দেবী – হুমায়ূন আহমেদ প্রথম পর্ব

0
1638

প্রথম পর্ব

#দেবী – হুমায়ূন আহমেদ

🔴 এক 🔴
.
মাঝরাতের দিকে রানুর ঘুম ভেঙ্গে গেল।
তার মনে হলো ছাদে কে যেন হাঁটছে। সাধারণ মানুষের হাঁটা নয়, পা টেনে টেনে হাঁটা। সে ভয়ার্ত গলায় ডাকল, ‘এই, এই।’ আনিসের ঘুম ভাঙল না। বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। অল্প-অল্প বাতাস। বাতাসে জামগাছের পাতায় অদ্ভুদ এক রকমের শব্দ উঠছে। রানু আবার ডাকল, ‘এই, একটু ওঠ না। এই।’
‘কী হয়েছে?’
‘কে যেন ছাদে হাঁটছে।’
‘কী যে বল! কে আবার ছাদে হাঁটবে? ঘুমাও তো।’
‘প্লীজ, একটু উঠে বস। আমার বড় ভয় লাগছে।’
আনিস উঠে বসল। প্রবল বর্ষণ শুরু হলো এই সময়। ঝমঝম করে বৃষ্টি। জানালার পর্দা বাতাসে পতপত করে উড়তে লাগল। রানু হঠাৎ দেখল, জানালার শিক ধরে খালিগায়ে একটি রোগামতো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটির দুটি হাতই অসম্ভব লম্বা। রানু ফিসফিস করে বলল, ‘ওখানে কে?’
‘কোথায় কে?’
‘ঐ যে জানালায়।’
‘আহ কী যে ঝামেলা কর! নারকেল গাছের ছায়া পড়েছে।’
‘একটু বাতিটা জ্বালাও না।’
‘রানু তুমি ঘুমোও তো।’
আনিস শোবার উপক্রম করতেই ছাদে বেশ কয়েক বার থপাথপ শব্দ হলো। যেন কেউ-এক জন ছাদে লাফাচ্ছে।
রানু চমকে উঠে বলল, ‘কিসের শব্দ?’
‘বানর। এ জায়গায় বানর আছে। কালই তো দেখলে ছাদে লাফালাফি করছিল।
‘আমার বড় ভয় করছে। একটু উঠে গিয়ে বাতিটা জ্বালাও না। পায়ে পড়ি তোমার।’
আনিস বাতি জ্বালাল। ঘড়িতে বাজে দেড়টা। ছাদে আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। তবু রানুর ভয় কমল না।
সে কেঁপে-কেঁপে উঠতে লাগল।
আনিস বিরক্ত স্বরে বলল, ‘এরকম করছ কেন?’
‘কেন জানি অন্য রকম লাগছে আমার। একটা খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছি।’
‘কী স্বপ্ন?’
‘দেখলাম আমি যেন….
কথার মাঝখানে হঠাৎ রানু থেমে গেল। কে যেন হাসছে। ভারি গলায় হাসছে। রানু কাঁপা স্বরে বলল, ‘হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছ? কে যেন হাসছে।’
‘কে আবার হাসবে। বানরের শব্দ। কিংবা কেউ হয়তো জেগে উঠেছে দোতলায়।’
আনিস লক্ষ্য করল, রানু খুব ঘামছে। চোখ-মুখ রক্তশূণ্য। বালিশের নিচ থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। দেশলাই জ্বালাতে-জ্বালাতে বলল, ‘কী স্বপ্ন দেখেছিলে?’
‘দিনের বেলা বলব।’
‘কী যে সব কুসংস্কার তোমাদের! এখনো ভয় লাগছে?’
‘হ্যাঁ।
‘ভয়টা কিসের? চোর-ডাকাতের, না ভূতের?’
‘বুঝতে পারছি না।’
‘ঠিক আছে বাতি জ্বালানোই থাক। বাতি জ্বালিয়েই ঘুমাব আজকে। এখন বল দেখি কী স্বপ্ন দেখলে?’
‘দিনের বেলা বলব।’
‘আহ্ বল না! বললেই ভয় কেটে যাবে।’
রানু আনিসের বাঁ হাত শক্ত করে চেপে ধরল। থেমে-থেমে বলল, ‘দেখলাম, একটা ঘরে আমি শুয়ে আছি। একটা বেঁটে লোক এসে ঢুকল। তারপর দেখলাম, সে আমার শাড়ি টেনে খুলে ফেলার চেষ্টা করছে।’
আনিস শব্দ করে হাসল।
রানু বলল, ‘হাসছ কেন?’
‘হাসব না? এটা কি একটা ভয় পাওয়ার স্বপ্ন?’
‘তুমি তো সবটা শোনো নি।’
‘সবটা শুনতে হবে না। পরে কী হবে তা আমার জানা। তুমি যা দেখেছ তা হচ্ছে একটা সেক্সুয়াল ফ্যান্টাসি। যুবক-যুবতীরা এ রকম স্বপ্ন প্রায়ই দেখে।’
‘আমি দেখি না।’
‘তুমিও দেখ। মনে থাকে না তোমার।’
‘আমি স্বপ্ন খুব কম দেখি। যা দেখি তা সব সময় সত্যি হয়। তোমাকে তো বলেছি অনেক বার।’
আনিস চুপ করে রইল। রানু এই কথাটি প্রায়ই বলে। বিয়ের রাতে প্রথম বার বলেছিল। আনিস সেবারও হেসেছে। রানু অবাক হয়ে বলেছে, ‘আপনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না, না?’
‘নাহ।’
‘আমি আমি আপনার গা ছুঁয়ে বলছি, বিশ্বাস করুন আমার কথা।’
রানু এমনভাবে বলল, যেন আনিসের বিশ্বাসের উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। আনিস শেষ পর্যন্ত হাসি মুখে বলল, ‘ঠিক আছে বিশ্বাস করলাম, এখন দয়া করে আপনি-আপনি বলবে না।’ রানু ফিসফিস করে বলল, ‘আপনার সঙ্গে যে আমার বিয়ে হবে, সেটাও আমি জানতাম।’
‘এটাও স্বপ্নে দেখেছিলে?’
‘হুঁ। দেখলাম, একটি লোক খালিগায়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পেটের কাছে একটা মস্ত কাটা দাগ। লোকটিকে দেখেই আমার মনে হলো, এর সঙ্গে আমার বিয়ে হবে। আমি তাকে বললাম, কেটেছে কীভাবে? আপনি বললেন, ‘সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিলাম।’
আনিস সে রাতে দীর্ঘক্ষণ কোনো কথা বলতে পারে নি। তার পেটে কেটা কাটা দাগ সত্যি-সত্যি আছে, এই মেয়েটির সেটি জানার কথা নয়। তবে সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে কাটে নি। জামগাছ থেকে পিছলে পড়ে কেটেছে। ব্যাপারটা কাকতালীয়, বলাই বাহুল্য। মাঝে-মাঝে এমন দুই-একটা জিনিস খুব মিলে যায়। তবুও কোথায় যেন একটা ক্ষীণ অস্বস্তি থাকে।
বাইরে বৃষ্টি খুব বাড়ছে। ঝড়টর হবে বোধহয়। শোঁ-শোঁ আওয়াজ হচ্ছে জানালায়। একটি কাঁচ ভাঙ্গা। প্রচুর পানি আসছে ভাঙ্গা জানালা দিয়ে, শীত-শীত করছে।
‘রানু চল ঘুমিয়ে পড়ি।’
‘সিগারেট শেষ হয়েছে?’
‘হ্যাঁ।’
বিছানায় ওঠামাত্র প্রবল শব্দে বিদ্যুৎ চমকাল। বাতি চলে গেল সঙ্গে-সঙ্গে। শুধু এ অঞ্চল নয়, সমস্ত ঢাকাই বোধ করি অন্ধকার হয়ে গেল। আনিস বলল, ‘ভয় লাগছে রানু?’
‘হ্যাঁ।
‘আচছা একটা হাসির গল্পটল্প কর। এতে ভয় কমে যায়। বল একটা গল্প।’
‘তুমি বল।’
আনিস দীর্ঘ সময় নিয়ে এক জন পাদ্রী ও তিনটি ইহুদি ও তিনটি মেয়ের গল্প বলল। গল্পের এক পর্যায়ে শ্রোতাকে জিজ্ঞেস করতে হয়–পাদ্রী তখন কী বলল?
এর উত্তরটি হচ্ছে পাঞ্চ লাইন, কিন্তু কিচ্ছু জিজ্ঞেস করল না রানু। সে কি শুনছে না? আনিস ডাকল, ‘এই রানু, এই!’ রানু কথা বলল না। বাতাসের ঝাপটায় সশব্দে জানালার একটি পাল্লা খুলে গেল। আনিস বন্ধ করার জন্য উঠে দাঁড়াতেই রানু তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁপা গলায় বলল, ‘তুমি যেও না। খবরদার, যেও না!’
‘কী আশ্চর্য, কেন?’
‘একটা-কিছু জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে।’
‘কী যে বল!’
‘প্লীজ, প্লীজ।’
রানু কেদে ফেলল। ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল, ‘তুমি গন্ধ পাচ্ছ না?’
‘কীসের গন্ধ?’
‘কর্পূরের গন্ধের মতো গন্ধ।’
এটা কি মনের ভুল? সু্ক্ষ্ম একটা গন্ধ যেন পাওয়া যাচ্ছে ঘরে। ঝনঝন করে আরেকটা কাঁচ ভাঙল। রানু বলল, ‘ঐ জিনিসটা হাসছে। শুনতে পাচ্ছ না?’ বৃষ্টির শব্দ ছাড়া আনিস কিছু শুনতে পেল না।
‘তুমি বস তো। আমি হারিকেন জ্বালাচ্ছি।’
‘না তুমি আমাকে ধরে বসে থাক।’
আনিস অস্বস্তির সঙ্গে বলল, ‘তুমি ঐ জানালাটার দিকে আর তাকিও না তো!’ আনিস লক্ষ্য করল, রানু থরথর করে কাঁপছে, ওর গায়ের উত্তাপও বাড়ছে। রানুকে সাহস দেবার জন্যে সে বলল, ‘কোনো দোয়া-টোয়া পড়লে লাভ হবে? আয়াতুল কুর্সি জানি আমি। আয়াতুল কুর্সি পড়ব?’
রানু জবাব দিল না। তার চোখ বড়-বড় হয়ে উঠছে। মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে নাকি? শ্বাস ফেলছে টেনে-টেনে।
‘এই রানু, এই।’
কোনোই সাড়া নেই। আনিস হ্যারিকেন জ্বালাল। রান্নাঘর থেকে খুটখুট শব্দ আসছে। ইঁদুর, এতে সন্দেহ নেই। তবু কেন জানি ভালো লাগছে না। আনিস বারান্দায় এসে ডাকল, ‘রহমান সাহেব, ও রহমান সাহেব।’ রহমান সাহেব বোধহয় জেগেই ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বেরুলেন।
‘কী ব্যাপার?’
‘আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েছে।’
‘কী হয়েছে?’
‘বুঝতে পারছি না।’
‘হাসপাতালে নিতে হবে নাকি?’
‘বুঝতে পারছি না।’
‘আপনি যান, আমি আসছি। এক্ষুণি আসছি।’
আনিস ঘরে ফিরে গেল। মনের ভুল, নিঃসন্দেহে মনের ভুল। আনিসের মনে হলো সে ঘরের ভেতর গিয়ে দাঁড়ানো মাত্র কেউ-এক জন যেন দরজার আড়ালে সরে পড়ল। রোগা, লম্বা একটি মানুষ। আনিস ডাকল, ‘রানু।’ রানু তৎক্ষণাৎ সাড়া দিল, ‘কি?’
ইলেকট্রিসিটি চলে এল তখনই। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই রহমান সাহেব এসে উপস্থিত হলেন। উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, ‘এখন কেমন অবস্থা?’ রানু অবাক হয়ে বলল, ‘কিসের অবস্থা? কী হয়েছে?’
রহমান সাহেব অবাক হয়ে তাকালেন। আনিস বলল, ‘তোমার শরীর খারাপ করেছিল, তাই ওঁকে ডেকেছিলাম। এখন কেমন লাগছে?’
‘ভালো।’
রানু উঠে বসল। রহমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল, ‘এখন আমি ভালো।’
রহমান সাহেব তবু মিনিট দশেক বসলেন। আনিস বলল, ‘আপনি কি ছাদে দাপাদাপি শুনেছেন?’
‘সে তো রোজই শুনি। বাঁদরের উৎপাত।’
‘আমিও তাই ভাবছিলাম।’
‘খুব জ্বালাতন করে। দিনে-দুপুরে ঘর থেকে খাবারদাবার নিয়ে যায়।’
‘তাই নাকি?’
‘জ্বি। নতুন এসেছেন তো! কয়েক দিন যাক টের পাবেন। বাড়িঅলাকে বলেছিলাম গ্রিল দিতে। তা দেবে না। আপনার সঙ্গে দেখা হলে আপনিও বলবেন। সবাই মিলে চেপে ধরতে হবে।’
‘জ্বি, আমি বলব। আপনি কি চা খাবেন না কি এক কাপ?’
‘আরে না না! এই রাত আড়াইটার সময় চা খাব নাকি, কী যে বলেন! উঠি ভাই। কোনো অসুবিধা হলে ডাকবেন।’
ভদ্রলোক উঠে পড়লেন। রানু চাপা স্বরে বলল, ‘এই রাত-দুপুরে ভদ্রলোককে ডেকে আনলে কেন? কী মনে করলেন উনি!’
‘তুমি যা শুরু করেছিলে! ভয় পেয়েই ভদ্র লোককে ডাকলাম।’
‘কী করেছিলাম আমি?’
‘অনেক কান্ড করেছ। এখন তুমি কেমন, সেটা বল।’
‘ভালো।’
‘কী রকম ভালো?
‘বেশ ভালো।’
‘ভয় লাগছে না আর?’
‘নাহ।’
রানু বিছানা থেকে নেমে পড়ল। সে বেশ সহজ ও স্বাভাবিক। ভয়ের কোনো চিহ্নও নেই চোখে-মুখে। শাড়ি কোমরে জড়িয়ে ঘরের পানি সরাবার ব্যবসা করছে।
‘সকালে যা করার করবে। এখন এসব রাখ তো।’
‘ইস, কী অবস্থা হয়েছে দেখ না!’
‘হোক, এস তো এদিকে।’
রানু হাসি-হাসি মুখে এগিয়ে এল।
‘এখন আর তোমার ভয় লাগছে না?’
‘না।’
‘জানালার ওপাশে কে যেন দাঁড়িয়েছিল বলেছিলে?’
‘এখন কেউ নেই। আর থাকলেও কিছু যায় আসে না।’
আনিস দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরাল। হালকা গলায় বলল, ‘এক কাপ চা করতে পারবে?’
‘চা, এত রাতে!’
‘এখন আর ঘুম আসবে না, কর দেখি এক কাপ।’
রানু চা বানাতে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পানি ফোটার শব্দ হলো। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে ঝমঝম করে। রানু একা-একা রান্নাঘরে। কে বলবে এই মেয়েটিই অল্প কিছুক্ষণ আগে ভয়ে অস্থির হয়ে গিয়েছিল! ছাদে আবার ঝুপঝুপ শব্দ হচ্ছে। এই বৃষ্টির মধ্যে বানর এসেছে নাকি? আনিস উঠে গিয়ে রান্না ঘরে উঁকি দিল। হালকা গলায় বলল, ছাদে বড় ধুপধাপ শব্দ হচ্ছে?’ রানু জবাব দিল না।
আনিস বলল, ‘এই বাড়িটা ছেড়ে দেব।’
‘সস্তায় এ রকম বাড়ি আর পাবে না।’
‘দেখি পাই কি না।’
‘চায়ে চিনি হয়েছে তোমার?’
‘হয়েছে। তুমি নিলে না?’
‘নাহ, রাত-দুপুরে চা খেলে আমার আর ঘুম হবে না।’
রানু হাই তুলল। আনিস বলল, ‘এখন বল তো তোমার স্বপ্ন-বৃত্তান্ত।’
‘কোন স্বপ্নের কথা?’
‘ঐ যে স্বপ্ন দেখলে! একটা বেঁটে লোক।’
‘কখন আবার এই স্বপ্ন দেখলাম? কী যে তুমি বল!’
আনিস আর কিছু বলল না। চা শেষ করে ঘুমুতে গেল। শীত-শীত করছিল। রানু পা গুটিয়ে বাচ্চা মেয়ের মতো শুয়েছে। একটি হাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে আনিসকে। তার ভারি নিঃশ্বাস পড়ছে। ঘুমিয়ে পড়েছে বোধ হয়। জানালায় নারকেল গাছের ছায়া পড়েছে। মানুষের মতোই লাগছে ছায়াটাকে। বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে। মনে হচ্ছে মানুষটি হাত নাড়ছে। ঘরের ভেতর মিষ্টি একটা গন্ধ। মিষ্টি, কিন্তু অচেনা।
আনিস রানুকে কাছে টেনে আনল। রানুর মুখে আলো এসে পড়েছে। কী যে মায়াবতী লাগছে! আনিস ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। ওদের বিয়ে হয়েছে মাত্র ছ’ মাস। আনিস এখনো অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। প্রতি রাতেই রানুর মুখ তার কাছে অচেনা লাগে। অপরুপ রুপবতী একটি বালিকার মুখ, যাকে কখনো পুরোপুরি চেনা যায় না। আনিস ডাকল, ‘রানু, রানু।’ কোনো জবাব পাওয়া গেল না। গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন রানু। আনিসের ঘুম এল না। শুয়ে-শুয়ে ঠিক করে ফেলল, রানুকে ভাল একজন সাইকিয়াট্রিস্ট্রের কাছে নিয়ে যেতে হবে। অফিসের কমলেন্দুবাবু এক ভদ্রলোকের কথা প্রায়ই বলেন, খুব নাকি গুণী লোক। মিসির সাহেব। দেখালে হয় একবার মিসির সাহেবকে।
রানু ঘুমের ঘোরে খিলখিল করে হেসে উঠল। অপ্রকৃতিস্থ মানুষের হাসি শুনতে ভাললাগে না, গা ছমছম করে।
.
🔴 দুই 🔴
.
ভদ্রলোকের বাড়ি খুঁজে বের করতে অনেক দেরি হলো। কাঁঠালবাগানের এক গলির ভেতর পুরোনো ধাঁচের বাড়ি। অনেকক্ষণ কড়া নাড়বার পর অসম্ভব রোগা এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। বিরক্ত মুখে বললেন, ‘কাকে চান?’
‘মিসির সাহেবকে খুঁজছি।’
‘তাকে কী জন্যে দরকার?’
‘জ্বি, আছে একটা দরকার। আপনি কি মিসির সাহেব?’
‘হ্যাঁ। বলেন, দরকারটা বলেন।’
রাস্তায় দাড়িয়ে সমস্যার কথা বলতে হবে নাকি? আনিস অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। কিন্তু ভদ্রলোকের ভাবভঙ্গি এ রকম যে, বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবেন, ভেতরে ঢুকতে দেবেন না। আনিস বলল, ‘ভেতরে এসে বলি?’
‘ভেতরে আসবেন? ঠিক আছে আসুন।’
মিসির সাহেব যেন নিতান্ত অনিচ্ছায় দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন। ঘন অন্ধকার। তিন-চারটা বেতের চেয়ার ছাড়া আসবাব পত্র কিছু নেই।
‘বসুন আপনি।’
আনিস বসল। ভদ্রলোক বললেন, ‘আজ আমার শরীরটা ভালো না। আলসার আছে। ব্যাথা হচ্ছে এখন। তাড়াতাড়ি বলেন কি বলবেন।’
‘আমার স্ত্রীর একটা ব্যাপারে আপনার কাছে এসেছি। আপনার নাম শুনেই এসেছি।’
‘আমার নাম শুনে এসেছেন?’
‘জ্বি।
‘আমার এত নাম ডাক আছে, তা তো জানতাম না! স্পেসিফিক্যালি বলুন তো কার কাছে শুনেছেন?’
আনিস আমতা-আমতা করতে লাগল। ভদ্রলোক অসহিষ্ণু স্বরে বললেন, ‘বলুন, কে বলল?’
‘আমাদের অফিসের এক ভদ্রলোক। কমলেন্দুবাবু। আপনি নাকি তার বোনের চিকিৎসা করেছিলেন।’
‘ও আচ্ছা,চিনেছি, কমলেন্দু। শোনেন, আমি ডাক্তার না, জানেন তো?’
‘জ্বি স্যার, জানি।’
‘আচ্ছা আগে এক কাপ চা খান, তারপর কথা বলব। রুগীটি কে বললেন?’ আপনার স্ত্রী?’
‘জ্বি।
‘বয়স কত?’
‘ষোল-সতের।’
‘বলেন কী! আপনার বয়স তো মনে হয় চল্লিশের মতো, ঠিক না?’
আনিস শুকনো গলায় বলল, ‘আমার সাঁইত্রিশ।’
‘এমন অল্প বয়সি মেয়েকে বিয়ে করেছেন কেন?’
এটা আবার কেমন প্রশ্ন। আনিসের মনে হলো, কমলেন্দুবাবুর কথা শুনে এখানে আসাটা ঠিক হয় নি। ভদ্রলোকের নিজেরই মনে হয় মাথার ঠিক নেই। একজন অপরিচিত মানুষকে কেউ এ রকম কথা জিজ্ঞে করে?’
‘বলুন বলুন, এ রকম অল্পবয়েসী মেয়ে বিয়ে করলেন কেন?’
‘হয়ে গেছে আর কি।’
‘বলতে চান না বোঝা যাচ্ছে। ঠিক আছে, বলতে হবে না। চা‘র কথা বলে আসি। চা খেয়ে তারপর শুরু করব।
ভদ্রলোক আনিসকে বাইরে বসিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। তারপর আর আসার নামগন্ধ নেই। আট-ন’ বছরের একটি বাচ্চা মেয়েমেয়ে এক কাপ দারুণ মিষ্টি সর-ভাসা চা দিয়ে চলে গেল। তারপর আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। দেখতে-দেখতে সন্ধ্যা হয়ে যায় । আনিস বেশ কয়েকবার কাশল। দুই বার গলা উঁচিয়ে ডাকল, ‘বাসায় কেউ আছেন?’ কোনো সাড়া নেই। কী ঝামেলা!
কমলেন্দুবাবু অবশ্য বারবার বলে দিয়েছেন-এই লোকের কথাবার্তার ঠিকঠিকানা নেই। তবে লোকটা অসাধারণ। আনিসের কাছে অসাধারণ কিছু মনে হয় নি। তবে চোখের দৃষ্টি খুব তীক্ষ্ণ। এইটি অবশ্য প্রথমেই চোখে পড়ে। আর দ্বিতীয় যে জিনিসটি চোখে পড়ে, সেটি হচ্ছে তার আঙ্গুল। অস্বাভাবিক লম্বা-লম্বা তার সব ক‘টা আঙ্গুল।
‘এই যে, অকেক্ষণ বসিয়ে রাখলাম।’
‘না, ঠিক আছে।’
‘ঠিক থাকবে কেন? ঠিক না।’
লোকটি এই প্রথম বার হাসল। থেমে-থেমে বলল, ‘আলসার আছে তো, ব্যথায় কাহিল হয়ে শুয়েছিলাম। অমনি ঘুম এসে গেল।’
‘আমি তাহলে অন্য একদিন আসি?’
‘না, এসেছেন যখন বসুন। চা দিয়েছিল?’
‘জ্বি।’
‘বেশ, এখন বলুন কী বলবেন?’
আনিস চুপ করে রইল। এটা এমন একটা ব্যাপার, যা চট করে অপরিচিত কাউকে বলা যায় না। ভদ্রলোক শান্ত স্বরে বললেন, ‘আপনার স্ত্রীর মাথার ঠিক নেই, তাই তো?’
‘জ্বি-না স্যার, মাথা ঠিক আছে।’
‘পাগল নন?’
‘জ্বি-না।’
‘তাহলে আমার কাছে এসেছেন কেন?’
‘মাঝে-মাঝে সে অস্বাভাবিক আচরণ করে।’
‘কী রকম অস্বাভাবিক?’
‘ভয় পায়। মাঝে-মাঝেই এ রকম হয়।’
‘ভয় পায়? তার মানে কী? কিসের ভয়?’
‘ভূতের ভয়।’
‘ঠিক জানেন ভয়টা ভূতের?’
‘জ্বি-না, ঠিক জানি না। মনে হয় এ রকম।’
ভদ্রলোক একটি চুরুট ধরিয়ে খকখক করে কাশতে-কাশতে বললেন, ‘বর্মা থেকে আমার এক বন্ধু এনছে, অতি বাজে জিনিস।’ আনিস কিছু বলল না। তবে এই ভদ্র লোকের স্টাইলটি তার পছন্দ হলো। ভদ্রলোক অবলীলায় অন্য একটি প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। এবং এমনভাবে কথা বলছেন, যেন আগের কথাবার্তা তাঁর কিছুই মনে নেই।
‘এ রকম চুরুট চার-পাঁচটা খেলে যক্ষ্মা হয়ে যাবে। আপনাকে দেব একটা?’
‘জ্বি-না।’
‘ফেলে দিলে মায়া লাগে বলে খাই। খাওয়ার জিনিস না। অখাদ্য। তবে হাভানা চুরুটগুলি ভালো হয়। হাভানা চুরুট খেয়েছেন কখনো?’
‘জ্বি-না।
‘খুব ভালো। মাঝে-মাঝে আমার এক বন্ধু আমাকে দিয়ে যায়।’
ভদ্রলোক চুরুটে টান দিয়ে আবার ঘর কাঁপিয়ে কাশতে লাগলেন। কাশি থামতেই বললেন, ‘এখন আমি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব। যথাযথ উত্তর দেবেন।
‘জ্বি আচ্ছা।’
‘প্রথম প্রশ্ন, আপনার স্ত্রী কি সুন্দরী?’
‘জ্বি।’
‘বেশ সুন্দরী?’
‘জ্বি।’
‘আপনার স্ত্রী কখন ভয় পান-রাতে না দিনে?’
‘সাধারণত রাতে। তবে একবার দুপুরে ভয় পেয়েছিল।’
‘ভয়টা কী রকম সেটা বলেন।’
‘মনে হয় কিছু-একটা দেখে।’
‘সব বার কি একই জিনিস দেখে না একেক বার একেক রকম?’
‘এটা আমি ঠিক বলতে পারছি না।’
‘এই সময় তিনি কি কোনো রকম গন্ধ পান?’
‘আমি ঠিক বলতে পারছি না।’
‘যখন সুস্থ হয়ে ওঠেন তখন কি তাঁর ভয়ের কথা মনে থাকে?’
‘বেশিরভাগ সময়ই থাকে না, তবে মাঝে-মাঝে থাকে।’
‘আপনার স্ত্রীর স্বাস’্য নিশ্চই খারাপ।’
‘জ্বি।
‘উনি প্রথম কখন ভয় পেয়েছিলেন, বলতে পারেন?’
‘জ্বি-না। তবে খুব ছোটবেলায়।
‘প্রথম ভয়ের ঘটনাটা আমাকে বলুন।’
‘আমি সেটা ঠিক জানি না।’
‘আপনি অনেক কিছুই জানেন না মনে হচ্ছে। আপনার স্ত্রীকে একদিন নিয়ে আসুন।’
আনিস কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘আমি তাকে আনতে চাই না।’
‘কেন চান না?’
‘সে খুব সেনসিটিভ। সে যদি টের পায় যে, তার অস্বাভাবিকতা নিয়ে আমি লোকজনের সাথেঘ আলাপ করছি, তাহলে খুব মন-খারাপ করবে।’
‘দেখুন ভাই, আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কথা না-বলে কিছুই করা যাবে না। আপনার স্ত্রী অসুস্থ এবং আমার মনে হচ্ছে এই অসুখ দ্রুত বেড়ে যাবে। আপনি তাঁকে নিয়ে আসবেন।’
আনিস উঠে দাঁড়াল। ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘আপনাকে কত দেব?’
ভদ্রলোক বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘কমলেন্দবাবু কি আপনাকে বলেন নি আমি ফিস নিই না? এই কাজটি আমি শখের খাতিরে করি, বুঝতে পারছেন?’
‘জ্বি পারছি।’
‘তবে আপনি যদি ভালো গোলাপের চারা পান, তাহলে আমাকে দিতে পারেন। আমার গোলাপের খুব শখ। সব মিলিয়ে ত্রিশটি ডিফারেন্ট ভেরাইটির চারা আমার কাছে আছে। একটা আছে দারুন ইন্টারেস্টিং, ঘাসফুলের মতো ছোট সাইজের গোলাপ।’
‘তাই নাকি?’
‘জ্বি। ওরা বলে মাইক্রো রোজ। হল্যান্ডের গোলাপ। কড়া গন্ধ। দেখবেন?’
‘আরেক দিন দেখব। আজ দেরি হয়ে গেছে, আমার স্ত্রী একা থাকে।’
‘ও, তাই নাকি? শোনেন, একা তাকে রাখবেন না। কখনো যেন মেয়েটি একা না থাকে। এটা খুবই জরুরি।’
রাস্তায় নেমে আনিসের মন খারাপ হয়ে গেল। খামোকা সময় নষ্ট। লোকটি তেমন কিছুই জানে না। কমলেন্দুবাবু যে সব আধ্যাত্মিক শক্তিটক্তির কথা বলেছেন, সে সব মনে হয় নেহায়েতই গালগল্প। তবে লোকটির কথাবার্তা বেশ ফোর্সফুল। রানুকে বুঝিয়েসুঝিয়ে এক বার এনে দেখালে হয়। ক্ষতি তো কিছু নেই।
তাছাড়া ভদ্রলোক খুব সম্ভব ফ্যালনাও নন। ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রির টীচার। একেবারে কিছু না-জেনে তো কেউ মাষ্টারি করে না। কিছু নিশ্চই জানেন। মানুষের চেহারা দেখে কিছু অনুমান করাটাও ঠিক না।
.
🔴 তিন 🔴
.
আনিস অফিসে চলে গেলে রানুর খুব একলা লাগে। কিছুই করার থাকে না। গোছানো আলনা আবার নতুন করে গোছায়। বসার ঘরের বেতের সোফা ঝাড়ন দিয়ে ঝাড়ে। শোবার মেঝে ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে মুছতে-মুছতে চকচকে করে ফেলে, তবু সময় কাটে না। এক সময় তেতলার বারান্দায় গিয়ে বসে। এ-বাড়ির ছোট বারান্দাটি তাঁর খুব পছন্দ। গ্রিল দেওয়া বারান্দাটি গোলাকার। এখানে বসে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। সামনেই একটা মেয়েদের স্কুল। টিফিন টাইমে মেয়েগুলোর কান্ডকারখানা দেখতে এমন মজা লাগে! রানু প্রায় সারা দুপুর বারান্দাতেই বসে থাকে। একা-একা ঘরে বসে থাকতে ভারো লাগে না। কেমন যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। একটু যেন ভয়ভয়ও লাগে।
অবশ্য যখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামতে থাকে, তখন ভয়ভয় ভাবটা কমে যায়। বিকেলবেলা বাড়িঅলার মেয়ে ুদটি তাদের ভেতরের দিকের বাগানে বসে মজা করে চা খায়। চা খেতে-খেতে দুইজনেই খুব হাসাহাসি করে। একেক দিন ওদের বাবাও সঙ্গে বসেন, রানুর দেখতে বেশ লাগে।
ছোট মেয়েটির সঙ্গে রানুর কিছু দিন আগে আলাপ হয়েছিল। বেশ মেয়েটি! খুব স্মার্ট। দেখতেও সুন্দর। একদিন দুপুরে রানু বারান্দায় এসে বসেছে, মেয়েটি এসে উপস্থিত। মুখে চাপা হাসি। হাতে কী-একটা বই। এসেই বলল, ‘আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছি।’
‘কি কথা?’
‘আপনি সারাদিন বারান্দায় বসে থাকেন কেন?’
‘সারাদিন কোথায়? দুপুরবেলায় বসি। কিছু করার নেই তো, একা একা লাগে।’
‘তা ঠিক। বসব আপনার এখানে? আজ আমি কলেজে যাই নি। বোটানি প্র্যাকটিক্যাল ছিল আজকে।’
মেয়েটি খুব সহজভাবে বসল। ঘন্টাখানেকের মধ্যে একগাদা কথা বলল। তারপর যাবার সময় হঠাৎ বলল, ‘আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করব?’
‘কর।’
‘আপনি এত সুন্দর কেন? যে আমার চেয়ে সুন্দরী, তাকে আমার ভালো লাগে না।
রানু কী বলবে ভেবে পেল না। মেয়েটি হাসতে-হাসতে বলল, ‘আমাদের ক্লাসের মেয়েদের কি ধারণা, জানেন? তাদের ধারণা, আমি হচ্ছি বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা। ওদের এক দিন এনে আপনাকে দেখিয়ে দেব।
‘ঠিক আছে, দিও। আরেকটু বস। চা খাবে?’
‘না আমি চা বেশি খাই না। বেশি চা খেলে গায়ের রঙ ময়লা হয়ে যায়।’
মেয়েটি যেমন হুট করে এসেছিল, তেমনি হুট করে নিচে নেমে গেল। বেশ লাগল রানুর। মালিবাগের বাসাটার মতো নয়। নিঃশ্বাস নেবার জায়গা ছিল না সেখানে। পাশ দিয়ে রাত-দিন রিকশা যাচ্ছে, গাড়ি যাচ্ছে। প্রথম দিনেই আনিসকে বলেছেন, ‘আমার বাড়ি ভাড়া দেবার দরকার নেই। টাকার জন্যেই তো বাড়ি ভাড়া। টাকা যথেষ্ট আছে। তবু দুই ঘর ভাড়াটে রাখি। কারণ এত বড় বাড়িতে মানুষ না-থাকলে ভালো লাগে না। কবরখানা-কবরখানা ভাব চলে আসে। তবে সবাইকে আমি বাড়ি ভাড়া দিই না। আপনাকে দিচ্ছি, কারণ আপনাকে পছন্দ হয়েছে।
ভাড়াও খুব কম। মাত্র ছয় শ’ টাকা। তিন-রুমের এত বড় একটা বাড়ি ছয় শ’ টাকায় পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। রানু এখানে এসে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। তার সবচেয়ে পছন্দ হয়েছে বাথরুম। বড় ঝকঝকে একটা বাথরুম। বাসাটা রানুর খুব পছন্দ হয়েছিল। আনিস যখন বলল, ‘কি, নেব? পছন্দ হয়?’
‘হয়।’
‘ভালো করে ভেবে বল নেব কি না। দুই দিন পর যদি বল পছন্দ না, তাহলে মুশকিলে পড়ব। মালিবাগের বাসাটা ভালো ছিল। শুধু-শুধু বদলালাম।’
‘এই বাসাটাও ভালো।’
রানু খুব খুশি মনে নতুন বাসা সাজাল। নিজেই পরদা কিনে আনল, সারা রাত জেগে সেলাই করল। তার উৎসাহের সীমা নেই।
‘বুঝলে রানু, সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকবে। অন্যদের বাসা যা-েটাবে। একা-একা থাকার অভ্যেসটা ভালো না। যাবে তো?’
‘যাব।’
‘একা থাকলেই মানুষের মধ্যে নানান রকম প্রবলেম দেখা যায়, বুঝলে? সব ভাড়াটেদের সঙ্গে খাতির রাখবে।’
‘ভাড়াটে তো মাত্র এক জন।’
‘ঐ ওনার বাসাতেই যাবে। বাড়িঅলার বাসায়ও যাবে।’
‘আচ্ছা, যাব।’
রানু অবশ্যি যায় নি কোথাও। তাঁর ভালো লাগে না। অন্যদের মতো সে কারো সঙ্গে সহজভাবে মিশতে পারে না। অন্যদের সামনে কেমন যেন আড়ষ্ট লাগে। বারান্দার বেতের চেয়ারটাতে বসে থাকতেই বেশি ভালো লাগে। দুপুরটাই যা কষ্টের। দুপুরটা কেটে গেলেই অন্যরকম একটা শান্তি লাগে। কিন্তু আজকের দুপুরটা দীর্ঘ। কিছুতেই আর কাটছে না। বারান্দায় বসে থাকতেও ভালো লাগছে না। মেয়েদের স্কুলটাও কী কারনে যেন বন্ধ। চারদিকে চুপচাপ। বড্ড ফাঁকা। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলে কেমন হয়?
ঘরের ভেতরটা কেমন যেন অন্য রকম। রানু ভেতরে ঢুকে জানালার পর্দা ফেলে দিল। অনেকখানি অন্ধকার হয়ে গেল। অন্ধকার ও চুপচাপ। আর তখন স্পষ্ট গলায় কেউ ডাকল, ‘রানু, রানু।’ কয়েক মূহুর্ত রানু নড়ল না। অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু যে ডেকেছে সে দ্বিতীয়বার আর ডাকল না।
রানুর এ রকম চারদিকের নিস্তব্ধতার মধ্যে এক জন অশরীরী কেউ তাকে ডেকে ওঠে। অসংখ্যবার শুনেছে এই ডাক। কে সে! কোত্থেকে আসে সে! রানু ফিসফিস করে বলল, ‘কে?’ কোনো জবাব পাওয়া গেল না।
‘কে তুমি?’
জানালার পরদাটা শুধু কাঁপছে। বিকেল হয়ে আসছে। রানু ছোট একটি নিঃশ্বাস ফেলে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। নিচের বাগানে বাড়িঅলার বড় মেয়েটি হাঁটছে। নীলু বোধহয় ওর নাম। এই মেয়েটি তার বোনের মতো নয়। গম্ভীর। কথাবার্তা প্রায়ই বলেই না। তবুও ওকে দেখলেই রানুর মনে হয়-মেয়েটি বড় ভালো। মায়াবতী মেয়ে।
রানু দেখল-বিষণ্ন ভঙ্গিতে মেয়েটি একা-একা বসে আছে। তার ইচ্ছা হল নিচে নেমে ওর সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু সে গেল না।
.
🔴 চার 🔴
.
নীলু দুই বার বিজ্ঞাপনটা পড়ল। বেশ একটা মজার বিজ্ঞাপন।
কেউ কি আসবেন?
আমি এক নিঃসঙ্গ মানুষ। স্ত্রীর মৃত্যুর পর একা জীবন-
যাপন করছি। সময় আর কাটে না। আমার দীর্ঘ দিবস ও দীর্ঘ
রজনীর নিঃসঙ্গতা কাটাতে কেউ আমাকে দুই লাইন লিখবেন?
জিপিও বক্স নাম্বার ৭৩
দৈনিক পত্রিকায় এ রকম বিজ্ঞাপন দেবার মানে কী? সাপ্তাহিক কাগজগুলিতে এই সব থাকে; ছেলেছোকরাদের কান্ড। এই লোকটি নিশ্চই ছেলেছোকরা নয়। বুড়ো-হাবড়াদের একজন।
‘বাবা, এইটা পড়েছ?’
নীলু জাহিদ সাহেবের হাতে কাগজটা গুঁজে দিল।
‘বাবা, এই বিজ্ঞাপনটা পড় তো!’
জাহিদ সাহেব নিজেও ভ্রু কুঞ্চিত করে দুই বার পড়লেন। তাঁর মুখের ভঙ্গি দেখে মনে হল বেশ বিরক্ত হয়েছেন।
‘পড়েছ?’
‘হুঁ, পড়লাম।
‘কী মনে হয় বাবা?’
‘কী আবার মনে হবে? কিছুই মনে হয় না। দেশটা রসাতলে যাচ্ছে। খবরের কাগজঅলারা এইসব ছাপে কীভাবে?’
নীলু হাসিমুখে বলল, ‘ছাপাবে না কেন?’
‘দেশটা বিলাত-আমেরিকা নয়, বুঝলি? আর ভালো করে পড়লেই বোঝা যায়, লোকটার একটা বদ মতলব আছে।’
‘কই, আমি তো বদ মতলব কিছু বুঝছি না।’
জাহিদ সাহেব গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘দেখিস, তুই আবার চিঠি লিখে বসবি না।’
নীলু মুখ নিচু করে হাসল।
‘হাসছিস কেন?’
‘এমনি হাসছি।’
‘চিঠি লিখবার কথা ভাবছিস না তো মনে-মনে?’
‘উঁহু।’
নীলু মুখে উঁহু বললেও মনে-মনে ঠিক করে ফেলল, গুছিয়ে একটা চিঠি লিখবে। দেখা যাক না কী হয়। কী লেখে লোকটি।
রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে সে সত্যি সত্যি একটা চিঠি লিখে ফেলল। মোটামুটি বেশ দীর্ঘ চিঠি।
জনাব,
আপনার বিজ্ঞাপনটি পড়লাম। লিখলাম কয়েক লাইন।
এতে কী আপনার নিঃসঙ্গতা কাটবে? আমার বয়স আঠার।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। আমরা দু’ বোন। আমার
ছোট বোনটির নাম বিলু। সে হলিক্রস কলেজে পড়ে। আমরা
দু’ বোনই খুব সুন্দরী। এই যা, এটা আপনাকে লেখা ঠিক হল না।
তাই না? নাকি সুন্দরী মেয়েদের চিঠি পেলে আপনার নিঃসঙ্গতা দ্রুত কাটবে?
নীলু চিঠিটি লিখেই তার মনে হলো যে, এ রকম লেখাটা ঠিক হচ্ছে না। চিঠির মধ্যে একটা বড় মিথ্যা আছে। সে সুন্দরী নয়। বিলুর জন্য কথাটা ঠিক, তার জন্যে নয়। নীলু ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে দ্বিতীয় চিঠিটি লিখল।
জনাব,
আমার নাম নীলু। আমার বয়স কুড়ি। আপনার নিঃসঙ্গতা
কাটাবার জন্যে আপনাকে লিখছি। কিন্তু চিঠিতে কি কারো
নিঃসঙ্গতা কাটে? আপনার বয়স কত, এটা দয়া করে জানাবেন।
নীলু
দ্বিতীয় চিঠিটিও তার পছন্দ হলো না। তার মনে হলো, সে যেন কিছুতেই গুছিয়ে আসল জিনিসটি লিখতে পারছে না। রাতে শুয়ে-শুয়ে তার মনে হলো, হঠাৎ করে সে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কেন? চিঠি লেখারই-বা কী দরকার?
সে নিজেও কি খুব নিঃসঙ্গ? হয়তো-বা। এ বাড়িতে আর দুটি মাত্র প্রাণী। বিলু আর বাবা। বাবা দিন-রাত নিজের ঘরেই থাকেন। মাসের প্রথম দিকের কয়েকটা দিন বাড়িভাড়ার টাকা আদায়ের জন্যে অল্প যা নড়াচড় করেন। তারপর আবার নিজের ঘরেই বন্দি। আর বিলু তো আছে তার অসংখ্য বন্ধুবান্ধব নিয়ে। শুধু মেয়ে বন্ধু নয়, তার আবার অনেক ছেলেবন্ধুও আছে।
মহানন্দে আছে বিলু। তবে সে একটু বাড়াবাড়ি করছে। কাল তার কাছে একটি ছেলে এসেছিল, সে রাত আটটা পর্যন্ত ছিল। এ সব ভালো নয। নীলু উঁকি দিয়ে দেখেছে, ছেলেটি ফরফর করে সিগারেট টানছে। হাত নেড়ে-নেড়ে কথা বলছে। আর বীলু হাসতে-হাসতে ভেঙে পড়ছে। ভাত খাওয়ার সময় নীলু কিছু বলবে না বলবে না করেও বলল, ‘ছেলেটা কে রে?’
‘কোন ছেলে?’
‘ঐ যে রাত আটটা পর্যন্ত গল্প করলি?’
‘ও, সে তো রুবির ভাই! মহাচালবাজ। নিজেকে খুব বু্দ্িধমান ভাবে, আসলে মহা গাধা।’
বলতে বলতে খিলখিল করে হাসে বিলু।
‘মহা গাধা হলে এতক্ষণ বসিয়ে রাখলি কেন?’
‘যেতে চাচ্ছিল না তো কী করব?’
বলতে বলতে বীলু আবার হাসল। বীলু এমন মেয়ে, যার উপর কখনো রাগ করা যায় না। নীলু কখনো রাগ করতে পারে না। মাঝে-মাঝে বাবা দুই-একটা কড়া কথা বলেন। তখন বিলু রাগ করে খাওয়া বন্ধ করে দেয়। সে এক মহা যন্ত্রনা! একবার রাগ করে সে পুরো দুদিন দরজা বন্ধ করে বসেছিল। কত সাধাসাধি, কত অনুরোধ! শেষ পর্যন্ত মগবাজারের ছোট মামাকে আনতে হলো। ছোটমামা বিলুর খাতিরের মানুষ। তাঁর সব কথা সে শোনে। তিনি এসে যখন বললেন, ‘দরজা না খুললে মা আমি কিন্তু আর আসব না। এই আমার শেষ আসা-’ তখন দরজা খুলল। এ রকম জেদী মেয়ে।
নীলুর কোনো জেদ-টেদ নেই। কালো এবং অসুন্দরী মেয়েদের জে কখনো থাকে না। এদের জীবন কাটাতে হয় একাকী। নীলু বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে চেষ্টা করল। ছোটবেলায় বাতি নেভানোর সঙ্গে সঙ্গে তার ঘুম আসত, এখন আর আসে না । অনেক রাত পর্যন্ত এপাশ-ওপাশ করতে হয়। পাশের খাটে টেবিল-ল্যাম্প জ্বালিয়ে চোখের ওপর একটা গল্পের বই ধরে আছে বিলু। অনেক রাত পর্যন্ত সে পড়বে। পড়তে-পড়তে হঠাৎ এক সময় ঘুমিয়ে পড়বে, বাতি নেভাবে না। মশারি ফেলবে না। নীলুকেই উঠে এসে বাতি নেভাতে হবে, মশারি ফেলতে হবে।
‘বিলু ঘুমো, বাতি নেভা।’
‘একটু পরে ঘুমাব।’
‘কী পড়ছিস?’
‘শীর্ষেন্দুর একটা বই। দারুন!’
‘দিনে পড়িস। আলো চোখে লাগছে।’
‘দিনে আমার সময় কোথায়? তুমি ঘুমাও-না!’
নীলু ঘুমাতে পারল না। শুয়ে-শুয়ে তাকিয়ে রইল বিলুর দিকে। দিনে-দিনে কী যে সুন্দর হচ্ছে মেয়েটা! একই বাবা-মার দুই মেয়ে-একজন এত সুন্দর আর অন্যজন অসুন্দর কেন? নীলু ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল।
‘আপা?’
‘কী?’
‘দারুন বই, তুমি পড়ে দেখ।’
‘প্রেমের?’
‘হ্যাঁ। প্রেমের হলেও খুব সিরিয়াস জিনিস। দারুণ!’
‘তাই নাকি?’
‘হুঁ, একজন খুব রুপবতী মেয়ের গল্প।’
‘তোর মতো একজন?’
‘দুর, আমি সুন্দর নাকি? আমাদের তিনতলার ভাড়াটের বৌটির মতো বলতে পার। রানু নাম, দেখেছ।’
‘না তো, খুব সুন্দরী?’
‘ওরে ব্বাপ, দারুণ! হেমা মালিনীর চেয়েও সুন্দরী।’
‘তুই মেয়েটিকে একবার আসতে বলিস তো আমাদের বাড়িতে! দেখব।’
‘বলব। তুমি নিজে একবার গেলেই পার। মেয়েটা ভালো। কথাবার্তায় খুব ভদ্র। ওর বরকে দেখেছ, আনিস সাহেব?’
‘হুঁ।
‘ঐ লোকটা বোকা ধরণের। বোকার মতো কথাবার্তা। আমাকে আপনি-আপনি করে বলে।
‘কলেজে পড়িস, তোকে আপনি বলবে না?’
‘ফ্রক-পরা কাউকে এ রকম এক জন বুড়ো মানুষ আপনি বলবে নাকি?’
‘বুড়ো নাকি?’
‘চল্লিশের ওপর বয়স হবে।’
‘মেয়েটার বয়স কত হবে?’
‘খুব কম। চৌদ-পনের বছর হবে।’
বিলু বাতি নিভিয়ে দিল এবং নিমিষেই ঘুমিয়ে পড়ল। নীলু জেগে রইল অনেক রাত পর্যন্ত। কিছুতেই তার ঘুম এল না। ইদানীং তার ঘুম খুব কমে গেছে। রোজই মাঝরাত না হওয়া অবধি ঘুম আসে না।
রানু চুলায় ভাত চড়িয়ে বসার ঘরে এসে দেখে বাড়িঅলার বড় মেয়েটি ঘরের ভেতর।
‘না জিজ্ঞেস করেই ঢুকে পড়লাম ভাই। আমার নাম নীলু।
‘আসুন, আসুন। আপনাকে আমি চিনি। আপনি বাড়িঅলার বড় মেয়ে। আজ ইউনিভার্সিটিতে যান নি?’
‘উঁহু। আজ ক্লাস নেই। আপনার সঙ্গে গল্প করতে এলাম। কী করছিলেন?’
‘ভাত রান্না করছি।’
‘চলুন, রান্নাঘরে গিয়ে বসি। বিলুর কাছ থেকে আপনার খুব প্রশংসা শুনি।
বিলুর ধারণা, আপনি হচ্ছেন হেমা মালিনী।
রানু অবাক হয়ে বলল, ‘হেমা মালিনীটি কে?’
‘আছে একজন। সিনেমা করে। সবাই বলে খুব সুন্দর। আমার কাছে সুন্দর লাগে না। চেহারাটা অহঙ্কারী।’
রানু মুখ টিপে হাসতে-হাসতে বলল, ‘সুন্দরী মেয়েরা তো অহঙ্কারীই হয়।’
‘আপনিও অহঙ্কারী?’
রানু হাসতে হাসতে বলল, ‘হ্যাঁ। কিন্তু আমাকে আপনি আপনি বলতে পারবেন না। তুমি করে বলতে হবে।
নীলু লক্ষ্য করল মেয়েটি বেশ রোগা কিন্তু সত্যিই রুপসী। সচরাচর দেখা যায় না। চোখ দুটি কপালের দিকে ওঠান বলে-দেবী প্রতিমার চোখের মতো লাগে। সমগ্র চেহারায় খুব সুক্ষ্ম হলেও কোথাও যেন একটি মূর্তি-মূর্তি ভাব আছে।
‘কী দেখছেন?’
‘তোমাকে দেখছি ভাই। তোমার চেহারায় একটা মূর্তি-মূর্তি ভাব আছে।’
রানু মুখ কালো করে ফেলল। নীলু অবাক হয়ে বলল, ‘ও কী! তুমি মনে হয় মন-খারাপ করলে?’
‘না, মন-খারাপ করব কেন?’
‘কিন্তু মুখ কালো করলে কেন? আমি কিন্তু কমপ্লিমেন্ট হিসেবে তোমাকে বলেছি। তোমার মতো সুন্দরী মেয়ে আমি খুব বেশি দেখি নি। তবে এক বার একটি বিহারি মেয়েকে দেখেছিলাম। আমার ছোটমামার বিয়েতে। অবশ্যি সে মেয়েটি তোমার মতো রোগা ছিল না। ওর স্বাস’্য বেশ ভালো ছিল।
‘আপনি কি একটু চা খাবেন?’
‘তুমি আমাকে আপনি করে বলছ কেন? তোমার কি মনে হয় আমার বয়স অনেক বেশি?’
‘না, তা মনে হয় না।’
‘তুমিও আমাকে তুমি বলবে। আর তোমার যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে আমি মাঝে-মাঝে তোমার কাছে আসব।’
রানু চায়ের কাপ সাজাতে সাজাতে মৃদু স্বরে বলল, ‘আমাকে মূতি-মূর্তি লাগে, এটা বললে কেন?
নীলু অবাক হয়ে বলল, ‘এমনি বলেছি! টানাটানা চোখ তো, সে জন্যে। তুমি দেখি ভাই রাগ করেছ।’
‘একটা কারণ আছে নীলু। তোমাকে এক দিন আমি সব বলব, তাহলেই বুঝবে। চায়ে কতটুকু চিনি খাও?’
‘তিন চামচ।’
নীলু অনেকক্ষণ বসল, কিন্তু কথাবার্তা আর তেমন জমল না। রানু কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। কিছুতেই মন লাগাতে পারছে না। সহজ হতে পারছে না। নীলু বেশ কয়েক বার অন্য প্রসঙ্গ আনতে চেষ্টা করল। ভাসা-ভাসা জবাব দিল রানু। এবং একসময় হালকা স্বরে বলল, ‘আমার একটা অসুখ আছে নীলু।’
‘কী অসুখ?’
‘মাঝে-মাঝে আমি ভয় পাই।’
‘ভয় পাই মানে?’
রানু মাথা নিচু করে বলল, ‘ছোট বেলায় একবার নদীতে গোসল করতে গিয়েছিলাম, তারপর থেকে এরকম হয়েছে।’
‘কী হয়েছে?’
রানু জবাব দিল না।
‘বল, কী হয়েছে?’
‘অন্য একদিন বলব। আজ তুমি তোমার কথা বল।’
‘আমার তো বলার মতো তেমন কথা নেই।’
‘তোমার বন্ধুদের কথা বল।’
‘আমার তেমন কোনো বন্ধুও নেই। আমি বলতে গেলে একা-একা থাকি। অসুন্দরী মেয়েদের বন্ধুটন্ধু থাকে না।
‘রঙ খারাপ হলে মানুষ অসুন্দর হয় না নীলু।’
‘আমি নিজে কী, সেটা আমি ভালোই জানি।’
নীলু উঠে পড়ল। রানু বলল, ‘আবার আসবে তো?’
‘আসব। তুমি তোমার ভয়ের কথাটথা কি বলছিলে, সেই সব বলবে।’
‘বলব।’
.
*****
.
নীলু পাঠাবে না পাঠাবে না করেও চিঠিটি পাঠিয়ে দিল, কিন্তু তার পরপরই দুশ্চিন্তার সীমা রইল না। কে জানে, বুড়ো-হাবরা লোকটি একদিন হয়তো বাসায় এসে হাজির হবে। দারুণ লজ্জার ব্যাপার হবে সেটা। নিতান্তই ছেলেমানুষি করা হয়েছে। চা-পাঁচদিন নীলুর খুব খারাপ কাটল। দারুণ অস্বস্তি। বুড়োমতো কোনো মানুষকে আসতে দেখলেই চমকে উঠত, এটিই সেই লোক নাকি? যদি সত্যি-সত্যি কেউ এসে পড়ে, তাহলে সে ভেবে রেখেছে বলবে-এই চিঠি তো আমার নয়। অন্য কেউ তামাশা করে এই ঠিকানা দিয়েছে। আমি এ রকম অজানা-অচেনা কাউকে চিঠি লিখি না।
কেউ অবশ্যি এল না। দেখতে-দেখতে এক সপ্তাহ কেটে গেল। চিঠিরও কোনো উত্তর নেই। লোকটি হয়তো চিঠি পায় নি। ডাকবিভাগের কল্যানে আজকাল তো বেশির ভাগ চিঠিই প্রাপকের হাতে পৌছায় না। এতে ক্ষতি যেমন হয়, লাভও তেমনি হয়। কিংবা হয়তো এমন হয়েছে, ঐ লোকটি অসংখ্য চিঠি পেয়ে পছন্দমতো চিঠিগুলোর উত্তর দিয়েছে। নীলুর তিন লাইনের চিঠি তার পছন্দ হয় নি। সে হয়তো লম্বা-লম্বা চমৎকার চিঠি পেয়েছে। ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেক কিছু লেখা সব চিঠিতে।
দশ দিনের মাথায় নীলুর কাছে চিঠি এসে পড়ল। খুবই দামী একটা খামে চমৎকার প্যাডের কাগজে চিঠি। গোটা-গোটা হাতের লেখা। কালির রঙ ঘন কালো। মাখন-রাঙা সে কাগজে লেখাগুলো মুক্তার মতো ফুটে আছে। এত সুন্দর হাতের লেখাও মানুষের হয়! চিঠিটি খুবই সংক্ষিপ্ত।
কল্যাণীয়াসু
তোমার চমৎকার চিঠি গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়েছি। একজন ব্যথিত
মানুষের আবেদনে তুমি সাড়া দিয়েছ-তোমাকে ধন্যবাদ। খুব সামান্য
একটি উপহার পাঠালাম। প্লীজ, নাও।
আহমেদ সাবেত
উপহারটি সামান্য নয়। অত্যন্ত দামী একটি পিওর পারফিউমের শিশি। নীলু ভেবে পেল না, এই লোকটি কি সবাইকে এ রকম একটি উপহার পাঠিয়েছে? যারাই চিঠির জবাব দিয়েছে তারাই পেয়েছে? কিন্তু তাও কি সম্ভব?
নাকি নীলু একাই চিঠির জবাব দিয়েছে? নীলুর বড় লজ্জা করতে লাগল। সে পারফিউমের শিশিটি লুকিয়ে রাখল এবং খুব চেষ্টা করতে লাগল সমস্ত ব্যাপার ভুলে যেতে। সে চিঠিটি কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলে দিল জানালা দিয়ে। কেন এমন একটা বাজে ঝামেলায় জড়াল?
কিন্তু দিন সাতেক পর নীল আবার একটি চিঠি লিখল। একটি বেশ দীর্ঘ চিঠি। সেখানে শেষের দিকে লেখা – আপনি কে, কী করেন-কিছুই তো জানা নি। আপনার বিজ্ঞাপনটিও দেখছি না। তার মানে কি এই যে আপনার নিঃসঙ্গতা এখন দূর হয়েছে?
নীলু বেশ কিছু দিন অপেক্ষা করল চিঠির জবাবের জন্যে, কিন্তু কোনো জবাব এল না। কেন জানি নীলুর বেশ মন-খারাপ হল। আরেকটি চিঠি লেখার ইচ্ছা হতে লাগল, কিন্তু তাও কি হয়? একা-একা সে শুধু চিঠি লিখবে? তার এত কী পড়েছে?
.
🔴 পাঁচ 🔴
.
দুপুর-রাতে আনিসের ঘুম ভেঙে গেল। হাত বাড়াল অভ্যেসমতো। পাশে কেউ নেই। আনিস ডাকল, ‘রানু, রানু।’ কোনো সাড়া নেই। বাথরুম থেকে একটানা পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে। বাথরুমে নাকি? আনিস উঁকি দিল বাথরুমে-কেউ নেই। কোথায় গেল! আনিস গলা উঁচিয়ে ডাকল, ‘রানু। বসার ঘর থেকে ক্ষীণ হাসির শব্দ এল। বসার ঘর অন্ধকার। রানু কি সেখানে একা-একা বসে আছে নাকি?
আনিস বসার ঘরে ঢুকে বাতি জ্বেলেই সঙ্গে-সঙ্গে বাতি নিভিয়ে ফেলল। রানু বসার ঘরে ছোট টেবিলে চুপচাপ বসে আছে। তার গায়ে কোনো কাপড় নেই।
‘এই রানু।’
‘উঁ।
‘কী হয়েছে? তোমার কাপড় কোথায়?’
‘খুলে ফেলেছি। বড্ড গরম লাগছে।’
আনিস এসে রানুর হাত ধরল। হিমশীতল হাত। একটু-একটু যেন কাঁপছে।
‘এস রানু, ঘুমুতে যাই।
‘আমার ঘুমুতে ইচ্ছে করছে না। তুমি যাও।’
‘কাল আমরা একজন ডাক্তারের কাছে যাব, কেমন?’
‘কেন?’
‘তোমার শরীর ভালো না রানু।’
‘আমার শরীর ভালোই আছে।’
‘না, তুমি খুব অসুস্থ। এস আমার সঙ্গে। কাপড় পরে ঘুমুতে এস।
রানু কোনো আপত্তি করল না। সঙ্গে-সঙ্গেই উঠে এল। কাপড় পরল এবং বাধ্য মেয়ের মতো বিছানায় শুয়ে প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল। জেগে রইল আনিস। রানুর শরীর দ্রুত খারাপ হচ্ছে। আগে তো এরকম কখনো হয় নি! মিসির আলি-টালি নয়, বড় কোনো ডাক্তারকে দেখানো দরকার।
খুটখুট করে শব্দ হচ্ছে রান্না ঘরে। ইঁদুরের উপদ্রব। তবু কেন জানি শব্দটা অন্য রকম মনে হচ্ছে। যেন কেউ হাঁটছে রান্নাঘরে। থপ্থপ্ শব্দও হলো কয়েক বার। আনিস বলল, ‘কে?’ রান্নাঘরের শব্দটা হঠাৎ থেমে গেল। আনিস বলল, ‘কে? কে?’ মনের ভুল নাকি? আনিস যেন স্পষ্ট শুনল, রান্নাঘর থেকে কেউ-এক জন বলল, ‘আমি।’ স্পষ্ট এবং তিক্ষ্ণ আওয়াজ। মেয়েলি স্বর। নাকি রানুই বলছে ঘুমের ঘোরে? এটাই হয়েছে। রানুরই গলা।
আনিস হাত বাড়িয়ে রানুকে কাছে টানল। রানু বলল, ‘হাতটা সরিয়ে নাও, গরম লাগছে।’ তার মানে কি রানু জেগেছিল এতক্ষণ?
‘রানু।’
‘উঁ।
‘তুমি জেগেছিলে?’
‘হ্যাঁ।
‘আমি যখন বললাম কে কে, তখন কি তুমি বলেছ, আমি?’
রানু চুপ করে রইল। আনিস বলল, ‘বল, বলেছ এ রকম কিছু?’
‘হ্যাঁ বলেছি।’
‘কিন্তু তুমি জবাব দিলে কেন? তোমাকে তো কিছু জিজ্ঞেস করি নি। আমি জানতে চাচ্ছিলাম রান্নাঘরে কেউ আছে কিনা?’
রানু ফিসফিস করে বলল, ‘আমি তো রান্নাঘরেই ছিলাম। আমি রান্নাঘর থেকেই জবাব দিয়েছি।’
আনিস চুপ করে গেল। বিছানায় উঠে বসে পরপর দুটি সিগারেট শেষ করল। বাথরুমে গিয়ে বাত জ্বালিয়ে রেখে এল। রান্নাঘরের বাতিও জ্বালিয়ে দিয়ে এল। থাকুক, সারা রাত বাতি জ্বালানো থাকুক।
‘রানু।’
‘কি?’
‘কাল তুমি আমার সঙ্গে একজন ডাক্তারের কাছে যাবে, কেমন?’
‘ঠিক আছে, যাব।’
‘ডাক্তার সাহেব যা-যা জানতে চান, সব বলবে।’
রানু জবাব দিল না। মনে হলো সে ঘুমিয়ে পড়েছে। শান্ত নির্বিঘ্ন ঘুম কিন্তু রান্নাঘরে আবার শব্দ হচ্ছে। আনিসের মনে হলো স্পষ্ট চুড়ির টুনটুন শব্দ শুনছে। কাঁচের চুড়ির আওয়াজ। আনিস কয়েকবার ডাকল, ‘কে, কে ওখানে?’ কেউ কোনো জবাব দিল না। বাথরুম থেকে একটানা জল পড়ার শব্দ আসছে। বাড়িঅলাকে বলতে হবে কল ঠিক করে দিতে। এক জন কাজের মানুষ রাখতে হবে। পুরুষমানুষ নয়, মেয়েমানুষ-সে রাত-দিন থাকবে। আত্নীয়স্বজন কাউকে এনে রাখলে ভালো হত। কিন্তু আনিসের তেমন কোনো আত্নীয়স্বজন নেই, যারা এখানে এসে থাকবে। আনিসের ঘুম এল শেষরাতের দিকে।
মিসির আলি সাহেবের সঙ্গে তারা প্রায় দুই ঘন্টা সময় কাটাল। রানু খুব সহজ-স্বাভাবিক আচরণ করল। এর প্রধান কৃতিত্ব সম্ভবত মিসির সাহেবের। তিনি খুব আন্তরিক ভঙ্গিতে কথাবার্তা বললেন। এক পর্যায়ে রানু বলল, ‘আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন, আমি আপনার মেয়ের বয়সী।’
‘মেয়ের বয়সী হলে হলে কী, আমার তো মেয়ে নেই। বিয়েই করি নি।’
রানু কিছু বলতে গিয়েও বলল না। ভদ্রলোক সেটি লক্ষ্য করলেন।
‘তুমি কিছু বলতে চাচ্ছিলে?’
‘জ্বি-না।’
‘কিছু বলতে চাইলে বলতে পার।’
‘না, আমি কিছু বলব না।’
মিসির আলি সাহেব চায়ের ব্যবসা করলেন। চা খেতে-খেতে নিতান্তই সহজ ভঙ্গিতে বললেন, ‘আনিস সাহেব বলেছিলেন, তুমি যা স্বপ্নে দেখ তা-ই সত্যি হয়।’
‘হুঁ।
‘যা স্বপ্নে দেখ তা-ই হয়?’
‘শুধুর স্বপ্ন না, যা আমার মনে আসে তা-ই হয়।’
‘বল কী!’
‘আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না, না?’
‘বিশ্বাস হবে না কেন? পৃথিবীতে অনেক অদ্ভুদ ব্যাপার আছে। পৃথিবীটা বড় অদ্ভুদ।’
বলতে-বলতে মিসির আলি ড্রয়ার খুলে চৌকা ধরণের চারটি কার্ড বের করলেন। হাসিমুখে বললেন,‘রানু, এই কার্ডগুলিতে ডিজাইন আঁকা আছে। আমি একেকটি টেবিলের ওপর রাখব, ডিজাইন গুলি থাকবে নিচে। তুমি না দেখে বলার চেষ্টা করবে।’
রানু অবাক হয়ে বলল, ‘না দেখে বলব কীভাবে?’
‘চেষ্টা করে দেখ। পারতেও তো পার। বল দেখি এই কার্ডটিতে কী আঁকা আছে?’
‘কী আশ্চর্য, কী করে বলব?’
‘আন্দাজ কর। যা মনে আসে তা-ই বল।’
‘একটা ক্রস চিহ্ন আছে। ঠিক হয়েছে?
‘তা বলব না। এবার বল এটিতে কী আছে?’
‘খুব ছোট-ছোট সার্কেল।’
‘ক’টি, বলতে পারবে?’
‘মনে হচ্ছে তিনটি। চারটিও হতে পারে।’
মিসির সাহেব কার্ডগুলো ড্রয়ারে রেখে সিগারেট ধরালেন। তাঁকে কেমন যেন চিন্তিত মনে হতে লাগল। আনিস বলল, ‘ও কি বলতে পেরেছে?’ মিসির সাহেব তার জবাব না-দিয়ে বললেন, ‘রানু, এবার তুমি বল, প্রথম ভয়টা তুমি কীভাবে পেলে। সবকিছু বলবে, কিছুই বাদ দেবে না। আমি তোমাকে সাহায্য করতে চেষ্টা করছি।’
রানু চুপ করে রইল।
‘তুমি নিশ্চই চাও, অসুখটা সেরে যাক। চাও না?’
‘চাই।’
‘তাহলে বল। কোনোকিছু বাদ দেবে না।’
রানু তাকাল আনিসের দিকে। মিসির আলি বললেন, ‘আনিস সাহেব, আপনি না হয় পাশের ঘরে গিয়ে বসেন। ঐ ঘরে অনেক বইপত্র আছে, বসে-বসে পড়তে থাকুন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির কারেন্ট ইস্যুটা আছে, গতকালই এসেছে।’
রানু বলতে শুরু করল। মিসির আলি শুনতে লাগলেন চোখ বন্ধ করে। একটি প্রশ্নও জিজ্ঞেস করলেন না। মাঝখানে একবার শুধু বললেন, ‘পানি খাবে? তৃষ্ণা পেয়েছে?’ রানু মাথা নাড়ল। তিনি পানির জগ এবং গ্লাস নিয়ে এলেন। শান্ত স্বরে বললেন, ‘চোখে-মুখে পানি দিয়ে নাও, ভালো লাগবে।’ রানু সে সব কিছুই করল না। শান্ত ভঙ্গিতে বসে রইল। কথা বলতে লাগল স্পষ্ট স্বরে।
.
[ রানুর প্রথম গল্প ]
.
আমার বয়স তখন মাত্র এগার-বার বৎসর। আমি মধুপুরে আমার এক চাচার বাড়িতে বেড়াতে গেছি। চাচাতো বোনের বিয়েতে। চাচাতো বোনটির নাম হচেছ অনুফা। খুবই ভালো মেয়ে, কিন্তু চাচা বিয়ে ঠিক করেছেন একটা বাজে ছেলের সঙ্গে। ছেলের প্রচুর জায়গাটায়গা আছে, কিন্তু কিছুই করে না। দেখতেও বাজে, দাঁত উঁচু, মুখে বসন্তের দাগ। দারুণ বেঁটে। অনুফা আপার এই নিয়ে খুব মন-খারাপ। প্রায়ই এই নিয়ে কাঁদে। আমি তাকে সান্ত্বনাটান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করি। কিন্তু আমি নিজে একটা বাচ্চা মেয়ে, তাকে কী সান্ত্বনা দেব? তবে আমার সঙ্গে অনুফা আপার খুব ভাব ছিল। আমাকে অনেক গোপন কথাটথা বলত।
যাই হোক, গায়ে হলুদের দিন খুব রঙ খেলা হলো। আমাদের ওদিকে রঙ খেলা হচ্ছে-উঠোনে কাদা ফেলে তাতে গড়াগড়ি খাওয়া। সারা দিন রঙ খেলে কাদা মেখে সবাই ভূত হয়ে গেছি। ঠিক করা হলো সবাই মিলে নদীতে গোসল সেরে আসবে। চাচা অবশ্যি আপত্তি করলেন-মেয়েছেলেরা নদীতে যাবে কী?
চাচার আপত্তি অবশ্যি টিকল না। আমরা মেয়েরা সবাই দল বেঁধে নদীতে গোসল করতে গেলাম। বাড়ি থেকে অল্প কিছু দূরেই নদী। আমরা প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ জন মেয়ে, খুব হৈচৈ হচ্ছে। সবাই মিলে মহানন্দে পানিতে ঝাঁপাঝাঁপি করছি। সেখানেও খুব কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু হলো। ঠিক তখন একটা কান্ড হলো, মনে হলো একজন কে যেন আমার পা জড়িয়ে ধরেছে। নির্ঘাত কেউ তামাশা করছে। আমি হাসতে-হাসতে বললাম-এ্যাই, ভালো হবে না। ছাড় বলছি, ছাড়। কিন্তু যে পা ধরেছে সে ছাড়ল না, হঠাৎ মনে হলো সে টেনে আমার পায়জামাটা খুলে ফেলতে চেষ্টা করছে। তখন আমি চিৎকার দিলাম। সবাই মনে করল কোনো-তামাশা হচ্ছে। কেউ কাছে এল না, কিন্তু ততক্ষণে আমার পায়জামাটা খুলে ফেলেছে আর, আর…..।
[এই সময় মিসির সাহেব বললেন, ‘বুঝতে পারছি তারপর কী হলো।’]
সবার প্রথম অনুফা আপা ছুটে এসে আমাকে ধরলেন, তারপর অন্যরা ছুটে এল। যে আমার পা জড়িয়ে ধরেছিল, সে আমাকে শক্ত করে চেপে ধরে গভীর জলের দিকে টেনে নিতে লাগল। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান হবার পর শুনেছি ওরা আমাকে বহু কষ্টে টেনে পাড়ে তুলেছে এবং দেখেছে একটা মরা মানুষ আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ঐ মরা মানুষটাকে গ্রামের লোকেরা নদীর পাড়ে চাপা মাটি দিয়েছিল। সেইসব কিছুই অবশ্যি আমি দেখি নি, শুনেছি। কারণ আমার কোনো জ্ঞান ছিল না। চাচা আমার চিকিৎসার জন্যে আমাকে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন। সবাই ধরে নিয়েছিল আমি বাঁচব না, কিন্তু বেঁচে গেলাম। এইটুকু আমার প্রথম ভয়ের গল্প।
রানু গল্প শেষ করে পুরো একগ্লাস পানি খেল। মিসির আলি সাহেব বললেন, ‘ঐ লোককে তুমি দেখ নি।?’
‘জ্বি-না।’
মিসির আলি সাহেব সিগারেট ধরিয়ে নিচু গলায় বললেন, ‘আমার কেন জানি মনে হচ্ছে কোনো একটি জিনিস তুমি আমাকে বল নি। কিছু একটা বাদ দিয়ে গেছ।’
রানু জবাব দিল না।
‘যে জিনিসটা বাদ দিয়েছ, সেটা আমার শোনা দরকার। সেটা কী, বলবে?’
‘অন্য আরেক দিন বলব।’
‘ঠিক আছে, অন্য এক দিন শুনব। তোমাকে আসতে হবে না, আমি গিয়ে শুনে আসব।’
রানু কিছু বলল না। মিসির আলি সাহেব কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে থেকে হঠাৎ বললেন, ‘যখন তুমি একা থাক, তখন কি কেউ তোমার সঙ্গে কথা বলে?’
‘হ্যাঁ।’
মিসির আলি খুব উৎসাহ বোধ করলেন।
‘ব্যাপারটা গুছিয়ে বল।’
‘মাঝে-মাঝে কে যেন আমাকে নাম ধরে ডাকে।’
‘পুরুষের গলায়?’
‘জ্বি-না। মেয়েদের গলায়।’
‘শুধু ডাকে, অন্য কিছু বলে না?’
‘জ্বি-না।’
‘এবং যে ডাকে তাকে কখনো দেখা যায় না?’
‘জ্বি-না।
‘এটা প্রথম কখন হয়? অর্থাৎ প্রথম কখন শুনলে? নদীর ব্যাপারটা ঘটার আগেই?’
‘হুঁ।
‘কত দিন আগে?’
‘আমার ঠিক মনে নেই।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, আজ এ পর্যন্তই।’
রানুরা উঠে দাঁড়াল। মিসির আলি ভারি গলায় বললেন, ‘আবার দেখা হবে।’
রানু কিছু বলল না। আনিস বলল, ‘আমরা তাহলে যাই।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
মিসির আলি ওদের রিকসা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলেন। ওরা রিকসায় উঠবার সময় তিনি হঠাৎ বললেন, ‘রানু, তোমার পা যে জড়িয়ে ধরেছিল, ওর নাম কী?’
‘ওর নাম জালালউদ্দিন।’
‘কি করে জানলে ওর নাম জালালউদ্দিন?’
রানু তাকিয়ে রইল, কিছু বলল না। মিসির আলি সাহেব বললেন, ‘ঠিক আছে, পরে কথা হবে।’
রিকসায় ওরা দুই জনে কোনো কথা বলল না। আনিসের এক বার মনে হলো, রানু কাঁদছে। সে সিগারেট ধরিয়ে সহজ স্বরে বলল, ‘ভদ্রলোককে তোমার কেমন লাগল রানু?’
‘ভালো। বেশ ভালো লোক। উনি আসলে কী করেন?’
‘উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পার্ট-টাইম টীচার। ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রি পড়ান। খুব জ্ঞানী লোক।’
‘ইউনিভার্সিটির টীচাররা এমন রোগা হয়, তা তো জানতাম না! আমার ধারণা ছিল তাঁরা খুব মোটাসোটা হন।’
রানু শব্দ করে হাসল। আনিস বলল, ‘আজ বাইরে খাওয়া-দাওয়া করলে কেমন হয়?’
‘শুধু-শুধু টাকা খরচ।’
‘তোমার গিয়ে রান্না চড়াতে হবে না। চল না, কিছু পয়সা খরচ হোক।’
‘কোথায় খাবে?’
‘আছে আমার একটা চেনা জায়গা। নানরুটি আর কাবাব। কি বল?’
.
🔴 ছয় 🔴
.
মিসির আলি সাহেব দেখলেন তাঁর ঘরের সামনে চারটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো টিউটোরিয়েল ক্লাস আছে নাকি? আজ বুধবার, টিউটোরিয়েল ক্লাস থাকার কথা নয়। তবে কে জানে হয়তো নতুন রুটিন দিয়েছে। তিনি এখনো নোটিস পান নি।
‘এই, তোমাদের কী ব্যাপার?’
মেয়েগুলো জড়সড় হয়ে গেল।
‘কি, তোমাদের সঙ্গে কোনো ক্লাস আছে?’
‘জ্বি-না স্যার।
‘তাহলে কি? কিছু বলবে?’
‘স্যার নোটিস-বোর্ডে আপনি একটা নোটিস দিয়েছিলেন, সেই জন্যে এসেছি।
‘কিসের নোটিস?’
তিনি ভুরু কোঁচকালেন। মেয়েগুলো মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।
‘কী নোটিস দিয়েছিলাম?’
‘স্যার, আপনি লিখেছেন-কারো এক্সট্রাসেপ্সরি পারসেপশনের ক্ষমতা আছে কি না আপনি পরীক্ষা করে বলে দেবেন।
মিসির আলি সাহেবের সমস্ত ব্যাপারটা মনে পড়ল। মাস দুয়েক আগে এ রকম একটা নোটিস দিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু এই প্রথম চার জনকে পাওয়া গেল, যারা উৎসাহী এবং সব ক’টি মেয়ে। মেয়েগুলো রোগা। তার মানে কি অকল্টের ব্যাপারে রোগা মেয়েরাই বেশি উৎসাহী? তিনি মনে-মনে একটা নোট তৈরি করলেন এবং তৎক্ষণাৎ তাঁর মনে হলো বিষয়টি ইন্টারেস্টিং। একটা সার্ভে করা যেতে পারে।
‘এস তোমরা। ঘরে এস। তোমরা তাহলে জানতে চাও তোমাদের ইএসপি আছে কি না?’
মেয়েগুলো কথা বলল না। যেন একটু ভয় পাচ্ছে। মুখ সবারই শুকনো।
‘বস তোমরা। চেয়ারে আরাম করে বস।’
ওরা বসল। মিসির আলি সাহেব একটা সিগারেট ধরালেন। নিচু গলায় বললেন, ‘সব মানুষের মধ্যেই ইএসপি কিছু পরিমাণে থাকে। টেলিপ্যাথির কথাই ধর। তোমাদের নিজেদেরই হয়তো এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে। সহজ উদাহরণ হচ্ছে, ধর, এক দিন তোমাদের কারো মনে হলো অমুকের সাথে দেখা হবে। যার সঙ্গে দেখা হবার কথা মনে হচ্ছে, সে কিন্তু এখানে থাকে না। থাকে চিটাগাং। কিন্তু সত্যি-সত্যি দেখা হয়ে গেল। কি, হয় না এ রকম?’
মেয়েগুলো কিছু বলল না। এর মধ্যে এক জন রুমাল দিয়ে কপাল মুছতে লাগল। মেয়েটি ঘামছে। নার্ভাস হয়ে পড়ছে মনে হয়। নিশ্চয়ই ব্ল্যাড-প্রেশার বেড়ে গেছে। মিসি আলি বিস্মিত হলেন। নার্ভাস মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই বিষয়ে চর্চা এখনো বিজ্ঞানের পর্যায়ে পড়ে না। বেশির ভাগ সিদ্ধান্তই অনুমানের ওপর। তবে আমেরিকায় একটি ইউনিভার্সিটি আছে-ডিউক ইউনিভার্সিটি। ওরা কিছু-কিছু এক্মপেরিমেন্টাল কাজ শুরু করেছে। মুশকিল হচ্ছে, ফলাফল সবসময় রিপ্রডিউসিবল নয়।’
মিসির আলি সাহেব ড্রয়ার খুলে দশটি চৌকো কার্ড টেবিলে বিছালেন। হাসিমুখে বললেন,‘পরীক্ষাটি খুব সহজ। এই কার্ডগুলোতে বিভিন্ন রকম চিহ্ন আছে। যেমন ধর ক্রস, স্কয়ার, ত্রিভুজ, বিন্দু। কোনটিতে কী আছে সেটা অনুমান করতে চেষ্টা করবে। দুই এক বার কাকতালীয়ভাবে মিলে যাবে। তবে ফলাফল যদি স্ট্যাটিসটিক্যালি সিগফিকেন্ট হয়, বুঝতে হবে তোমাদের ইএসপি আছে। এখন এস দেখি, কে প্রথম বলবে? তোমার নাম কী নাম?’
‘নীলুফার।’
‘হ্যাঁ নীলুফার, তুমিই প্রথম চেষ্টা কর। যা মনে আসে তা-ই বল।’
‘আমার কিছু মনে আসছে না।’
‘তাহলে অনুমান করে বল।’
মেয়েটি ঠিকমতো বলতে পারল না। তার সঙ্গীরাও না। মিসির আলি হাসতে-হাসতে বললেন,‘নাহ্, তোমাদের কারো কোনো ইএসপি নেই।’ ওরা যেন তাতে খুশিই হলো। মিসির আলি গম্ভীর গলায় বললেন,‘আধুনিক মানুষদের এসব না থাকতে নেই। এতে অনেক রকম জটিলতা হয়।’
‘কী জটিলতা?’
‘আছে, আছে।’
‘বলুন না স্যার।’
মিসির আলি লক্ষ্য করলেন, নীলুফার নামের মেয়েটিই কথা বলছে। স্পষ্ট সতেজ গলা।
‘অন্য আরেক দিন বলব। আজ তোমরা যাও।’
নীলুফার বলল, ‘এমন কিছু কি আছে স্যার, যা করলে ইএসপি হয়?’
‘লোকজন বলে, প্রেমে পড়লেও এই ক্ষমতাটা অসম্ভব বেড়ে যায়। আমি ঠিক জানি না। তোমরা যদি কেউ কখনো প্রেমে পড়, তাহলে এস, পরীক্ষা করে দেখব।’
কথাটা বলেই মিসির আলি অপ্রস্তুত বোধ করলেন। ছাত্রীদের এটা বলা ঠিক হয় নি। কথাবার্তায় তার আরো সাবধান হওয়া উচিত। এ রকম হালকা ভঙ্গিতে কথা বলা ঠিক হচ্ছে না।
‘স্যার, আমরা যাই?’
‘আচ্ছা্ ঠিক আছে, দেখা হবে।’
মিসির আলি নিজের টীচার্স লাউঞ্জে চা খেতে এলেন। বেলা প্রায় তিনটা। লাউঞ্জে লোকজন নেই। পলিটিক্যাল সায়েন্সের রশিদ সাহেব এক কোণায় বসেছিলেন। তিনি অস্পষ্ট স্বরে বললেন, ‘মিসির সাহেব, অনেক দিন পর মনে হয় এলেন এদিকে। চা খাবেন?’
‘কে যেন বলছিল, আপনি নাকি ভূতে-ধরা সারাতে পারেন। ঠিক নাকি?’
‘জ্বি-না। আমি ওঝা নই।’
‘রাগ করলেন নাকি? আমি কথার কথা বললাম।’
‘না, রাগ করব কেন?’
‘আচ্ছা মিসির আলি সাহেব, আপনি ভূত বিশ্বাস করেন?’
‘না।’
রশিদ সাহেব উৎসাহিত হয়ে উঠলেন।
‘আত্মা, আত্মায় বিশ্বাস করেন?’
‘না ভাই, আমি একজন নাস্তিক।’
‘আত্মা নেই-এই জিনিসটা কি প্রমাণ করতে পারবেন? কী কী যুক্তি আছে আপনার হাতে?’
মিসির আলি একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। রশিদ সাহেব বললেন, ‘আত্মা যে আছে, এর পক্ষে বিজ্ঞানীদের কিছু চমৎকার যুক্তি আছে।’
‘থাকলে তো ভালোই। বিজ্ঞানীরা জড়জগৎ বাদ দিয়ে আত্মাটাত্মা নিয়ে উৎসাহী হলেই কিন্তু ঝামেলা। রশিদ সাহেব, আমার মাথা ধরেছে। এ নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। কিছু মনে করবেন না।’
মিসির আলি চা না খেয়েই উঠে পড়লেন। তাঁর সত্যি-সত্যি মাথা ধরেছে। প্রচন্ড ব্যথা। বড় রকমের কোনো অসুখের পূর্বলক্ষণ।
.
🔴 সাত 🔴
.
নীলু ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে এসে দেখে তার বিছানার উপর চমৎকার একটি প্যাকেট পড়ে আছে। ব্রাউন কাগজে মোড়া প্যাকেটে গোটা-গোটা করে তার নাম লেখা। নীলুর বুক কেঁপে উঠল, বিলুর চোখে পড়ে নি তো? বিলুর খুব খারাপ অভ্যাস আছে, অন্যের চিঠি খুলে-খুলে পড়বে। হাসাহাসি করবে। নীলু দরজা বন্ধ করেই প্যাকেটটি খুলল। ছোট্ট চিঠি, কিন্তু কী চমৎকার করেই না লেখা:
কল্যাণীয়াসু,
ইচ্ছা করেই তোমাকে আমি কম লিখি। তোমার চিঠি পড়ে-পড়ে খুব
মায়া জন্মে যায়। এ বয়সে আমার মায়া বাড়াতে ইচ্ছা করে না।
মায়া বাড়ালেই কষ্ট পেতে হয়। আরেকটি সামান্য উপহার পাঠালাম।
গ্রহণ করলে খুব খুশি হব।
আহমেদ সাবেত
উপহারটি বড় সুন্দর! নীল রঙের একটি ডায়েরি। অসম্ভব নরম প্লাষ্টিকের কভার, যেখানে ছোট্ট একটি শিশুর ছবি। পাতাগুলো হালকা গোলাপী। প্রতিটি পাতায় সুন্দর-সুন্দর দুই লাইনের কবিতা। ডায়েরিটির প্রথম পাতায় ইংরেজিতে লেখাঃ
‘I wish I could be eighteen again’
– A.S.
পড়তে গিয়ে কেন জানি নীলুর চোখে জল এল। এক জন সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা মানুষের জন্যে মন কেমন করতে লাগল। লোকটি দেখতে কেমন কে জানে? সুন্দর নয় নিশ্চয়ই। বয়স্ক মানুষ, হয়তো চুলটুল পেকে গেছে। তাতে কিছু যায় আসে না। মানুষের বয়স হচ্ছে তার মনে। মন যত দিন কাঁচা থাকে, তত দিন মানুষের বয়স বাড়ে না। এই লোকটির মন অসম্ভব নরম। শিশুর মতো নরম। নীলুর মনে হলো এই লোকটি স্বামী হিসেবে অসাধারণ ছিল। তার স্ত্রীকে নিশ্চয়ই সমস্ত হৃদয় দিয়ে ভালোবেসেছে।
নীলু রাতের বেলা দরজা বন্ধ করে দীর্ঘ একটা চিঠি লিখল-আপনি এমন কেন? নিজের কথা তো কিছুই লেখেন নি! অথচ আমি আমার সমস্ত কথা লিখে বসে আছি। তবু মনে হয় সব বুঝি লেখা হলো না। অনেক কিছু বুঝি বাকি রয়ে গেল। আপনি আমাকে এত সুন্দর-সুন্দর উপহার দিয়েছেন, কিন্তু আমি তো আপনাকে কিছুই দিই নি। আমার কিছু-একটা দিতে ইচ্ছা করে, কিন্তু আমি তো জানি না আপনি কী পছন্দ করেন। আচ্ছা, আপনি কী টাই পড়েন? তাহলে লাল টকটকে একটা টাই আপনাকে দিতে পারি। জানেন, পুরুষমানুষের এই একটি জিনিস আমি পছন্দ করি। কিন্তু হয়তো আপনি টাই পরেন না, ঢিলেঢালা ধরণের মানুষদের মতো চাদর গায়ে দেন। আপনার সম্পর্কে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। এক দিন আসুন না আমাদের বাসায়, এক কাপ চা খেয়ে যাবেন। জানেন, আমি খুব ভালো চা বানাতে পারি। অন্য কেউ চা বানিয়ে দিলে আমার বাবা খেতে পারেন না। সব সময় আমাকে বানাতে হয়। গত রোববারে কী হলো, জানেন? রাত তিনটেয় বাবা আমাকে ডেকে তুললেন-মা, এক কাপ চা বানা তো, বড্ড চায়ের তৃষ্ণা পেয়েছে।
‘আপা, দরজা বন্ধ করে কী করছ?’
নীল অপ্রস্তুত হয়ে দরজা খুলল। বিলু দাঁড়িয়ে আছে। সন্দেহজনকভাবে তাকাচ্ছে।
‘কী করছিলে?’
‘কিছু করছিলাম না।’
বিলু বিছানায় এসে বসল, ‘আপা,তোমার মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছি।’
‘কী পরিবর্তন?’
‘অস্থির-অস্থির ভাব। লক্ষণ ভালো না আপা। বল তো কী হয়েছে।?’
‘কী আবার হবে? তোর শুধু উল্টোপাল্টা কথা।’
‘কিছু-একটা হয়েছে আপা। আমি জানি।’
‘কী যে বলিস!’
‘আমার কাছে লুকোতে পারবে না আপা। আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া মুশকিল।’
‘যা ভাগ, পাকামো করিস না।’
বিলু গেল না। কাপড় ছাড়তে-ছাড়তে বলল, ‘রানু আপাকেও বললাম তোমার পরিবর্তনের কথা। তারও ধারণা, তুমি কারো প্রেমে পড়েছ।’
‘হুঁ, আমার খেয়েদেয়ে কাজ নেই। তা ছাড়া প্রেমটা আমার সঙ্গে করবে কে? চেহারার এই তো অবস্থা।’
‘খারাপ অবস্থাটা কী? রঙটা একটু ময়লা। এ ছাড়া আর কি?’
নীলু ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল।
‘নিঃশ্বাস ফেললে কেন আপা? নিজের চেহারা সম্পর্কে তোমার এমন খারাপ ধারণা থাকা উচিত নয়।’
‘উচিত নয় কেন?’
‘সুন্দরী মেয়েদের অনেক রকম প্রবলেম থাকে।’
‘কী প্রবলেম?’
‘রানু আপার মাথা খারাপ-সেটা তুমি জান?’
‘কী বলছিস এসব!’
‘ঠিকই বলছি। আকবরের মা একদিন দুপুরে কি জন্যে যেন গিয়েছিল, শোনে রানু আপা নিজের মনে হাসছে এবং কথা বলছে।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ। কথাগুলো বলছে আবার দুই রকম গলায়। আকবরের মা প্রথম ভেবেছিল কেউ বোধহয় বেড়াতে এসেছে। শেষে ঘরে ঢুকে দেখে কেউ নেই।’
‘সত্যি?’
‘হুঁ। রহমান সাহেবের স্ত্রী বললেন, একদিন নাকি আনিস সাহেব গভীর রাতে রহমান সাহেবকে ডেকে নিয়ে গেলেন তাঁর স্ত্রীর খুব অসুখ, এই কথা বলে। রহমান সাহেব গিয়ে দেখেন অসুখটসুখ কিচ্ছু নেই, দিব্যি ভালো মানুষ।’
নীলু মৃদু স্বরে বলল, ‘রানুর মতো সুন্দরী হলে আমি পাগল হতেও রাজি।’
বিলু হেসে ফেলল। হাসতে-হাসতে বলল, ‘কথাটা ঠিক বলেছ আপা।’
.
🔴 আট 🔴
.
রানু প্রসঙ্গে পাওয়া সব তথ্য লিখে রাখবার জন্যে মিসির আলি সাহেব মোটা একটা খাতা কিনে এনেছেন। খাতাটির প্রথম পাতায় লেখ-
‘এক জন মানসিক রুগীর পর্যায়ক্রমিক মনোবিশ্লেষণ।’ দ্বিতীয় পাতায় কিছু ব্যক্তিগত তথ্য। যেমন-
নাম : রানু আহমেদ।
বয়স : সতের বৎসর (রুপবতী)।
বৈবাহিক অবস্থা : বিবাহিত। (তের মাস আগে বিয়ে হয়)।
স্বাস্থ্য : রুগ্ন।
ওজন : আশি পাউন্ড।
স্বামী : আনিস আহমেদ। দি জেনিথ ইন্টারন্যাশনালের ডিউটি অফিসার। বয়স ৩৭। স্বাস্থ্য ভালো। তৃতীয় পাতার হেডিংটি হচ্ছে-‘অডিটরি হেলুসিনেশন’। এর নিচে লাল কালি দিয়ে একটি বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন আঁকা। এই পাতায় অনেক কিছুই লেখা হয়েছে, আবার কাটাকুটি করা হয়েছে। যেন মিসির আলি সাহেব মনস্থির করতে পারছেন না কী লিখবেন। দুটি লাইন শুধু পড়া যায়। লাইন দুটির নিচে লাল কালি দিয়ে দাগ দেয়া।
‘মেয়েটি অডিটরি হেলুসিনেশন হচেছ: সে একা থাকাকালীন শুনতে পায় কেউ যেন তাকে ডাকছে।’
পরের কয়েকটি পাতায় রানুর সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের খুঁটিনাটি প্রতিটি বিষয় লেখা। এ পাতাগুলো পড়লেই বোঝা যায়, মিসির আলি নামের এই লোকটির স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। অতি তুচ্ছ ব্যাপারগুলোও লেখা আছে। যেমন, এক জায়গায় লেখা-মেয়েটি বেশ কয়েকবার শাড়ীর আঁচল টেনেছে। দুই বার শব্দ করে আঙুল ফুটিয়েছে। আমি লক্ষ্য করলাম মেয়েটি পানি খেল মাথা নিচু করে। বেশ খানিকটা নিচু করে। যেন পানি পান করার ব্যাপারটি সে আড়াল করতে চায়।
নদীতে গোসলের গল্পটি লেখা আছে। গল্পের শেষে বেশ কিছু প্রশ্ন করা আছে। যেমন-
– একজন মৃত মানুষ পানিতে ভেসে থাকবে। ডুবে থাকবে না। গল্পে মৃত মানুষটির ডুবে-ডুবে চলার কথা আছে। এ রকম থাকার কথা নয়।
– পাজামা খুলে ফেলার কথা আছে। কিশোরীরা সাধারণত শক্ত গিট দিয়ে পাজামা পরে। গিট খুলতে হলে ফিতা টানতে হবে। ঐ মানুষটি কি ফিতা টেনেছিল, না পাজামাটাই টেনে নামিয়েছে?
– তার আনুমানিক বয়স কত ছিল?
– প্রথম অসুস্থতার সময় কি মেয়েটি ঘুমের মধ্যে কোনো কথাবার্তা বলত? কী বলত?
– মেয়েটি বলল, লোকটির নাম জালাল উদ্দিন। কীভাবে বলল? লোকটির নাম তো জানার কথা নয়। নাকি পরে শুনেছে?
– জালালউদ্দিন-জাতীয় নামের কারো সঙ্গে কি এই মেয়েটির পূর্বপরিচয় ছিল?
প্রশ্ন শেষে তিনটি মন্তব্য লেখা আছে। মন্তব্যগুলো সংক্ষিপ্ত। প্রথম মন্তব্য-মেয়েটি যে ঘটনার কথা বলছে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। দ্বিতীয় মন্তব্য- এই ঘটনা অন্য যেসব ব্যক্তি প্রত্যক্ষ করেছে তাদের সঙ্গে প্রথমে আলাপ করতে হবে। দ্বিতীয় মন্তব্যটি লাল কালি দিয়ে আন্ডারলাইন করা ও পাশে লেখা-অত্যন্ত জরুরি। তৃতীয় মন্তব্য-মেয়েটির অবশ্যই কিছু পরিমাণ এক্সট্রান্সেরি পারসেপশন আছে। সে কার্ডের সব ক’টি চিহ্ন সঠিকভাবে বলতে পেরেছে। আমি এ রকম আগে কখনো দেখি নি। এই বিষয়ে আমার ধারণা হচ্ছে, মানসিকভাবে অসুস্থ রুগীদের এই দিকটি উন্নত হয়ে থাকে। আমি এর আগেও যে ক’টি অসুস্থ মানুষ দেখেছি, তাদের সবার মধ্যেই এই ক্ষমতাটি কিছু পরিমাণে লক্ষ্য করেছি। দি জার্নাল অব প্যারাসাইকোলজির তৃতীয় ভল্যুমে(১৯৭৩) এই প্রসঙ্গে রিভিউ পেপার আছে। অথর জন নান এবং এফ টলম্যান।
.
*******
.
সোহাগী হাইস্কুলের হেডমাষ্টার সাহেব দারুণ অবাক হলেন। রানুর ব্যাপারে খোঁজখবর করার জন্যে এক ভদ্রলোক এসেছেন-এর মানে কী? অতো দিন আগে কী হয়েছিল, না-হয়েছিল, তা কি এখন আর কারো মনে আছে? আর মনে থাকলেও এইসব ব্যাপার নিয়ে এখন ঘাঁটাঘাঁটি করাটা বোধহয় ঠিক নয়। কিন্তু যে ভদ্রলোক এসেছেন, তাঁকে মুখের ওপর না বলতেও বাধছে। ভদ্রলোক হাজার হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন শিক্ষক। মানী লোক। তা ছাড়া এত দূর এসেছেন, নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। মুখে বলছেন রানু অসুস্থ এবং তিনি রানুর এক জন চিকিৎসক, কিন্তু এটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। কারণ মাস খানেক আগেই রানুকে তিনি দেখে এসেছেন। কিছুমাত্র অসুস্থ মনে হয় নি। আজ হঠাৎ এমন কি হয়েছে যে ঢাকা থেকে এই ভদ্রলোককে আসতে হলো?
‘রানুর কী হয়েছে বলবেন?’
‘মানসিকভাবে অসুস্থ।’
‘আমি তো সেদিনই তাকে দেখে এলাম।’
‘যখন দেখেছেন তখন হয়তো সুস্থই ছিল।’
‘কী জানতে আপনি, বলেন।’
‘নদীতে গোসলের সময় কী ঘটেছিল, সেটা বলেন?’
‘সে সব কি আর এখন মনে আছ্ে?’
‘ঘটনাটা বেশ সিরিয়াস এবং নিশ্চয়ই আপনাদের মধ্যে বহু বার আলোচিত হয়েছে, কাজেই মনে থাকার কথা। আপনার যা মনে আসে তাই বলেন।’
হেডমাস্টার গম্ভীর স্বরে ঘটনাটা বললেন। রানুর গল্পের সঙ্গে তাঁর গল্পের কোনো অমিল লক্ষ্য করা গেল না। শুধু ভদ্রলোক বললেন, ‘মেয়েরা গোসল করতে গিয়েছিল দুপুরে, সন্ধ্যায় নয়।’
‘পায়জামা খোলার ব্যাপারটি বলেন। পায়জামাটা কি পাওয়া গিয়েছিল?’
‘আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছি না।’
‘রানু বলছিল, নদীতে গোসল করবার সময় সেই মরা মানুষটি তার পায়জামা খুলে ফেলে।’
‘আরে না না, কী বলেন!’
‘ওর পরনে পায়জামা ছিল?’
‘হ্যাঁ, থাকবে না কেন?’
‘আপনার ঠিক মনে আছে তো?’
‘মনে থাকবে না কেন? পরিষ্কার মনে আছে। আপনি অন্য সবাইকেও জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।’
‘ঐ মরা মানুষটি সম্পর্কে জানেন?’
‘কিছুই জানি না রে ভাই। থানায় খবর দিয়েছিলাম। থানা হচ্ছে এখান থেকে দশ মাইল। সেই সময় যোগাযোগ ব্যবসা ভালো ছিল না। থানাঅলারা আসে দুই দিন পরে। লাশ তখন পচে-গলে গিয়েছে। শিয়াল-কুকুর কামড়াকামড়ি করছে। থানাঅলারা এসে আমাদের লাশ পুঁতে ফেলতে বলে। আমরা নদীর ধারেই গর্ত করে পুঁতে ফেলি।
‘আচ্ছা, ঐ লাশটি তো উলঙ্গ ছিল, ঠিক না?’
‘জ্বি-না, ঠিক না। হলুদ রঙের একটা প্যান্ট ছিল আর গায়ে গেঞ্জি ছিল।’
মিসির আলি সাহেবের ভ্রু কুঞ্চিত হলো।
‘আপনার ঠিক মনে আছে তো ভাই?’
‘আরে, এটা মনে না-থাকার কোনো কারণ আছে? পরিষ্কার মনে আছে।’
‘লাশটি কি বুড়ো মানুষের ছিল?’
‘জ্বি-না, জোয়ান মানুষের লাশ।’
‘আর কিছু মনে পড়ে?’
‘আর তো কিছু নেই মনে পড়ার।’
‘আপনার ঐ মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে চাই, অনুফা যার নাম। শুনেছি ওর শ্বশুরবাড়ি কাছেই।’
‘হরিণঘাটায়। আপনি যেতে চান হরিণঘাটা?’
‘জ্বি।’
‘কখন যাবেন?’
‘আজকেই যেতে পারি। কত দূর এখান থেকে?’
‘পনের মাইল। বেবিট্যাক্সি করে যেতে পারেন।’
‘রাতে ফিরে আসতে পারব?’
‘তা পারবেন।’
‘বেশ, তাহলে আপনি আমাকে ঠিকানাটা দিন।’
‘দেব। বাড়িতে চলেন, খাওয়াদাওয়া করেন।’
‘আমি হোটেল থেকে খেয়েদেয়ে এসেছি।’
‘তা কি হয়, অতিথি-মানুষ! আসুন আসুন।’
ভদ্রলোক বাড়িতে নিয়ে গেলেন ঠিকই, কিন্তু বড়ই গম্ভীর হয়ে রইলেন। মাথার ওপর হঠাৎ এসে পড়া উপদ্রবে তাঁকে বেশ বিরক্ত মনে হলো। ভালো করে কোনো কথাই বললেন না। অকারণে বাড়ির এক জন কামলার ওপর প্রচন্ড হম্বিতম্বি শুরু করলেন।
কিন্তু অনুফার বাড়িতে সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার ঘটল। মেয়েটি আদর-যত্নের একটি মেলা বাধিয়ে ফেলল। মিসির আলি অবাক হয়ে দেখলেন, মেয়েটির স্বামী সন্ধ্যাবেলাতেই জাল নিয়ে পুকুরে নেমে গেছে। অনুফা পরিচিত মানুষের মতো আদুরে গলায় বলল, ‘রাতে ফিরবেন কি-কাল সকালে যাবেন।’ লোকজন মিসির আলিকে দেখতে এল। এরা বেশ সম্পন্ন গৃহস্থ। মেয়েটিও মনে হয় বেশ ক্ষমতা নিয়ে আছে। সবাই তার কথা শুনছে।
ঘন্টাখানেকের মধ্যে তাঁকে গোসলের জন্যে গরম পানি করে দেয়া হলো। একটা বাটিতে নতুন একটা গায়ে মাখার সাবান। মোড়কটি পর্যন্ত ছেড়া হয় নি। বাংলাঘরে নতুন চাদর বিছিয়ে বিছানা করা হলো। মেয়েটির বৃদ্ধ শ্বশুর একটি ফর্সী হুক্কাও এনে দিলেন এবং বারবার বলতে লাগলেন, খবর না-দিয়ে আসার জন্যে ঠিকমতো খাতির-যত্ন করতে না পেরে তিনি বড়ই শরমিন্দা। তবে যদি কালকের দিনটা থাকেন, তবে তিনি হরিণঘাটার বিখ্যাত মাগুর মাছ খাওয়াবেন। খাওয়াতে না-পারলে তিনি বাপের ব্যাটা না-ইত্যাদি ইত্যাদি।
মিসির আলিরও বিস্ময়ের সীমা রইল না। তিনি সত্যি-সত্যি এক দিন থেকে গেলেন। মিসির আলি সাহেব এ রকম কখনো করেন না।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে