায় বসে চিরুনী দিয়ে চুল ছাড়াতে থাকে। বেডরুমে লাইট অফ করে মোবাইলে কি যেন দেখছে শফিক, স্নিগ্ধার স্বামী। স্নিগ্ধার মতে পৃথিবীর সুখি মানুষ। যা হয়ে যায় যাক, সে সকালে উঠে গোসল করে খেয়ে অফিসে যাবে আর ফিরে খাওয়া, টিভি আর মোবাইল। এর বাইরে তার কোন দুনিয়া নেই। ও হ্যাঁ আছে, মোবাইলে কথা বলে অফিসের অমুক খারাপ তমুকের এই সমস্যা বলে বদনাম করে। স্নিগ্ধা যেন একটা শরীর মাত্র যাকে প্রয়োজন অনুসারে ব্যবহার করে। তার যে মন থাকতে পারে, ভালো লাগা মন্দ লাগা থাকতে পারে এই ব্যাপারে শফিকের মনে কখনোই কিছু আসে না কিংবা এসব নিয়ে ভাবার চিন্তাই করে না!

দুই একদিন একটু বলার চেষ্টা করেছিলো, স্নিগ্ধার কষ্ট হয়ে যায়। শফিক মুখ কালো করে বলেছিলো- ওর অফিসের মেয়েরা ঘর সংসার সামলে অফিস করে আর স্নিগ্ধা শুধু ঘরের কাজেই কাত হয়ে যায়!

ঘরে এসে বিছানায় বসে স্নিগ্ধা
– উফ, তোমার শরীর দিয়ে তো ডাস্টবিনের মতো গন্ধ বের হচ্ছে। রান্নাঘর থেকে বের হয়ে গোসল করতে পারো না?
নাক মুখ কুঁচকে বলে উঠে শফিক। গরমে রান্নাঘরে কাজ করাতে শরীর ভিজে গেছে কিন্তু এতোটা দুর্গন্ধ তো হচ্ছে না! তবুও পাল্টা কোন উত্তর না করে গোসল করে আসে। এসে দেখে শফিক নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আবার চুল শুকিয়ে ফেলে। না হলে ঠান্ডা লাগতে পারে।
সকালে উঠে রুটি, আলুভাজি, ডিম এই নাস্তাগুলো তৈরি করে টেবিলে দেয়। রুটি নরম আর ফুলো ফুলো হতে হবে। আলুভাজি চিকন করে কেটে অল্প তেলে ভাজি। ডিমের মামলেটের রঙ হতে হবে বাদামী এবং অবশ্যই ফুলে ডাবল হবে। সাথে মশলা দেয়া দুধ চা। শফিকের দুপুরের খাবার হটপটে ভরে টেবিলে দিয়ে দেয়। এরপর রুমে ঢুকে সবার বিছানা ঝেড়েঝুড়ে ঠিক করে কাপড় নিয়ে ধোয়ার জন্য রাখে।

ঠিকা বুয়া জরিনা ঠিক টাইম মতো এসে গুণে গুণে দুই কাজ করে – ঘর মোছা, কাপড় ধোয়া। এর বাইরে সে কোন কাজেই হাত দেয় না। স্নিগ্ধা হাতের কাজ সেরে টেবিলে এসে দেখে সবার খাওয়া শেষ, রুটিও শেষ! এমন তো হওয়ার কথা না! ও তো সবার জন্যই বানিয়েছে।

– আম্মা, রুটি তো নাই আর। আমি কি খাবো?
– পেট মেপে খেতে হবে নাকি? কারো কি দুটোর বেশি তিনটে রুটি খাওয়া বারণ? গতরাতের ভাত তরকারি আছে, সেটাই খাও।

বাসি ভাত আর তরকারি নিয়ে বসে স্নিগ্ধা। দুই নার মুখে নেয়ার পরে মিতু এসে চিল্লাতে থাকে।

– কি ইস্তি করেছো ভাবী? কিচ্ছু হয় নাই। কুঁচকায়ে আছে।এই ড্রেস পরে আমি এখন কিভাবে বের হবো। সময় নাই তেমন। শিঘ্রী আবার ইস্ত্রি করে দাও।
ভাতের প্লেট রেখে উঠে পড়ে স্নিগ্ধা। ঠিকা বুয়া জরিনা ঘর মুছছিলো। সে রাগে গজগজ করতে থাকে – মাইয়াডারে পাইয়া এরা একদুম ল্যাংড়া হইয়া গেছে গা, কেউ কিচ্ছু করার পারে না।

শাশুড়ি আর মিতুর হুকুম করা, খুঁত ধরা আর অল্প কিছুতেই চিল্লাচিল্লি করাতে স্নিগ্ধা আজকাল এতো বেশি ভয়ে থাকে যে, বেশি করে কাজে ভুল হয়। এমনকি রাতেও দু:স্বপ্ন দেখতে থাকে। তার চেয়ে বড় সমস্যা হলো ভুলে যায়, অন্যমনস্ক হয়ে যায় শুধু। শফিকও রাগ করে আজ কাল।
– কি অবস্থা তোমার হাতের? একটু লোশন লাগাও না? চুলগুলোর যত্ন নাও না ঠিকঠাক? আমি আসলে তো একটু নিজেকে গুছিয়ে রাখতে পারো নাকি! দেখে মনে হয় কাজের বেটি, পাঁচ বাসায় কাজ করে ঘরে ফিরেছে!

দিন দিন স্নিগ্ধার মায়াবী একটা সংসারের স্বপ্ন ফিকে হয়ে আসে। এদিকে শাশুড়ির কড়া শাসন – এখুনি বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে বসো না বাপু, নিজেই ঠিকঠাক মানুষ হও নি, আরেকটা মানুষ করবে কিভাবে!

লজ্জায় মাথা কাটা যায় স্নিগ্ধার। ঠিকমতো ঘুম না, খাওয়া না -চোখের নিচে কালি, চুল পড়ে গেছে। মুখের রঙ তামাটে। শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে। কোন কালে মরে যাওয়া মা’কে মনে পড়ে শুধু। কান্নাকাটিও ভুলে গেছে। কেউ কিছু বললে মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।

– হাঁ করে তাকিয়ে আছো কেন? যাও আমার এই শাড়ি’টা ভালো করে ধুয়ে ইস্ত্রি করে দিও। বেশ দামী শাড়ি, শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে দিও৷ জরিনার হাতে দিও না। ও তো আঁচড়ে ফেলা ছাড়া ধুইতে পারে না।

বিপত্তি বাঁধে ইস্ত্রি করার সময়। ইস্ত্রি করার সময় হঠাৎ মনে হয় চুলায় চায়ের পানি বসানো ছিলো । শুকিয়ে হাঁড়ি পুড়ে গেলো না তো! দৌড়ে গিয়ে চুলা বন্ধ করতে যায়। এসে দেখে শাড়ি এক জায়গায় সামান্য একটু পুড়ে গেছে। ভয় পেয়ে যায় স্নিগ্ধা। কাউকেই কিছু বলে না। রাতে ভয়ে খায়ও না। বারান্দায় বসে বসে কাঁদে। কি করবে বুঝতে পারে না। কেমন যেন পাগল পাগল লাগে। এরপর বেশ গভীর রাতে যখন এক ফালি চাঁদ এসে আলো দিচ্ছে, কাউকে কিছু না বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে