#দোলনচাঁপা
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -১২
বাদশা বাবু মুচকি হাসলেন। ফাহাদের চোখ-মুখে হাসির ছিটেফোঁটা নেই।
” ফাহাদ সাহেব, কিছু চিন্তা করছেন নাকি? ”
” তেমন কিছু নয়। ফুফু নিজের মুখে সবকিছু স্বীকার করছে?”
” হ্যাঁ, তবে বিশেষ করি বলেনি। ”
” উনার সাথে কথা বলতে পারবো?”
” হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। চলুন। ”
চৌদ্দশিকের আবডালে মিজান কাকা দাঁড়িয়ে আছে। ফুফুকে অন্য জায়গায় রাখা হয়েছে। দু’জনের কামরা আলাদা।
” কাকা। ”
” কে? ওহ্ ফাহাদ। কিছু বলবি? ”
” নিজের ভাইকে মা’র’তে পারলে? তোমাদের হাত কাঁপলো না?’
” না রে বাবা। হাত কাঁপবে কেন? হাত কাঁপলে কি মা’র’তে পারতাম নাকি?”
” কেন মা’র’লে বাবাকে? তোমাদের কি ক্ষ’তি করেছিল?”
” শুনবি? ‘
” হ্যাঁ শুনবো। আমাকে জানতে হবে। ”
” তোর বাপ ভাই-বোনদের মধ্যে বড়। আব্বা মা’রা যাওয়ার পরে উনি সবকিছুর দেখাশোনা করতেন। সবকিছুতে উনার মাতব্বরি। একটা টাকা নিতে গেলে হিসাব দিতে হতো। খুব ইচ্ছে ছিলো পড়াশোনা করবো। কিন্তু তোর বাপ আমাকে পড়তে দেয়নি। পড়াশোনা করতে গেলে শুধু শুধু টাকা নষ্ট হবে। আমি যেন এইসব কেতাব পড়ার ভুত মাথা থেকে নামিয়ে ফেলি। আগামীকাল থেকে উনার গুদামে কাজ করি। তাতে কিছু পয়সা হবে। মা-ও বড় ভাইয়ের কথায় তাল মেলালো। মা’য়ের কি দোষ! তোর বাপ উনাকে যা বুঝিয়েছে তা-ই বুঝছে। সেকেলে মেয়ে মানুষ। পড়াশোনার ব্যাপারে তেমন জ্ঞান ছিলো না।
নিজের স্বপ্নকে মাটি চাপা দিয়ে রাত-দিন গুদামঘরে পড়ে থাকতাম। সারা রাত গুদামঘর পাহারা দিয়ে সকালে মালামাল আনতে ছুটতে হতো। ”
” এসব তো বহু আগের কথা। এতো বছর পর এ-সব কারণে বাবাকে মে’রে ফেললে?”
” না, এসব কারণে মা’রিনি। এসব ছোট বেলার কথা। ছেলেবেলা থেকেই মনির চৌধুরীর প্রতি ঘৃ’ণা জমে আছে। মা মা’রা গেল, আমিও বিয়ে করলাম। সংসার আলাদা হলো। তোর বাপ আমায় একটা পয়সাও দেয়নি। আজীবন বিনা পয়সার চাকর খাটিয়েছে। মজার ব্যাপার জানিস? আমার বিয়ের সাতদিন পরে আমাদের ঘর থেকে নামিয়ে দিয়েছিল। তার বাড়িতে বউ নিয়ে থাকা যাবে না। বাপের পোতায় সে ঘর তুলেছে। সেখানে কেন আমরা ভাগ বসাবো। আমার সাথে সাথে মনিরাও ও-ই ঘর থেকে নেমে এসেছিল। তিনজন মিলে অনেক কষ্ট করে নিজেদের ঘর তুলেছি।
সময়ের সাথে সাথে সবকিছু ভুলে গেছিলাম। বড় ভাইয়ের দোষত্রুটি ধরতে নেই। পায়ে ধরে মাফ চাইলাম। উনিও আমায় বুকে জড়িয়ে নিলেন। ভেবেছিলাম সম্পর্ক জোড়া লেগে গেছে। কিন্তু না! আমদের ধারণা ভুল ছিলো। মনির চৌধুরী মিষ্টি কথা বলে একটা কাগজে আমার টিপছাপ নিলেন। উত্তরে জমিতে বাড়ি করবেন, আমার সই প্রয়োজন। সরল মনে টিপছাপ দিয়ে দিলাম। ব্যাস! লোকটা আমাদের সব সম্পত্তি নিজের নামে করে নিয়েছে।
মনে পড়ে দু’মাস আছে তোরা গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলি?”
” হ্যাঁ। মনে আছে। বাবা বলেছিল গ্রামের জমিজমা আমার নামে লিখে দিবে। ”
” হ্যাঁ। হাতে পায়ে ধরে অনেক বুঝিয়েছি। লাভ হয়নি। আমাদের বাড়ি ছাড়তে হবে। দু’মাস পর সবকিছু দখল করে নিবেন। সেদিন সকালে বাড়িতে উকিল গেছিলো। আমাদেরকে ঘর ছাড়ার নোটিশ দিয়ে দিয়েছে। উপায় না পেয়ে শহরে এলাম।
সেদিন রাতে,
” মনিরা, তোর কি মনে হয়? উনি আমাদের কথা মেনে নিবেন?”
” জানি না, ভাই। হয়তো মেনে নিবে না। যে লোকটা আমার বিয়ের জন্য এক পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে রাজি হয়নি। সে কি করে এতো জমির লোভ ছাড়বে।”
” ঠিকই বলেছিস। সেদিন জয়নালকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে পারলে তোর বিয়েটা ভাঙতো না। ”
” কিভাবে বুঝবো বলো? লোকটা ভালোবাসা কথা বলে বিয়ে করতে চাইলো। বছর তিনেক সম্পর্ক রাখার পর জন্য বিয়ের কথা হলো। টাকা জন্য বিয়ে করলো না। ”
” ওর সঙ্গে বিয়ে না হয়ে ভালোই হয়েছে। যে টাকার জন্য বিয়ে করেনি, তার সাথে বিয়ে হলে কি তুই সুখী হতে পারতি?”
” তা পারতাম না বটে। কিন্তু দেখো, সে-ই ঘটনার সূত্র ধরে আজও বিয়ে হলো না। গ্রামের মানুষ কিসব কথা বলে। ”
” বাদ দে। যে কাজে এসেছি তাই করি। ভাইয়ের সামনে নরম থাকতে হবে। ”
” ঠিক আছে। আর কিছু বলছি না। তুমি দরজায় কড়া নাড়ো। ”
মনিরা এগিয়ে গিয়ে দরজায় কড়া নাড়লো। মনির চৌধুরী দরজা খুলে দিতেন। ঘুম জড়ানো চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ” এতো রাতে তোরা? কি হয়েছে?”
” তেমন কিছু হয়নি। একটা কাজে এসেছিলাম। ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করে যাই। ”
” দরকার ছিলো না। যাক চলেই যখন এসেছিা ভেতরে আয়। তনিমাকে ডেকে দিচ্ছি। ”
” বউমাকে ডাকতে হবে না। আমরা একটু কথা বলে চলে যাব। গাড়ি ঠিক করা। ”
” ওহ্, আয়। ”
ঘরের ভেতরে গিয়ে সোফায় বসলাম। হাতজোড় করে বললাম, ” ভাই আমাদের জমিটুকু ফেরত দেও। উকিল বলেছে তোমার কাগজপত্র একদম ক্লিয়ার। কে’স করলে আমরা হেরে যাব। এমন করো না। ”
” এসব কথা বাদ দে। ও জমি বাপের। আমারও ভাগ আছে। ”
মনিরা রেগে যায়। কর্কশ গলায় বলে, ” না ওই জমি আমাদের। র’ক্ত পানি করা টাকা দিয়ে কিনেছি। ”
” বেশ তো। মামলা কর গিয়ে। এখন এখান থেকে বেরিয়ে যা। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। ”
” ম’রার ঘুম ধরছে তোমারে। ”
“কি বললি তুই?”
দাদা মনিরার দিকে তেড়ে যায়। ওদের ছাড়াতে গিয়ে জড়াজড়ি শুরু। এ পর্যায়ে দাদাকে ঠেলে খাটের উপর ফেলে দিলাম। উনি চিৎকার করতে যাচ্ছিলো। মনিরা বিছানা থেকে বালিশ উঠিয়ে মুখের উপর বালিশ চেপে ধরলো। কয়েক মিনিট পর সব শেষ। আমরা ইচ্ছে করে তোর বাপ মা’রিনি। মা’রার জন্য আফসোসও নেই। ভুলে করে হলেও সঠিক কাজ করেছি।”
মিজান সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তরল গলায় বললেন, ” বাবা ফাহাদ। আমার ছেলে-মেয়েগুলো অনেক ছোট। ওদের বাড়ি ছাড়া করিস না। ওদের যাওয়ার কোন জায়গা নেই রে। ”
প্রতিত্তোরে ফাহাদ কিছু বললো না। চোখ মুছে থা’না থেকে বেরিয়ে গেল। বাদশা বাবুও ফাহদের পিছন পিছন যাচ্ছে।
” নিজেকে শান্ত করুন। এভাবে ভেঙে পড়লে হবে না। ”
” আমার বাবা এমন কেন ছিলেন! উনার জীবনে কত পাপ লুকিয়ে আছে!’
” বাদ দিন। আপনাকে একটা সত্যি কথা বলবো।”
” হ্যাঁ বলুন। ”
” আপনার বাবার ঘরে কোন ক্যামেরা পাইনি। বোধহয় ক্যানেরা লাগানোর সময় পাননি। খু’নের ব্যাপারটা উনারা নিজে থেকে স্বীকার করেছে। ”
” তাহলে ক্যামেরার কথা বললেন কেন?”
” আপনার রিয়াকশন দেখতে। কিছু মনে করবেন না। আমাদের এমন অনেক কিছুই বলতে হয়। যেহেতু আপনিই ক্যামেরার ব্যাপারে বলেছিলেন সেজন্য আপনাকেও পরীক্ষা করে নিলাম। ”
“আচ্ছা। তা বেশ। কে’সটা কিভাবে সমাধান করলেন?”
” কফি খেতে খেতে বলি?”
” হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। ”
দু’জনে হেঁটে গিয়ে সামনের কফিশপে বসলো। ফাহাদ বাদশার মুখোমুখি বসে আছে। ছিপছিপে গড়নের এক ছেলে এসে ওদের দু’কাপ কফি দিয়ে গেল। বাদশা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বললো, ” হ’ত্যার দিন সকালে আপনাদের ঘরে একটা মিষ্টি গন্ধ পেয়েছিলাম। দোলনচাঁপা ফুলের ঘ্রাণ। ঘ্রাণটা বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছিল। আশেপাশে খুঁজে দেখলাম। কোথাও এই ফুলের গাছ দেখতে পেলাম না। গাছ না থাকলে ফুলের গন্ধ আসবে কোথা থেকে। খুঁজতে খুঁজতে কয়েকটা ফুল পেলাম। মেঝের কোণায় পড়ে ছিলো। ফুলগুলো খুব বেশি পুরনো না, আজ-কালের মধ্যে ছেঁড়া হয়েছে। বড়জোর এক রাত আগে।
ফুলগুলো উঠিয়ে পকেটে ভরে নিলাম। আপনাদের সকলের উপর নজরদারীর ব্যবস্থা করলাম। মনে হচ্ছিলো আপনাদের মধ্যেই কেউ খু’নি। বাড়ির উপরও নজর রাখা হচ্ছিল।
পরবর্তীতে একজন খবর দিলো আপনি বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন। কোন মেয়ের সাথে আছেন। তমালকে আপনাদের পিছু করতে বললাম। এ পর্যায়ে তুলি মেয়েটা গাড়ি থেকে নেমে গেল।
তমাল গিয়ে তুলির সঙ্গে কথা বলতে লাগলো। প্রথম দিকে তুলি ওকে এড়িয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তমাল ওকে থানায় নিয়ে আসে। ওর ব্যাগেও একই ফুল পাওয়া গেছে। দোলনচাঁপা। ফুলগুলো হুবহু আপনাদের বাড়িতে যে রকম ফুল পাওয়া গেছিলো সেগুলোর মতো। মনে হচ্ছিল সবগুলো ফুল একই দিনে তোলা হয়েছে।
সেখান থেকেই সন্দেহ তীব্র হয়। ওকে নানান রকম জিজ্ঞেসাবাদ করতে থাকি। প্রথমে কিছু স্বীকার করতে চায়নি। পরবর্তীতে সবকিছু খুলে বললো। আপনাদের গ্রামে খোঁজ নিয়ে জায়গাজমির ব্যাপারটা জানতে পারলাম। আস্তে আস্তে সবকিছু পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। ”
” সবকিছুর মূলে দোলনচাঁপা ফুল? ওই ফুলের জন্য সব ধরতে পেরেছেন? ”
” হ্যাঁ। অনেকটাই। ছোট ছোট ভুল থেকে অনেক বড় সত্যি প্রকাশ পেয়ে যায়। তুলি সেদিন খু’নের উদ্দেশ্যে আপনাদের বাড়িতে গিয়েছিল। মনির সাহেবকে জীবিত পায়নি। রাগে মেয়েটার মাথা খারাপ হয়ে যায়। মনির সাহেবের শরীরে আঘাত করতে থাকে। তখনই বোধহয় ফুলগুলো মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল। যাওয়ার সময় খেয়াল করেনি। ”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে শেষবার কাপে চুমুক দিলো। কফি শেষ। এবার উঠতে হবে। বাবার মৃ’ত্যু রহস্য জানা হয়ে গেছে। লোকটা বাবা বলতে ইচ্ছে করছে না। বাবারা তো এমন নিষ্ঠুর হয় না।
ফাহাদ এখনও রঞ্জুর চিঠি হাতে পায়নি। রঞ্জুর বুদ্ধি করে চিঠিটা ফাহাদের ফোনের ব্যাককভারের ভেতর লুকিয়ে রেখেছে। যেন মোবাইল হাতে নিলেই বুঝতে পারে ভেতরে কিছু আছে। আসার সময় তাড়াহুড়োয় খেয়াল করেনি।
হঠাৎ কি মনে করে পকেট থেকে মোবাইল বের করলো ফাহাদ। তনিমাকে সবকিছু জানাতে ইচ্ছে করছে। মোবাইল হাতে নিতেই ফাহাদের সন্দেহ হলো। ব্যাককভার খুলে দেখলো সাদা কাগজ ভাজ করে রাখা। বিরক্ত হয়ে কাগজটা হাতে নিলো। কাগজে কিছু লেখা রয়েছে। কৌতুহলী হয়ে লেখাগুলো পড়তে আরম্ভ করলো।
ফাহাদের চোখ ভিজে যাচ্ছে। সে কিছুতে মানতে পারছে না রঞ্জু চলে গেছে। আচ্ছা হারিয়ে যাওয়া কি কোন কিছুর সমাধান হতে পারে? ফাহাদ তো রঞ্জুকে নিজের ভাইয়ের মতো ভালোবাসে। একসাথে থাকলে কি খুব বেশি অসুবিধা হতো? পরক্ষণেই মনে হলো সে নিজেকে মিথ্যা সান্তনা দিচ্ছে। সে-ও চায়নি রঞ্জু সম্পত্তিতে ভাগ বসাক। ছোট জীবনে সম্পদের প্রয়োজন এতো বেশি!
চলবে