দোলনচাঁপা পর্ব-০২

0
524

#দোলনচাঁপা
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -২

সকালবেলা ভাবীর চিৎকারে ঘুম ভাঙলো। বাবার ঘর থেকে আওয়াজ আসছে। ভাবী ভীতু গলায় চিৎকার করছে। মুচকি হেসে বাবার ঘরের দিকে দৌড় লাগালাম। এতোদিনে কাজটা শেষ হলো। বাবার ঘরে গিয়ে চোখ কপালে উঠে গেল। বাবার শরীরে অসংখ্য ক্ষ’ত, ক্ষ’ত থেকে র’ক্ত চুয়িয়ে পড়ছে। কোন কোনটায় র’ক্ত শুকিয়ে গেছে। মুখমণ্ডলের অবস্থাও ভালো নয়। কেউ অনেকদিনের আক্ষেপ মিটিয়ে বাবার শরীরে ছু”রি চালিয়েছে। কিন্তু কে এমন করবে?

পরিস্থিতি বুঝতে না পেরে মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লাম। আমি ছাড়াও অন্য কেউ আছে? বাবার সঙ্গে কারো দন্দ আছে বলে জানা নেই। হুট করে কাউকে দোষারোপ করতে পারছি না। ভাবী শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে একনাগাড়ে কেঁদে চলেছে। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে শূন্য দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে, উনার দিকে তাকাতে দেখে আমার কাছে এগিয়ে এলো। কাঁধে র উপর হাত রেখে ভীতু গলায় বললো,

” রঞ্জু, তোমার ভাইকে খরব দিবো? ”

” হ্যাঁ। তা তো দিতেই হবে। তুমি ভাইকে খবর দেও। ভাইয়ার এসব জানা প্রয়োজন। আমি পু’লি’শকে কল করে বিষয়টা জানাচ্ছি। দেরি করলে সবাই আমাদেরকে স’ন্দে’হ করবে। ”

” কি থেকে কি হয়ে গেল! আল্লাহ রে..”

ভাবী কাঁদতে কাঁদতে মোবাইল খুঁজতে গেলেন। যদিও ভাবীর মোবাইলটা উনার ঘরে টেবিলের উপর রাখা আছে। বাবার রুমে আসার পথে দেখে এসেছি, ঘরের দরজা হাট করে খোলা। ঘরের মধ্যে একপলক তাকালে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তবুও তা খুঁজে পেতে বেশ সময় লাগবে এখন। বিপদের সময় কোন কিছু ঠিকভাবে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় না।

দোতলা বাড়ি আমাদের। নিচের তলার একটা রুমে বাবা থাকেন। নিচ তলার বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে ড্রইংরুম আর খাওয়ার ঘর, উত্তর দিকে রান্নাঘর, রান্নাঘরের সাথে বিশাল বারান্দা। দক্ষিণ দিকে দু’টো রুম আছে। এক রুমে বাবা থাকেন। অন্যটা খালিই পড়ে থাকে। কালে ভদ্রে কেউ কখনো বেড়াতে এলে ও ঘরে জায়গা হয়। উপরের তলায় পাঁচটা রুমের দুটোতে ভাবীদের জিনিসপত্র। একটা রুম ফাঁকা, অনেক মেহমান আসলে ঢালাই বিছানা করে ঘুমানোর জন্য। একটাতে দুনিয়ার অকেজো জিনিসপত্র বোঝাই করা, অন্য ঘরে আমার বসবাস।

বাড়িটা দূর থেকে দেখতো অদ্ভুত সুন্দর হলেও, কাছ থেকে কেমন যেন এলোমেলো করা। কে যে বাড়ির ইন্জিনিয়ার ছিল জানা নেই। তবে মা’য়ের মুখে শুনেছি বাবা নিজে তদারকি করে বাড়ি তৈরী করেছে।

” তোমার ভাই কল ধরছে না। ”

” ওহ্! ঘুমিয়ে আছে বোধহয়। আজকাল সকালের দিকে বেশ ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। এমন সময় কাঁথার নিচে গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকার মজাই আলাদা। ”

” পুলিশ কি বললো?”

” কল দেওয়া হয়নি। মোবাইলের ব্যালেন্স শেষ, তোমার মোবাইল দিতে কল দিতে হবে। ”

” তাহলে দেরি করছ কেন? নাও নাও। তাড়াতাড়ি কল দেও। ”

ভাবি মোবাইলটা আমার দিকে এগিয়ে দিলো। উনার হাত কাঁপছে। কিছু মানুষের এমন পরিস্থিতিতে হাত-পা কাঁপতে থাকে। ভয়ের কারণে এমন হয় নাকি?

পুলিশের নম্বর জানা নেই। উপায় না পেয়ে নয়শত নিরানব্বই নম্বরে কল দিলাম। একবার রিং হতেই কল রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে গম্ভীর স্বর ভেসে এলো। কর্মকর্তারা চাইলে একজন সুকন্ঠীর স্বর সেট করতে পারতেন।

মিনিট সাতেক কথা বলার পর কল কাটলাম।

” কি বললো?”

” আমাদেরকে দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করেছে, কোন জিনিসে হাত লাগানো যাবে না। ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ওদের প্রতিনিধিরা কিছু সময়ের মধ্যে আমাদের বাড়িতে পৌঁছে যাবে। শুধু মোবাইলটা চালু রাখতে হবে। ”

” ওহ্ আচ্ছা। ”

” তুমি গিয়ে চোখে-মুখে পানি দিয়ে এসো। আমি ভাইয়াকে কল দিচ্ছি। ”

” আচ্ছা। ”

ভাবী এলোমেলো পায়ে বাথরুমের দিকে হাঁটা দিলো। ভাইয়ার নম্বরের কল দিলাম, ভাবী মেয়ে হিসাবে বড্ড রোমান্টিক। স্বামীর মোবাইল নম্বর জানপাখি দিয়ে সেভ করে রেখেছে।
পরপর চারবার কল দেওয়ার পরেও ভাইয়া কল রিসিভ করলো না। বিরক্ত হয়ে মোবাইল রেখে দিলাম।

” তোমার ভাইয়া কি বললো?”

” কিছু বলেনি। ”

” এতসব কান্ড শুনেও কিছু বলেনি?”

” না ভাবী, কিছু বলেনি। কল পর্যন্ত রিসিভ করেনি। ”

ভাবীর মুখটা মলিন হয়ে গেল। হয়তো বুঝতে পেরেছে ভাইয়া উনার কল দেখে রিসিভ করতে চাইছে না। এসব ঘটনা নতুন বলে৷ মনে হচ্ছে না। এমন অনেক স্বামী আছে যারা বউয়ের কলকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। বউয়ের কলের থেকে সীম কোম্পানির কলগুলো ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

সোফায় বসে পড়লাম। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। সোফার কোণে সেই ওষুধের বোতলটা রাখা। ভাগ্য আমার সহায় হয়েছে তাহলে। ভাবীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বোতলটা হাতে তুলে নিলাম। তারপর সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগলাম।

” কোথায় যাচ্ছো?”

” প্রকৃতি ডাক দিয়েছে। না গিয়ে উপায় কি বলো!”

ভাবী লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিলেন। রুমে এসে সোজা বাথরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম। কমোডের ভেতর ওষুধ ঢেকে ফেলে দু’বালতি পানি দিয়ে দিলাম। পুলিশের কেউ এ ঘরের তল্লাশি নিতে এলে ঝামেলায় পড়ে যাবো। সমস্যা হলো বোতলটা কোথায় লুকাবো?
ঘরের কোণে ফেলে রাখলে সমস্যা হতে পারে।

পানি দিয়ে বোতলের ভিতরে পরিষ্কার করে নিলাম। তারপর স্টোর রুমের জানালা দিয়ে ওই ঘরে ফেলে দিলাম। নিচ থেকে ভাবীর গলার স্বর ভেসে আসছে। নিচে গিয়ে দেখলাম বাড়ির সামনে সাদা রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ওরা চলে এসেছে বোধহয়। আমার ভাবনা সত্যি করে চারজন লোক বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো। সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললো, ” রঞ্জু নামের কে আছে?”

দ্রুত পায়ে দরজার কাছে এগিয়ে গেলাম। বিনম্র গলায় বললাম, ” জ্বি, আমি রঞ্জু। ”

” আপনি আমাদের কল করেছিলেন? আপনার বাবার মা’র্ডা’র হয়েছে? ”

” জ্বি, হ্যাঁ।”

” চলুন তো, কোথায় কি হয়েছে দেখাবেন। ”

উনাদের নিয়ে বাবার ঘরে প্রবেশ করলাম। ঘরে ঢুকতেই একজন বলে উঠলো, ” চাঁপা ফুলের গন্ধ পাচ্ছেন কেউ?”

” কই না তো। ”

” রঞ্জু বাবু, আপনার নাকে এসব গন্ধ ধরা পড়বে না। আপনার কাছে জানতে চাইনি।”

রোগা মতো লোকটা বলে উঠলো, ” হ্যাঁ স্যার পাচ্ছি। দোলনচাঁপা ফুলের গন্ধ এটা। ”

মুখ বি’কৃ’ত করে ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে রইলাম। লোকটা আমায় অপমান করলো কেন! নিজেদোর নাককে মনে হয় কু’কু’রের নাক মনে করে। যত্তসব!

” রঞ্জু সাহেব কি আমায় গাল মন্দ করছেন?”

” কই না তো। ”

” আপনার মুখের ভাবসাব দেখে তেমনই মনে হচ্ছে। সে যাইহোক। ”

কথা বলতে বলতে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো, মুচকি হেসে বললো, ” আমি বাদশা। আপাতত এই কে’সের দায়িত্ব আমার উপর। সেই সুবাদে আপনার সঙ্গে অনেক কথা বলতে হবে। ”

অনিচ্ছা শর্তেও হাত বাড়িয়ে দিলাম। ছেলে মানুষের হাত এমন নরম হয় নাকি! নিশ্চয়ই তিনবেলা অলিভওয়েল লাগায়।

” আপনার বাবার নাম?”

” মনির চৌধুরী। ”

” বিখ্যাত মানুষ!”

” কি বললেন?”

” জ্বি মনির চৌধুরী একজন বিখ্যাত মানুষ ছিলেন। তা উনার এ অবস্থা কি করে হলো?”

” জানি না। কি করে হলো জানলে আপনাদের ডাকবো কেন?”

” আপনি বোধহয় রেগে আছেন। ”

” নাহ্! একদমই না। বরং বিরক্ত লাগছে। ”

” সবকিছু জন্য দুঃখিত। বাবার মৃ’ত্যুতে ছেলের মনে অবস্থা বুঝে কথা বলা উচিত ছিলো। ”

” আচ্ছা। ”

“কিছু মনে না করলে আপনারা একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়ান। আমরা ঘরের তল্লাশি নেবো। ”

” খু”নি কি প্রমাণ ছেড়ে যায়?”

” চেষ্টা করে প্রমাণ লোপাট করে দেওয়ার, তবে সফল হয় না। ”

বাদশা নামক পুলিশ অফিসারকে খুব বেশি পছন্দ হলো না। লোকটা কেমন হেয়ালি করে কথা বলে। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সোফায় উপর বসে পড়লাম। বাড়ির বাইরে লোক জড় হয়ে গেছে। পুলিশের একটা লোক ওদের কাউকে বাড়ির ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। দু’জন মিলে ঘরের তল্লাশি করছে। আর বাদশা বাবু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হুকুম করছে। এটা ওটা ধরে দেখছে।
ভাবী মোবাইল কানে ধরে বসে আছে। হয়তো ভাইয়াকে কল দিচ্ছে, কিম্বা বাপের বাড়ির লোকজনকেও বলতে পারে।

” রঞ্জু, তোমার ভাইয়া কল ধরছে না। দেখ না কি হলো!”

” কই দেখি আমার কাছে মোবাইলটা দেও। ”

ভাবী হাত বাড়িয়ে মোবাইল এগিয়ে দিলো। তারপর মলিন মুখে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো।
পরপর দু’বার চেষ্টা করার পর ভাইয়া কল ধরলেন। ঝাঁঝালো গলায় বললেন, ” এতোবার কল দেওয়ার দরকার কি? তোমার বাবা ম”রে গেছে নাকি? খবর দিতে কল দিয়েছ?”

ভাইয়া প্রতি জমিয়ে রাখা বিশ্বাসটুকু খুচরো পয়সার মতো মাটিতে গড়িয়ে পড়লো। ভাবী সঙ্গে এমন ব্যবহার মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। বিরক্ত গলায় বললাম, ” নাহ্! ভাবীর বাবা ম”রে”নি। তোমার বাবা ম”রে”ছে। ”

আমর কন্ঠে ভাইয়া চমকে উঠলো। ব্যস্ত গলায় বললো, ” রঞ্জু তুই? কিসব বলছিস? মজা করিস না। ”

” মজা করার পরিস্থিতি নেই। বাবা আর নেই। কেউ বা কারা যেন উনাকে খু’ন করেছে। বাড়িতে পুলিশ এসেছে। ”

” তোরা এখন খবর দিচ্ছিস? কবে যে তোদের জ্ঞান-বুদ্ধি হবে!’

” সকাল থেকে কতবার কল দেওয়া হয়েছে হিসাব করে দেখ। ”

” এখন কি অবস্থা! ”

” নিজের চোখে দেখে যেতে পারলে দেখে যাও। ”

ভাইয়া কল কেটে দিলো। আগে-পরে কখনো উনার সঙ্গে এভাবে কথা বলিনি। আজ ভাবীর কল মনে করে লোকটা যে কথাগুলো বলেছে তা মেনে নেওয়া কঠিন।

” কি বললো তোমার ভাই?”

” জানি না। ”

” কথা বললে যে। ”

” হুম সবকিছু জানিয়েছি। ”

ভাবী কিছু বলতে চাচ্ছিলো। কিন্তু উনাকে সময় দিলাম না। মোবাইলটা উনার হাতে দিয়ে বাবার ঘরের দিকে রওনা দিলাম। বাদশা বাবু র’ক্তমাখা ছু”রি হাতে দাঁড়িয়ে আছে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে