#দোলনচাঁপা
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৭
জানো রিপা মনির চৌধুরী আমার নিজের বাবা না। উনি আমার মা’য়ের স্বামী। ”
রিপা যেন আকাশ থেকে পড়লো। অবাক কন্ঠে কি বলে চিৎকার দিলো। প্রতিত্তোরে কিছু বলে মুচকি হাসলাম। রিপা এখন জান্নাতুলের ব্যাপারটা ভুলে যাবে। বিব্রতকর প্রশ্ন করবে না।
” সত্যি বলছেন? ”
” হ্যাঁ, সত্যি বলছি। তোমার কাছে মিথ্যে বলার প্রয়োজন নেই। ”
” তাহলে কে আপনার বাবা?”
” ছিলেন একজন। অনেক দিন আগের একটা ছবি আছে আমার কাছে। বেশ পুরনো ছবি, সাদা-কালো। কিন্তু তুমি কিভাবে দেখবে বলো?”
” আপনি দেখাতে চাইলে নিশ্চয়ই দেখতে পাবো। দরকার হলো আপনার সঙ্গে ও বাড়িতে ফিরে যাব। ”
” কেউ কিছু মনে করবে না?”
” না। কে কি মনে করবে? তাছাড়া নিজের বোনের বাড়ি যাওয়ার জন্য কোন কারণের দরকার পড়ে না। ”
” ওদিকটায় কেউ নেই, চলো দু’জনে ওখানে গিয়ে বসি। ”
” কেন? বিশেষ কিছু বলবেন?”
” এমনিতেই, তোমার অসুবিধা হলে চলে যেতে পারো।”
” না ঠিক আছে। আমিও যাচ্ছি আপনার সাথে। ”
রিপা আমার পিছন পিছন নদীর পাড়ে এলো। নদীর পাড় বললে ভুল হবে, নদীর আকার সরু নালার মতো. তবুও নদী তো নদীই। বুকের ভেতর জমিয়ে রাখা কথাগুলো কাউকে বলে দিতে ইচ্ছে করছে। অনেকদিন তো হলো।
” জানো রিপা, আমার বাবা স্কুল শিক্ষক ছিলেন। সকাল আটটায় স্কুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতেন, বাড়ি ফিরতেন সন্ধ্যার দিকে। মা’য়ের সঙ্গে থাকতাম। মনির সাহেব প্রায়ই আমাদের বাড়িতে যেতেন। কোন দিন পাকা কলা হাতে, কখনো শুকনো কদবেল। মা’য়ের এসব একদমই পছন্দ ছিলো না। মাঝেমধ্যে উনাকে আসতে নিষেধ করতেন। মায়ের কেন এতো অসুবিধা হতো কিছু বুঝতাম না। বরং উনি গেলে বেশ খুশি লাগতো। মজার মজার খাবার নিয়ে আসতেন। ”
” কেন? উনি কি আপনাদের আত্মীয় ছিলেন?”
” না, উনি ছিলেন বাবার বন্ধু। গ্রামের বাজারে কাচামালের গুদাম ছিলো। সেবার গ্রামের মাঠে অনেক বড় করে মেলা হলো। বাবার কাছে বায়না ধরলাম মেলায় যাওয়ার জন্য। বাবা স্কুল বাদ দিয়ে আমায় নিয়ে যেতে পারবেন না। অনেক বায়নার পর সিদ্ধান্ত হলো মা’য়ের সঙ্গে মেলায় যাব। বাবা স্কুল শেষ করে সোজা মেলায় আসবেন। তেঁতুল গাছের নিচে তিনজন মিলিত হবো। যে কথা সে-ই কাজ। বিকেলে মা’কে নিয়ে মেলায় গেলাম। তিনজন মিলে অনেক ঘোরাফেরা করলাম। মা ছিলো পর্দানশীন মেয়ে, বোরকা নিকাবে মুখ ডেকে রাখতেন সবসময়। জীবন দশায় দ্বিতীয়বার মেলায় এসেছিলেন আমার জন্য, এই নিয়ে পরে অনেক বকাবকি শুনেছি। বেশ কিছু সময় মেলার ঘোরার পর মুষলধারে বৃষ্টি লামলো। সকলে এদিক-ওদিক ছুটতে লাগলেন। দোকানীরা নিজেদের জিনিস সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে।
বাবা আমাদের দু’জনকে নিয়ে মনির চৌধুরীর গুদাম ঘরে আশ্রয় নিলেন। গুদাম ঘরটা ছিলো মাঠের এক কোণায়, আমরা বাদে অন্যরাও ছিলো। মনির চৌধুরী এগিয়ে এসে বললেন,
” আরে মোতালেব মাস্টার যে, হঠাৎ মেলায় যে, কি মনে করে?”
” আর বলিস না। ছেলেটা ভীষণ বায়না করছিলো। কি আর করার! ”
” হ্যাঁ ভাই আজকালকার ছেলেদের বায়না এমনই হয়। সাথে কে? ভাবী নাকি?”
” হ্যাঁ, ও-ই ছেলেকে নিয়ে এসেছে। আমি তো মাত্র এলাম। ”
” ভাবীকে নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে এসে বসবি না? ভাবী আসুন তো। এই লোকটা সে-ই প্রাইমারি স্কুল থেকেই হাধা। বই ছাড়া কোন কিছু ওর মাথায় ঢোকে না। ”
কথাগুলো বলে উনি অট্টহাসি হাসলেন। মা কিছু বললেন না, জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলেন। বাবা মা’কে তাড়া দিয়ে বললো, ” ভেতরে গিয়ে বসো। এখানে লোকের ভীড় বাড়ছে। মনির আমার অনেক পুরনো বন্ধু। প্রাইমারি স্কুলে একসাথে পড়েছি। ”
মা ধীর পায়ে হেঁটে গুদাম ঘরের ভেতরে গিয়ে বসলো। সঙ্গে আমিও গেলাম। মনির চৌধুরী আমাদের জন্য নোনতা বিস্কুট নিয়ে এলেন। সাথে এক গ্লাস পানি। খাবারগুলো দিয়ে উনি বাইরে চলে গেছিলেন। মায়ের বোধহয় তৃষ্ণা লেগেছিল। নিকাব সরিয়ে পানি খেলেন। দরজার ওপাশ দিকে কেউ একজন উঁকি দিয়ে মা’য়ের মুখ দেখলো। সে-ই থেকে শুরু। এরপর প্রায় দিন মনির চৌধুরী আমাদের বাড়ি আসতেন। বাবা না থাকলে ঘন্টার পর ঘন্টা বসার ঘরে বসে বাবার জন্য অপেক্ষা করতেন। মা প্রচন্ড বিরক্ত হতেন কিন্তু মুখে কিছু বলতেন না। কখনো সখনো মুখের উপর বলে দিতেন বাবা না থাকলে যেন উনি না আসে। উনি মা’য়ের কথা আমলে নিতেন না। ঠোঁট বেঁকিয়ে মুচকি হাসতেন। নরম গলায় বলতেন, ” বেজায় তেজী! এমন মেয়ে মানুষ সোনার হরিণ। ”
আমি তখন অনেক ছোট, সবকিছু ভালো মতো খেয়াল নেই। উনার কথার মানে বুঝতাম না। মাঝেমধ্যে ভাবতাম বাবার কাছে জিজ্ঞেস করবো, কথাগুলোর মানে কি। কিন্তু বাবাকে দেখলে এসব কথা মনে থাকতো না।
এরপর একদিন বাবা মা’রা গেলেন। গ্রামের সকলে মনির চৌধুরীকে অনুরোধ করলো মা’কে বিয়ে করার জন্য। মহিলা একা একা কোথায় যাবে, কি খাবে, ছোট্ট একটা ছেলেও আছে। মনির সাহেব খুশি মনে রাজি হয়ে গেল। তবে মা একটুও রাজি ছিলেন না। কিন্তু আমাদের হাতে কোন উপায় ছিলো না। সত্যিই অসহায় হতে পড়েছিলাম। ”
” একি! আপনি কাঁদছেন কেন?”
” কোথায় কাঁদছি? চোখে পোকা পড়েছে। ”
” ওহ আচ্ছা। দু’জনে মিলে কফি খেলে কেমন হয়?’
” আজ না, অন্য কোনো দিন। তুমি বরং বাড়ি ফিরে যাও। আমার কিছু কাজ আছে। ”
কথাগুলো বলে এক মুহুর্ত দেরি করলাম না। রিপাকে রেখেই হাঁটা ধরলাম। গলা জড়িয়ে আসছে। রিপা সামনে নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করতে চাই না। আজ অনেক কিছু বলে ফেলেছি। আমি জানি, এ ব্যাপারে রিপা কাউকে কিছু বলবে না। বরং আমার দুঃখে নিজেও কিছুটা কষ্ট পাবে। চলে আসার সময় পিছন ফিরে তাকালাম না। তাকালে হয়তো নজরে আসতো রিপা অবাক চোখে আমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে, চোখে-মুখে অভিমানের কালো মেঘ ভীড় করতে আরম্ভ করেছে।
রাড়ি ফিরে দেখলাম ভাইয়া সোফায় বসে আছে। ফুফুর সঙ্গে কথা কাটাকাটি হচ্ছে। ফুফু ভীষণ চটে আছে। আমার দেখে মুখ বেঁকিয়ে বললো, ” তোর জন্য নিজের ভাইপোর লগে ঝগড়া-ঝাটি করতে হয়। ”
” আমি আপনাকে ঝগড়া করতে বলিনি। তাছাড়া আমি তো বাড়িতে ছিলাম না, মাত্রই এসেছি। কি নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে তা-ও জানা নেই। ”
” দশ ক্লাস লেখাপড়া করে নিজেকে অনেক বড় হনু ভেবে ফেলেছিস। বড়দের মুখে মুখে তর্ক করিস।”
” তর্ক করছি না। ”
ফুফু হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলো। ফুফু কান্না শুনে কাকা বেরিয়ে এলেন। হয়তো ঘরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন।
” কি হয়েছে রে মনিরা? ভর দুপুরবেলা ঝগড়া করছিস কেন?”
” এখন কি দুপুর আছে? ঝগড়া করি কপালের দোষে। ”
কাকা কিছু না বলে বাইরের দিকে হাঁটা দিলো। চোখেমুখে বিরক্তি, যেন এখানে এসে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছে। কথা বাড়ালাম না। বিছানায় গিয়ে পিঠ এলিয়ে দিলাম। সবকিছু এলোমেলো লাগছে। বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করছি, অনেকদিন আগের ব্যাথাটা ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে।
* * *
” তনিমা, তুমি কি রেগে আছো?”
” না। কার উপর রাগ করবো? নিজের স্বামীর উপর রাগ করার অধিকার আমার নেই।”
” স্বামী হিসাবে তোমার যোগ্য হতে পারিনি, তাই না বলো?”
” না তেমনটা কখন বললাম। আপনার পাশে আমাকে মানায় না। সহজ কথাটা বুঝতে দেরি করে কি লাভ?”
” ভালোই কথা শিখেছ। ”
” ভালো খারাপ জানি না। তবে সত্যটা মেনে নিতে শিখেছি। অনেক তো হলো, মিথ্যে আশায় বুক বেঁধে কি লাভ! ”
” বাহ্, চমৎকার! ‘
” খুশি হলেন নাকি উপহাস করলেন? ”
” কিছু না। ”
” একটা প্রশ্ন করবো?’
” বলো। ”
” বিয়ে হয়েছে তিন বছর হতে চললো, আমি আজও মা হতে পারিনি কেন?”
” জানি না। ”
” আপনি ঠিকই জানেন। আল্লাহ দেয়নি বলে হয়নি, কিন্তু আপনি কি করছেন?’
ফাহাদ কথা বাড়ালো না। চুপচাপ মোবাইলের দিকে তাকিয়ে রইলো। তনিমাও বুঝতে পারলো কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। ফাহাদ এই মুহুর্তে তাকে কিছুই বলবে না। এই প্রসঙ্গ এলেই ফাহাদ চুপ হয়ে যায়। হয়তো নিজের অন্যায়ের কথা মনে করে ভাষা হারিয়ে ফেলে। তনিমাও কথা বাড়ায় না চোখ মুছে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। রঞ্জু বাড়ি ফিরে ঘরে ঢুকেছে। ওঁকে ডেকে কিছু খেতে দিতে হবে। দুপুরবেলা না খেয়ে বেরিয়েছিল।
বেশ কিছু সময় ধরে রঞ্জুর মোবাইল বাজছে। রঞ্জু ছেলেটা বিছানার এক কোণে বালিশ কোলে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে। রিংটোনের শব্দ তার কানে পৌঁছাচ্ছে না।
” রঞ্জু, তোমার মোবাইল বাজছে। উঠে দেখো কে কল করেছে। ”
ভাবীর ডাকে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলাম। ৫৩বার কল এসেছে, তার মধ্যে তিনবার থানা থেকে, বাকিগুলো রিপার নম্বর থেকে। মোবাইল হাতে নেওয়ার ২৫ সেকেন্ডের ভেতর আবার কল এলো। বাদশা বাবু কল দিয়েছে।
” রঞ্জু সাহেব বলছেন?”
” জ্বি। ”
” আমরা আপনার বাবার খু’নিকে ধরে ফেলেছি। কাল সকালে সবাই মিলে থানায় চলে আসবেন। ”
” আচ্ছা। ”
” সবাই আসবেন কিন্তু, কেউ যেন বাদ না পড়ে। খু’নি ধরা পড়েছে এ কথা সবাইকে জানিয়ে দেন। ”
” ঠিক আছে। ”
কল কেটে গেল। দ্রুত পায়ে বসার ঘরের দিকে ছুটলাম। কেউ নেই। দোতলায় ফিরে এলাম। ভাইয়া নিজের ঘরে শুয়ে মোবাইল দেখছে।
” ভাইয়া, বাবার খু’নি ধরা পড়েছে। ”
ভাইয়া লাফ দিয়ে উঠল। উত্তেজিত গলায় বললো, ” তোকে কে বলেছে?”
” বাদশা বাবু কল দিয়েছিলেন। উনিই বললেন। কাল আমাদের থানায় যেতে বলেছেন। ”
ভাইয়ার চোখমুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
চলবে