দেবী তৃতীয় এবং শেষ পর্ব

0
1120

দেবী তৃতীয় এবং শেষ পর্ব

# – হুমায়ূন আহমেদ

🔴 পনেরো 🔴
.
সারাটা পথ নীলু চুপ করে রইল। একবার সে বললো, ‘কী ব্যাপার, এত চুপচাপ যে?’ নীলু তারও জবাব দিল না।তার কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। সে আছে একটা ঘোরের মধ্যে।
‘গান শুনবে? গান দেব?’
নীলু মাথা নাড়ল। সেটা হাঁ কি না, তাও স্পষ্ট হলো না।
‘কী গান শুনবে? কান্ট্রি মিউজিক? কান্ট্রি মিউজিকে কার গান তোমার পছন্দ?’
নীলু জবাব দিল না।
‘আমার ফেবারিট হচ্ছে জন ডেনভার। জন ডেনভারের রকি মাউন্টেন হাই গানটা শুনেছ?’
‘না।’
‘খুব সুন্দর! অপূর্ব মেলোডি!’
সে ক্যাসেট টিপে দিতেই জন ডেনবারের অপূর্ব কণ্ঠ শোনা গেল, ‘ক্যালিফোর্নিয়া রকি মাউন্টেন হাই।’
‘কেমন লাগছে নীলু?’
‘ভালো।’
‘শুধু ভালো না। বেশ ভালো।’
সেও জন ডেনভারের সঙ্গে গুনগুন করতে লাগল। নীলুর মনে হলো ওর গানের গলাও তো চমৎকার! একবার ইচ্ছা হলো জিজ্ঞেস করে গান জানেন কি না, কিন্তু সে কিছু জিজ্ঞেস করল না। তার কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। গাড়ি কোন দিক দিয়ে কোথায় যাচ্ছে তাও সে লক্ষ্য করছে না। এক বার শুধু ট্রাফিক সিগনালে গাড়ি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এক জন ভিখিরি এসে ভিক্ষা চাইল। সে ধমকে উঠল কড়া গলায়। তারপর আবার গাড়ি চলল। নীলু ফিসফিস করে বলল, ‘কটা বাজে?’
‘সাতটা পঁয়ত্রিশ। তোমাকে আটটার আগেই পৌঁছে দেব।’
‘আপনার বাড়ি মনে হয় অনেক দূর?’
‘শহর থেকে একটু দূরে বাড়ি করেছি। কোলাহল ভালো লাগে না। ফার ফ্রম দি ম্যাডিং ক্রাউড কার লেখা জান?’
‘নাহ্।’
‘টমাস হার্ডির। পড়ে দেখবে, চমৎকার! অথচ ট্রাজিডি হচ্ছে, টমাস হার্ডিকেই নোবেল পুরুষ্কার দেয়া হয় নি। তুমি তাঁর কোনো বই পড়েছে?’
‘পড়ে দেখবে। খুব রোমান্টিক ধরনের রাইটিং।’
গাড়ি ছুটে চলছে মিরপুর রোড ধরে। হঠাৎ নীলু বলল, ‘আমার ভালো লাগছে না।’
সে তাকাল নীলুর দিকে। একটি হাত বাড়িয়ে ক্যাসেটের ভল্যুম বাড়িয়ে দিল। গাড়ির গতি কমলো না।
‘আমি বাসায় যাব।’
‘আটটার সময় আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেব।’
‘না, আজ আমি কোথাও যাব না। প্লীজ গাড়িটা থামান, আমি নেমে পড়ব।’
‘কেন?’
‘আমার ভালো লাগছে না। প্লীজ।’
সে তাকাল নীলুর দিকে। নীলু শিউরে উঠল। এ কেমন চাউনি! যেন মানুষ নয়, অন্য কিছু।
‘প্লীজ, গাড়িটা একটু থামান।’
‘কোনো রকম ঝামেলা না-করে চুপচাপ বসে থাক। কোনো রকম শব্দ করবে না।’
‘আপনি এ রকম করে কথা বলছেন কেন?’
গাড়ির গতি ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। ঝড়ের গতিতে পাশ দিয়ে দুটো ট্রাক গেল। লোকটি তার একটি হাত রাখল নীলুর উরুতে। নীলু শিউরে উঠে দরজার দিকে সরে গেল। লোকটি হাসলো। এ কেমন হাসি!
‘গাড়ি থামান। আমি চিৎকার করব।’
‘কেউ এখন তোমার চিৎকার শুনবে না।’
‘আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?’
‘আমি ভয় দেখাচ্ছি না।’
‘আমি আপনাকে বিশ্বাস করে গাড়িতে উঠেছি।’
‘আরো কিছুক্ষণ থাক। বেশিক্ষণ নয়, এসে পড়েছি বলে।’
‘কী করবেন আপনি?’
‘তেমন কিছু না।’
নীলু এক হাতে দরজা খুলতে চেষ্টা করল। লোকটি তাকিয়ে দেখল, কিন্তু বাধা দিল না। দরজা খোলা গেল না। নীলু প্রাণপণে বলতে চেষ্টা করল, আমাকে বাঁচাও, কিন্তু বলতে পারল না। প্রচুর ঘামতে লাগল। প্রচণ্ড তৃষ্ণা বোধ হলো।
.
🔴 ষোলো 🔴
.
আনিস এলো রাত সাড়ে আটটায়। ঘর অন্ধকার। কারো কোনো সাড়া শব্দ নেই। রানু বাতিটাতি নিভেয়ে অন্ধকারে বসে আছে। জিতু মিয়া মশারি খাটিয়ে শুয়ে পড়েছে।
‘রানু, কী হয়েছে?’
রানু ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল, ‘তুমি এত দেরি করলে!’
‘কেন, কী হয়েছে?’
‘নীলুর বড় বিপদ।’
আনিস কিছু বুঝতে পারল না। অবাক হয়ে তাকাল। রানু থেমে-থেমে বলল, ‘নীলুর খুব বিপদ।’
‘কিসের বিপদ? কী বলছ তুমি?’
রানুর কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। সে গুছিয়ে কিছু বলতে পারছে না।
‘রানু, তুমি শান্ত হয়ে বস। তারপর ধীরেসুস্থে বল-কী হয়েছে নীলুর?’
‘ও একজন খারাপ লোকের পাল্লায় পড়েছে। লোকটা ওকে মেরে ফেলবে।’
রানু ফোঁপাতে লাগল। আনিস কিছুই বুঝতে পারল না। নীলুর বাবার সঙ্গে কিছুক্ষণ আগেই তার কথা হয়েছে। ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করেছেন, ‘কি, এত দেরি যে?’ যার মেয়ের এত বড় বিপদ, সে এ রকম স্বাভাবিক থাকবে কী করে?
আনিস বলল, ‘ওরা তো কিছু বলল না।’
‘ওরা কিছু জানে না। আমি জানি, বিশ্বাস কর-আমি জানি।’
‘আমাকে কী করতে বল?‘
‘আমি বুঝতে পারছি না। আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’
‘জিনিসটা কি তুমি স্বপ্নে দেখেছে?’
‘না। কিন্তু আমি দেখেছি।’
‘কী দেখেছ?’
‘আমি সেটা তোমাকে বলতে পারব না।’
‘তুমি যদি চাও আমি নিচে গিয়ে ওদের বলতে পারি, কিন্তু ওরা বিশ্বাস করবে না।’
রানু চোখ বড়-বড় করে তাকিয়ে রইল। ওর শরীর অল্প-অল্প করে কাঁপছে। আনিস বলল, ‘নাকি মিসির আলি সাহেবের কাছে যাবে? উনি কোনো-একটা বুদ্ধি দিতে পারেন।যাবে?’
রানু কাঁপা গলায় বলল,‘তুমি নিজে কি আমার কথা বিশ্বাস করছ?’
‘হ্যাঁ, করছি।’
একতলার বারান্দায় বিলু বসেছিল। ওদের নামতে দেখেই বিলু বলল, ‘ভাবী, নীলু আপা এখনো ফিরছে না। বাবা খুব দুশ্চিন্তা করছেন।’
রানু কিছু বলল না।
‘তোমরা কোথায় যাচ্ছ ভাবী?’
রানু তারও জবাব দিল না। রিকশায় উঠেই সে বলল, ‘আমাকে ধরে রাখ,খুব ভালো লাগছে।’
আনিস তার কোমর জড়িয়ে বসে রইল। রানুর গা শীতল। রানু খুব ঘামছে। জ্বর নেমে গেছে।
.
রানু চোখ বড়-বড় করে বললো, ‘আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না, তাই না?’
মিসির আলি চুপ করে রইলেন।
‘আগে আপনি বলুন-আপনি কি আমার কথা বিশ্বাস করছেন?’
‘বিশ্বাসও করছি না, আবার অবিশ্বাসও করছি না। তুমি নিজে যা সত্যি বলে মনে করছ, তা-ই বলছ। তবে আমি এত সহজে কোনো কিছু বিশ্বাস করি না।’
‘কিন্তু যদি সত্যি হয়,তখন?‘
মিসির আলি সিগারেট ধরিয়ে কাশতে লাগলেন।
‘বলুন, যদি আমার কথা সত্যি হয়-যদি মেয়েটা মারা যায়?’
মিসির আলি শান্ত স্বরে বললেন, ‘ঠিক এই মুহূর্তে কী করা যায়, তা তো বুঝতে পারছি না। মেয়েটি কোথায় আছে, তা তো তুমি জান না। নাকি জান?’
‘না,জানি না।’
‘ছেলেটির নামধামও জান না?’
‘ছেলেটি দেখতে খুব সুন্দর। আমার এ রকম মনে হচ্ছে।’
‘এই শহরে খুব কম করে হলেও দশ হাজার সুন্দর ছেলে আছে।’
‘আমরা কিছুই করব না?’
‘পুলিশের কাছে গিয়ে বলতে পারি একটি মেয়ে হারিয়ে গেছে এবং আশঙ্কা করা যাচ্ছে দুষ্ট লোকের খপ্পরে পড়েছে। কিন্তু তাতেও একটা মুশকিল আছে, ২৪ ঘন্টা পার না হলে পুলিশ কাউকে মিসিং পারসন হিসেবে গণ্য করে না।’
‘রানু, তুমি যদি ঐ লোকটির কোনো ঠিকানা কোনোভাবে এনে দিতে পার, তাহলে একটা চেষ্টা চালানো যেতে পারে।’
‘ঠিকানা কোথায় পাব?’
‘তা তো রানু আমি জানি না। যেভাবে খবরটি পেয়েছ, সেইভাবেই যদি পাও।’
রানু উঠে দাঁড়াল। মিসির আলি সাহেব বললেন, ‘যাচ্ছ নাকি?’
‘হ্যাঁ, বসে থেকে কী করব?’
নীলুদের সব ক’টি ঘরে আলো জ্বলছে। রাত প্রায় এগারটা বাজে। নীলুর বাবা পাথরের মূর্তির মতো বাগানের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। রানুদের ঢুকতে দেখে এগিয়ে এলেন কিন্তু কিছু বললেন না। রানু মাথা নিচু করে তিনতলায় উঠে গেল। নীলুদের ঘরে ঘনঘন টেলিফোন বাজছে। দুটি গাড়ি এসে থামল। মনে হয় ওঁরা খুঁজতে শুরু করেছেন। পুলিশের কাছে নিশ্চয়ই লোক গিয়েছে। নীলুর বাবা অস্থির ভঙ্গিতে বাগানে হাঁটছেন।
.
*****
.
ছোট্ট একটি ঘর। কিন্তু দু শ’ পাওয়ারের একটি বাতি জ্বলছে ঘরে। চারদিক ঝলমল করছে। লোকটি একটি চেয়ারে বসে আছে। নীলু লোকটির মুখ দেখতে পাচ্ছে না, কারণ লোকটি বসে আছে তার পেছনে। ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাবার কোনো উপায় নেই নীলুর। নাইলনের চিকন দড়ি তার গা কেটে বসে গেছে। চারদিকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। মাঝে-মাঝে দূরের রাস্তা দিয়ে দ্রুতগামী ট্রাকের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। নীলু থেমে-থেমে বলল, ‘আপনি কি আমাকে মেরে ফেলবেন?’
কেউ কোনো জবাব দিল না।
‘আমি আপনার কোনো ক্ষতি করি নি। কেন আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন? প্লীজ, আমাকে যেতে দিন। আমি কাউকে কিছু বলব না। কেউ আপনার কথা জানবে না।’
পেছনের চেয়ার একটু নড়ে উঠল। ভারি গলায় লোকটি কথা বলল, ‘কেউ জানলেও আমার কিছু যায়-আসে না।’
‘কেন আপনি এ রকম করছেন?’
‘আমি একজন অসুস্থ মানুষ। মাঝে-মাঝে আমাকে এ রকম করতে হয়।’
‘আপনি কি আমাকে মেরে ফেলবেন?’
কোনো জবাব পাওয়া গেল না। লোকটি হাত বাড়িয়ে বাতি নিভিয়ে দিল। চারদিকে ঘন অন্ধকার। নীলু চাপা স্বরে ডাকল, ‘মা, মাগো!’
‘চুপ করে থাক, কথা বলবে না।’
‘কেন এ রকম করছেন আপনি?’
‘আমি একজন অসুস্থ মানুষ। পৃথিবীতে কি অসুস্থ মানুষ থাকে।’
‘আপনি কি আমার মতো আরো অনেক মেয়েকে এইভাবে ফাঁদ পেতে এনেছেন?’
কোনো জবাব পাওয়া গেল না। লোকটি এগিয়ে এসে নীলুর গায়ে হাত রাখল। এই কি সেই ভালোবাসার স্পর্শ? নীলূ ডাকল, ‘মা, মাগো!’
‘চুপ করে থাক।’
‘আপনি মানুষ, না অন্য কিছু?’
‘বেশির ভাগই আমি মানুষ থাকি, মাঝে-মাঝে অন্য রকম হয়ে যাই।’
লোকটি শব্দ করে হাসল। কী কুৎসিত হাসি! ঘরে একটুও বাতাস নেই। দম বন্ধ হয়ে আসছে। নীলু প্রাণপণে তার একটা হাত ছুটিয়ে আনতে চেষ্টা করছে। যতই চেষ্টা করছে দড়িগুলো ততই যেন কেটে-কেটে বসে যাচ্ছে।
‘কেন, কেন আপনি এরকম করছেন?’
‘বলেছি তো নীলু! অনেক বার বললাম তোমাকে। আমি অসুস্থ।’
‘কী করছেন অন্যদের?’
লোকটি হেসে উঠল। নীলু কাতর স্বরে বলল, ‘আপনি দয়া করুন, আমি আপনার পায়ে পড়ি। প্লীজ। আমি আপনার কথা কাউকে বলব না।’
‘তা কি হয়?’
‘বিশ্বাস করুন। আমি আমার কথা রাখি। কাউকে আমি আপনার কথা বলব না।’
লোকটি ফিরে যাচ্ছে। নীলু কি বেঁচে যাবে? লোকটি কি তাকে ছেড়ে দেবে? নীলু গুছিয়ে চিন্তা করতে পারছে না। সব কেমন যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। লোকটি একটি ড্রয়ার খুলল। ঘর অন্ধকার, নীলু কিছু দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু সে নিশ্চিত জানে, তার হাতে ধারাল কিছু একটা আছে। ক্ষুরজাতীয় কিছু। লোকটি সেটি বাঁ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। আসবে, সে এক সময় এগিয়ে আসবে তার কাছে। খুব কাছে কোথাও রিকশার টুনটুন শোনা গেল। নীলু প্রাণপণে চেঁচাল,‘বাঁচাও। আমাকে বাঁচাও।’ কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরুল না।
.
🔴 সতেরো 🔴
.
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রানুর অবস্থা খারাপ হতে লাগল। বারবার বলতে লাগল-উফ্, বড্ড গরম লাগছে। আনিস সমস্ত দরজা-জানালা খুলে দিল, ফ্যান ছেড়ে দিল, তবু তার গরম কমল না। রানু কাতর স্বরে বলল, ‘তুমি আমাকে ধরে থাক, আমার বড্ড ভয় লাগছে।’
‘কোনো ভয় নাই রানু।’
‘লোকটি ক্ষুর হাতে বসে আছে। তবু তুমি বলছ ভয় নেই?’
‘এই সব তোমার কল্পনা। এস, তোমার মাথায় একটু পানি দেই?’
‘তুমি কোথায়ও যেতে পারবে না। ঐ লোকটি এখন উঠে দাঁড়িয়েছে। তুমি আমাকে শক্ত করে ধরে থাক। আরও শক্ত করে ধর।’
আনিস তাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। রানু ক্ষীণ কন্ঠে বলল, ‘আমি তোমাকে একটি কথা কখনো বলি নি। একবার একজন লোক আমাকে মন্দিরে নিয়ে গিয়েছিল।’
‘রানু, এখন তোমাকে কিছুই বলতে হবে না। দয়া করে চুপ করে থাক।’
‘না, আমি বলতে চাই।’
‘সকাল হোক। সকাল হলেই শুনব।’
‘মাঝে-মাঝে আমার মনে হয় একজন-কেউ আমার সঙ্গে থাকে।’
‘রানু, চুপ করে থাক।’
‘না, আমি চুপ করে থাকব না। আমার বলতে ইচ্ছে করছে। যে আমার সঙ্গে থাকে, তার সঙ্গে আমি অনেক বার কথা বলেছি, কিন্তু আজ সে কিছুতেই আসছে না।’
‘তার আসার কোনো দরকার নেই।’
‘তুমি বুঝতে পারছ না, তার আসার খুব দরকার।’
রাত দেড়টার দিকে নিচ থেকে বিলুর কান্না শোনা যেতে লাগল। অনেক লোকজনের ভিড়। কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। রানু বলল, ‘বিলু কাঁদছে। বড় খারাপ লাগছে আমার।’
‘রানু, তুমি একটু শুয়ে থাক। আমি জিতুকে ডেকে দিচ্ছি।’
‘তুমি কোথায় যাবে?’
‘আমি একজন ডাক্তার নিয়ে আসব। আমার মোটেই ভালো লাগছে না।’
‘তুমি আমাকে ফেলে রেখে কোথাও যেতে পারবে না।’
রানুর কথা জড়িয়ে যেতে লাগল। এক সময় বিছানায় নেতিয়ে পড়ল। আনিস ছুটে গেল ডাক্তার আনতে। বড় রাস্তার মোড়ে একজন ডাক্তারের বাসা আছে। ডাক্তার সাহেবকে পাওয়া গেল না। আনিস ফিরে এসে ঘরে ঢোকবার মুখেই তীব্র ফুলের গন্ধ পেল। ঘরের বাতি নেভানো। কে নিভিয়েছে বাতি? আনিস ঢুকতেই রানু বলল, ‘ও এসেছে।’
‘কে? কে এসেছে?’
‘তুমি গন্ধ পাচ্ছ না?’
আনিস এগিয়ে এসে রানুর হাত ধরল। গা ভীষণ গরম। রানু বলল, ‘ও নীলুর কাছে যাবে।’
‘রানু, শুয়ে থাক।’
‘উহু, শোব কীভাবে? ও একা যেতে ভয় পাচ্ছে। আমিও যাব ওর সঙ্গে। ও আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।’
বলতে বলতে রানু খিলখিল করে হাসল।
আনিস বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডাকল, ‘রহমান সাহেব, রহমান সাহেব। ভাই, একটু আসুন, আমার বড় বিপদ।’
রহমান সাহেব ঘরে ছিলেন না। তাঁর স্ত্রী বেরিয়ে এলেন। তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে?’
‘আপনি একটু আসুন, আমার স্ত্রী কেমন যেন করছে।’
ভদ্রমহিলা সঙ্গে-সঙ্গে এলেন। এবং ঘরে ঢুকেই অবাক হয়ে বললেন, ‘নূপুরের শব্দ না?’ রানু কিশোরী মেয়ের গলায় খিলখিল করে হাসল।
‘কী হয়েছে ওনার?’
‘আপনি একটু বসুন ওর পাশে। আমি ডাক্তার নিয়ে আসি।’
আনিস ছুটে বেরিয়ে গেল। ফুলের সৌরভ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগল। রানু হাসিমুখে বলল, ‘আামার সময় বেশি নেই, ঐ লোকটি এগিয়ে আসছে।’
‘কোন লোক?’
‘আপনি চিনবেন না। না-চেনাই ভালো।’
ভদ্রমহিলা রানুর হাত ধরলেন। উত্তাপে গা পুড়ে যাচ্ছে। তিনি কী করবেন ভেবে পেলেন না।
আনিস ডাক্তার নিয়ে ফেরার আগেই রানু মারা গেল।
.
******
.
ঘর অন্ধকার, কিন্তু চোখে অন্ধকার সয়ে আসছে। আবছামতো সব কিছু দেখা যায়। বাড়িটা কোথায়? কহর থেকে অনেক দূরে কী? কোনো শব্দ নেই। কত রাত এখন? বাড়িতে এখন ওরা কী করছে? বিলু কি ঘুমিয়েছি মশারি ফেলে? না, না-আজ কেউ ঘুমায় নি, আজ সবাই ছোটাছুটি করছে। সবাই খুঁজছে নীলুকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো পুলিশের গাড়ির শব্দ শোনা যাবে। বাবা এসে বলবেন-কোনো ভয় নেই মা-মণি।
চেয়ার নড়ার শব্দ হলো। লোকটি কি উঠে দাঁড়িয়েছে? তার হাতে ওটা কী? নীলু মনে-মনে বলল, ‘বাবা, আমি একজন অসুস্থ লোকের হাতে আটকা পড়েছি, আমাকে তোমরা বাঁচাও। আমার আর মোটেও সময় নেই বাবা। তোমাদের খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে।’
লোকটি এগিয়ে আসছে। পেছন থেকে খুব ধীর গতিতে এগিয়ে এল সামনে। এখন নীলু আবছাভাবে লোকটির মুখ দেখতে পাচ্ছে। কী সুন্দর একটি মুখ! নীলু বিড়বিড় করে বলল, ‘প্লীজ, দয়া করুন।’ লোকটি অদ্ভুত শব্দ করল। এটি হাসির শব্দ? নীলুর গা গোলাচ্ছে। নীলু চিৎ হয়ে থাকা অবস্থাতেই মুখ ভর্তি করে বমি করল।দুঃস্বপ্ন, সমস্তটাই একটা দুঃস্বপ্ন। এক্ষুণি ঘুম ভেঙে যাবে। আর নীলু দেখবে-বিলু বাতি জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার বুকের ওপর একটা গল্পের বই। এখানে যা ঘটেছে, তা সত্যি হতেই পারে না।
লোকটি তার পাশে দাঁড়িয়ে হাত বাড়াল। নীলু চাপা গলায় বলল, ‘আমার গায়ে হাত দেবেন না, প্লীজ।’ লোকটি হেসে উঠছে শব্দ করে। আর ঠিক তখনই নূপুরের শব্দ শোনা গেল। যেন কেউ-একজন ঢুকেছে এ ঘরে।
লোকটি ভারি গলায় বলল, ‘কে, কে ওখানে?’ তার উত্তরে অল্পবয়সী একটি মেয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। লোকটি চেচাঁল, ‘কে, কে?’ কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। শুধু ঘরের শেষ প্রাস্তের একটা জানালা খুলে ভয়ানক শীতল একটা হাওয়া এসে ঢুকল ঘরে। সে হাওয়ায় ভেসে এল অদ্ভুত মিষ্টি একটা গন্ধ।
নীলুর দেখল, লোকটি ক্রমেই দেয়ালের দিকে সরে যাচ্ছে। এক বার সে চাপা স্বরে বলল, ‘তুমি কে?’ মিষ্টি একটি হাসি শোনা গেল তখন। ফুলের গন্ধ আরো তীব্র হলো। অন্য কোনো ভুবন থেকে ভেসে এল নূপুরের ধ্বনি। লোকটি গা ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘এসব কী হচ্ছে! কে, এখানে কে?’ কেউ তার কথার জবাব দিল না। একটি দুষ্টু মেয়ে শুধু হাসতে লাগল। ভীষণ দুষ্টু একটি মেয়ে। তার পায়ে নূপুর। তার গায়ে অপার্থিব এক ফুলের গন্ধ। মেয়েটি এবার দুইহাত বাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে লোকটির দিকে। লোকটির কর্কশ কণ্ঠ শোনা গেল, ‘এইসব কী? কে, কে?’ তার উত্তরে সমস্ত ঘরময় মিষ্টি খিলখিল হাসি ঝমঝম করতে লাগল। লোকটি চাপা গলায় বলে উঠল, ‘আমাকে বাঁচাও। বাঁচাও।’ দুষ্টু মেয়েটি আবার হাসল, যেন খুব একটা মজার কথা।
.
🔵 পরিশিষ্ট 🔵
.
থার্ড ইয়ারের অনার্সের এই ক্লাসটি মিসির আলি সাহেবকে দেয়া হয়েছে। সাইকোলজি ফিফ্থ পেপার। মিসির আলি সাহেব হাসিমুখে ঢুকলেন। তাঁর মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। রানু বসে আছে সেকেন্ড বেঞ্চে। তাঁর দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। তিনি মেয়েটির দিকে তাকালেন এবং তাকিয়ে রইলেন। মনে হলো, মেয়েটির ঠোঁটের কোণায় হাসি লেগে আছে। মিসির আলি কাঁপা গলায় বললেন, ‘তোমার নাম কি?’
মেয়েটি উঠে দাঁড়াল। স্পষ্ট স্বরে বলল, ‘আমার নাম নীলু। নীলুফার। রোল নাম্বার থার্টি টু।’
‘আমি একটি মেয়েকে চিনতাম। তুমি দেখতে অবিকল তার মতো।’
নীলুফার শান্ত স্বরে বললো, ‘আমি জানি।’
মিসির আলি সাহেব কপালের ঘাম মুছলেন। সমস্ত ব্যাপারটি ভুলে যাবার প্রাণপণ চেষ্টা করতে-করতে বললেন, ‘আমি তোমাদের পড়াব ফিফ্থ পেপার। খুব ইন্টারেস্টিং একটি টপিক-’

রানুর মতো দেখতে মেয়েটি তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। মেয়েটির মুখে মৃদু হাসি।
.
[ বিঃদ্রঃ এই গল্পের দ্বিতীয় পার্ট হচ্ছে নিশিথীনী। তবে নিশীথিনী পড়লেও কিছু রহস্য রহস্যই থেকে যাবে ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে