#দোলনচাঁপা
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
শেষ পার্ট
ফাহাদের চোখ ভিজে যাচ্ছে। সে কিছুতেই মানতে পারছে না রঞ্জু চলে গেছে। হারিয়ে যাওয়া কি কোন কিছুর সমাধান হতে পারে? রঞ্জুকে নিজের ভাইয়ের মতো ভালোবাসে। একসাথে থাকলে কি খুব বেশি অসুবিধা হতো? পরক্ষণেই মনে হলো এগুলো বলে নিজেকে মিথ্যা সান্তনা দিচ্ছে। সে-ও চায়নি রঞ্জু তার প্রাপ্য সম্পত্তিতে ভাগ বসাক। ছোট জীবনে সম্পদের প্রয়োজন এতো বেশি!
জীর্ণ শীর্ণ কুটিরের বারান্দায় বসে আপনমনে বিড়বিড় করছে রঞ্জু। বাড়ির দেওয়ালগুলো খসে পড়েছে। চালের অবস্থাও শোচনীয়। দেখে মনে হয়, বহুবছর ধরে পরিত্যক্ত পড়ে আছে। মানুষজনের যাতায়াত নেই। উঠোনোর বেশিরভাগ জায়গায় বুনো গাছপালা জন্মেছে। ঘরের ভেতরটা আগাছায় ভরে গেছে।
বাড়ির অবস্থা এমন করুণ হলেও বাড়ির সামনের ক’ব’রটা বেশ যত্নে আছে। ক’ব’রের চারপাশে আধ-পুরনো বাঁশের বেড়া। ছোট বড় ফুলগাছ লাগনো। ক’ব’রের পশ্চিম পাশে দোলনচাঁপা ফুলের গাছ। সবে ফুল ফুটতে আরম্ভ করেছে। দোলনচাঁপার মিষ্টি গন্ধে ভরে আছে চারদিক।
রঞ্জু বাড়ির ভেতর দিয়ে বেরিয়ে ক’ব’রের সামনে এসে দাঁড়ালো। ধরা গলায় বললো, ” বাবা, কেমন আছো তুমি? অনেকদিন হলো তোমার কাছে আসা হয়নি। মা’য়ের ক’ব’রটা তোমার পাশে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল। দু’জনকে একসাথে দেখতে পাবো। কিন্তু ওই মনির চৌধুরী রাজি হলেন না। কি আর করার! সবার সব ইচ্ছে পূরণ হবার নয়। ”
ওপাশে থেকে উত্তর আসে না। রঞ্জু দু’হাতে বাঁশের বেড়া চেপে ধরে। কপল বেয়ে পাণনি গড়িয়ে পড়ছে। নির্জন জায়গাগুলো কাঁদার উপযুক্ত স্থান। অশ্রু লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে হয় না
এই মুহুর্তে রঞ্জুকে গল্প-উপন্যাসের চরিত্র মনে হচ্ছে। আজকালকার দিনে এমন ছেলে পাওয়া বড়োই দুষ্কর। বেশিরভাগ মানুষের মা-বাবার ক’ব’রের কাছে দাঁড়ানোর সময় হয় না। সকলেই নিজেদের কাজে ব্যস্ত।
রঞ্জুর শরীর নড়েচড়ে না। এক দৃষ্টিতে ক’ব’রের দিকে তাকিয়ে থাকে। সদ্য জন্মানো কচি ঘাসগুলো চোখে লাগছে। ক’ব’রের উপর এদের মানাচ্ছে না।
* * *
ফাহাদ বাড়ি ফিরেছে মিনিট খানেক হলো। গলা ছেড়ে তনিমাকে ডাকছে। তনিমার সাড়াশব্দ নেই। হয়তো বাথরুমে, এখন তনিমার গোসলের সময়। বাবাও এ সময়ে গোসল করতেন। বাবার কথা মনে পড়তেই বুক ভারী হয়ে আসে। একরাশ ঘৃণা মনের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ফাহাদ শেষবারের মতো তনিমা বলে চিৎকার।
তনিমা দৌড়ে আসে।ব্যস্ত গলায় বলে, ” এভাবে ডাকছেন কেন? কোন সমস্যা হয়নি তো?”
ফাহাদ ভ্রু কুঁচকে তনিমার দিকে তাকিয়ে আছে। পরনে ভেজা কাপড়, চুল থেকে পানি পড়ছে।
” কোথায় ছিলে তুমি?’
” গোসল করছিলাম। যেভাবে ডাকছেন, কাপড় বদলানোর সময় পাইনি। ”
প্রতিত্তোরে কিছুই বললো না। গুটিগুটি পায়ে তনিমার দিকে এগিয়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো। ফাহাদের কান্ড দেখে তনিমা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফাহাদের এমন আচরণ সম্পূর্ণ নতুন। আগে-পরে কখনো এমন করেনি।
” রঞ্জু চলে গেছে। আর কখনো আসবে না। ”
” কোথায় চলে গেছে? আসবে না কেন?”
” জানি না আমি। জায়গার নাম বলে যায়নি। থানা থেকে ফেরার পথে একটা চিঠি পেয়েছি। সেখানেই লেখা ছিলো। ”
” থানা থেকে ফেরার পথে চিঠি কে দিলো?”
” ফোনের ব্যাককভারের মধ্যে ছিলো। ”
” ওহ্! ”
“তুমিও আমায় ছেড়ে চলে যাবে তাই না? সবাই আমায় একা করে দিচ্ছে। জীবনে অনেক পা’প করে ফেলেছি। এখন সে-ই শাস্তি পাচ্ছি বোধহয়। ”
ফাহাদের চোখের পানিতে তনিমার কাঁধ ভিজে যাচ্ছে। ভেজা শরীরের স্পষ্ট অনুভব করা যাচ্ছে। স্বামীর কষ্টে মন পুড়ছে তনিমার, মুখে কিছু বলতে পারছে না। বহুদিন পর দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে আছে।
হালাল সম্পর্কগুলো এমন সুন্দর থাকলে কি খুব বেশি অসুবিধা হয়? সব দোষ মাফ করে দিয়ে দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরা যায় না?
মিনিট পাঁচেক পর তনিমাকে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ায়। ফাহাদের শার্টের অনেক অংশ ভিজে গেছে। অন্যদিন হলে ফাহাদ ভীষণ রেগে যেত। কিন্তু আজ রাগতে পারছে না। রঞ্জুর চলে যাওয়া তাঁকে ভীষণ পো’ড়া’চ্ছে।
” তনিমা, এভাবে দাঁড়িয়ে থেকো না। ঠান্ডা লাগবে। কাপড় বদলে আসো। ”
” আচ্ছা। ”
তনিমা দ্রুত পায়ে ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। অজানা অনুভূতিতে তাঁর শরীর কাঁপছে। হুট করে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। কি আদো কখনো ফাহাদকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভেবেছে? রঞ্জুকেও নিজের ভাইয়ের মতো ভালোবাসে, ছেলেটা যে কোথায় চলে গেল!
কাপড় পরা শেষ, ওড়নার ভাজ খুলতেই এক টুকরো কাগজ মাটিতে পড়ে। তনিমা নিচু হয়ে কাগজটা তুলে নেয়। চিঠির মতো চার ভাজ করা।
প্রিয় বোন,
আশা করি স্বামীর সঙ্গে ভালোই থাকবে। আমার চলে যাওয়া নিয়ে একটুও কষ্ট পাবে না। মুখে যা-ই বলো না কেন। আমি জানি, তুমি আমায় কতোটা ভালোবাসো। মা মা’রা যাওয়ার পর থেকে হাত পু’ড়ি’য়ে রান্না করতে হতো। তিনজনের রান্নায় ভাইয়াও অনেক সাহায্য করেছে। মনির চৌধুরী কাজের বুয়া রাখতে সাহস পেতেন না। সমস্যা মেটানোর জন্য ভাইয়ার বিয়ে দেওয়া হলো। তুমি এলে। তুমি আসার পর একদিনও রান্না করতে হয়নি, ঘর গোছাতে হয়নি। বাড়ির সব কাজের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলে। মা হা’রা ছেলেটার অনেক যত্ন করেছো। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ভাষা আমার জানা নেই।
মনের মাঝে পুষে রাখা স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য ঘর ছেড়েছি। ও বাড়িতে বিড়ালের মতো দিন কাটাতে ইচ্ছে করে। যদি কখনো সময় হয় ফিরে আসবো। নিজের খেয়াল রাখবে। তোমার জন্য চিঁড়ের মোয়া কিনেছিলাম। আমার ঘরে টেবিলের নিচে রাখা আছে। না জানি কবে এই চিঠি পাও। ততদিনে ওগুলো ভালো থাকলে হয়!
ইতি
রঞ্জু
চিঠিতে বিশেষ কিছু নেই৷ তবুও তনিমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। কাঁদতে কাঁদতে ওয়াশরুমের দরজা খোলে। ফাহাদের কাছে গিয়ে ভাঙা গলায় বলে, ” রঞ্জুর আমায় এই চিঠি লিখেছি। আসুক একবার। খুব জোরে কান মলে দেবো। ”
ফাহাদ কিছু বলে না। চুপচাপ জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। নিজের জীবনের হিসাব মেলাতে বড্ড ব্যস্ত সে।
দুপুরে কারোরই খাওয়া হয় না। ফাহাদ ঘুমিয়ে পড়ছে, তনিমা বিষন্ন মুখে সোফার উপর বসে আছে। হাতে গল্পের বই, তবে সেদিকে মন নেই।
সবে সন্ধ্যা নেমেছে। পশ্চিম আকাশে সন্ধ্যাতারা জ্বলজ্বল করছে। ফাহাদ বাবার ক’ব’রের কাছে দাঁড়িয়ে কিসব বিড়বিড় করছে। দূর থেকে সে কথা কানে আসে না। অন্ধকার গাঢ় হতে আরম্ভ করছে, বাড়ির সামনে লাইট জ্বলে উঠলো। ফাহাদের শরীর নড়ছে না। ক’ব’রটা বড্ড আকর্ষণ করছে। ক’ব’রের ভেতর আ’যা’ব হচ্ছে না তো?
” ঘরে আসবেন না?”
তনিমা গলা শুনে ফাহাদ চমকে ওঠে। কোমল গলায় বলে, ” আমায় ঘরে নিয়ে যাবে? একা যেতে পারছি না। ”
তনিমা এগিয়ে এসে স্বামীর বাহু চেপে ধরে। ফাহাদ তনিমার কাঁধের উপর হাত রেখেছে। এমন ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত আগে আসেনি কেন!
সময় তার নিজের নিয়মে চলছে। মাঝে কেটে গেছে চারটে বছর। তনিমা ফাহাদকে ছেড়ে যায়নি। কেউ যদি নিজের ভুল বুঝে ক্ষমা চায়, তবে তাকে মাফ করে দিতে হয়। সকলে প্র’তি’শো’ধের কাহিনীতে মেতে থাকলে দুনিয়া চলবে না। ক্ষমা তো ভালোবাসারই অংশ। বছর দুয়েক হলো ওদের একটা ছেলে হয়েছে। আজ-কাল ছেলেটা বড্ড দুষ্ট হয়ে উঠেছে। ছেলেকে সামলাতে রিতীমত হিমসিম খেতে হয় তনিমার। তবুও যেন অদ্ভুত শান্তি খুঁজে পায়। প্রশান্তিতে মন ভরে ওঠে।
সকাল থেকে ছেলের পিছনে ছুটতে হচ্ছে তনিমার। বিয়ে বাড়ির কোন কাজে হাত লাগতে পারছে না। মঞ্জিলা বেগম বড় মেয়ের উপর রেগে যাচ্ছেন। রিপাকে সাজানো হয়নি। পার্লারের মেয়েগুলো এখনও এসে পৌঁছায়নি। তনিমার বাবা ফাহাদের সঙ্গে বাইরের দিকটা সামলাচ্ছে। যদিও বর পক্ষ এসে পৌঁছায়নি, তবুও কাজের শেষ হচ্ছে না।
শেষবারের মতো আলমারির নিচের ড্রয়ার খোলে রিপা। কিছু কাগজের টুকরো পড়ে আছে সেখানে। সযত্নে সেগুলো হাতে তুলে নেয়। চোখের পানি যেন বাঁধ মানছে না।
” এ চিঠি আমায় না লিখলেও পারতে তুমি! তাহলে এদিন ধরে কাগজের টুকরোগুলোকে যত্ন করে রাখতে হতো না। মনে পড়ে চিঠিতে কি লিখেছি। আমার উদ্দেশ্যে প্রেমপত্র লেখনি। তার থেকেও বেশি কিছু লিখেছি। কতটা আপন ভাবলে এসব লেখা যায়। প্রথমে বুঝতে পারিনি। বোকার মতো অভিমান করে চিঠিটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলেছিলাম। সময়ের সাথে বুঝতে পেরেছি, তুমি কি লিখেছো! একান্ত আপন মানুষ ছাড়া কাউকে এসব কথা বলা যায় না। সব থেকে প্রিয় মানুষকে মনের কথা বলে নিজেকে হালকা করা যায়। ”
“রিপা, দরজা লাগিয়ে কি করছিস? পার্লারের মেয়েগুলো চলে এসেছে। তোদের কারো কোন হেলদোল নেই দেখছি। ”
” খুলছি দাঁড়াও। ”
চিঠির টুকরোগুলো এক জায়গায় করে আ’গুন ধ’রিয়ে দেয়। আগুনের শিখায় কাগজ পু’ড়ছে। রিপার পু’ড়’ছে মন।
” আজ থেকে তোমায় ভালোবাসতে পারবো না রঞ্জু। তেমার কথা চিন্তা করতেও লজ্জা হবে। আমি যে অন্য কারো স্ত্রী হয়ে যাচ্ছি। তোমায় কত খুঁজেছি জানো? পাইনি। হয়তো এ কপালে তুমি ছিলে না!”
চোখ মুছে দরজা খুলে দেয়। রিপা তার হবু বরকে দেখিনি। ফাহাদ বিয়ের প্রস্তাব এনেছিল। ছেলে স্কুলের টিচার, দোতলা বাড়ি। ছেলের মা-বাবা বেঁচে নেই। নিজের চেষ্টায় সবকিছু করেছে। রিপার বাবা অমত করেনি। সবকিছু দেখে বেশ পছন্দ হয়েছে। রিপা অবশ্য বিয়ে করতে চাইনি, কিন্তু কি আর করার! একটা বয়সের পর মেয়েদের জন্য বাপের বাড়িতে থাকা অসহ্যকর হয়ে ওঠে। ঘরের লোক কিছু না বললেও বাইরের মানুষের নানান কথা কানে আসে। কতদিন আর অপেক্ষা করা যায়!
রিপা ফুলে সাজানো বিছানার এক কোণায় মুখ গোমড়া করে বসে আছে। সদ্য বিবাহিত স্বামী রিপার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ছেলেটার এভাবে তাকানো একদমই পছন্দ হচ্ছে না। ভাব দেখে মনে হচ্ছে রিপাকে রাগতে দেখে সে খুব মজা পাচ্ছে।
কবুল বলার আগ মুহূর্তে রঞ্জুকে দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল রিপা। এক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল সে স্বপ্ন দেখছে। পরক্ষনেই উপলব্ধি করলো এটা স্বপ্ন নয়। সত্যি! রিপার দিকে তাকিয়ে তনিমা মুখ টিপে হাসছিলো। নিশ্চয়ই এসব ওদের প্লান! রাগে তনিমার চোখে পানি চলে আসছে। এরা এমন না করলেও পারতো।
” সারা রাত বউয়ের গোমড়া মুখে্ দেখে কাটাতে হবে বুঝি?”
” কোন কথা বলবেন না আপনি। একদমই না। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাইনি। ”
” তাই নাকি? বেশ তো। কাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলে। ”
” জানি না। ”
” আরে পা’গল, কাঁদছে কেন? দেখি। সব মেকাপ নষ্ট হয়ে যাবে না। ”
রঞ্জুর রিপার কাছে এগিয়ে বসে। পরম যত্নে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে, ” তুমি খুশি হওনি?”
” হয়েছি। কিন্তু আগে জানলে চিঠিটা নষ্ট করতে হতো না। ”
” চার বছর ধরে অনেক চিঠি লিখেছি। আগে সেগুলো পড়ে শেষ করো। ”
” সত্যি? ”
” হ্যাঁ। একদম সত্যি। দেখবে?”
রঞ্জু উঠে দাঁড়িয়ে রিপাকে কোলে তুলে নেয়। ধীর পায়ে হেঁটে যায় ঘরের কোণে রাখা আলমারি দিকে। আলমারি খোলার পরে রিপা হতভম্ব হয়ে যায়। হাজার খানেক চিঠি পড়ে আছে। সে-ই সঙ্গে অসংখ্য উপহার।
” এগুলো সব?”
” তোমার জন্য! ”
” এত্ত কিছু? এতো কিছু কেনার দরকার ছিলো না। ”
” চার বছর ধরে কিনেছি। সেজন্যই। ”
রিপা রঞ্জুর দিকে তাকায়। রঞ্জুর চোখেমুখে খুশির আভা ছড়িয়ে আছে। এগিয়ে গিয়ে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে। আদুরে গলায় বলে, ” এতো কষ্ট না দিলেও পারতে। ”
” তবে যে আজকের সুখ পেতে না প্রিয়তমা! ‘
সমাপ্ত