#দোলনচাঁপা
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -১০
হাবু মিয়া কাকার হাত ধরে জে’লের ভেতর নিয়ে গেল। মহিলা পুলিশ এগিয়ে এসে ফুফুর হাত ধরলেন। ভাইয়াকে নিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে এলাম। আপাতত এখানের কাজ শেষ। ভাই-ভাবী দু’জনের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। ওরা পাশাপাশি হাঁটতে চাইছে না।
” রঞ্জু রে, এসব কি হয়ে গেল? আমাদের পরিবারের উপর ঝড় শুরু হলো কেন?”
” পা’পের ফল। শান্ত থাকার চেষ্টা করো। বিপদের সময় ভেঙে পড়লে হবে? ”
” ভালো লাগছে না রে। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। শরীর ছেড়ে দিচ্ছে, হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে। ”
” গাড়ি চালাতে পারবে? না পারলে দরকার নেই। অটোরিকশা ভাড়া করে বাড়ি ফিরে যাব। ”
” গাড়ির কি হবে?”
” থাকুক এখানে। পরে এসে নিয়ে গেলে হবে। বাদশা বাবুকে বলে আসছি। ”
” তাড়াতাড়ি আসিস। ”
দৌড়ে থানার ভেতর ঢুকলাম। বাদশা বাবু চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন, আমায় দেখে ব্যস্ত গলায় বললো, ” কোন সমস্যা? এভাবে দৌড়ে আসলেন যে।”
” তেমন কিছু না। ভাইয়ার ভালো লাগছে না। উনার গাড়িটা থানার সামনে রেখে গেলে সমস্যা হবে না তো?”
” না, না। সমস্যা হবে কেন! রেখে যান। হাবু মিয়াকে বলে দিচ্ছি, উনি খেয়াল রাখবে। ”
” ধন্যবাদ। ”
” রঞ্জু, শোনো। ”
” হ্যাঁ, বলুন। ”
” তনিমাকে দেখে রেখো। মেয়েটা অনেক ভেঙে পড়েছে।”
” ঠিক আছে। ”
ভাবী ভাইয়ার ডান দিকে দাঁড়ানো। দু’জনের মাঝে এক মুহূর্তের দূরত্ব। এই সামান্য দূরত্ব পার করার সাহসটুকু ওদের নেই। সম্পর্কটা জোড়া লাগবে তো? নাকি এভাবেই দূরত্ব বাড়তে থাকবে!
অনেক খুঁজেও অটোরিকশা পাওয়া গেল না। দুপুরে রোদে পিচ ঢালা রাস্তা গরম হয়ে গেছে। রোদের তাপ সবকিছু পুড়িয়ে ফেলতে চাইছে।
” গাড়িটা নিয়েই চলে যাই। কি বলিস?”
” না দরকার নেই। তোমরা দু’জন রিকশা করে চলে যাও। আমি পরে আসছি। ”
” আরে না। তুইও চল। ”
ওদের দু’জনকে রিকশায় উঠিয়ে দিলাম। ইচ্ছে করেই এমন করেছি। কিছু সময় কাছাকাছি থাকলে সম্পর্ক গভীর হতে পারে। ভাইয়ার মতো আমারও কিছু ভালো লাগছে না। মোবাইল বের করে রিপাকে কল দিলাম। ব্যালেন্স শেষ। কল যাচ্ছে না। মোবাইলটা পকেটে রেখে রিকশা খুঁজতে লাগলাম। বাড়ি ফিরে যাব। কয়েকটা কাজ বাকি রয়ে গেছে।
থানা থেকে বাড়ি ফিরতে বড়জোর আধঘন্টা সময় লাগে। এই সামান্য সময় শেষ হচ্ছে না। তনিমা রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। ফাহাদ মাথা নিচু করে বসে আছে। তনিমার পায়ের দিকে নজর যাচ্ছে বারবার। বিরক্ত হয়ে নজর সরিয়ে নিচ্ছে ফাহাদ। তনিমা পা দু’টো অদ্ভুত সুন্দর। সাদা মসৃণ পা, যেন কখনো ধূলোময়লা স্পর্শ করেনি।
” তনিমা!”
স্বামীর কন্ঠে চমকে ওঠে তনিমা। ফাহাদ কখনো এতো দরদ মিশিয়ে তাকে ডাকেনি। কি বলবে ভেবে পায় না, চিন্তা ভাবনা গুলিয়ে যেতে থাকে, কয়েক মুহূর্ত পর ব্যস্ত গলায় বলে, ” বলুন। ”
” আমি মানুষটা স্বামী হিসাবে বড্ড অযোগ্য। তাই না বলো?’
ফাহাদের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। তনিমা তরল গলায় বললো, ” আমি কখনো আপনার পছন্দসই হয়ে উঠতে পারিনি। এ ব্যর্থতা শুধু আমার। ”
” হয়তো, সত্যি কথা শুনবে। ”
” বলুন। ”
” তুলি চোখের পানি আমায় ততটা আঘাত করতে পারে না যতটা তুমি পারো। থানায় তুলির চোখে পানি দেখে খারাপ লেগেছিল, খুব খারাপ। তবে তোমার চোখে পানি দেখে হৃদয় পুড়ছে। ”
” বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। ইচ্ছেও করে না। ”
” তোমার ব্যাপার। ”
দু’জন দু’দিকে তাকিয়ে রইলো। বাড়ি পর্যন্ত তাদের মধ্যে কোন কথা হলো না। দু’জনেই চুপচাপ। কেউ আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যায়নি।
* * *
বাড়ি ফিরে দেখি ভাবী রান্নাঘরে বসে আছে। চুলায় কড়াই চাপানো। বোধহয় দুপুরে খাওয়ার জন্য খাবার গরম করছে। ভাইয়া ঠান্ডা খাবার খেতে পারে না।
” কি রান্না করবে?”
” রান্না করা ছিলো। গরম করছি। ”
” কেন করছো? দুপুরে ঠান্ডা খাবার খেলে তেমন কিছু হয় না। ”
” তোমার ভাইয়াই তো.’
এতটুকু বলে চুপ হয়ে গেল। আমিও কিছু বললাম না। চুপচাপ নিজের ঘরে চলে এলাম। দরজা লাগিয়ে খাতা কলম নিয়ে বসলাম। অনেকদিন কিছু লেখা হয়নি। আজ লিখতে হবে। দু’টো চিঠি লিখবো। একটা ভাইয়ার জন্য অন্যটা রিপার। নাহ্ তিনটে লিখবো। ভাবীর উদ্দেশ্যে সামান্য কিছু হলেও লিখবো, উনাকেও ভীষণ ভালোবাসি। তিন বছর ধরে অনেক যত্ন করেছে, খেয়াল রেখেছে। ঝগড়াঝাটি, মনমালিন্য সংসারের অংশ। এসব তো থাকবেই। চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকালাম। মাথার উপরে আকাশ নেই, ইট পাথরের ছাদ।
ভাইয়া,
আমার মতো তুমিও জানো আমাদের মধ্যে র’ক্তের সম্পর্ক নেই। আমাদের মা-বাবা আলাদা। তবুও তুমিই আমার ভাই। ছোটবেলায় এ বাড়িতে এসেছি, তুমিও অনেক ছোট ছিলে। কখনো আমায় পর করে দেখোনি। মনে পড়ে প্রথম যেদিন এ বাড়িতে এসেছিলাম। মা’য়ের আঁচলের নিচে লুকিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি। কত বড় বাড়ি, আমাদের বাড়ি তো এতো ছিলো না। তুমি সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বাবাকে ডাকছো। বিরক্ত গলায় বলছো তোমার নতুন ভাই চাই না। তোমার কথা শুনে মা ভয় পেয়ে যায়। শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরে। কোমল গলায় বলে, ” ও থেকে দূরে থাকিস। ”
মাথা নেড়ে সম্মতি জানাই। মা আমার কপালে চুমু এঁকে দেন। এসব দৃশ্য তোমার নজর এড়ায়নি। তুমি আমাদের দিকে দৌড়ে এলে। উৎফুল্ল গলায় বললে, ” তুই কি আমার নতুন ভাই? ”
” না। আমি তোমার ভাই না। ”
ভয়ে বলেছিলাম কথাগুলো। যদি বাড়ি থেকে বের করে দাও। তাহলে তো মা’য়ের সঙ্গে থাকতে পারবো না। মা বলেছে, ‘ এ বাড়িতে তোমার কথাই শেষ কথা। মনির সাহেব তোমার কথার উপর কথা বলে না। ‘
তুমি আমার কথা বিশ্বাস করলে না। হাত ধরে টানতে টানতে বললে, ” না কেন? বাবা বলেছে আজ নতুন ভাই আসবে। তুই এসেছিস। তাহলে তুই-ই তো নতুন ভাই। এদিকে আয়। আয় বলছি। ”
মা ভীষণ ঘাবড়ে গেছিলো, সাথে আমিও। এই বুঝি বাড়ি থেকে বের করে দিলে। কিন্তু না। আমাদেরকে ভুল প্রমানিত করে আমায় বুকে জড়িয়ে ধরলে। আদুরে গলায় বললে, ” ভয় পাচ্ছিস কেন? বড় ভাইকে জড়িয়ে ধরতে ভয় কিসের? বো’কা ছেলে। ”
সে-ই থেকে শুরু। সত্যি বলছি তুমিই আমার ভাই। আমি জানি এই বাড়ি, গাড়ি, সকল সম্পত্তির মালিক তুমি। হিসাব অনুযায়ী সবকিছু তোমার পাওয়ার কথা ছিলো। এসবের প্রতি আমার লোভ নেই। সম্পত্তির অংশও চাই না। সবকিছু তোমারই থাকবে। আমি এখান থেকে অনেক দূরে চলে যাব।
ছোট ভাই হিসাবে শেষ অনুরোধ : ভাবীর সঙ্গে সবকিছু মিটিয়ে নিও। উনি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে, সারাক্ষণ তোমার কথা ভাবে, তোমার কথা বলে। সংসারে ঝামেলা থাকবেই। তবুও জীবন থেমে থাকে না।
ইতি তোমার ভাই ( রঞ্জু)
ভাইয়ার চিঠি লেখা শেষ। দ্বিতীয়বার পড়তে সাহস পাচ্ছি না। ভেজা চোখজোড়া হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিলাম। কাগজটা ভাঁজ করে খাটের কোণায় রেখে দিলাম। এখান থেকে চলে যাওয়ার সময় এসেছে।। এ বাড়িতে আমার কাজ শেষ।
” রঞ্জু, ভরদুপুরে কিসব লেখালেখি করছো? খাবার গরম করা শেষ। খেতে এসো। ”
” আসছি। ”
ভাইয়া এখন খাবে না। তাঁর শরীর খারাপ লাগছে। ভাবী আমায় খেতে দিতে গোসল করতে চলে গেল। যেতে যেতে বললো, ” ওখানে সব রাখা আছে। কিছু লাগলে নিয়ে নিও। গোসল করতে যাচ্ছি। ”
খেতে ইচ্ছে করছে না। ভাবী ডাকলো বিধায় আসলাম, না হলে দুপুরে খাওয়া হতো না। ভাবীর রান্নার হাত বেশ ভালো। গিলতে দারুণ লাগছে। এ বাড়িতে এই শেষ খাওয়া। কাল সকালে অজানা পথে রওনা দেবো। হারিয়ে যেতে হবে।
বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছি। লিখতে ইচ্ছে করছে না। মাঝেমধ্যে বাবার ক’ব’র দেখতে ইচ্ছে করে। মা’য়ের কোলে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে চোখ বুজতে ইচ্ছে করে। মা’য়ের কাছে যাওয়া সাধ্যের বাইরে, আগামীকাল বাবার ক’ব’র দেখতে যাব। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। ওদিকটায় নতুন ক’ব’র হয়েছে। মনির চৌধুরীর ক’ব’র। পাতাবাহার গাছগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে।
” ভাবী। খেয়েছো?”
” হ্যাঁ, আমার খাওয়া শেষ। তোমার ভাই এখনও খায়নি। উনার শরীর খারাপ লাগছে। ”
” আচ্ছা। এক কাপ চা বানিয়ে দেবে? মাথাটা বড্ড ধরছে। ”
” অপেক্ষা করো। ”
” ভাবী!”
” কিছু বলবে?”
” রাতের জন্য ভালো-মন্দ কিছু রান্না করো। রিপাকেও আসতে বলবে। ”
” বিশেষ কিছু আছে নাকি?”
” না। তোমার হাতের রান্না খেতে ইচ্ছে করছে। অনেকদিন আদা বাটা দিয়ে গরুর গো’শত খাইনি। ”
” ঠিক আছে। তবে রিপাকে বলতে পারবো না। ওর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। তোমার ইচ্ছে হলে বলো। ”
সোফায় কোণায় বসে চায়ের অপেক্ষা করতে লাগলাম। ভাবী চায়ের মধ্যে আদা দিয়ে আনবে। উনার মতে আদা দেওয়া চা খেলে মা যন্ত্রণা কমে। মোবাইলে টাকা রিচার্জ করতে হবে। রিপাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।
চা খাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিলাম রিপাকে এখানে আসতে বলবো না। কাল যাওয়ার পথে দেখা করে যাব।
রাতে খাওয়া হলো না। বমি আসছে, কিছু মুখে তুলতে পারছি না। ভাবী অনেক যত্ন নিয়ে সবকিছু রান্না করেছে। আদা বাটা দিয়ে গরুর গোশত। এক টুকরো মুখে দিতেই বমি আসলো। রাতের খাওয়া ওখানেই শেষ। ঘরে এসে চিঠি লিখতে বসলাম। আকাশে মেঘ জমছে। বৃষ্টি নামবে নাকি? ঝড়-বৃষ্টির সময় কারেন্ট থাকে না। মেঘের গর্জন কানে আসছে। এখনই কারেন্ট চলে যাবে।
বলতে বলতে কারেন্ট চলে গেল। মোবাইলের আলোয় ড্রয়ার থেকে মোমবাতি বের করলাম।মোমবাতি জ্বালিয়ে চিঠি লিখবো।
চলবে