||দৃষ্টিভ্রম|| ||অংশ: ২০||
সিন্থিয়া হাম্মাদের সাথে লেগে থাকে সারাক্ষণ। সবার সম্মুখে যখন তখন গা ঘেষাঘেষি করে। লজ্জা তাকে ছুঁয়েও যায়নি। শ্বশুর শ্বাশুড়ির সামনে নির্লজ্জের মতো আচরণ করে। তারা লজ্জায় ভেতরে চলে যায় কিন্তু তার এতে কিছুই আসে যায় না। হাম্মাদ তাকে কখনো কোনো কিছুতে বাঁধা দেয় না। সে জানে সিন্থিয়ার মস্তিষ্ক বিগ্রে গেলে পাগল হয়ে যাবে। তখন কাকে না আবার খুন করে বসে। এমনিতেও সিন্থিয়ার সকল পাপ কাজ সেই ঢেকে রাখছে শুরু থেকেই। সে যাই চায় তাই করতে দেয়। এসবের লিস্ট করলে হয়তো শেষ হবে না।
আজ সন্ধ্যায় শতরূপা আদিয়ানের ফ্লাইট। আদিয়ানের কোম্পানি তাকে চাকরির সুবাদে দুবাই পাঠাচ্ছে। বিকেলেই সবার থেকে বিদায় নিয়ে এয়ারপোর্টে চলে আসে তারা। বিদায় নেওয়ার জন্য সিন্থিয়া আর হাম্মাদকে পায় না। শতরূপার চেয়েছিল শেষবারের মতো তাদেরকে একবার দেখিয়ে নিতে। উৎসবকে কোলে নিয়ে ওয়েটিং এড়িয়ায় বসে আছে। এনাউন্সমেন্ট হয়ে গেছে সবাই প্লেনে চড়ে বসার জন্য। আদিয়ান উঠে দাঁড়ায়।
আচমকা শতরূপা বলল, “আমি বাবুকে নিয়ে একটু ওয়াশরুম হয়ে আসছি।”
“এখনই এনাউন্সমেন্ট করলো। প্লেনে গিয়ে ওয়াশরুম যেও চলো আগে।”
“আরে কিছু হবে না। একটু অপেক্ষা করো আমি আসছি।”
শতরূপা উৎসবকে নিয়ে ওয়াশরুমের জন্য এগিয়ে যায়। পাঁচ মিনিট চলে যায় কিন্তু তার আসার কোনো নামগন্ধ নেই। অতিরিক্ত সময় লাগছে দেখে সে তাকে এদিক সেদিক খুঁজতে লাগে। ওয়াশরুমে গিয়ে শতরূপাকে বা উৎসবের মধ্যে কাউকেই পায় না। অন্যদিকে লাস্ট এনাউন্সমেন্ট করে দেয়। আদিয়ান কোনো উপায় না পেয়ে ফ্লাইট মিস করে। এয়ারপোর্টের বাইরে এসে শতরূপাকে খুঁজতে লাগে। তার মোবাইলে কল দিচ্ছে কিন্তু বন্ধ দেখাচ্ছে। টেনশনে মাথাটা এলোমেলো হয়ে আসে। ঘাড়ের পাশ বেয়ে একফোঁটা ঘাম বেয়ে পড়ে। তার মাথায় এখন হাজারো প্রশ্ন। শতরূপা গেল কোথায়! তার সাথে কোনো খারাপ কিছু হয়ে যায়নি তো! এসবের পেছনে হাম্মাদ কিংবা সিন্থিয়া ব্যতীত অন্য কেউই হবে না।
হাম্মাদ অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে ঘন্টা খানেক আগে। বাসা থেকে তার মা কল করে জানান শতরূপা আর আদিয়ান বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে। সে শেষবারের মতো উৎসবকে দেখতে ছুটে আসে এয়ারপোর্টে। এয়ারপোর্টের আশেপাশে অনেক খুঁজে কিন্তু কোথাও তাদের দেখতে পায় না। বুকের মধ্যে একটা কঠিন হাহাকার অনুভব করে। চিৎকার করতে কান্না বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। কিন্তু চেপে রেখেছে। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে রাস্তার পাশে বসে রয়। জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটা আজ হারিয়ে ফেলল। শতরূপাকে সে ভালোবাসে আজ বুঝতে পারে। কিন্তু সে তাকে ভালোবাসেনি। সে চাইলে হাম্মাদ তাকে নিয়ে ভিন্ন জগতে নিজের একটা ঘর তৈরি করতো। কেউ জানতো না তারা কোথায় আছে। এই ভালোবাসা সে তার বুকের ভেতরেই দাফন করে দেবে। কাউকে জানতে দেবে না। সিন্থিয়া জানতে পারলে তাকে খুন করে ফেলবে। হাম্মাদ যদি কোনো মেয়ের সাথে রাত কাটায় তাতে তার কিছুই আসে যায় না কিন্তু সে তাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসলে তাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলার মতো ক্ষমতা ঠিকই রাখে।
আদিয়ান একা বাড়িতে এসে পা রেখেছে। শতরূপা আর উৎসব তার সাথে আসেনি। মা মমতা মির্জা আদিয়ানিকে দেখে দ্রুত পায়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে বাবা? একা কেন এসেছ তুমি? রূপা মা কোথায়?”
আদিয়ান ভেবেছিল তারা হয়তো এখানে আসতে পারে। কিন্তু মমতা মির্জার কথা শুনে বুঝে যায় সে এখানে আসেনি। তাহলে উৎসব আর শতরূওপা গেল কোথায়! নাকি কেউ তাদের গায়েব করে দিল! ভাবনারা যেন থমকে গেছে। আদিয়ান মাকে কোনো জবাব দেয় না। সোজা পুলিশ স্টেশনে চলে যায়। মিসিং রিপোর্ট লেখাতে। থানায় মিসিং রিপোর্ট করে বাসায় ফিরে আসে গভীর রাত করে। সিন্থিয়া ছাড়া ঘরের সবাই তখনো জেগে। তার পেছনে হাম্মাদও এসে ঢুকে। আদিয়ান পুলিশ স্টেশনে গিয়েছে শুনে সেও গিয়েছিল সেখানে। পুলিশ বলেছে তারা দ্রুত কাজ শুরু করে দেবে।
হাম্মাদ সিন্থিয়ার কাছে ছুটে যায়৷ তার ভয় সত্যি যেন না হয় ওই দোয়াই মনে মনে করছে। সিন্থিয়া বসে বসে মোবাইলে গেইম খেলছিল। হাম্মাদ উপস্থিতি টের পেয়ে বলল, “সেই বিকেল থেকে তোমার কোনো খোঁজ নেই। কোথায় ছিলে?”
“তুমি কী শতরূপার সাথে কিছু করেছ?”
মোবাইলে দৃষ্টি রেখেই সে জবাব দেয়, “আমি কী ছেলে যে এই মেয়ের সাথে আমি কিছু করবো? তুমি ছেলে হয়েও তো এই মেয়ের সাথে কিছু করতে পারলে না। আমি ছেলে হলে অবশ্য এই মেয়েকে খেয়ে ছেড়ে দিতাম।”
হাম্মাদ দাঁতে দাঁত চেপে রাগ আটকে রাখার চেষ্টা করছে। সিন্থিয়া জেনে-বুঝে এসব উলটা পালটা কথা বলছে তার সাথে। হাতের মোবাইলটা রেখে উঠে হাম্মাদের কাছে আসে সে।
দু’হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরে মৃদুস্বরে বলল, “আচ্ছা হাম্মাদ, একলা ঘরে কেবল তোমরা দু’জন মানুষ ছিলে। নিজেকে কীভাবে আটকালে? আমার অজান্তে তোমাদের মাঝে আবার কিছু হয়নি তো? অবশ্য হলেও সমস্যা নেই, তুমি তো জানোই ওসবে আমিও আনন্দ পাই। তাছাড়া তুমি ছেলে মানুষ দশ বিশটা মেয়ের সাথে শুইলে আমার কিছু যায় আসে না। আমি আবার অন্য বউদের মতো পজেসিভ নই। দিনশেষে তো তুমি আমারই।”
“এসব কথা কেন বলছো তুমি? কী হয়েছে না হয়েছে সবই তোমার জানা। তুমি যা যা করতে বলেছ আমি তাই তাই করেছি। শতরূপাকে ভয় দেখানোর জন্য রাতের বেলা কখনো কান্নার, তো কখনো হাসির আওয়াজ শুনিয়েছি। সে রান্না করে রেখে গেলে সেই পাতিল বদলে নতুন পাতিল এনে রেখে বিভ্রান্ত করেছি। এমনকি তোমার কথায় আমি তার শরীরেও হাত দিয়েছি। চুমু খেয়ে রক্তাক্ত করেছি। তুমি তো ঘরে বসে সিসিটিভি ফুটেজে সবকিছুর লাইভ টেলিকাস্ট দেখেছ। আর এখন এসব কথা বলছো?”
সিন্থিয়া হাম্মাদের দু’গালে হাত রেখে ফিসফিস করে বলল, “ট্রাস্ট মি বেইবি, তোমাকে অন্য কোনো মেয়ের সাথে দেখলে আমার অন্য রকম একটা ভালো লাগে। সেদিন যখন শতরূপাকে চুমু খেয়েছিলে সেই দৃশ্যটা কী দারুণ উপভোগ করেছি আমি তা বলে বোঝাতে পারবো না।”
হাম্মাদ কিছু বলতে যাচ্ছিলো তখনই সিন্থিয়া নিজেকে হাম্মাদের সামনে উন্মুক্ত করে তোলে। ভালোবাসার এক গভীর চুম্বনে সবকিছু ভুলিয়ে দেয় তাকে। রাত কেটে যায় একে অপরের মাঝে মত্ত অবস্থাতে।
ভোরবেলা বিছানা ছেড়ে উঠে বসে হাম্মাদ। সিন্থিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা চোখের সামনে কেমন পরিবর্তন হয়ে গেল। তাকে কন্ট্রোল করার সব পন্থা তার জানা আছে৷ সিন্থিয়ার বাবা- মা মারা যাওয়ার পরে খারাপ সঙ্গ ধরে ভুল পথে পা বাড়ায়। ড্রিংকস করে ছেলেদের সাথে রাত-বিরেতে ঘুরে। ধীরে ধীরে মাদকাসক্ত হয়ে উঠে। তার জীবনের প্রথম গাড়ির চাপায় পড়ে এক্সিডেন্টলি একজন মারা যায় রাতের বেলা। সেদিন থেকেই শুরু হয় নতুন অধ্যায়। হাম্মাদ তাকে সবকিছু থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে৷ তার মন চাইলেই সে ছেলেদের সাথে রাত কাটিয়েছে। যখন বলেছে তখন হাম্মাদকেও মেয়েদের সাথে শারিরীক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়েছে। আর এসব সে ক্যামেরা ফুটেজে দেখে আনন্দ খুঁজে নিয়েছে। কিন্তু শতরূপার সাথে তেমন কিছু করতে পারেনি। ভাগ্যের জুড়ে মেয়েটা তার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। হাম্মাদ তাকে ছুঁয়ে দিতে গিয়ে ফিরে এসেছে। তার সরলতার কাছে ধোঁকা খেয়ে গিয়েছিল সে। মনের কোণে একটা অনুভূতি কাজ করা শুরু করেছিল। সিন্থিয়া শতরূপার সাথে কিছু করেছে কি না এই খবর হাম্মাদ কীভাবে নেবে ভেবে পায় না। মেয়েটার কোনো রকম ক্ষতি হয়ে যাক এটা সে চায় না। তাছাড়া তার ছেলে রয়েছে। চিন্তা হচ্ছে উৎসবের জন্য। দু’জনে সুস্থ আছে কি না কে জানে!
আদিয়ানের হাতে একটা চিঠি। চিঠির ভাঁজ খুলে পড়তে লাগে সে।
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা