||দৃষ্টিভ্রম|| ||অংশ: ১৯||
“আপনি কী ভেবেছেন, আমি আপনাকে বিয়ে করেছি? যদি এটা ভেবে থাকেন তাহলে সম্পূর্ণ ভুল ধারণা করছেন মি. হাম্মাদ।”
সিন্থিয়া বিছানায় পায়ের উপর পা তুলে বসে পড়ে। ওমনি শতরূপা দৌড়ে উৎসবের কাছে যায়।
সিন্থিয়া ব্যাঙ্গ করে বলল, “ডোন্ট ওয়ারি বেইবস, এই বাচ্চাটাকে আমি আর তোমার থেকে কেড়ে নিচ্ছি না। এই আপদকে বিদায় করার ছিল যেকোনো উপায়ে। এখন যার কাছেই থাকুক এতে আমার কিছুই যায় আসে না।”
ক্ষণকাল থেমে আবার বলল, “হাম্মাদ, আমার ফ্রেন্ডের বিয়ের একটা পার্টি আছে কাল। মাইন্ড ফ্রেশ করতে যাব। তুমিও আমার সাথে যাচ্ছ। এইসব যন্ত্রণা আর ভালো লাগছে না।”
“তুমি কী কিছুক্ষণ চুপ করবে?”, তীর্যক কণ্ঠস্বর শোনায় হাম্মাদের।
সিন্থিয়া অবাক হয় তার ব্যবহারে। এই প্রথম সে তার সাথে উচ্চস্বরে কথা বলেছে তাও মানুষের সামনে। প্রচন্ড অপমানবোধ করছে। কিন্তু এই মুহুর্তে তা প্রকাশ্যে আসতে দিচ্ছে না। চুপচাপ বসে রাগে ফুসছে। অন্য সময় হলে এই রুম থেকে বেরিয়ে যেত সে কিন্তু এখন তার জানতে হবে এখানে এতসব ঘটনা কীভাবে হলো।
হাম্মাদ শতরূপাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তোমার কথার মানেটা কী ছিল? বিয়ে করোনি মানে?”
আদিয়ান এগিয়ে এসে বলল, “ডিয়ার বিগবি, আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন আমি একজন উকিল। যার মাধ্যমে আপনার বিয়ে হয়েছে সে আমারই কাছের বন্ধু। যে বিয়ের দাবী আপনি করছেন সেই বিয়ে কেবল মিথ্যে কাগজেই ছিল। শতরূপা নিজের সাইনটাও ঠিকমতো করেনি। এতকিছু জানার পরেও আপনি এই বিয়েতে বিশ্বাস করে নিলেন! এমন কাঁচা খেলা আমি খেলি না ব্রো।”
“হোয়াট ডু ইউ মিন?”, বলেই আদিয়ানের শার্টের কলার চেপে ধরে হাম্মাদ।
বিষয়টা তার আত্মসম্মানে লেগেছে খুব। সে ভেবেছিল সবকিছু তার হাতের মুঠোয়। সেই সবকিছু করছে অথচ তার নাকের ডগায় দড়ি বেঁধে আদিয়ান আর শতরূপা নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করিয়েছে সে টেরই পায়নি। শতরূপা এসে হাম্মাদের হাত আদিয়ানের কলার থেকে ছাড়িয়ে একদম সম্মুখে দাঁড়ায়।
“খুব সাবধানে হাত রাখবেন। আপনার মতো নীচ মানুষের হাত আমার আদিয়ানের গায়ে লাগালেও পাপ হবে। নিজেকে যতটা চালাক মনে করেন আসলে আপনি ততটাই বোকা। আপনি শুধু আমাদের ইশারায় নেচে গেছেন। ওইসব ডকুমেন্টস ফেইক ছিল। বিয়ের, ডিভোর্সের সবকিছু। বিয়েটা কী রেজিস্ট্রি হয়েছিল? আপনি তো উকিলের উপর ভরসা করেই শেষ। কিন্তু উকিল কী করেছে, না করেছে তার খোঁজ নিয়েছিলেন? যেখানে বিয়েটাই হয়নি সেখানে ডিভোর্স তো হাস্যকর বিষয়।”
“আমার সাথে এত্তবড় ধোঁকা!”, গর্জে উঠে হাম্মাদ।
“আস্তে হাম্মাদ সাহেব। ধোঁকার প্রথম ধাপে তো আপনিই এগিয়েছিলেন। আমরা তো কেবল চতুরতার সাথে সেই ধাপ পার হয়ে এসেছি। তাছাড়া আপনি বিয়ে নিয়ে এত পড়ে আছেন কেন? আপনি তো উৎসবের থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এতকিছু করেছেন। মুক্তি তো পেয়েই গেলেন। তাহলে খামাকা এসব নিয়ে এখন কেন ক্যাচাল করছেন?”
হাম্মাদ ভেবে পায় না আসলেই সে কেন বিয়ে নিয়ে পড়ে আছে। নাকি তার আত্মসম্মানে লেগেছে বলেই এমন করছে! সে যেভাবে চেয়েছিল সেভাবে হয়নি বলেই কী তার এত ভাবনা! নাকি অন্য কিছু! উৎসবকে দেখার জন্য উঁকি দেয় সে। শতরূপা স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। যতই হোক সে বাচ্চার বাবা। একবার দেখা করতে দিতেই পারে। কিন্তু হাম্মাদ এগোয় না। রুম থেকে বেরিয়ে যায়৷ মাথাটা এখনো ঝিম ধরে আছে। সিন্থিয়াও তার পেছন পেছন বেরিয়ে আসে। রুমে এসে এদিক সেদিক পায়চারি করছে হাম্মাদ। ভালো লাগছে না কিছুই। এদের খুন করে ফেললে তবেই শান্তি পেত সে।
সিন্থিয়া কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে বলল, “আমার উপর তোমার এভাবে রিয়েক্ট করা ঠিক হয়নি। তাও কোনো বাহিরের মানুষের সামনে।”
হাম্মাদ জবাবে একটা কথাও বলে না। সে জানে এই মুহুর্তে কথা বললেই ঝগড়া হবে। সিন্থিয়ার সাথে সে এখন ঝগড়া করতে চায় না। সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় বসে পড়ে। পেছনে সিন্থিয়া অনেক কথা বলছে সেদিকে কান দেয় না। তার ভাবনায় কেবল এখন নানান ধরনের প্রশ্ন। ওরা কীভাবে তাকে এত বোকা বানিয়ে দিল! আর সেও বোকা হয়ে গেল। ভাবতেই গা পুড়ে যাচ্ছে। জ্বলন্ত সিগারেট নিজের হাতে চেপে ধরে। রাগ সহ্য করতে পারছে না। তাকে ঠকানোর একটা শিক্ষা দিতেই হবে। এই অপরাধের শাস্তি সে তাদেরকে দেবে।
সকালে ড্রয়িংরুমে আসতেই উৎসবকে দেখে আড়ালে সরে যায় হাম্মাদ। একই ঘরে নিজের সন্তান অন্যের বলে দেখছে এটা যন্ত্রণা দিচ্ছে তাকে। তাছাড়া উৎসবের সামনে গেলে যদি পাপ্পা বলে ডাক দেয় তাহলে সমস্যা হয়ে যাবে তার। পরিবারের কাউকেই জানায়নি। হুট করে কোনো সমস্যা হোক এসব চায় না সে। সিন্থিয়া হাম্মাদের পাশ কাটিয়ে নিচে নেমে আসে। তাকে দেখা মাত্রই উৎসব শতরূপার কাছে ঘেঁষে বসে। এই মানুষটাকে সে ভূত দেখার মতো ভয় পায়। নীতি এটা বুঝতে পারে। সে এগিয়ে এসে উৎসবকে কোলে নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। খাওয়াতে লেগে যায় তাকে।
সিন্থিয়ার কথা রক্ষার্থে রাতের বেলা হাম্মাদ তার সাথে বন্ধুর বিয়েতে যায়। সেখানেও তার ভালো লাগছে না। যতটা উৎসবকে মনে পড়ছে তার থেকে বেশি মনে পড়ছে শতরূপাকে। এত সহজ সরল যাকে ভেবেছিল সেই মানুষটা কীভাবে তাকে ধোঁকা দিয়ে গেল! এসব ভাবতে ভাবতেই একজন পুলিশ অফিসারকে কল করে সে। কল দিয়ে শতরূপার ছবি পাঠিয়ে দেয়। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে তার সম্পর্কে সকল তথ্য দিতে বলে তাকে।
শায়ানকে কল করেছে শতরূপা। অপরিচিত নম্বর দেখে রিসিভ করতেই শতরূপার কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে তড়িঘড়ি করে বলল, “রূপা! তুমি! কোথায় আছো? আমি এখানে তোমাকে পাগলের মতো খুঁজে যাচ্ছি। তুমি নাকি এখান থেকে চলে গেছ?”
শতরূপার কণ্ঠস্বর খানিকটা কাঁপছে। কীভাবে শায়ানকে বলবে ভেবে পাচ্ছে না। ইতস্তত করে বলল, “শায়ান, আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিও। আমি তোমার সাথে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি।”
অবাক শায়ান শতরূপার বলা সব কথা নিশ্চুপ শুনতে থাকে। সে তাকে শুরু থেকে সবকিছু খুলে বলে। শায়ান নিস্তব্ধ বসে যায়। যাকে সে এত বিশ্বাস করলো, সেই তার বিশ্বাস ভেঙে দিল। পরক্ষণেই ভাবলো, বাচ্চার জন্যই তো সে এসব করেছে। তার উপর রাগ রেখে কী লাভ! মৃদু হেসে সব কথা উড়িয়ে দেয়।
“থাক কিছু রাগ, অভিমান চাপা। তবু তুমি খুশি আছ এতেই আমি খুশি। আমার সাথে অন্যায় করেছ এই কথা আর ভাবার দরকার নেই। মনে করো বন্ধু হিসেবে আমি তোমাকে সহায়তা করেছি। অবশ্য আমাকে শুরুতে জানালেও আমি না করতাম না। তবু বাদ দিই এসব কথা। ভালো থাকো তোমরা। কখনো উৎসবকে নিয়ে এসো এই গরীবখানায়।”
কথা শেষ করে শতরূপা কল রেখে দেয়। খানিকটা স্বস্তি ফিরে পায় সে। শায়ান তাকে ক্ষমা করেছে এতেই শান্তি। এখন তাদের এখান থেকে যাওয়ার পালা। আদিয়ান সব গুছিয়ে নিয়েছে। কালই তারা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তবে যাওয়ার আগে শতরূপা আরেকটা কাজ করে যেতে চায়। যে কাজ সবার অজান্তেই করতে হবে তাকে।
আদিয়ান উৎসবকে পাশে নিয়ে ঘুমাচ্ছে। বাপ ছেলে যেন একে অপরের ছায়া। শতরূপা বিছানা ছেড়ে উঠে একটা সাদা কাগজ নেয়। লুকোনো কথাগুলো কলমের আঁচড়ে কাগজের মাঝে তুলে ধরে। যে কথা একজন মানুষকে জানানো খুব জরুরি।
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা