সূচনা পর্ব
#দোলনচাঁপা
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
বাবার ওষুধের বোতলে কয়েক ফোঁটা বি’ষ মিশিয়ে ভাবীর হাতে দিয়ে বললাম, ‘ বাবার কাশিটা খুব বেড়েছে। রাতেও ঘুমাতে পারে না। সেজন্য ওষুধ নিয়ে এলাম। রাতে খাওয়ার পরে দু’চামচ করে খাইয়ে দিও। ‘
— কি মনে করে ওষুধ নিয়ে এলে?তোমার তো বাবার প্রতি কোন খেয়াল নেই। যাক এনেছো যখন ভালোই করেছ।’
মুচকি হেসে রুমে চলে এলাম। কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে না। এ বাড়িতে ভাবীর কথাই শেষ কথা। বাবা পর্যন্ত উনার কথার উপর কোন কথা বলে না। ভাবীকে ভয় করে এমন না, বরং উনাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসে। ভাবীও বাবার যত্ন-আত্তির ত্রুটি করে না। সেজন্যই ওষুধটা ভাবীর হাত দিয়ে দিলাম। খারাপ কিছু ঘটলেও কেউ কোন সন্দেহ করবে না। ভালোয় ভালোয় কাজটা শেষ হলে হয়। লোকটা বলে দিয়েছে বি’ষে কোন গন্ধ নেই, স্বাদেরও খুব বেশি পরিবর্তন হবে না। সামান্য একটু গলা দিলে নামলেই খেল খতম!
সবে রাত আটটা বাজে। বাবা খাওয়া শেষ করে সোফার কোণায় বসে খবরের কাগজ পড়ছে। বাবার কড়া আদেশ তাঁকে রাত আটটার ভিতর খাবার দিতে হবে, যুগের পর যুগ এই নিয়ম পালন করে আসছে। বয়স হয়েছে বলে নিয়মের ত্রুটি করেন না। দশটার ভিতর ঘুমিয়ে পড়তে না পারলে ফজরের নামাজটা হাত ছাড়া হয়ে যায়।
‘ মা জননী, কাশির ঔষধ দিতে চেয়েছিলে। এখনও দিলে না যে?’
‘ এইতো নিয়ে আসছি। আপনার জন্য একটু পায়েস রান্না করেছিলাম। বিকেলে বলেছিলেন ক’দিন ধরে রাতে খাওয়ার পর মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করে। ‘
‘ এই না হলে আমার মেয়ে! সবকিছু মনে থাকে। ‘
‘ মা বলতো, পায়েস আপনার খুব পছন্দের। ‘
‘ হ্যাঁ মা জননী। ছোট বেলা থেকে অনেক পছন্দের খাবার । আতপ চাল, দুধ, চিনি, বাদাম, কিসমিস, কেশর এসব দিয়ে দারুণ রাঁধতেন আমার মা। ‘
‘ খেয়ে বলুন তো, আপনার মা’য়ের মতো হয়েছে কি-না? ‘
ঘরে শুয়ে ওদের কথপোকথন শুনছি। বাবা ওষুধ খেয়েছে কি-না দেখা প্রয়োজন। নিজের চোখে না দেখলে শান্তি পাবো না। রাতের মধ্যে কাজটা শেষ করতে হবে। না হলে ঝামেলা হতে পারে। রাতে খাওয়ার নাম করে ওখানে গিয়ে বিষয়টা দেখে আসতে হবে। বিছানা দিয়ে নেমে খাওয়ার ঘরে গেলাম। ভাবী ঘরে নেই, বাবা দরজার পাশে রাখা সোফার উপর বসে পায়েস খাচ্ছে। উঁচু আওয়াজে বললাম,
‘ ভাবী খেতে দাও। ‘
‘ রাত এগারোটা না বাজলে যে ছেলের খাওয়ার সময় হয় না, সে আজ এতো সকালে খেতে চাচ্ছে! ‘
‘ শরীরটা ভালো লাগছে না। গলাটা খুসখুস করেছে। ‘
‘ মা জননী, এই অ’প’দার্থটাকে খেতে দাও তো। ‘
‘ অপদার্থ না বললে কি অনেক সমস্যা হয়?’
‘ অপদার্থকে আর কি বলবো?’
‘ বাবা কিন্তু ভুল বললেন। রঞ্জু মোটেও অপদার্থ নয়। বরং খুব কাজের ছেলে। আপনার জন্য কাশির ওষুধ নিয়ে এসেছে। ‘
বাবার মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। এমন উত্তর আশা করেননি। বেশিরভাগ সময় এ ব্যাপারে ভাবী বাবার সঙ্গে একমত থাকেন। মনের মতো হতে পারিনি বিধায় বাবা সবসময় খোঁচা দিতে কথা বলে। ব্যবহারটা গা সওয়া হয়ে গেলেও মাঝেমধ্যে বেশ বিরক্ত লাগে। সবাই কি একরকম হয়! সকলে এক রকম হলে নিজস্ব ব্যক্তিত্ববোধ বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে না। বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বিষন্ন গলায় বললো, ‘ ওহ! তা বেশ, তা বেশ। ‘
‘ পায়েস খাওয়া শেষ হলে ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়েন। আজ-কাল আপনার শরীরটা একটুও ভালো যাচ্ছে না। সর্দিকাশি লেগেই আছে।’
” আচ্ছা ঠিক আছে। এইতো খাচ্ছি। ”
বাবা ওষুধের বোতল থেকে দুচামচ ওষুধ ঢেলে মুখে পুরে দিলো। ওষুধ মুখে দিতেই চোখ-মুখ বিকৃত করে ফেললেন। হাত বাড়িয়ে পানির গ্লাস নিতে নিতে বললেন, ” ওষুধের স্বাদটা বেশ ঝাঁঝালো ! অল্পতেই কাজে দেবে। ”
প্রতিত্তোরে কিছু বললাম না। দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে খাবারের অপেক্ষা করতে লাগলাম। মিনিট পাঁচেক পর ভাবী এসে ভাত বেড়ে দিলেন। চাপা গলায় বললেন, ‘ রিপার সঙ্গে কথা হয়?’
‘ তা মাঝেমধ্যে হয়ে থাকে। কেন বলো তো?’
‘ রিপা তোমাকে অনেক পছন্দ করে। সোজা কথায় বলতে গেলে ভালোবাসে। গতকাল আমায় কল দিয়ে বললো, তোমার সঙ্গে ওর ব্যাপারটা ম্যানেজ করে দিতে। ‘
‘ তোমায় আগেও বলেছি ওঁকে বোনের নজরে দেখি। এসব হবে না। ‘
‘ আমার বোনটা দেখতে খারাপ? নাকি ওর চালচলন পছন্দ হয় না?’
‘ কোনটাই নয়! রিপা মারাত্মক সুন্দরী, স্বভাবতই ভদ্র। এতো ভালো মেয়েকে আমার পাশে মানায় না। ‘
‘ কি যে বলো তুমি!’
‘ ঠিকই বলছি। ওকে বিয়ে করলে একসময় তুমিও আফসোস করবে। ‘
‘ কেন বলো তো?’
‘ বাউণ্ডুলে ছেলেদের সাথে প্রেম করা যায়, স্বামী হিসাবে পেতে গেলেই সমস্যা। ‘
‘ কি সমস্যা?’
‘ তুমি ওসব বুঝবে না। ভাইয়া বড্ড ঘরকুনো, নিজে না ভুগলে অন্যের সমস্যা বোঝা যায় না। ‘
‘ আজ-কাল অনেক কঠিন কথা বলো। বুঝতে অসুবিধা হয়। তবে সত্যি বলতে তোমার ভাই ঘরকুনো লোক না। ঘরের প্রতি ভালোবাসা থাকলে এভাবে দিনের পর দিন বাইরে বাইরে ঘুরতে পারতো না। ‘
ভাবীর বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। স্বামী নামক মানুষটা দিনের পর দিন অফিসের কাজে বাইরে বাইরে রাত কাটালে বেশিরভাগ মেয়েই ভালো থাকতে পারে না।
‘ ভাইয়া কবে ফিরছে কিছু কি জানিয়েছে? ‘
‘ নাহ্! ও ব্যাপারে তার সঙ্গে কথা হয় না। সবে চার দিন হলো, আরও দিন দুয়েক যাক। তারপর হয়তো ফিরে আসবে। এ মা! তোমার পাত তো খালি, আর একটু ভাত দিই?’
‘ নাহ্, অনেকটা খেয়ে ফেলেছি। তোমার সাথে কথা বলতে বলতে খাওয়া কখন খাওয়া শেষ হয়ে গেল খেয়ালই করতে পারলাম না। তুমিও খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়ো। শুধু শুধু রাত জেগে কি করবে। ভাইয়া আজ আর ফিরবে না। ‘
বাবা নিজের রুমে চলে গিয়েছে অনেক্ক্ষণ আগে। ভাবী মলিন হেসে নিজের রুমের দিকে হাঁটা দিলো। ভাবী মানুষ নেহাৎ মন্দ নয়, বরং তাকে ভালোই বলা চলে। দিনের পর দিন বাড়ির সবকিছু দেখে শুনে রাখছে। ভাইয়ার সাথে সম্পর্কটা খুব বেশি রঙিন না হলেও দু’জনের দাম্পত্য জীবন বেশ সুখের। ভাইয়ার সঙ্গে কোন ঝগড়া বিবাদ নেই। সপ্তাহ খানেক বাইরে কাটিয়ে বাড়ির ফেরার পর যত্ন-আত্তির কোন ত্রুটি করে না। আচ্ছা রিপাও কি এমন মানানসই মেয়ে মানুষ? নাকি প্রচন্ড তেজি স্বভাবের!
বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছি। ঘুম পাখি ধরা দিতে চাইছে না। সামান্য চিন্তাও হচ্ছে। ওষুধটা ঠিকমতো কাজ করলে হয়। ওষুধে কাজ না করলে আবারও কিছু টাকা নষ্ট হবে। এর আগেও দু’বার চেষ্টা করেছি তবে লাভ হয়নি। বাবা যেন কেমন করে বেঁচে গিয়েছিল। বোধহয় বি’ষ নষ্ট ছিল, দোকানদার ঠকিয়ে দিয়েছে। পরপর দু’বার কাজ না হওয়ার পর লোকটাকে অনেক খুঁজেছি কিন্তু কোথাও পাইনি। এসব জিনিস নিয়ে বেশিদিন এক এলাকায় ঘোরাঘুরি করা বেশ মুশকিল। পুলিশের খপ্পরে পড়লেই সব শেষ।
আপাতত বি’ষের চিন্তাগুলোকে মস্তিষ্ক থেকে দূরে সরাতে হবে না হলে সারা রাত নির্ঘুম কাটতে পারে। বাবা ঠিকই বলেন, আসলেই আমি একটা অপদার্থ ছেলে। অপদার্থ না হলে কি একই মিশনে পরপর দুবার ফেল করি। সে যাইহোক। এবার কাজ হলেই হলো। সবকিছুর সমাধান হয়ে যাবে। ব্যর্থ হওয়ার পর ভেঙে না পড়লেই দিন শেষে সফলতার মুখ দেখা যায়।
নাহ্! এসব চিন্তা হতে বের হতে পারছি না। মোবাইল বের করে রিপার নম্বরে কল দিলাম। মেয়ে মানুষের সাথে কথা বললে নাকি দুনিয়ার চিন্তা ভুলে থাকা যায়। দু’বার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ হলো। ফোনের ওপাশ থেকে ঘুম জড়ানো মেয়েলি কন্ঠ বলে উঠলো, ” কে আপনি? রাত-বিরেতে কল দিয়েছেন কেন?’
চাপা গলায় বললাম, ” আমি রঞ্জু। ভাবী বললো আপনি কিছু কথা বলতে চান। সময় করে আপনার সঙ্গে কথা বলতে। ‘
‘ ওহ্! সরি সরি। আসলে বুঝতে পারিনি। আপনার সময়ের যে দাম!”
” কি জন্য কল দিতে বলেছিলেন? ”
‘আমি আপনাকে কল দিতে বলিনি। বরং আপনি আপাকে বলেছেন আমার সঙ্গে আপনার মাঝেমধ্যেই কথা হয়ে থাকে। ‘
‘ ওই তখন এ কথা বলতে ইচ্ছে হয়েছিল। ‘
‘ মিথ্যা বলতে হবে কেন? মাঝেমধ্যে একটু কথা বললে কি খুব অসুবিধা হয়?”
‘ নাহ্, তা হবে কেন?’
‘ তাহলে যোগাযোগ রাখেন না যে? জানেন কলেজের কত্ত ছেলে আমার পিছনে পড়ে থাকে। শুধু আপনিই কোন গুরুত্ব দেন না। ‘
‘ গুরুত্ব দেই না বলেই আমার প্রতি এতো আকর্ষণ তোমার। সুন্দরী মেয়েরা কখনোই চাইবে না কোন পুরুষ তাকে অবহেলা করুক৷ ‘
‘ কবিদের মতো কথা বলছেন। ‘
‘ নাহ্, ওসব কবি-টবি হওয়ার ইচ্ছে নেই। তোমার কেন মনে হচ্ছে আমি কবিদের মতো কথা বলছি?’
‘ অনেক সাজিয়ে-গুছিয়ে কথা বলছেন তাই বললাম। ‘
‘ হাসালে! আমি নাকি সাজিয়ে-গুছিয়ে কথা বলছি! এই কাজটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ‘
‘ কেন সম্ভব নয়?’
‘ কোন কারণ ছাড়াই। সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারলে এতোদিনে গোটাকতক প্রেমিকা জুটিয়ে ফেলতাম। ‘
‘ প্রেমিকা জোটানোর ইচ্ছেটা বুঝি অনেক বেশি?’
‘ না না। তা বলতে চাইনি। ‘
অনেক রাত পর্যন্ত রিপার সঙ্গে কথাবার্তা চললো। মেয়েটার কন্ঠে সম্মোহনী ক্ষমতা আছে। একবার শুনতে আরম্ভ করলে শেষ করতে ইচ্ছে হয় না। কথা বলতে বলতে বাবার ব্যাপারটা মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিলো। দুশ্চিন্তা না থাকলে ঘুম পাখি খুব সহজেই ধরা দেয়।
সকালবেলা ভাবীর চিৎকারে ঘুম ভাঙলো। বাবার ঘর থেকে আওয়াজ আসছে। ভাবী ভীতু গলায় চিৎকার করছে। মুচকি হেসে বাবার ঘরের দিকে দৌড় লাগালাম। এতোদিনে কাজটা শেষ হলো। বাবার ঘরে গিয়ে চোখ কপালে উঠে গেল। বাবার শরীরে অসংখ্য ক্ষ’ত, ক্ষ’ত থেকে র’ক্ত চুয়িয়ে পড়ছে। কোন কোনটায় র’ক্ত শুকিয়ে গেছে। মুখমণ্ডলের অবস্থাও ভালো নয়। কেউ অনেকদিনের আক্ষেপ মিটিয়ে বাবার শরীরে ছু”রি চালিয়েছে। কিন্তু কে এমন করবে?
পরিস্থিতি বুঝতে না পেরে মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লাম। আমি ছাড়াও অন্য কেউ আছে?
চলবে