দৃষ্টির_সীমানা
পর্ব০২ (শেষপর্ব)
#লিখা জান্নাতুল ফেরদৌস
রুমে এসে মেঘ চিরকুটটা খুলে দেখল।তন্ময় ওর জন্য কিছু লিখেছে।
“তোমাকে দয়া করে আমি বিয়েটা করছি না।বিয়েটা কেন করছি তার উত্তর তুমি কালকেই পেয়ে যাবে। আর বিয়েটা হচ্ছেই এবং সেটা তোমার সাথে।তোমাকে বিয়ে করে এরপর আমার দৃষ্টির সীমানা যতটুকু যায় ততটুকু জায়গা আমি তোমাকে নিয়ে সাথে ঘুরব আর ভালবাসবো।কালকে আবারো দেখা হচ্ছে তোমার সাথে।তোমার বাসায় এসে কালকে আমি তোমাকে নিতে আসবো। কান্নাকাটি একদম করবে না আর নিজের যত্ন নিবে।”
চিরকুটটা পরে মেঘ মনে মনে ভাবছে,
-“আচ্ছা লোকটা কি সত্যিই এত ভালো না ভালো হওয়ার অভিনয় করছে।আমার মত মেয়েকে নিঃস্বার্থভাবে উনি বিয়ে করবেন বিশ্বাস হচ্ছে না।আচ্ছা আমিতো পঙ্গু….. আমাকে দিয়ে তো কোন কাজ হবে না। একটা ফেলনার সমতুল্য আমি তাহলে!তাহলে আমার সাথে লোকটা বা লোকটার পরিবারের তেমন ভালো সম্পর্ক থাকবে না তাহলে ওরা কি টাকার জন্য আমাকে ওদের বাড়ির বৌ বানাতে চাচ্ছে?কিন্তু আমাদের তো এতো সার্মথ্য নেই।
কিন্তু লোকটা বা লোকটার পরিবারকে এত খারাপ মনে হচ্ছে না তারপরও প্রথম দেখায় এত বিশ্বাস করতে নেই।খুব ভয় হচ্ছে।পঙ্গু হয়ে গেলাম বলে মা বাবার সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নিতে হচ্ছে। জানি না কি আছে কপালে!”
.
.
এরপরের দিন,
-“কেমন আছেন আন্টি?”
-“এইতো বাবা,, ভালো আছি। তুমিসহ তোমার পরিবারের সবাই কেমন আছে?”
-“আন্টি সবাই ভালো আছে।আন্টি মেঘকে নিয়ে একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসতে চাচ্ছিলাম।”
-“হ্যা যাও না বাবা। কোন সমস্যা নেই।তবে তাড়াতাড়ি বাসায় এসে যেও।”
-“জ্বী আন্টি।”
-“কিন্তু যাওয়ার আগে একটু নাস্তা করে যাও বাবা।”
-“না,না আন্টি এইসবের কিছু লাগবে না।”
-“তোমার না না তো আমি শুনব না।তুমি আসবে বলে তোমার জন্য অনেক কিছু বানিয়েছি।কিছু একটা তো মুখে দাও।”
-“আন্টি এই যে পিঠাটা নিলাম। ব্যস এতটুকুই আর না।এরপর কিন্তু সত্যি দেরি হয়ে যাবে।আরেকবার বাসায় আসলে পেটভরে খেয়ে যাব।এখন আসি তাহলে,”
-“আচ্ছা যাও তাহলে তোমরা।”
মেঘকে কোলে তুলে গাড়িতে বসাল তন্ময়।এরপর ওরা একটা পার্কে আসল।
.
.
-“কি কথা বলার জন্য আমাকে এখানে নিয়ে আসলেন?!
-“হুম সব বলব।তার আগে বল কিছু খাবে। আইস্ক্রিম, চকলেট আনবো তোমার জন্য।”
একপাশ হেসে মেঘ বলল,,
-“এইসবের কিছু লাগবে না।পানির তৃষ্ণা পেয়েছে একটু। পানি খাব….।”
-“আচ্ছা পানি গাড়িতে আছে একটু ওয়েট কর এখনি নিয়ে আসছি আমি।”
-“হুম।”
.
.
কিছুক্ষণ পর,তন্ময় মেঘকে ডাক দিয়ে বলল,,
-“এই নাও পানি,”
-“থ্যাংকস।”
মুচকি হেসে তন্ময় বলল,,
-“থ্যাংকস নেওয়ার মত কিছুই আমি করে নি।নিজের হবু বউ যে কয়েকদিন পর আমার পার্মানেন্ট বউ হবে তার জন্য মানে আমার জন্যি কাজটা করেছি।এতে থ্যাংকস বলার মতন কিছুই হয়নি।”
-“………….”
-“আচ্ছা তোমার কাছে আমার কথাবার্তায় খুব অবাক লাগছে না!কালকে প্রথমে তোমাকে আপনি করে ডেকে তোমার সাথে কথা বললাম আর এরপর আপনি তুমি গড়মিল করে ফেললাম।আবার আজকে তোমাকে তুমি করে ডাকছি।আমার এইরকম ব্যবহারে আমাকে তোমার আজব প্রাণি মনে হচ্ছে না!”
-“হ্যা প্রথম প্রথম তাই মনে হয়েছিল।এরপর এর কারণটা আমি বুঝতে পেরেছি।প্রথম দেখায় কথা বলায় এইরকম কনফিউশন সবার হয় এটাই স্বাভাবিক।তাই এতে ভাববার কিছু নেই।আপনি এখন যা বলতে চান বলে ফেলুন।”
.
.
-“আমারটা পরে শুরু করি আগে তোমারটা শুরু কর।”
-“কথা কিন্তু এইরকম ছিল না।”
-“হ্যা জানি।কিন্তু কি বলতো তোমার ব্যাপারে অনেক কিছু জানার আগ্রহ আমার আছে।সেগুলো না জানতে পারলে মনটা কিছুতেই শান্ত হবে না।আগে নিজের মনটাকে শান্ত করি এরপর না হয় আমি তোমাকে যা বলতে এসেছি সব খুলে বলব।”
কিছুটা বিরক্ত হওয়ার নিঃশ্বাস ফেলে মেঘ বলল,,,
-“আচ্ছা তাহলে বলে ফেলুন কি জানতে চান আমার ব্যাপারে।”
-“বেশি কিছু জানতে চাই না শুধু আজকে এতটুকু জানতে চাই তোমার এই অবস্থাটা কি করে হল?এর পিছনের ঘটনাটা আমি জানতে চাই।”
তন্ময়ের এই কথায় মেঘ ওর দিকে কয়েক সেকেন্ডের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে চোখের দৃষ্টি অন্যদিকে নিয়ে যায়।
-“এইসব কথা বলতে আমি ইচ্ছুক নই।”
-“কিন্তু আমিও যে নাছোড়বান্দা।আমার বউয়ের আজকে যে অবস্থা হয়ছে তার পিছনের রহস্যটা তো আমাকে জানতেই হবে।”
-“আমি জন্মগতভাবে পঙ্গু।”
-“থাপ্পড় দিব একটা।ফাজিল মেয়ে।ফাজলামি করার জন্য তুমি আর মানুষ পেলে না, না?আমরা এখন সিরিয়াস একটা ব্যাপার নিয়ে কথা বলছি আর তুমি?”
তন্ময়ের ধমকভরা কথা শুনে মেঘের গলাটা শুকিয়ে গেল।এই লোকটার এত রাগ কেন!
-“কি হল চুপটি না মেরে আমাকে সব খুলে বল কি করে এতকিছু হল?আমি জানি তুমি জন্মগতভাবে পঙ্গু নও।তোমাকে বিয়ে করব তাই বিয়ের আগেই তোমার সব খোঁজখবর নিয়ে রেখেছি আমি।”
-“তাহলে আমার এইরকম অবস্থা কিভাবে হল সেটাও নিশ্চয় জেনে নিয়েছেন?”
মেঘের সাহস দেখে তন্ময় অবাক হয়ে যাচ্ছে। একটু আগে সে কাকে বকা দিল।একটু আগের বকা খাওয়ার পরও ও তন্ময়ের মুখের উপর দিয়ে কথা বলছে!
-“সে কথা বাদ দাও।আমি তোমার কাছ থেকেই সব সত্যি জানতে চাই।”
-“হায়রে কিরকম মানুষ উনি!আমার পঙ্গু হওয়ার কাহিনীও এখন উনাকে রসিয়ে কষিয়ে শুনাতে হবে।কতটা আক্কেল আর খারাপ হলে একজন মানুষ আরেকটা মানুষের কষ্টের কথাগুলো পেট থেকে বের করে।”(মনে মনে)
.
.
আচ্ছা শুনোন তাহলে,,,
-“সেটা কয়েকমাস আগের কথা।তখন আমার সাহিল নামের একটা লোকেরর সাথে এনগেজমেন্ট হয়।লোকটা বেশ ভালোই, আচার-আচরণও ভালো ঠিক আপনার মতন।”
তন্ময় বুঝতে পারল মেঘ ওকে ঠেস মেরেই কথাটা বলল।রাগ উঠলেও সে নিজের হাত মুঠি করে রাগটাকে কন্ট্রোল করল।
-“সাহিলের সবকিছু আস্তে আস্তে আমার ভালো লাগতে শুরু করে।কারণ ও আমাকে প্রতিবারই একটা জিনিস অনুভব করাত ওর লাইফে আমি কতটা ইম্পরটেন্স রাখি।আস্তে আস্তে আমাদের বিয়ের দিনতারিখও ঘনিয়ে আসতে থাকে।বিয়ের দুই দিন আগে আমি বিয়ের কাপড় কেনাকাটা করার জন্য ফ্রেন্ডের সাথে শপিং করতে গেলাম।কেনাকাটা শেষ করে বাইরে আসতে দেখি একটা লোক মোবাইলে কথা বলতে বলতে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছে।লোকটাকে অনেকবার সেখান থেকে সরে আসতে বললেও সে সরেনি।আমার গলার আওয়াজ হয়ত তার কানে যায় নি।হঠাৎ একটা ট্রাক আসতে দেখি।ট্রাক চলার স্পিডটাও বেশি ছিল।লোকটাকে চোখের সামনে মরতে দেখার মতন সাহস আমার ছিল না তাই দৌঁড়ে তাকে সরাতে গিয়ে আমি নিজেই ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে যায়।”
.
.
-“আর সেই লোকটা কি এরপর আপনার আর খোঁজ নেই নি?”
-“বান্ধবীর কাছে শুনেছি ওনি নিজেই আমাকে মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছেন।একজন মানুষের সেবার জন্য যা যা করা লাগে তা করেছেন।কিন্তু উনার হয়ত কোন একটা দরকারি কাজের খবর এসেছিল তাই কিছু না বলেই চলে যান।”
-“…………”
-“এরপর আর দেখা হয়নি উনার সাথে।”
-“না, কয়েকদিন পর বাসায় চলে আসি।আর দেখা হয়নি।”
-“আমি মনে করি লোকটা খুব স্বার্থপর। কারণ তুমি যার জন্য নিজের জীবনটা বাজি রেখেছিলে সে তোমাকে ফেলে চলে গেছে।তাও তোমার দুর্দিনে।”
-“আর আমি মনে করি সে এতটাও খারাপ না।শুধু শুধু কাউকে না বুঝে দোষ দেওয়াটাও উচিত না।এটা নির্বুদ্ধিতার লক্ষণ।উনি একমাসের জন্য কাজের উদ্দেশ্য দেশের বাইরে যান। তাই কাজে যাওয়ার আগে ডাক্তারকে বলে গেছেন আমার সব খবরাখবর যাতে তাকে দেওয়া হয়।আমি যে আমার একটা পা হারিয়েছি তা বাইরের মানুষকে বলে কি লাভ হত?কোন লাভই হয় না।তাই শুধু শুধু বাইরের একটা মানুষকে অযথা বিরক্ত করে তাকে দেশের বাইরে থেকে আনার কোন মানে হয় না।আমি জানতাম তিনি উনার দায়িত্ববোধের খাতিরে ঠিকই এখানে চলে আসতেন।”
-“এমনটা মনে হওয়ার কারণ!”
-“চোখের পানি।এক্সিডেন্টের সময় জ্ঞান হারানোর আগে উনার চোখ দিয়ে যে পানি পড়ছিল তা আমি অনুভব করেছিলাম।তাই এই কথাটা আমার মনে হল………।”
.
.
তন্ময় অবাক হয়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে।মেয়েটা এত ভালো কেন!এত কিছু হওয়ার পরও মেঘ ওই লোকটার উপর কোন দোষ চাপাচ্ছে না!
-“তারপর ও বলব ওই লোকটার কারণেই আজকে তোমার এই অবস্থা।”
-“এইসব কিছু আমার কপালে ছিল।কপালে ছিল বলেই আমার সাথে এতকিছু হয়েছে। আমি এতে উনার কোন দোষ দেখছি না।হ্যা দোষ উনার ছিল যদি উনি রাস্তার মাঝে কেয়ারলেস ভাবে না দাঁড়াতেন………। তারপরো বলব আল্লাহ কপালে যা লিখে রাখছে সেটাইতো হবে।তা উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমাদের কারোররই নেই।অবশ্য এইসব হওয়ার মনে হয় দরকারও ছিল না হলে মানুষের আসল চেহেরার রং কিভাবে দেখতাম।”
-“……………..”
-“সাহিল আমার এই অবস্থা দেখে ওর চেহেরার রং বদলাতে শুরু করে।এককালে ও যে আমাকে ভালোবাসত সেটা ওকে দেখে তখন আর মনে হত না।আমার জন্য ওর যে ভালোবাসা জমা ছিল সেটা হয়ত আমার এই অসহায়ত্বের কারণে শেষ হয়ে গেছে।আমার বিয়েটা ভেঙ্গে গেল।সাহিল নিজেই বিয়েটা ভেঙ্গে দিয়েছিল।কারণ ও বুঝে গিয়েছিল আমার মত পঙ্গু মেয়ের দ্বারা ওর জীবনের প্রয়োজনগুলো মিটানো সম্ভব না তাই……..। আর আমিও যাকে মনে মনে ভালোবেসেছিলাম তার আসল ভালোবাসা সেদিন দেখতে পারলাম।অবশ্য ও ঠিকইই করেছে।এখানে আমি ওর কোন ভুল দেখছি না।পঙ্গু মেয়েকে বিয়ে করে ও তো আমাকে আর ননীর পুতুল হিসেবে সাজিয়ে রাখবে না। যে মেয়ে তার স্বামী,সংসারের কোন কাজে আসে না তাকে বিয়ে করে কি লাভ!সাহিল যা করেছে ঠিকইই করেছে।একদম ঠিক কাজ করেছে ও।”
মেঘের কথাগুলো তন্ময় এতক্ষণ ধরে মনোযোগ দিয়ে শুনল।মেয়েটা এতদিন অনেক কষ্ট পেয়েছে আর না….। কোন দোষ ছাড়াই মেয়েটাকে আর কষ্ট দেয়া যাবে না।
.
.
-“মেঘ নাও পানি খাও।ভালো লাগবে।”
তন্ময়ের হাত থেকে পানির বোতলটা নিয়ে একটু একটু করে মেঘ পানি খেতে লাগল।মেঘের পানি খাওয়া অবস্থায়ই তন্ময় বলতে লাগল,,
-“১ মাস আগের ঘটনার জন্য আজকে তোমার যে অবস্থা হয়েছে তার জন্য আমি দায়ি।আমাকে বাঁচাতে গিয়েই তোমার এক্সিডেন্ট হয় আর তুমি তোমার পা হারাও।”
তন্ময়ের কাছ থেকে মেঘ এই ধরণের কথা আশা করে নি।আকস্মিকভাবে তন্ময়ের কাছ থেকে এই কথাটা শুনে পানি ওর গলায় উঠে গেল।
মেঘের কাশির আওয়াজ শুনে তন্ময় তাড়াতাড়ি করে ওর মাথায় আর পিঠে আস্তে করে বাড়ি মারতে লাগল।
.
.
-“মেঘ তুমি ঠিক আছো তো?”
তন্ময়ের প্রশ্নে মাথাটা নাড়ালাম।তন্ময়ের এই ধরণের কান্ডে আমার বাবার কথার মনে পড়ল।আমার অনেক সময় খাবার খাওয়ার সময়ে খাবার গলায় উঠে যায়।তখন বাবা আমার মাথায় আর পিঠে এইরকম আস্তে করে বাড়ি মারে।আজ তন্ময়ও সেই একি কাজটা করল।তন্ময়ের জন্য একটু আগে যে রাগটা আমার মনের মধ্যে ছিল তা নিমিষেই চলে গেল।হয়ত মেয়েরা এইরকমি।যেসব মেয়েরা তাদের বাবাকে ভালোবাসে তাদের বাবার গুণাবলি কোন ছেলের মধ্যে দেখলে মেয়েদের মনটা নরম হয়ে যায়।
মেঘ কিছু বলছি শুনতে পাচ্ছ তুমি?
-“হ্যা বলুন,,,”
-“মেঘ তোমার সাথে আজ পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে তার জন্য আমি দায়ি।”
-“আর সেই দায়বদ্ধতা থেকেই দয়া করে আপনি আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন এইতো?আমি আগেই জানতাম আমার মত মেয়েকে শুধু দয়া করা যায়।”
.
.
মেয়েটা একটু বেশিই বুঝে।আমার একটা সোজা কথাকে কিরকম উল্টা করে ঘুরিয়ে তেড়িবেড়ি করে উত্তরটা দিল।খুব রাগ উঠছে তন্ময়ের মেঘের প্রতি।মেয়েটা ওকে কেন বুঝতে চাই না।এরপর তন্ময় নিজেই বুঝতে পারল মেঘের এখানে কোন দোষ নেই। ওর সাথে যা ঘটেছে যা দেখেছে তাতে ওর মনটা অন্যরকম হয়ে গেছে।এইজন্য ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মেয়েটা একি কথা বলে।
-“মেঘ আমি এখনো কথা শেষ করেনি।আমার আরো কথা বাকি আছে।”
-“……………..”
-“তোমার বারবার মনে হচ্ছে আমি তোমাকে দয়া করছি।কারণ আমাকে তুমি বাঁচিয়েছ সেই দায়বদ্ধতা থেকে আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাইছি।মেঘ আমার মনে এইসব কিচ্ছু নেই।তোমাকে আমি ভালোবাসি।আর সেটাও অনেক আগে থেকে।”
-“কিহ!”
-“হ্যা যা শুনছ সব সত্যি। আমি তোমাকে অনেক আগে থেকেই ভালোবাসি।তোমার ছোট স্টুডেন্ট তিন্নি যাকে তুমি ছবি আঁকা শিখাও ওর কথা মনে আছে তোমার।”
-“হ্যা তিন্নি……. চিনি ওকে।অনেক প্রিটি একটা গার্ল।”
-“হ্যা….কিউটের ডিব্বাটা আমার।ও আমার বড় ভাইয়ের মেয়ে।তোমার কাছ থেকে ছবি আঁকা যেদিন থেকে ও শিখছে সেদিন থেকেই ও বাসায় এসে তোমার কি প্রশংসাটা না করে।তিন্নির মেঘ ম্যাডাম অনেক ভালো, ওকে মাঝেমাঝে মজার মজার খাবার বানিয়ে খাওয়ায়, ওকে অনেক আদর করে আরো অনেক গল্প করে তোমাকে নিয়ে।তোমার কথা ওর মুখ থেকে আমার শুনাই লাগত নাহলে আমার এই কিউট চুলগুলো ধরে টানাটানি করে ও কি অবস্থাটা নাই করত”
মুচকি হেসে কথাটা তন্ময় বলল।
মেঘতো লজ্জায় তন্ময়ের দিকে তাকাতে পারছে না।না জানি পুচকি মেয়েটা গোপনে গোপনে উনাকে আর কি কি বলেছে।
.
.
-“তোমার গল্প ওর মুখ থেকে শুনতে শুনতে তোমার প্রতি ভালোলাগাটা কাজ করে।এরপর জানি না তোমাকে কখন আমি আমার নিজের অজান্তে ভালোবেসে ফেলেছি।আর মজার কথা কি জানো তোমার চেহেরা না দেখেই শুধু আমার কিউটিটার মুখে তোমার গল্প শুনে তোমাকে ভালোবেসেছি।তখন তুমি কিরকম তা আমি জানতাম না।আর তোমার বিয়ে যে সাহিলের সাথে ঠিক হয়েছিল তা আমি জানতাম না। এরপর এই এক্সিডেন্টটা হয়।আর তারপরতো তুমি জানোই কাজের উদ্দেশ্য একমাসের জন্য আমাকে দেশের বাইরে থাকতে হয়।কিন্তু সেখান থেকেই আমি তোমার সব খোঁজ খবর নিতাম ।খোঁজ খবর নিলাম ঠিকই অথচ আসল খবরটা জানতে পারলাম না তোমার কি ভয়ানক অবস্থা হয়েছে।
এরপর দেশে এসেই ঠিক করি আমি তোমাকে তিন্নির ম্যাডামকে বিয়ে করব যাকে আমি না দেখেই ভালোবেসেছি।তোমাকে ভালোবেসেছি সেটা পরিবারের সবাইকে জানাই।এরপর ওদের মুখ থেকেই শুনতে পারি তুমি এক্সিডেন্টে তোমার পা হারিয়েছ।জানো বুকের ভিতরটায় কি রকম কষ্ট হচ্ছিল।নিজের মনকে বারবার বুঝাচ্ছিলাম এইরকম কিছু হয়নি।কিন্তু তাই বলে তো সত্য আর ঢেকে রাখা যায় না।হয়ত আল্লাহ আমার পরীক্ষা নিচ্ছে তাই এতকিছু হয়ে গেল তোমার সাথে।ভালো যেহেতু তোমাকে বেসেছি তাই তোমাকেই বিয়ে করব সিদ্ধান্ত নিয়েছি সে তুমি যেমনি হও না কেন।আমার ভালোবাসা কোন সস্তা না যে তোমার বিপদে আমি তোমাকে ফেলে তোমার থেকে ভালো অন্য কাউকে ধরব।তাই তোমাকে দেখার জন্য তোমার ছবি ভাবির কাছে চাই।আর তোমার ছবি দেখেই বুঝতে পারি আল্লাহ আমার ভালোবাসার পরীক্ষা খুব ভালোভাবে নিচ্ছে।আমারি জন্য যে তোমার আজকে এই অবস্থা তা পরিবারের সবাইকে বলে দেই।আমার পরিবার সব বুঝতে পেরে তোমাকে আমাদের পরিবারের বউ হিসেবে মেনে নিতে সম্মতি জানাই।আর আমাকে তুমি না বাঁচালেও এইরকম পঙ্গু হলেও আমার পরিবার তোমাকে মেনে নিত।কারণ তোমার জন্য কি অনুভব করি তা তারা নিজের চোখের দেখেছে।এইসব ঘটনা আল্লাহর ইচ্ছায় হয়েছে। আমরা আর কিইবা করতে পারি তোমার এই কথাটাই আমার পরিবার মনেপ্রাণে মেনে নিয়েছে আর তোমার আমার জুড়ি আল্লাহ নিজ হাতে বানিয়েছি সেটা চাইলেই কি আমার পরিবাদ জোর করে তা ভাঙ্গতে পারবে!পারবে না তাই তারা সত্যিকারের মন থেকেই চাই তুমি আমার বউ হও আর আমাদের পরিবারের বৌমা হিসেবে থাক।তাই এর কয়েকদিন পর মা বাবাকে নিয়ে তোমাদের বাসায় আসা হয়।”
.
.
তন্ময়ের কথায় কেন জানি মেঘের একটু ভরসা করতে ইচ্ছে করছে।তারপরও ও বলে বসল,,,
-“আপনার আর আমার জুড়ি আল্লাহ লিখে রেখেছেন এতটা নিশ্চিত আপনি কি করে হলেন?
-“আল্লাহকে ভরসা করি আর আমার ভালোবাসার প্রতি অগাধ বিশ্বাস।তাছাড়া তোমার আর আমার সাথে যা হল আর যা হচ্ছে সব কিন্তু উনার ইশারায় হচ্ছে। তাই উনার প্রতি বিশ্বাস রেখেই আমি কথাটা বললাম।আর আরেকটা কথা বলতে চাই,”
-“বলুন,”
-“ধর,,একমাস আগে সাহিলের পরিবর্তে যদি আমার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হত আর তোমার এই এক্সিডেন্টটা না হয়ে যদি আমার সাথে এই এক্সিডেন্টটা হত তাহলে তুমি কি আমাকে বিয়ে করতে না?অথবা তুমি আমাকে ফেলে কি অন্য কারোর হাত ধরতে….এমন কাজ কি তুমি করতে?”
-“আমি এইরকম জঘণ্য কাজ কখনো করতাম না।ভালোবাসা মানেই বিশ্বাস। আর সেই বিশ্বাসটা সবসময় থাকা উচিত।ভালোবাসায় আরেকটা মূলকথা হল পরিস্থিতি যেরকম হোক না কেন ভালোবাসার মানুষটার হাত কখনো ছাড়তে নেই।আর এইসব আমি মন থেকে মানি।তাই আমার পক্ষে এইরকম জঘণ্য কাজটা কখনো করা সম্ভব না।”
-“আর আমাকে বিয়ে করাটা যদি তোমার দয়ার হয় তখন কি বলবে তুমি?”
-“ভালোবাসার মানুষকে আর যাই হোক দয়া করা যায় না।তাকে দয়া করলে ভালোবাসাটা আর কোথায় থাকে…..।”
-“আমার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই।আর এতক্ষণ ধরে এইসব কথায় আমি তোমাকে বুঝাতে চাইছি।এবার আশা করছি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর তুমি পেয়ে গেছ”
মুচকি হেসে কথাটা তন্ময় মেঘকে বলল।
-“লোকটা অনেক চালু সেটা কথা শুনেই বেশ বোঝা যাচ্ছে। শেষে কিনা আমাকে…. আমাকে তন্ময় নামের এই লোকটা আমার কথার জালে আমাকেই ফাঁসালো।তবে লোকটার সাথে কথা বলে বুঝলাম সে সত্যি আমাকে মন থেকে ভালোবাসে।যেখানে কোন ছলনা নেই,নেই হারানোর কোন ভয়।”
.
.
-“দেখি হাতটা সামনে আনো।”
-“কেন?”
-“আরে বাবা আগে আনোইই না এরপর না তোমার প্রশ্নের উত্তর পাবে।”
-“আচ্ছা…..”
-“দেখো কি এনেছি তোমার জন্য।”
-“শিউলি ফুলের মালা।”
-“হুম।”
-“তোমাদের বাগানের মততো আর আমাদের বাগানে শিউলি ফুলের গাছ নেই।এই ফুল কিনে নিজ হাতে তোমার জন্য মালা,হাতের বালা আর আংটি বানিয়েছি।এই ফুলের আংটি এখন তোমাকে পড়াব।পড়বে তো?”
মেঘ আর দেরি না করে তন্ময়ের সামনে হাতটা নিয়ে আসলো। আর তন্ময়ও মেঘের মতন তাড়াতাড়ি করে মেঘের হাতে শিউলি ফুলের বানানো আংটি পড়িয়ে দিল।
.
.
-“থ্যাংকস মেঘ আমাকে বুঝার জন্য।দেখিও তোমাকে বিয়ে করার পর কোন কষ্টই আমি তোমাকে পেতে দিব না।আমাদের দৃষ্টির সীমানা যতটুকুু পৌঁছবে ততটুকু পথ আমরা দুইজনে একসাথে পাড়ি দিব।”
-“হুম….।”
-“আচ্ছা তাহলে বাসায় যাওয়া যাক।”
-“হুম….।”
তন্ময় মেঘকে সাথেসাথে কোলে নিয়ে ফেললো।
-“আচ্ছা মেঘ একটা গান ধরি।”
তন্ময়ের এই প্রস্তাবে মেঘ অনেক খুশি হল।
-“হুম ধর…..”
যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়
যে ছিল হৃদয়ের আঙ্গিনায়
সে হারালো কোথায়
কোন দুর অজানায়
সেই চেনা মুখ কতদিন দেখিনি,
তার চোখে চেয়ে স্বপ্ন আঁকিনি।
যতখানি সুখ দিয়েছিলো
তার বেশী ব্যাথা দিয়ে গেল
সৃতি তাই আমারে কাঁদায়।
সে হারালো কোথায় কোন দুর অজানায়…….
যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়
যে ছিল হৃদয়ের আঙ্গিনায়
সে হারালো কোথায় কোন দুর অজানায়
যতটুকু ভুল হয়েছিলো
তার বেশী ভুল বুঝি ছিলো
কি যে চায় বলেনি আমায়।
সে হারালো কোথায় কোন দুর অজানায়।
সে হারালো………..
সেই চেনা মুখ কতদিন দেখিনি
তার চোখে চেয়ে স্বপ্ন আঁকিনি।
-“আপনার গানের গলা কিন্তু অসম্ভব সুন্দর তাই যখন এই গানটা গাচ্ছিলেন গানটা না গাওয়ার জন্য নিষেধ করতে পারিনি।কিন্তু এইরকম বিরহের গান কেন গাচ্ছেন?”
-“তোমাকে চিনার পর আর তোমার এই কষ্টের কথাগুলো শুনে আমার এই গানটায় বারবার মনে পড়ত তাই আর কি হঠাৎ করে এই গানটা গেতে ইচ্ছে করল।”
-“ও আচ্ছা…..।তবে এখন এই বিরহের গানটা গাবেন না অন্য গান ধরুন….”
তন্ময় মুচকি হেসে মেঘকে কোলে নিয়ে হেঁটে আরেকটা গান ধরল……
এই পথ যদি না শেষ হয়,
তবে কেমন হত তুমি বলত।
আর এইভাবেই অবশেষে দুটি মানুষের মনের দৃষ্টির সীমানার ভালোবাসা পূর্ণতা পেল।