দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
4370

“দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা”
(স্বাগতা)

(শেষ অংশ)
রাগে ফোঁস ফোঁস করছে শায়না, “ভালবাসা লজ্জাজনক? প্রেম হতে পারে না?”
“হতেই পারে প্রেম!… ভালবাসাকেও আমি লজ্জাজনক বলি না… লজ্জাজনক বলি সেই কাজকে, যা অনৈতিক, অবৈধ… আমার এবং নীলার কমন ফ্রেন্ডস এবং পারিবারিকভাবে পরিচিত অনেক… আজকে যদি আমার শ্যালিকার বান্ধবী একজন এসে তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে… তোর দুলাভাই নাকি হাঁটুর বয়সী মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে? তোর বোনের সংসার কি টিকবে না কি মনে হয়?’, সেটা তার জন্য কতোটা কষ্টের আর কতোটা লজ্জার, সেটা বুঝবার মতো বোধটুকু আপনি হারিয়ে ফেলেছেন শায়না… আপনার পরিবার এবং পরিচতদের মাঝে কি ধরণের আলাপ হতে পারে, সেটা ভাবতেও আমার আতঙ্ক হচ্ছে, আর আপনি সেটাকে কিভাবে ইগ্নোর করছেন সেটা আমার মাথায় কুলাচ্ছে না… আজকে যদি আমি ডিভোর্সি বা বিপত্নীক হতাম… কোনও ব্যাপার ছিলো না একটা সম্পর্কে জড়ানো… কিন্তু আমি হ্যাপিলি ম্যারেড… সন্তানের বাবা… তার চাইতেও বড় কথা আমি আপনার ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড না… আর হলেও আমি বাকি ফ্যাক্টরগুলো কখনোই অস্বীকার করতে পারতাম না… সুতরাং আপনি ব্যাড ইনফ্লুয়েন্স আমার জন্য… অন্যায় করতে উস্কাচ্ছেন আমাকে!”
এইবার রাগে-ক্ষোভে-বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে পড়লো শায়নার। এইভাবে রোহান ওকে বললো! খুব আদরের মেয়ে ওর বাবা-মায়ের শায়না! সারাজীবন বাবা-মায়ের কাছে যা চেয়েছে তাই পেয়ে এসেছে। আবার রূপসী হওয়ায় বরাবর ছেলেরা ওর চাওয়ার কাছে নিজেদের সমর্পণ করে ধন্য হয়ে যায়, এটাই দেখে এসেছে। রোহানের ক্ষেত্রেও ভেবেছিলো সেটাই হবে। ও চাইবে আর ওর চাওয়ার কাছে নতি স্বীকার করতেই হবে রোহানকে। পাশা যে এভাবে উল্টে যাবে তা ওর কল্পনাতেও ছিলো না! এতো দিকের বাস্তবতা এতো ভাবে ভাববার কথা মাথাতেও আসে নি ওর, বা আসলেও তা এড়িয়ে গেছে রোহানের প্রতি অদম্য আকর্ষণে। কিন্তু রোহানের কথা তখনও শেষ হয় নি।
“আমি আরও বলছি… আপনি অভদ্র… আমি আমার বাকি কলিগদের মতো আপনাকেও এখন পর্যন্ত আপনি বলে সম্বোধন করছি… কিন্তু আপনি আমাকে তুমি করে বলার আগে আমার অনুমতিটুকু পর্যন্ত চান নি… তার উপর আমার নাম ধরে ডাকছেন, না কর্মক্ষেত্রে সিনিয়র হিসেবে, না বয়সের বিচারে কোনও লেহাজ রেখেছেন আপনি… আপনার ভালো লাগা না লাগা, সেটা আপনার সমস্যা… আপনার কল্পনার জগতে আপনি কি করেন সেটা আমার দেখার বা জানার বিষয় না… কিন্তু বাস্তবে অবশ্যই আপনার আচরণে ভদ্রতার আড় থাকতে হবে… আপনার আর আমার মধ্যে কোনও সম্পর্ক গড়ে ওঠে নি যে আপনি অধিকার খাটাবেন… আর একটু আগে আপনি আমার স্ত্রী’কে নিয়ে যে কথাটা বললেন, সেটা চরম আপত্তিকর শুধু না, রীতিমতো কুরুচিপূর্ণ… একে তো আপনি তাকে চেনেনই না… যাকে চেনেন না, তার সম্বন্ধে একটা খারাপ মন্তব্য করে ফেলাটা অত্যন্ত নীচ একটা কাজ… আর তাও এমন একজন সম্পর্কেই আপনি বলছেন যে আমার অত্যন্ত প্রিয়, আমার ভালবাসার মানুষ…”
শায়নার চোখ আর এবার বাধা মানলো না। দুই চোখ ছাপিয়ে এলো জল। ওরই সামনে বসে ওরই ভালবাসার মানুষ বার বার বলে যাচ্ছে যে সে আর কাউকে ভালবাসে! কিভাবে মেনে নেবে ও? আর সেই মানুষের জন্য ওকে অপমান করতেও আটকাচ্ছে না রোহানের! রোহান কি একটা বারের জন্যও ওর মনের অবস্থাটা বুঝবার চেষ্টা করবে না?
রোহান দেখলো শায়নাকে কাঁদতে। ওর কোনও প্রতিক্রিয়া হলো কিনা সেই কান্না দেখে সেটা বুঝতে দিলো না ও। একটু চুপ করে থেকে বলতে লাগলো, “আপনি সব জেনে বুঝে একজন মেয়ের সংসার নষ্ট করতে চাইছেন মিস শায়না… একটু ভেবে বলবেন কি, যে একজন পুরুষ যদি একজন নারীকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্নই দেখে, তো এমন একজন নারীকে নিয়ে কেন ভাববে যে অন্যের ঘর ভাঙে? স্বেচ্ছায় যে এমন গর্হিত অপরাধের কথা চিন্তাও করতে পারে, তার সাথে জড়াবে একমাত্র আরেকজন কোনও বিকৃত চিন্তার মানুষ…” রোহান চেষ্টা করছে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে, কিন্তু নীলাকে নিয়ে শায়না ওই রকম একটা মন্তব্য করায় মেজাজ হারিয়েছে ও। রাগ ঠান্ডা করতে পারছে না। নীলার সাথে ওর সম্পর্ক যেমনই হোক, স্ত্রী সে ওর, ওর বাচ্চার মা। বাইরের কেউ ওকে নিয়ে কোনও বাজে মন্তব্য করবে, ওর উপস্থিতিতে সেটা সে হতে দেবে না। নীলার ব্যাপারে এই দিক দিয়ে রোহান ভালোই পজেসিভ। ঘরের ভেতর দু’জনের মারামারি, খুনোখুনি যাই হয়ে যা, তাতে বাইরের লোকের কি!
জলে ভর্তি ঝাপসা দুই চোখ মেলে চাইলো শায়না ওর দিকে। বললো, “আর আমি? আমি যে আমার ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছি তোমাকে নিয়ে? তার কি হবে? আমি যে ভালবাসি তোমাকে? আমি তো ইচ্ছে করে কিছু করি নি! এই অনুভূতি তো আমি নিজে থেকে নিজের মাঝে তৈরি করি নি!… আমার ভালবাসা কি কিছুই না? আমার এই আবেগের কোনও মূল্যই কি নেই? আমার কি হবে?”
বহু কষ্টে নিজের বিরক্তি আর রাগটাকে নিয়ন্ত্রণে এনে মুখ খুললো রোহান, “আমাকে নিয়ে আপনার যে অনুভূতি, সেটা ক্ষণিকের মোহ মাত্র… বয়সের দোষও বলা চলে… মনের মানুষ খুঁজে পাওয়া বা কারও মনের মানুষ হয়ে ওঠা এতো সহজ না শায়না… নিজেকে কিছু সময় দিন, ইট উইল পাস… যাকে নিয়ে ঘর বাঁধা আপনার ভাগ্যে লেখা আছে, তার দেখা পেলে এই সমস্ত কিছু ভুলে যাবেন… আর যদি এই আবেগ, এই অনুভূতি সত্যিও হয়, এর কোনও ভবিষ্যৎ নেই, সেটা আপনাকে বুঝতে হবে, কারণ এটা এক পাক্ষিক… জোর করে কিছু হয় না শায়না…”
“আমি এতোটাও ছোট নই যে নিজের আবেগ নিজের অনুভূতির ব্যাপারে বুঝবো না… বা, তোমার চোখের মুগ্ধতা টের পাবো না! আই এ্যাম নট আ টিনেজার রোহান!”
“এগজ্যাক্টলি শায়না! আপনি এতোটাও ছোট নন যে টিন এজের রঙিন চশমা দিয়ে দুনিয়াটাকে দেখবেন… বাস্তবতা বোঝার বয়স আপনার হয়েছে… আর দুঃখজনক হলেও বাস্তবতাটা আপনার পক্ষে নেই, এটাই সত্যি… আপনার একটা কাজ কতোগুলো মানুষকে এ্যাফেক্ট করতে পারে, সেটা না বোঝার মতো ছোট আসলেও আপনি নন… আর আপনার কথার উত্তরে বলছি, মুগ্ধতা আর ভালবাসা এক জিনিস না… সত্যিকারের ভালবাসা মানুষের অধোঃপতন ঘটায় না… বরং তাকে উঁচুতে নিয়ে যায়, সম্মানিত করে… আপনি যা করছেন শায়না, তাতে আপনি বাকিদের চোখে তো বটেই, এমন কি আমার চোখেও নিজেকে টেনে নামাচ্ছেন…”
চোখের জলে আগুন জ্বলছে শায়নার। দাঁতে দাঁত চেপে বললো, “মিস্টার রোহান, এমনভাবে কথা বলছেন আপনি যেন আপনি আর আপনার স্ত্রী একেবারে রোমিও-জুলিয়েট অথবা লায়লা-মজনুর জুটি! একজন একজনের জন্য মরে যান একদম! দুনিয়ার কোনও কিছুই আপনাদের প্রেমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে না! প্রেমে ভাসতে ভাসতে একদম সম্মানের শিখরে পৌঁছে গেছেন!” ইচ্ছে করে এবার তুমি থেকে আপনিতে সম্বোধনটাকে বদলে দিলো শায়না, যাতে রোহান ওর ক্ষোভটা বুঝতে পারে।
পুরো একটা মিনিট শায়নার দিকে চেয়ে ওকে দেখলো রোহান স্থির, শীতল দৃষ্টিতে। তারপর বললো, “শায়না, আপনার কাছে প্রেম মানে কাঁধে মাথা রেখে চা খাওয়া আর বৃষ্টি দেখা হতে পারে… কদম আর বেলী ফুলের বিনিময় মনে হতে পারে… হ্যাঁ, প্রেমের প্রকাশ প্রয়োজন, কিন্তু প্রেম কখনোই সম্পূর্ণ হয় না যদি সেখানে বিশ্বাস, আস্থা এবং সম্মান না জুড়ে থাকে… আমাদের কাছে প্রেম মানে দায়িত্ব, নির্ভরতা, সততা এবং অবশ্যই, সম্মান… আমার আর নীলার প্রেমটা খুব সাধারণ… আপনার কথামতো রোমিও-জুলিয়েট বা শিরিন-ফরহাদের প্রেম না… বরং রাগারাগি, দুইজন একমত হতে না পেরে প্রচন্ড ঝগড়াঝাঁটি, অভিমান, অসন্তুষ্টি এবং অপ্রাপ্তি দিয়ে ভরা একটা সম্পর্ক… কিন্তু যা আমাদের এতোগুলো বছর একসাথে রেখেছে, তা হলো সন্দেহাতীতভাবে একে অন্যের মঙ্গল চাওয়া, দু’জন দু’জনের পরম নির্ভরতার আশ্রয় হওয়া… আমাদের একজন মরে গেলে আরেকজন মরে যাওয়ার কথা মাথাতেও আনবে না, কারণ আমাদের দায়িত্বের পরিধি অনেক বড়, সেখানে আমাদের সন্তান থেকে শুরু করে মা-বাবা-ভাই-বোন অনেকে জড়িত… আর তাই, আমরা একজন মরলে নিশ্চিন্তেই মরতে পারবো এটা জেনে যে আরেকজন আছে আমার ফেলে রাখা কাজগুলো শেষ করার জন্য, সে থাকতে আমার বাকি আপনজনেরা অকুল পাথারে পড়বে না… সেই সাথে আছে আমাদের একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ… নীলা আমার স্ত্রী হওয়ার বাইরেও একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ, যাকে আমি চিনি একজন সৎ, দায়িত্বশীল, অসম্ভব দয়ালু এবং প্রখর ব্যক্তিত্বময়ী একজন মানুষ হিসেবে… সে আমার স্ত্রী, আমার সন্তানের মা, এবং সর্বোপরি আমার অকৃত্রিম বন্ধু, আমি চোখ বন্ধ করে যাকে নিয়ে বলতে পারি যে আমার যে কোনও সমস্যায়, যে কোনও বিপদে তাকে আমি পাশে পাবো…”
“বাহ রোহান!… আপনার স্ত্রী’কে তো একেবারে অতিমানবী বানিয়ে দিলেন আপনি!… তা এতো এতো যে সমস্ত নীতির বাণী ঝাড়ছেন!… আপনার স্ত্রী জানেন তো যে আপনি এখন এখানে আমার সাথে? জানেন উনি আমার ব্যাপারে? আজকের দিনটা আসার আগে আমার প্রতি আপনার যে প্রশ্রয় ছিলো সেটা উনি জানেন তো? আজ অফিস শেষে বিকেলটা যে আমার সাথে কাটাচ্ছেন, সেটা জানা আছে তো উনার?” ফোঁস ফোঁস করছে শায়না।
বাঁকা হাসলো রোহান। টেবিলের উপর থাকা ওর মোবাইলটা তুলে নিলো হাতে। ছোট্ট একটা টেক্সট করতে দেখা গেলো ওকে। শায়না এই সময়টুকু অপেক্ষা করলো। রোহান মোবাইলটা আবার টেবিলের উপর রেখে দিতেই আবার ফোঁস করে উঠলো, “কি হলো জবাব দিলেন না আমার কথার? এতো এতো ফুটানি কই গেলো এখন? সততার বোলচাল নেই হয়ে গেলো নাকি?”
“শায়না, আমার ধারণা মতে আমি কখনোই আপনাকে কোনও প্রশ্রয় দেই নি… না আপনার সাথে কোনও প্রেমের অভিনয় করেছি, না আপনার আবেগ নিয়ে খেলেছি… আপনার প্রতি আমার আবেগ কখনোই ছিলো না আর না আমি কোনরকম আবেগ দেখানোর চেষ্টা করেছি… যা আমি চেষ্টা করেছি তা হলো আপনার মনের অবস্থাকে সহানুভূতির সাথে বুঝতে… এবং আজকে স্বীকার করতে দ্বিধা করছি না যে আমি ভুল করেছি… আপনার প্রতি আমার সিম্প্যাথিটাকে আপনি ভুল বুঝেছেন আমার দুর্বলতা ভেবে… এখানে আমি আপনার দোষ দেবো না… এই দোষটা আমি নিজের উপর নিচ্ছি… নিশ্চয়ই আমার আচরণে বা ব্যবহারে এমন কিছু ছিলো যাতে আপনি ভুল বুঝেছেন… আপনার বয়স কম, আপনার ভুল হতে পারে… আমার তো তা না! সুতরাং আমার হয়তো আরও ম্যাচিওর আচরণ করা উচিৎ ছিলো আপনার সাথে… আমি সেই জন্য আপনার কাছে দুঃখপ্রকাশ করছি…”
“দুঃখপ্রকাশ মাই ফুট! দুঃখপ্রকাশ দিয়ে আমি কি করবো? ধুয়ে পানি খাবো?…”
আরও কিছু বলতো শায়না, হাত তুলে থামিয়ে দিলো রোহান, “অযথা রিয়্যাক্ট করছেন শায়না… আপনি নিজেও জানেন আমি সত্য বলছি… শুনুন শায়না… আমি জানি পুরুষ মাত্রই খুব দ্রুত একের অধিক নারীতে আকৃষ্ট হতে পারে, এটা পুরুষের স্বভাবের অন্তর্গত… কিন্তু পৃথিবীর সমস্ত পুরুষই যে লালসা আর কামনার বশ হবে, তা তো না! কিছু পুরুষ থাকে যারা শুধুমাত্র নিজের চাহিদা আর নিজের স্বার্থের বাইরেও নিজের পরিবারকে বেশি গুরুত্ব দেয়… আমি… রোহান আহমেদ, আপাদমস্তক একজন ফ্যামিলি ম্যান শায়না… আমার কাছে আমার যে কোনও চাহিদার আগে প্রাধান্য পায় আমার পরিবার… আপনি টেক্সটে যে সমস্ত রোমান্টিক সিনারিও বর্ণনা করছেন, বারান্দায় বসে দুই জন ধোঁয়া ওঠা কাপে চা খাওয়া, তাও আবার এক কাপ থেকে… আমার বাস্তবতাটা সেখানে অন্যরকম… আমি আর আমার ওয়াইফ যখন বারান্দায় বৃষ্টি বিলাস করতে বসি দুই কাপ চা নিয়ে, হই হই করতে করতে আমার দুই ছেলেমেয়ে সেখানে এসে উপস্থিত হয়… ছেলে আবার গিয়ে আমাদের সাথে এক সাথে আমাদের মতো করে খাবে বলে নিজের আর ছোট বোনের জন্য দুই কাপ হট চকোলেট বানিয়ে নিয়ে আসে… তারপর শুরু করে তার বন্ধু-বান্ধব আর স্কুলে নতুন আসা বান্ধবীর গল্প, নয়তো ক্রিকেটের আলাপ… আর মেয়ে তখন মায়ের গলা জড়িয়ে গায়ের সাথে লেপ্টে বসে নিজের কবিতার খাতা দেখাতে ব্যস্ত… ট্রাস্ট মি, এই মাত্র যে সীনটা বললাম, সেটা আমার পরিপূর্ণতার দৃশ্য… এই সীন ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ… এবং সেই সীনে আপনার কোনও স্থান নেই… ভাবার চেষ্টা করে দেখুন… এখানে আপনি নিজেকে কোথাও খুঁজে পান কিনা… খুব ভালো করে চিন্তা করে দেখুন… আপনি চাইলেও আমার দুই ছেলেমেয়ে এবং আমাকে সাথে নিয়ে এমন একটা দৃশ্য আনন্দ এবং ভালো লাগা নিয়ে চিন্তা করে উঠতে পারছেন কিনা… পারবেন না… আপনি যখন ভাবছেন অফিস থেকে ফেরার পথে আমি বেলি ফুলের মালা নিয়ে ফিরবো আপনার জন্য, আমি তখন ফিরছি অফিসের সেমিনারে দেয়া স্ন্যাক্সের প্যাকেটে চিকেন প্যাটিস আর সন্দেশ নিয়ে নিজে না খেয়ে… প্যাটিস পছন্দ করে আমার মেয়ে, আর সন্দেশ খাবে ছেলে… এমন না যে আমি নিজে তাদের কিনে খাওয়াতে পারি না… কিন্তু এই ঘরে নিয়ে ফেরাটুকুর মধ্যেই পরিবারের আবেদন… আপনি আমার অবসরের পুরো সময় চাইবেন নিজের জন্য… আর আমি সেখানে আমার আব্বা-আম্মার সাথে দেশের জমিজমা থেকে শুরু করে ন্যাশনাল-ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্স নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলাপ করবো… আপনার মস্তিষ্ক আমাকে নিয়ে ব্যস্ত… সেখানে ওরা কেউ না… আর আমার মস্তিষ্কে আমার ফ্যামিলি ছাড়া আর কিছু নেই, সেখানে আপনি কেউ না… আমি আপনার জন্য আমার এই তৃপ্তি, এই সন্তুষ্টি, এই আনন্দ অস্বীকার করতে পারবো না… আর আমার স্ত্রী’র সাথে আমার কেমিস্ট্রি কেমন, সেই বর্ণনা করে আপনাকে আমি আর অপমানিত বা আহত কোনটাই করতে চাই না…”
চম্পাকলির মতো সুদৃশ্য আঙুলগুলো দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরেছে শায়না যাতে কান্নার আওয়াজ জোরে বের হয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে। কিন্তু অনেকেই এখন অবাক আর কৌতুহলী দৃষ্টিতে ঘুরে ঘুরে দেখছে ওদের দুই জনের দিকে। একটা সুন্দরী, সুসজ্জিত তরুণী আর একজন মাঝবয়সী লোক কোন সম্পর্কের সূত্র ধরে এখানে বসে আছে, কি তাদের আলোচনার বিষয় আর কেনই বা এই আকুল হয়ে কান্না, মানুষের মনে প্রশ্ন জাগাতে এই বিষয়গুলো যথেষ্ট। ঘাড় না ঘুরিয়েও রোহান বুঝতে পারছে আশে পাশের টেবিলে আলোচনা হচ্ছে ওদের নিয়ে। কিন্তু ও নিরুপায়।
হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে চাপাস্বরে শায়না বললো, “আমি সহ্য করতে পারছি না রোহান!… কি করে বলছো যে তোমার জীবনে আমি কেউ না? আমি কিভাবে বাঁচবো? আমি যে আমার পুরো জীবনটা আমার পুরো পৃথিবীটাকে তোমার নামে করে দিয়েছি! তোমার কি একটু মায়াও হচ্ছে না আমার জন্য?”
ক্লান্ত কণ্ঠে রোহান বললো, “আপনিই ভাবুন মায়া হওয়ার কথা কিনা! একে তো আমাকে উত্যক্ত করে ফেলেছেন এতোগুলো দিন ধরে… এতোবার এতো ভাবে বুঝিয়েও আপনাকে আমি থামাতে পারি নি এই বলে যে আমি আপনার ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড না… আমার ২৪ ঘন্টা আপনি আমাকে রীতিমতো আতঙ্কে ছুটিয়ে বেড়িয়েছেন… আজকে যখন কথা বলতে আসলাম… তখনও কি আপনি একটু ভদ্র আচরণ করতে পারতেন না? তা না করে আপনি নিজের সাথে আমার স্ত্রী’র একটা বিশ্রী তুলনা টেনে আনলেন… বলতে বাধ্য হচ্ছি… আপনি যে তাঁর বয়স নিয়ে মন্তব্যটা করলেন, আপনার নিজের বয়স কি কোনদিন বাড়বে না বলে আপনার ধারণা? আর আমার স্ত্রী’কে আপনার কাছে বয়স্ক মনে হচ্ছে, তাহলে আমাকে কি আপনার কাছে কচি খোকা বলে মনে হচ্ছে?”
আশে পাশের লোকজনকে চমকে দিয়ে দুই হাতে টেবিল চাপড়ে প্রায় চিৎকার করে প্রশ্ন করলো শায়না, “হ্যাঁ আমি তুলনা করেছি!… আমি জানতে চাই যে কি আছে ওর মধ্যে যা আমার নেই?”
টেবিলের উপর কনুই রেখে দুই হাতের আঙুল দিয়ে কপালের দুই পাশ চেপে ধরলো রোহান। মাথা দপ দপ করছে ওর। শান্তভাবেই বললো, “আমি এ্যাম সরি বাট আই হ্যাভ টু সে দিস… ওর সাথে আপনার সবচাইতে বড় পার্থক্যটা হলো ব্যক্তিত্বের… আপনি… এই মুহূর্তে যে আচরণগুলো করছেন, তা ব্যক্তিত্বহীনের মতো… আজকে যদি আমি কোনভাবে ওর প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে অন্য কারও ইন্টারেস্টেড হতাম, ও এক মুহূর্তের জন্যও নিজের আত্মসম্মান কম্প্রোমাইজ করে আমার সঙ্গে থাকতো না … ও নিজের অবস্থান জানে, ও জানে যে ও কারও অল্টারনেটিভ হয়ে বাঁচতে আসে নি… ও ঠিক তাই যা আপনি নন মিস শায়না… ও দায়িত্বশীল একজন মানুষ… যে আমার সংসারটা শুধু চালাচ্ছে তা না, ওর নিজের বাবা-মা, ভাই-বোনের প্রতিও তাঁর দায়িত্বে কখনও ছেদ পড়তে দেখি নি আমি… আপনি কি করছেন আপনিই দেখুন! আপনি এই যে ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছেন, আমার কথা ছাড়ুন… না ভাবলেন আমার বা আমার পরিবারের কথা… আপনার নিজের পরিবারের উপর এই ঘটনাগুলো কি প্রভাব ফেলবে, আপনি সেটাও ভাবছেন না… এরপরেও যদি জানতে চান কি আছে ওর কাছে যা আপনার কাছে নেই, তাহলে উত্তরটা হলো, ওর কাছে আছে আমার ২২টা বছর…”
স্তম্ভিত হয়ে বসে আছে শায়না। চোখের পানি গড়িয়ে পড়তেও ভুলে গেছে যেন। ওর জীবনে এভাবে কখনও অপমান হয়েছে বলে ও মনে করতে পারলো না। ও কি এতোটাই অযোগ্য? এতোটাই আত্মসম্মানজ্ঞানহীন? এতোটাই ভুলের সমুদ্রে ডুবে আছে ও? রোহান! ওর ভালবাসার মানুষ এভাবে এই কথাগুলো বলতে পারলো ওকে?
ঠিক এই সময় যে দোকানের টেবিলে ওরা বসা, সেই দোকান থেকে একজন অল্পবয়সী ওয়েটার এসে দাঁড়ালো ওদের টেবিলের পাশে। শায়নার মাথায় কাজ না করলেও রোহান চট করেই বুঝে গেলো কেন এসেছে ছেলেটা এখানে। আশেপাশের লোকজন বিরূপ হয়ে উঠছে ও টের পাচ্ছে। একটা মেয়ে এভাবে উত্তেজিত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে কথা বলছে, সকলে ধরেই নিয়েছে যে রোহানই এমন কিছু ঘটিয়েছে যার জন্য মেয়েটার এই অবস্থা। দোকানের ভেতর থেকে নিশ্চয়ই কর্মীরাও খেয়াল করেছে, সেই কারণেই এগিয়ে এসেছে ছেলেটা শায়নার কোনও সাহায্য লাগবে কিনা দেখতে। ছেলেটা এসে জিজ্ঞেস করলো, “স্যার আপনাদের আর কিছু লাগবে?”, বলেই একটু হাসলো, “ওহ! আপনারা তো আপনাদের অর্ডারের কিছুই এখনও শেষ করেন নি!… এনিথিং রঙ, স্যার?”
রোহান কিছু বলার আগেই একটা কর্তৃত্বপূর্ণ মহিলাকণ্ঠ ভেসে এলো ছেলেটার পেছন থেকে, “রোহান!… তোমার মিটিং হলো? আমার কিন্তু কেনাকাটা
শেষ!”
শায়না এক দৃষ্টে চেয়েছিলো রোহানের দিকে। বিস্মিত হয়ে দেখলো, ক্ষণিকের জন্য যে উদ্বেগটা ফুটে উঠেছিলো রোহানের চেহারায়, মুহূর্তেই সেটা কেটে গিয়ে স্বস্তি ফিরে এলো সেখানে। নরম হয়ে এলো চোখের দৃষ্টি। মহিলা কন্ঠটা অনুসরণ করে ও তাকালো ওয়েটার ছেলেটার পেছনে, একই সাথে ঘুরে তাকালো ছেলেটাও। বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো শায়নার। স্মিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে নীলা। পরণে গাঢ় সবুজ জামদানী, হাই নেক ব্লাউজ, থ্রি-কোয়ার্টার হাতা, ঈষৎ কোঁকড়া চুলগুলো আলতো খোঁপা করা কাঁধের কাছে, একটা কাঠের কাঁটা গুঁজে দেয়া সেখানে, কপালে গাঢ় সবুজ ছোট একটা টিপ, কানে একটা করে পান্না বসানো আয়তক্ষেত্র শেপের সোনার দু’টো দুল, গলার স্বর্ণের চেইনে বুকের উপর ঝুলছে সেই একই শেপের পান্না বসানো একটা লকেট, চোখে ভারী কালো ফ্রেমের চশমা, একে অন্যের উপর চেপে বসা পাতলা দুই ঠোঁটে ন্যুড শেডের ম্যাট লিপস্টিক, বাঁ হাতে চামড়ার চিকন গাঢ় খয়েরি রঙের চামড়ার বেল্টের একটা ঘড়ি, ডায়ালটাও রেকট্যাঙ্গুলার, আর বাঁ হাতের অনামিকায় একটা হীরার আংটি। কাঁধে ঘড়ির বেল্টের মতোই ডার্ক ব্রাউন রঙের একটা বড় ব্যাগ, সেখানে উঁকি দিচ্ছে দু’টো অফিশিয়াল ফাইল, বোঝাই যাচ্ছে রোহানের মতোই সেও অফিস থেকেই এসেছে, হালকা ঘাম কপালে, শান্ত চেহারায় ঈষৎ ক্লান্তি, সারাদিনের অফিশিয়াল হ্যাজার্ড সামলে আসার চিহ্ন। হাতের পায়ের ম্যানিকিউর করা নখে নেইল পলিশ নেই এই মুহূর্তে, পায়ে ওই একই ডার্ক ব্রাউন রঙের সামান্য হিলের জুতো। পাঁচ ফুট পাঁচ প্রায় মহিলার উচ্চতা, কাঁধ গড়পড়তা মেয়েদের তুলনায় কিছুটা চওড়া, উচ্চতা আর পোক্ত গঠন এমনিতেই তাকে একটা এক্সট্রা এ্যাডভান্টেজ দিয়েছে, প্রথম দর্শনেই তার উপস্থিতির ওজন বুঝে যায় লোকে। হালকা মেদ শরীরে, বেশ একটা সম্পন্ন, সুখী গার্হস্থ্যের ছাপ রেখে গেছে তার চেহারায়। প্রথম নজরেই যে কথা মনে আসে মহিলাকে দেখলে তা হলো, গোছালো, আত্মবিশ্বাসী, ঘরে এবং বাইরে কর্তৃত্বপরায়ণ একজন মানুষ তিনি। ভারী চশমার কাঁচ ভেদ করে নিজের উপর ওই দুই চোখের দৃষ্টি পড়ামাত্র অনুভব করলো শায়না যে তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন ওই হালকা বাদামী মণির চোখের মালকিন।
কান্না থেমে গেছে শায়নার। সামনা সামনি নীলাকে দেখছে এই প্রথম ও। চোখের কোণা দিয়ে দেখলো রোহান উঠে দাঁড়িয়েছে নিজের অফিসের ব্যাগ নিয়ে। ঘুরে দাঁড়িয়ে মহিলাকে দেখে ওয়েটার ছেলেটাও একটু থমকে গেছে মনে হলো। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, “ম্যাম! আপনি কি উনাদের সাথেই? চেয়ার দেবো আরেকটা? কিছু অর্ডার করবেন?”
শায়নার উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ছেলেটার দিকে তাকালো নীলা, হাসলে দেখা গেলো ডান দিকে একটা গজদন্ত ওর। বললো, “না রে! আজকে এখন কিছু অর্ডার করবো না… হাজবেন্ডকে নিতে এসেছি… ওর কাজ হলে বাড়ি ফিরবো এবার…”, স্নেহ আর ব্যক্তিত্বের মিশেল কণ্ঠে। ছেলেটা গলে গেলো সাথে সাথেই।
একটা মুহূর্তে, একটা বাক্যে যেন পুরো দৃশ্যটার পট ঘুরিয়ে দিলো নীলা নিমেষে! টেনশন তৈরি হয়েছিলো যেখানে, ওর এমন সাবলীল উপস্থিতি, নিজের পরিচয় এবং রোহানের সাথে সম্পর্ক খোলসা করে বলা, সব মিলিয়ে মুহূর্তেই যেন সেই টানটান ভাবটা সরে স্বাভাবিক হয়ে এলো পরিস্থিতি। উৎসাহী কিছু চোখ তখনও ওদের দিকে, এরপরে আরও নাটক হয় কিনা দেখার প্রত্যাশায়। কিন্তু নীলার হাসিটাই যেন একটু আগের অস্বাভাবিকত্বটাকে ধুয়ে দিলো পুরোটা। শায়না শুধু বোবা হয়ে চেয়ে রইলো।
একটু আগেই রোহানকে এক রকম চ্যালেঞ্জ করেই জিজ্ঞেস করেছিলো শায়না যে নীলা জানে কিনা যে এই মুহূর্তে ওরা দু’জন একসাথে। শায়না বুঝলো, নীলা সবটাই জানে শুধু না, এক সাথে এসেছেও এখানে ওরা। শুধু রোহানকে ওর সাথে কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে অন্য কোথাও ছিলো হয়তো এতোক্ষণ। শায়না বুঝলো তখন টেক্সটটা রোহান নীলাকেই করেছিলো এখানে চলে আসারা জন্য। এতোক্ষণ পরে শায়না যেন পুরোপুরি হেরে গেলো। ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়লো ওর সমস্ত আশা, স্বপ্ন, জেদ। রোহান উঠে দাঁড়ালেও ও বসেই রইলো মাথা নিচু করে। অনুভব করছে যে নীলার দৃষ্টি ফিরে এসেছে ওর উপর। কিন্তু ওর আর মুখ তুলে তাকাতে ইচ্ছে করলো না। টপটপ করে গড়াচ্ছে দু’চোখের পানি।
রোহান বলছে শুনলো শায়না, “হ্যাঁ… আমার কাজ শেষ… তোমার কেনাকাটা হয়েছে? ছেলে কই?”
“ও ওই পেছনের দোকানটায় দাঁড়ালো একটু!… ছোটির জন্য দই ফুচকা না কি যেন নেবে!… ওরা ভালো বানায় নাকি…”
“ওহ… তুমি তোমার জুতা নিয়েছো?”
“নাহ… আমারটা পরে নেবো… আব্বুর জন্য যে জুতোটা দেখছিলাম গতবার… সাইজ পাই নি… ওটার সাইজ এসেছে দেখলাম… তাই ওটা নিয়ে নিলাম আজকে… আব্বুর সকালে হাঁটতে যেতে সমস্যা হচ্ছে ক’দিন ধরে… আমারটা পরে নিলেও চলবে…”
“ওটা নিয়েছো ভালো কথা… কিন্তু তোমারটা নিলে না কেন!… এখন নামার পথে নিয়ে নেবে চলো… তোমার ব্যাক পেইনটা বাড়ছে… ওটা জরুরী হয়ে গেছে… পরে পরে করে অনেক দিন হয়ে গেছে… এখনই নিয়ে নাও…”
“আচ্ছা! ঠিক আছে নিয়ে নেবো… তো… পরিচয় করিয়ে দেবে না?”
এই কথা বলাতে শায়নার দৃষ্টি অটোমেটিক্যালি উঠে গেলো নীলার দিকে। ওর চোখ ভর্তি তখনও পানি। অবাক ব্যাপার হলো, নীলা কিন্তু জিজ্ঞেস করলো না যে ও কাঁদছে কেন বা চোখে পানি কেন এমন কিছু। সে শুধু মৃদু হেসে বললো, “হ্যালো!… আমি নীলা… আপনি নিশ্চয়ই শায়না!… শুনেছি আপনার কথা আমার হাজবেন্ডের কাছে বেশ কয়েকবার…”
শায়নার ঠোঁট কেঁপে উঠলো, কিছু বলতে পারলো না। উঠে দাঁড়াবার শক্তিটাও পাচ্ছে না।
নীলা যেন বুঝলো ওর অবস্থাটা, একটু সিরিয়াস হয়েই এবার জিজ্ঞেস করলো, “আপনার কি আরও কোনও কাজ আছে এখানে? নাকি ফিরবেন এখন? আমরা কি আপনাকে কোথাও নামিয়ে দিতে পারি নাকি গাড়ি আছে সাথে?”
শায়না চেয়েই আছে নীলার দিকে। নীলাকে দেখে একটুও মনে হচ্ছে না যে বিন্দুমাত্র কোনও বিদ্রূপ বা খোঁচা আছে ওর গলায়। শায়না দেখলো রোহান আলতো করে নীলার বাহু স্পর্শ করে কিছু একটা ইশারা করলো। না চাইতেও রোহানের ইশারা অনুসরণ করে নিজের চেয়ারের পেছন দিকে তাকালো শায়না। আর তারপরেই জমে গেলো নিজের জায়গায়।
ওর ঠিক পেছনের টেবিলে ৩জন মানুষ বসা। তাঁদের ৩ জনের দৃষ্টিই এখন ওদের ৩ জনের দিকে, যেমন ওদের দৃষ্টি তাঁদের দিকে। মানুষ ৩ জন হলেন শায়নার বাবা-মা এবং বড় ভাই। শায়নার বড় ভাইয়ের দিকে চেয়ে রোহান বললো, “আমি কলটা এবার কাটছি… আশা করি কোনও ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ নেই!” তারমানে ওদের পুরো কথোপকথন শুনেছে শায়নার বড় ভাই! শায়না এতোক্ষণ খেয়ালই করে নি যে রোহানের কানে ব্লুটুথ! এতোটাই উত্তেজিত ছিলো আজকের এই সাক্ষাৎ নিয়ে! ভীড় আর হইচইয়ের মধ্যে কথা এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে স্পষ্টভাবে শোনা নাও যেতে পারে, সেই জন্য ফোনে কানেক্টেড ছিলো রোহানের সাথে ওর ভাই! স্তব্ধ হয়ে গেলো শায়না। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে ওর। টের পেলো, একটু আগে যে মনে হচ্ছিলো আশে পাশের সকলে রোহানকে দোষী ভাবতে যাচ্ছে ওর কারণে, রোহান আদতে তেমন কোনও বিপদে ছিলো না! নীলা আসবে ও জানতো, এও জানতো যে শায়নার পরিবারও আছে! এই জন্যই শান্ত ছিলো ওভাবে!
কয়েকটা নীরব মুহূর্তের পরে মুখ খুললো রোহান, “সরি মিস শায়না… এছাড়া আমার আর কোনও উপায় ছিলো না… আপনাকে যেহেতু কোনভাবেই বোঝাতে পারছিলাম না আমি, তাই আমাকে আপনার ফ্যামিলিতে যোগাযোগ করতেই হয়েছে… আমি চাকরি ছেড়ে দিলে অন্য জায়গায় চাকরি পেয়ে যাবো নিশ্চয়ই, কিন্তু আপনার পাগলামি না কমলে সারাজীবন তো আমার পক্ষে পালিয়ে বেড়ানো সম্ভব না! আর আপনারও মুভ অন করাটা খুব জরুরী, তাই…”
চলে যেতে গিয়েও ফিরে দাঁড়ালো রোহান, “মিস শায়না, একটু আগে বলছিলাম যে আপনি এতোটাও ছোট নন যে বাস্তবের জ্ঞান থাকবে না আপনার… এখন বলছি… আপনি এতোটাও বড় হয়ে যান নি যে নিজেকে শুধরে নিতে পারবেন না… আপনার সামনে বিরাট লম্বা জীবন… এটা জীবনের একটা ছোট্ট ফেইজ মাত্র, সামান্য ভুল… ক্ষমার অযোগ্য এমন কোনও অপরাধ আপনি করে ফেলেন নি যে এখান থেকে ফেরার আর কোনও পথ নেই… স্বাভাবিক হোন… একটু অন্যভাবে দেখুন… আপনার জন্য যে পথ নির্ধারিত, ঠিক সেই পথের খোঁজ পেয়ে যাবেন… সাজিয়ে নিন নিজের মতো… আর আমিও এসব কিছুই মনে রাখবো না… আপনার জন্য শুভকামনা থাকবে সব সময়… আসছি…”
বলা বাহুল্য শায়নার এ্যাপয়েন্টমেন্টের সময় অফিসে দেয়া তথ্যের মধ্যেই ওর ঠিকানা, ইমার্জেন্সীতে যোগাযোগ পরিবারে কার সাথে করতে হবে এগুলো দেয়া ছিলো, তাই রোহানের জন্য ওর পরিবারে যোগাযোগ করাটা কঠিন কিছুই ছিলো না। এই মুহূর্তে শায়নার মা-বাবা-ভাই অপার বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে নিজেদের মেয়ের দিকে। যা উনারা দেখলেন এবং নিজ কানে শুনলেন, তা কি মেয়ের পাগলামি বলবেন নাকি মেয়ের অধোঃপতন নাকি যুগের দোষ, সেটাই ভেবে চলেছেন স্তম্ভিত হয়ে। উনাদের ৪ জনকে ওভাবেই রেখে নীলা আর রোহান ভদ্রতাসূচক সালাম দিয়ে এবং সংক্ষিপ্তভাবে বিদায় নিয়ে এগিয়ে গেলো নিজেদের গন্তব্যের দিকে। এই ৪ জনের এখন বেশ কিছু বোঝাপড়া বাকি নিজেদের সঙ্গে, এবং সেখানে বাইরের কারও উপস্থিতি বাঞ্ছনীয় নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবারের কাছেই থাকে সব ক্ষতের প্রলেপ আর সব সমস্যার সমাধান। নীলা আর রোহান শুধু এটুকুই আশা করতে পারে যে শায়নার পরিবার ওর ক্ষেত্রে সঠিক কোনও সিদ্ধান্তই নেবে ওর পাশে থেকে, এবং এমন কিছু করবে না যাতে ওর পরবর্তী জীবনে আরও গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। ওর মনের ভুল পথের দিশা বদলে সঠিক পথ খুঁজে পেতে সাহায্য করবে। কিন্তু সেখানে আর নীলা বা রোহানের কিছু করার নেই। এটা এখন একান্তই শায়নাদের পারিবারিক ব্যাপার।
দু’জন ওরা যখন একা হলো, নীলা প্রশ্ন করলো হালকা চালে, “কি গো! এতো সুন্দর একটা মেয়েকে কাঁদিয়ে রেখে আসলে, মনটাতে একটু একটু কষ্ট হচ্ছে না কি গো?”
রোহান হাসলো, “যা কিছু চক চক করে তাই কি সোনা হয়? মনের মানুষ মনে হলেই কি সে মনের মানুষ হয়? আমাকে নিয়ে যা ভেবেছে মেয়েটা তা ভুল ছিলো… কষ্ট হচ্ছে না, তবে খারাপ লাগছে এটা ভেবে ফ্যামিলি যা জানলো, তারপরে মেয়েটার সাথে কি ট্রিটমেন্ট হয়…”
“হুম্মম… আচ্ছা! সত্যি করে বলেন তো মিস্টার রোহান আহমেদ!… একটুখানি হলেও কি শায়নার প্রতি আপনি দুর্বল হন নি?” চোখের তারায় কৌতুক নীলার। তবু রোহান বুঝলো এই কৌতুকে লুকানো বিপদ সংকেত। সিদ্ধান্ত নিলো সিরিয়াসলি প্রশ্নটার উত্তর দেয়ার।
আলতো করে কাঁধ জড়িয়ে ধরলো নীলার, বললো, “মাই ডিয়ার ওয়াইফ… তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে বিয়ের আগে সিগারেট খেতাম আমি!… বিয়ের পরেও খেয়েছি তোমার বারণ স্বত্ত্বেও…ছেড়ে দিয়েছি তুমি প্রথমবার প্রেগ্ন্যান্ট হওয়ার পরেই… কিন্তু তারপরেও বহু বছর পর্যন্ত আমার কিন্তু সিগারেটের ক্রেভিং ছিলো… ঘ্রাণ পেলেই পাগল হয়ে উঠতাম… যে কোনও নিষিদ্ধ আকর্ষণও ঠিক সেরকমই… এই আকর্ষণ থাকবেই… নানান ফর্মে… নানান জায়গায়… নানান ভাবে… কিন্তু তার মানে এই না যে থাকলেই তার উপর হামলে পড়তে হবে… আমি দুর্বল হয়েছি কি হই নাই সেটার চাইতেও জরুরী হলো, এটা যে আমার জন্য ক্ষতিকর, আমাদের জন্য ক্ষতিকর… সেই জ্ঞানটুকু আমার আছে… এ্যান্ড দ্যাটস অল দ্যাট ম্যাটারস… তবে হ্যাঁ… আমি আশা করবো এটা নিয়ে আর ফারদার খোঁচাখুঁচি তুমি করবে না… যা হয় নি… সেটাকে সমস্যা বানিয়ে আমাদের জীবন কমপ্লিকেটেড করার কোনও দরকার আছে কি? এমনিতেই এই বিষয়টা যথেষ্ট ভুগিয়েছে আমাকে… আর তিতা করো না এটাকে প্লিজ!”
হাসলো নীলা, “নাহ… তার দরকার নেই… কিন্তু তার মানে তুমি এটাও ভেবো না ডার্লিং, যে আমি তোমাকে চোখে চোখে রাখবো না… তোমার উপর নজর আমার সবসময়েই থাকবে…”
হাসলো রোহানও, “আই নো মহারাণী! মাই সুইট হার্ট!… ট্রাস্ট মি… আই নো…”।।
সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে