#দোলনচাঁপা
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৬
বাদশা বাবু মুচকি হাসলেন। হাসির মাঝে অসংখ্য রহস্য লুকিয়ে আছে। বাবাকে মা’রার পিছনে কার হাত থাকতে পারে? আমার বি’ষে তো উনার মৃ’ত্যু হয়নি।
‘রঞ্জু সাহেব কিছু ভাবছেন নাকি?”
” নাহ্, কিছু না। আপনাদের তদন্ত কতদূর এগিয়েছে? ”
” হ’ত্যার কারণ বুঝতে পারছি না। কারো কাছে শক্তপোক্ত উদ্দেশ্য পাওয়া যাচ্ছে না। ”
” মানে?”
“কিছু না। আপনাদের সকলের সঙ্গে আলাদা ভাবে কথা বলতে চাই। ব্যবস্থা করুন।”
বাদশা বাবুর কথা মতো গেস্ট রুমের তালা খোলা হলো। ওই ঘরে গিয়ে উনার সঙ্গে কথা বলতে হবে। ভাইয়া বেশ বিরক্ত হচ্ছে, কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না। বাদশা বাবু হেলদোল নেই। খাটের কোণায় পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। ভাবী ভীতু গলায় বললো, ” প্রথমে আমি যাব। ”
ভাইয়া আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো, মুখে কিছু বললো না। ভাবী এলোমেলো পায়ে ঘরের মধ্যে চলে গেল। ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো। ভাইয়া সরু চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবী তো আর দারোগা সাহবের সঙ্গে একান্ত সময় কাটাতে যায়নি। তবুও এমন দৃষ্টির কারণ বুঝতে পারছি না।
” তনিমা, বসো বসো। ”
” নাহ্, ঠিক আছে। বলুন কি বলতে চান। ”
” অনেক সময় ধরে কথা বলতে হবে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে ব্যাথা হয়ে যেতে পারে। সোফার কোণায় বসে পড়ুন। ইতস্তত করবেন না। ”
তনিমা সজোরে সোফার কোণায় বসে পড়লো। শরীর খারাপ লাগছে, গলাটা কেমন শুকিয়ে আসছে। একটু পানি হলে বেশ ভালো হতো।
” কোন সমস্যা? ”
” না না। সব ঠিক আছে। ”
” তা বেশ। মনির সাহেবের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?”
” খুব ভালো। আমাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতেন। সব সময় আমার কথায় সায় দিতো। ”
” আপনার কাছে খু’ন করার মতো কারণ নেই। ”
” না নেই। ”
” শেষবার কি কথা হয়েছিল? ”
” বাবার জন্য পায়েস রান্না করেছিলাম। খুব তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছিলেন। এটাই যে শেষ খাওয়া হবে কিভাবে বুঝবো বলেন! মনে হচ্ছে নিজের বাবাকে হারিয়ে ফেলেছি। ”
” ফাহাদ বাবুর সঙ্গে কেমন সম্পর্ক আপনার? দাম্পত্য জীবন কেমন চলছে?”
” এসব প্রশ্ন করছেন কেন? ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছুক নয়। দয়া করে এসব প্রশ্ন করবেন না। ”
” আচ্ছা দুঃখিত। মনির সাহেবের সঙ্গে ফাহাদের সম্পর্ক কেমন? বাপ-ছেলের মধ্যে মনমালিন্য হয়?”
” খুব ভালো। বলতে গেলে বাবার পছন্দের ছেলে। ফাহাদকে খুব ভালোবাসতেন। বাপ-ছেলের মধ্যে কখনো মনমালিন্য হয়নি। ”
” রঞ্জুর সঙ্গে কেমন সম্পর্ক ছিলো?”
” ভালোই। বাবার সঙ্গে তেমন কথা বলতো না। বাবাকে এড়িয়ে যেত। বাবাও ওর উপর সন্তুষ্ট ছিলেন না। ”
” উনার ভাই-বোনের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক?”
” জানি না। উনারা এ বাড়িতে আসতেন না। কালে ভদ্রে এলেও দুপুরের পরে চলে যেতেন। রাতে থাকতে দেখিনি। বাবা মাঝেমধ্যে গ্রামে যেতেন। সেখানে দুয়েক রাত কাটিয়ে আসতেন। ”
” আপনার মা-বাবার এখানে আসা-যাওয়া করেন?”
” মাঝেমাঝে আসেন। দু’চার দিন থেকে চলে যান। ”
” আপনার বিয়ে হয়েছে কত দিন? ”
” প্রায় তিন বছর। ”
“আপনি এখন যেতে পারেন। রঞ্জুকে পাঠিয়ে দিবেন। ”
তনিমা উঠে দাঁড়ায়। বাবা মা’রা যাওয়ার দিন রঞ্জুর ওষুধ এনে দিয়েছিল। এ কথা বললে বোধহয় ভালো হত। দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় পিছন ফিরে তাকায়।
” কিছু বলবেন?”
” না, কিছু নাহ।”
তনিমা রুম থেকে বেরিয়ে যায়। রঞ্জুর কাছে গিয়ে বলে, ” দারোগা সাহেব তোমাকে যেতে বলেছেন। তুমি গিয়ে কথা বলো। আমি বরং উনার জন্য এক কাপ চা বানিয়ে আনি। ”
রঞ্জু তনিমার কথায় উত্তর দেয় না। গটগট করে রুমের ভেতর গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। বিরক্ত গলায় বলে, ” কি বলবেন আমাকে?”
” অনেক কিছু। শুনেছি সামনে আপনার বিয়ে, পাত্রী পছন্দ হলো?”
” কি সমস্যা আপনার? সবসময় এমন হেয়ালি করেন কেন? ”
” এমনিতেই, যান্ত্রিক মানব হতে ইচ্ছে করে না। তাছাড়া সব সময় কাজের কথা বলতে এমন তো নয়। ”
” কি বলবেন? বলেন তাড়াতাড়ি। ”
” ব্যস্ত নাকি?”
” না, তেমন কোন কাজ নেই। তবে আপনার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। ”
” কেন? আমাকে অপছন্দের কারণ কি?”
” কোন কারণ ছাড়াই। ”
” বুঝলেন রঞ্জু সাহেব, শুধুমাত্র অপরাধীরাই আমায় পছন্দ করে না। সাধারণ মানুষের কাছে এসব হেয়ালি বেশ ভালো লাগে। ”
” কাজের কথা বলুন। কি জানতে চান?”
“কিছু জানতে চাই না। আপনি যেতে পারেন। ”
রঞ্জু মুখ বিকৃত করে, মনে মনে কয়েকটা গা’লিও দেয়। বাদশা বাবুর মাথায় সমস্যা আছে কি-না কে জানে। বাদশা কিছু বলে না, চুপচাপ রঞ্জুর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। ছেলেটা সবসময় ডান পা আগে বাড়ায়। ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি ফুটে ওঠে বাদশার। যেন অনেক বড় সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে। রঞ্জুর পরে ফাহাদ রুমের ভেতর প্রবেশ করে। দু’নিমিট কথা বলার পরে বেরিয়ে আসে। একে একে সকলের কথা বলা শেষ হয়।
তনিমা চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। বেশি দেরী হলে চা ঠান্ডা হয়ে যাবে। তখন আরেক বিপত্তি। কারো সামনে ঠান্ডা চা এগিয়ে দেওয়া যায় না। কফি হলে অন্য ব্যাপার ছিলো।
বাদশা বাবু চা খাওয়ার অপেক্ষা করলেন না। কথা শেষ করে বেরিয়ে গেলেন। তনিমা শুকনো মুখে চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
” দারোগা জন্য ভালোই দরদ হয়েছে দেখছি। আগ বাড়িয়ে চা করে খাওয়ানো হচ্ছে। ”
” এসব কি বলছো তুমি? লোকটা বাড়ি এসেছে দেখে চা করেছি।”
ফাহাদ কিছু বললো না। তনিমার বাবার দিকে তাকিয়ে ঘরে চলে গেল। পরিস্থিতি কেমন থমকে গেছে। চরকির মতো এক জায়গায় ঘুরছে যেন। খু’নের কূলকিনারা হচ্ছে না। পুলিশ কাকে সন্দেহ করছে বোঝার উপায় নেই।
রাতটা নির্বিঘ্নে কেটে গেল। হাবু মিয়া পরেরদিন সকালে মনির সাহেবের লা’শ নিয়ে এলেন। বাড়িতে লোকজনের ভীড়। বাচ্চা ছেলে-মেয়েরা লা”শের দিকে দৌড়ে আসছে। কেউ হাত উঁচু করে লা’শের দিকে ইশারা করছে। মহিলারা সুপারি পাতার বেড়ার আড়ালে দাঁড়িয়ে সব কিছু লক্ষ্য করছে। জোয়ান ছেলেরা বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কেটে আনছে, কেউ কেউ ক’ব’র খুঁড়ছে। সব মিলিয়ে হুলুস্থুল কান্ড।
দশটার দিকে জানাজার নামাজ। মাইকিং করে সকলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। লোকের ভীড় বাড়ছে। নামাজের আগে ফাহাদ ধরা গলায় বললো, ” আমার আব্বার কাছে কেউ টাকা-পয়সা পেলে আমাদেরকে বলবেন। আমরা তার দেনা পরিশোধ করে দেবো। আব্বা কখনো কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করলে, কাউকে কষ্ট দিলে উনাকে মাফ করে দিবেন।”
“না না উনার প্রতি কোন দাবী নেই। উনি ভালো মানুষ ছিলেন। ”
বেশিরভাগ লোক সুর মিলিয়ে কথাটা বললো। লা’শ ক’ব’রে রাখার পর পর ভীড় পাতলা হতে শুরু করলো। রঞ্জুর মাথা ধরেছে, সে ঘরে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। লা’শ ক’ব’রে রাখার পরই ঘরে চলে গেছে। হাবু মিয়া ক’ব’রের পাশে দাঁড়িয়ে এক নাগাড়ে কাঁদছে, যেন তার পরম আত্মীয় মা”রা গেছে। উনার কাজে ফাহাদ বেশ বিরক্ত হচ্ছে।
” হাবু মিয়া বাবার কে’সের কোন সমাধান হলো?’
” না এখনও হয়নি। বাদশা সাহেব এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবে। ”
” আপনারা কি করছেন বুঝতে পারছি না। কতদিন হয়ে গেল কোন কিছুর হদিস পেলেন না।”
” রাগ করো না বাবা। তোমার কষ্ট আমি বুঝতে পারছি। আমারও যে বাবা নেই। ”
কথাগুলো বলে উনি হু হু করে কাঁদতে আরম্ভ করলো। লোকটা বোধহয় বাবাকে খুব ভালোবাসতো। দুপুরে খাওয়ার পর হাবু মিয়া চলে গেলেন। কে’সের সমাধান হলে আমাদেরকে জানিয়ে দেওয়া হবে। কাকা বা ফুফু কেউই গ্রামে ফিরতে পারবেন না। উনাদের প্রয়োজন পড়বে।
পরেরদিন সকাল থেকে জীবন যাত্রা একদম স্বাভাবিক। দেখে বোঝার উপায় নেই এ বাড়িতে শোকের ছায়া আছে। ভাবীর বাপের বাড়ির সবাই ফিরে গিয়েছে। প্রয়োজন পড়লে খবর দিতে বলেছে। সকলে শান্ত থাকলেও ফাহাদের মনে শান্তি নেই। গত দু’দিন ধরে তুলির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে। বাড়ির ঠিকানা বদলে ফেলেছে। ওদের কি হলো, কোথায় চলে গেল, সেই চিন্তা ফাহাদের ঘুম হা’রা’ম হয়ে গেছে। পুলিশের কাছেও কিছু বলতে পারছে না।
* * *
টিউশনিতে এসে ছিলাম। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল পড়ানো শেষ হচ্ছে না। বাবার মৃ’ত্যুতে বেশ ক’দিন পড়াতে আসিনি। সেজন্য আজ একটু বেশি বেশি পড়াতে হচ্ছে। কাল নাকি সিয়ামের পরীক্ষা। সবকিছু দেখিয়ে দিতে হবে। ওর মা এসে বলে গিয়েছে কোথায় কোথায় সমস্যা হচ্ছে। খালি হাতে আসেনি যদিও, প্লেট ভর্তি নাস্তা সাজিয়ে নিয়ে এসেছিল।
পড়ানো শেষ হতে বিকাল পাঁচটা বেজে গেল। ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখালাম রিপা দাঁড়িয়ে আছে। কারো জন্য অপেক্ষা করছে বোধহয়।
” একি, রঞ্জু সাহেব! আপনি এখানে?”
” হ্যাঁ, এইতো এই বাড়িতে পড়ানো ছিলো। তুমি এখানে কি করছো?”
” ফেরদাউসের জন্য অপেক্ষা করছি। কেন যে দেরি করছে কে জানে। ”
রিপার মুখে ছেলেদের নাম শুনে চমকে উঠলাম। অন্য রকম অনুভূতি হতে লাগলো। তরল গলায় বললাম, ” কে সে? তোমার বন্ধু নাকি?”
” হ্যাঁ। খুব ভালো বন্ধু। ”
” আচ্ছা। আমি তাহলে এখন যাই। একটু কাজ আছে। ”
” একটু দাঁড়িয়ে যান। একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে না। ”
” আমি দাঁড়িয়ে থাকলে তোমার বন্ধু কিছু মনে করতে পারে, তা কি উচিত হবে?”
” আরে কিছু মনে করবে না। সে তো আপনার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য পা’গ’ল।”
” আমি তেমন কেউ না। ”
” দূর, চুপ করে দাঁড়ান। ওইতো ও চলে এসেছে। ”
শ্যামলা চেহারার একটা মেয়ে এসে আমাদের পাশে দাঁড়ালো। রিপা এগিয়ে গিয়ে মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরলো। আলিঙ্গন শেষে আমার দিকে ইশারা করে বললো, ” এই হচ্ছে রঞ্জু বাবু। আপুর দেবর। ”
মেয়েটা মুচকি হেসে বললো, ” আমি জান্নাতুল। ভাইয়া কেমন আছেন? ”
” জ্বি ভালো। আপনি কেমন আছেন? ”
প্রতিত্তোরে মুচকি হাসলো। কোন কথা বললো না। রিপা ইচ্ছে করে মেয়েটার নাম ঘুরিয়ে বলেছে। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করার পর জান্নাতুল চলে গেল। রিপা উত্তেজিত হয়ে বললো, ” কেমন লাগলো ওকে?”
” বেশ ভালো। ”
” আর আমাকে?”
” খারাপ না।”
” ওহ্ আচ্ছা। ”
” জানো রিপা মনির চৌধুরী আমার নিজের বাবা না। উনি আমার মা’য়ের স্বামী। ”
রিপা যেন আকাশ থেকে পড়লো। অবাক কন্ঠে কি বলে চিৎকার দিলো। প্রতিত্তোরে কিছু বললাম না। শুধু মুচকি হাসলাম। রিপা এখন জান্নাতুলের ব্যাপারটা ভুলে যাবে। বিব্রতকর প্রশ্ন করবে না।
চলবে