#দোলনচাঁপা
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৯
ভাইয়া ডান দিকে মাথা কাত করে সম্মতি জানালো। বাদশা বাবু এসব কোথা থেকে জানলেন? সবকিছু অদ্ভুতভাবে এক জায়গায় করা হয়েছে। আস্তে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। ২৪-২৫ বছরের তরুনীর সঙ্গে ৬৫ বছরের বৃদ্ধের কি সম্পর্ক?
রহস্যের জট খুলতে শুরু করেছে, ভয় হচ্ছে যদি ধরা পড়ে যাই। সেদিন বাদশা বাবু বলেছিল বাবার শরীরে আর্সেনিক পাওয়া গেছে। হ্যাঁ, আর্সেনিক দিয়েই তো উনাকে মা’র’তে চেয়েছি। তবে তৃতীয়বারও সফল হতে পারিনি। তুলির মতো সাহসী হলে মন্দ হতো না।
” রঞ্জু সাহেব কি কিছু ভাবছেন?”
” না, তেমন কিছু নয়। ”
তুলি কাঠের চেয়ারটায় বসে দু’হাতে নিজের কপাল চেপে ধরে আছে। কারো দিকে তাকাচ্ছে না। ভাইয়া করুণ চোখে তুলির দিকে তাকিয়ে আছে, উনার চোখ দু’টো ছলছল করছে। ভাবীর চোখের পানি শুকিয়ে গেছে, সে এদিকে নজর দিচ্ছে না। আনমনে কিছু ভাবছে।
” তুলি, সময় নষ্ট করো না। মনির চৌধুরীর সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক? ”
” উনি বাবার অনেক পুরনো বন্ধু। মা-বাবার সঙ্গে গ্রামের পরিবেশে আমার শৈশব কেটেছে। বয়স যখন বারো, তখন বাবার এ’ক্সি’ডে’ন্ট হয়। দুই পায়ের সাথে হারিয়ে ফেলেন চিরতরে হাঁটার ক্ষমতা। বাবার রোজগারের সংসার চলতো। রোজগারের জন্য অন্যকেউ ছিলো না। মা বাইরের কাজে হাত দিতেন না। ঘরের সবকিছু দেখাশোনা করতেন। তেমন কিছু জমানো ছিলো না, যা একটু ছিলো তা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। বাবার চিকিৎসা, সংসার খরচ চালতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হতো। কয়েকমাস পর সংসারে অভাব শুরু হয়। উনুনে হাঁড়ি চাপলে দ্বিতীয়বার রান্নার কিছু অবশিষ্ট থাকতো না।
এমন অভাবের সংসারে মনির চৌধুরীর আগমন। বাবার এমন অবস্থা দেখে উনি ভীষণ কষ্ট পেলেন। পরামর্শ দিলেন কিছু টাকা ঋণ নিয়ে একটা মুদি দোকান চালু করতে। বাড়ির সামনে অমন সুন্দর ফাঁকা জায়গা পড়ে রয়েছে, একদম পথের সঙ্গে। দোকান খুললে মন্দ হয় না। লাভের অংশ দিয়ে দিব্যি সবকিছুর খরচ চালিয়ে নেওয়া যাবে। ভেঙে পড়া মানুষগুলো যেন আশার আলো দেখলো। বাবা কাঁদতে কাঁদতে মনির সাহেবের হাত চেপে ধরলেন। মা’য়ের চোখেও অশ্রু টলটল করছে।
কিস্তিতে ঋণ দেয় এমন ব্যাংক থেকে লোন নেওয়া হলো। মোট টাকার দশ শতাংশ সুদ দিতে হবে। হাতে কিছু টাকা এলো বটে তবে দোকান তোলা কি চারটি খানি কথা! বড় মামার পরিচিত মিস্ত্রি দিয়ে দোকানের কাঠামো তৈরি হলো। কিন্তু জিনিসপত্র? সেসব জিনিসপত্র শহর থেকে আনতে হবে। বড় মামা এতো ঝামেলা পোহাতে পারবেন না। তিনি ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন। আমরা পড়লাম মহা বি’প’দে, মাথার উপর ঋণের বোঝা, দোকানে মাল তোলা হয়নি, ঘরে খাওয়ার কিছু নেই। মা বারান্দায় কোণায় গালে হাত দিয়ে বসে আছে। বাবা বিছানায় শুয়ে হাসফাস করছেন। কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না।
” আশালতা, একবার মনিরকে বললে হতো না? যদি কোন উপায় পাওয়া যেত। ”
” সে কথা আমিও ভেবেছি। তবে উনাকে পাবো কোথায়? ঠিকানা জানি না। যোগাযোগ করার উপায় আছে নাকি!’
” আল্লাহ রহমত করুক। কি যে হলো আমার, মেয়েটাও ছোট। সংসারটা রক্ষা পেল না, এবার বোধহয় সবকিছু শেষ যাবে। ”
” কিচ্ছু ভেসে যাবে না। মালামালের চিন্তা করিস না। আমার নিজেরই তো কাঁচামালের ব্যবসা। আমার গাড়ি করে সবকিছু পৌঁছে দেবো। তোরা বিক্রি করবি। ”
” ভাই তুই এসেছিস। আল্লাহ! তুলি মা কাকাকে বসতে দে তো। ঘরে কিছু থাকতে এনে দে। ”
আচমকা উনার আগমন যেন খুশির জোয়ার বইয়ে দিয়েছিল। ছোট হাতে চেয়ার এনে উনাকে বসতে দিয়েছিলাম। ক’দিন বেশ ভালোই চলছিল। মনির সাহেব নগদ টাকার বিনিময়ে দোকানের মালামাল দিয়ে যেতেন। গ্রামে সেসব জিনিস ভালোই চলতো।
বেশ কিছুদিন পর গ্রামের বাজারে কয়েকজন লোক এলো। উনারা নাকি সরকারি অফিসার। মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন। বাজারের প্রতিটা দোকানের মালামাল চেক করে দেখবেন। কোন বাজে জিনিস বিক্রি করা যাবে না।
দুলু কাকার দোকানের বেশিরভাগ জিনিস রাস্তায় ছুড়ে মারলেন। দুলু কাকা নাকি পঁচা জিনিস বিক্রি করে, এসব খেলে মা’রাত্মক ক্ষ’তি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ভয়ে বুক কাঁপছিল, যদি আমাদের দোকানের জিনিসগুলো এভাবে রাস্তায় ফেলে দেয়। মা’কে রাগারাগি করে। শেষমেশ আমার ভয় সত্যি হলো, উনারা আমাদের দোকানের জিনিসে ভেজাল পেলেন। প্যাকেটজাত খাবারগুলোর মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে। এসব জিনিস বিক্রি করার জন্য জরিমানা করা হলো।
মা’য়ের তখন পাগল পাগল অবস্থা। ঘরে যা ছিলো তাই দিয়ে জরিমানা পরিশোধ করলেও বেঁচে থাকার জন্য কিছু অবশিষ্ট ছিলো না।
একে তো সবকিছু শেষ তারপর আবার ঋনের বোঝা। চার দিন পর মনির সাহেব আমাদের বাড়ি গেলেন। মা লোক পাঠিয়ে খবর দিয়েছিল। উনাকে দেখে চেয়ার এগিয়ে দিলাম, মা বাড়ি ছিলো না। দৌড়ে গিয়ে মা’কে ডেকে নিয়ে আসলাম। বাবা এসবের কিছুই জানতো না। মা ইচ্ছে করে বাবাকে কিছু জানায়নি।
” ভাবী, জুরুরি ডেকে পাঠালেন। দোকানের মালামাল শেষ নাকি? বললেই তো পাঠিয়ে দিতাম। ”
” না ভাই সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছে। ”
মা সবকিছু খুলে বললেন। সবকিছু শুনে উনি এমন ভাব করলেন যে এসবে উনার কোন হাত নেই। দেদার হেসে বললেন, ” তা আপনি কোথা থেকে এসব দুই নম্বর মাল এনেছেন? আমি এসব দুনম্বরি ব্যবসা করি না। ”
” এসব কি বলছেন? আপনিই তো সবকিছুর ব্যবস্থা করে দিলেন। ”
” মিথ্যা বলবেন না। এসব মালামাল আমি দেইনি। ”
” ভাই, এমন করবেন না। পথের ফকির হয়ে যাব। মেয়েকে নিয়ে রাস্তায় বসতে হবে। মাথার উপর ঋণের বোঝা। ”
” জানি না। তাছাড়া বিনা পয়সায় কোনো মাল পাবেন না। নগদ টাকা জোগাড় করতে পারলে খবর দিবেন। ”
” আপনি উনার বন্ধু, একটু সাহায্য করুন। ”
” পারবো না। ”
মনির সাহেব ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। তারপর হনহন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। মা কান্নায় ভেঙে পড়েন। দৌড়ে গিয়ে মা’কে জড়িয়ে ধরি, মা কাঁদতে কাঁদতে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। ভেজা গলায় বলেন, ” ওরে মাফ করবি না মা। কখনোই না। ”
এই ঘটনার সাতদিন পর, মা আ’ত্ম’হ’ত্যা করেন।
সেদিন মনির সাহেব বেরিয়ে যাওয়ার পরপর সমিতির লোক এসেছিল। কিস্তির টাকা নিতে, মায়ের কাছে টাকা ছিলো না বলে অনেক অপমান করেছে। মা’য়ের কিছু বলার ছিল না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছিলেন। শেষ পর্যন্ত উনাদের হাত-পায়ে ধরে কয়েকদিনের সময় চেয়ে আনেন। তারপর আবারও দুলু কাকাকে দিয়ে মনির সাহেবকে খরব পাঠায়।
” ভাবী অনেক অভাবে আছেন দেখি। ”
” আমাদের অবস্থা তো জানেনই, মাথার উপর ঋণের বোঝা। দোকানে মাল নেই। যদি কিছু জিনিস ধারে দিতেন। বিক্রি করে আপনার টাকা শোধ করে দিতাম। ”
” জিনিসপত্র দেওয়া-নেওয়া থাকবে। বাইরে দাঁড়িয়ে এসব কথা না বলাই ভালো। চলুন ঘরের ভেতর যাই। তুলি মা, তুমি বাইরে খেলা করো। কেমন?”
মাথা নাড়লাম। উনি মা’কে নিয়ে ঘরের ভেতর চলে গেলেন। তাকিয়ে দেখলাম মনির সাহেব দরজার কড়া লাগাচ্ছেন। দৌড়ে দরজার কাছে গেলাম। দরজা লাগালো। ঘরের ভেতর মা’য়ের গলা শোনা যাচ্ছে।
” এসব কি করছেন? না ভাই, এমন কিছু করবেন না। আল্লাহর দোহাই লাগে। ”
মনির সাহেবের গলা শোনা গেল না। কয়েক মুহূর্ত পর ঘরের ভেতর থেকে গোঙ্গানির আওয়াজ ভেসে আসছে। মা’য়ের গলা। দৌড়ে বাবার কাছে গেলাম। বাবাকে সব খুলে বললাম। শুনে বাবা শেষবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। নিচে পড়ে গেল। র’ক্তে ঘর ভেসে যাচ্ছে। খাটের কোণায় লেগে মাথা ফে’টে গেছে। দু’হাতে চোখ চেপে ধরলাম।
বাড়ি ভর্তি মানুষ। পুলিশের পোশাক পরা কয়েকজন লোক মা’য়ের লা’শ নামাচ্ছে। বাবার শরীর সাদা কাপড়ে ঢাকা। লোকজন অনেক কিছু বলাবলি করছে। তবে সেসব আমার কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। বারান্দার কোণায় পাথরের মুর্তির মতো বসে আছি।
সুখের সংসার শেষ। হাসিখুশি একটা পরিবার। ”
তুলির বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ধরা গলায় বললো, ” এরপর আর কি, মামার বাড়িতে বড় হয়েছি। আমার জীবনের কোন মানে নেই। এখন শা’স্তি হলেও কিছু যায়-আসে না। ”
“এসব মিথ্যে কথা! বাবা এমন করতে পারেন না। কখনোই না। ”
ভাইয়া চিৎকার করে উঠলো। তুলি হাসছে, তাচ্ছিল্যের হাসি! ঠোঁটের উপর হাত চাপা দিয়ে রেখেছি, না হলে আমার হাসিটাও সবার নজরে পড়তো।
” মিথ্যে অপবাদ দিয়ে আমার কি লাভ? ”
” জানি না। তবে তুমি সত্যি বলছো না। একদমই না। তনিমা তুমি কি এসব বিশ্বাস করেছ? ”
ভাবী কিছু বললেন না। বাদশা বাবু ভাইয়ার দিকে পানিভর্তি গ্লাস এগিয়ে দিলো। নরম গলায় বললো, ” পানি খেয়ে শান্ত হয়ে বসুন। উত্তেজিত হবেন না। ”
ভাইয়া গ্লাস ধরলো না। কর্কশ গলায় বললো, ” আপনারা খু’নিকে ধরতে না পেরে এসব নাটক করছেন।”
বাদশা বাবু ভাইয়াকে কিছু না বলে আমার দিকে তাকালো। কাকাকে উদ্দেশ্য করে বললো, “আপনি কেন নিজের ভাইকে মা’র’তে গেলেন? আপনার কি ক্ষতি করেছিলো? ”
” ভাইকে আমি মা’রি’নি। মনিরা মে’রে’ছে। ”
” না আমি কিছু করিনি। তুই মিথ্যা বলছিস। ”
“বেশ ভালো, হাবু মিয়া উনাদের দু’জনকে জে’লের ভেতর নিয়ে যাও। যা বলার আদালতে গিয়ে বলবে। ”
হাবু মিয়া কাকাকে ধরে জে’লের ভেতর নিয়ে গেল। মহিলা পুলিশ এগিয়ে এসে ফুফুর হাত ধরলেন। ভাইয়াকে নিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে এলাম। এখানের কাজ শেষ।
চলবে