||দৃষ্টিভ্রম|| ||অংশ: ০৯||
জীবন নামের নৌকায় সুখ যাত্রী হয়ে আসে মাঝেমধ্যে, আর দুঃখ হলো চিরসাথী বৈঠা। যাত্রী সাময়িক সময়ের জন্য এসে চলে যায় কিন্তু বৈঠা ছায়ার মতো লেগে থাকে। যা ছাড়া এই নৌকা অচল। শতরূপার জীবনটাও ঠিক তেমন। সুখ ক্ষণস্থায়ী আর দুঃখ দীর্ঘস্থায়ী।
“তুমি খাবে না?”
“আমার প্রশ্নের উত্তর না পেলে আমি কিছুই খাব না।”
এমন উত্তর শুনে হাম্মাদ খাওয়া বাদ দিয়ে টেবিল ছেড়ে উপরে নিয়ে যায়। শতরূপাও তার পিছুপিছু আসে। রুমের ভেতর মৃদু আলো জ্বলছে। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে। মোবাইলে কাকে যেন একের পর এক মেসেজ করে যাচ্ছে। সে চুপচাপ দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছে সব।
হাম্মাদ সহসা বলল, “তুমি যা জেনেছ তা আমার জীবনে একটা লিখিত অধ্যায়, আর এখন যা জানবে সেটা হলো অলিখিত অধ্যায়। সময় হলেই জানতে পারবে। ততদিন অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করার নেই।”
অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শতরূপা। হাম্মাদ কী এমন লোকাচ্ছে তার থেকে। চোখে জল টলমল করছে। ঝাপসা দেখছে সব। চোখ মুছে আবার তাকায়। হাম্মাদ মোবাইলের গ্যালারিতে কিছু ছবি দেখছে। কয়েকটা নীরব মুহূর্ত তাদের মাঝে।
ক্ষণকাল পর হাম্মাদ বলল, “শুধু জেনে রাখো যে, ছ’মাস পর তুমি আমাকে ডিভোর্স দেবে।”
শতরূপা যেন আকাশ থেকে পড়ে। মাথাটা ঝিম ধরে আছে। এসব কথার কোনো অর্থ বুঝতে পারছে না সে।
বিছানায় তার সম্মুখে বসে প্রশ্ন করল, “মানে! কেন? এসব কথার মানে কী? ডিভোর্সই যদি নেওয়ার ছিল তবে কেন এই বিয়ে করলেন আপনি? দয়া করে উত্তর দিন।”
আচমকা হাম্মাদ শতরূপার একটা হাত ধরে কাছে টেনে নেয়। হৃদস্পন্দন যেন থমকে যায় তার। নিশ্বাস এসে লুটিয়ে পড়ছে তার মুখে। আঙুল দিয়ে মুখে স্পর্শ করে বলল, “তোমার কোনো প্রয়োজন নেই আমার জীবনে। তাই আমাকে ডিভোর্স দেবে তুমি। আর হ্যাঁ যতদিন এই ঘরে আছ, আমার থেকে দূরে থাকবে। এই ক’দিন তোমার চাকরি করতে হবে না।। ঘরের সকল কাজ করবে। কাজ যেন একটুও এলোমেলো না হয়। নাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।”
শতরূপাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে ঠেলে রুম থেকে বেরিয়ে যায় সে। কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। চিৎকার করে কান্না করছে। কিন্তু এই কান্না কারো কানে পৌঁছাতে পারবে না। বিয়ের আগে একটাবার যদি ভালো করে খোঁজ নিতো তাহলে হয়তো আজ তার এই অবস্থা হতো না।
প্রতিরাতে হাম্মাদ দেরি করে আসে। কখনো কখনো তো আসেই না। বাসায় না আসলে শতরূপা একটা শান্তির মধ্যে থাকে। এই মানুষটাকে সে ভীষণভাবে ভয় পায়। সামনে এলেই থরথর কাঁপতে লাগে। অবশ্য আসলেও এক রুমে থাকা হয় না তাদের। বিয়ের দিনের পর থেকে আজ অবধি একই রুমে থাকেনি তারা। একা একা সারাদিন ঘরের কাজ করেই যাচ্ছে। রানু মেয়েটাকে চাকরি থেকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে ছয় মাসের জন্য। ছ’মাস পর আবার নিয়ে আসবে। এখন তার দাসী হিসেবে শতরূপা তো আছেই তাই আরেকজনকে রাখার কোনো মানেই হয় না। সারাদিন গাধারখাটুনি খেটে ক্লান্ত সময়টাতে হাম্মাদের ছোট্ট লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়ে সে। এটা এখন তার একটা নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজ শেষ করেই বই পড়া। বাড়িতে কল দিয়ে যে কথা বলবে তারও ইচ্ছে করে না। সুখের অজস্র কথা বলা যায় কিন্তু দুঃখের একটা কথাও বলা যায় না। দুই-একটা কথা বলার পর আর কথা খুঁজে পায় না, রেখে দেয়।
হালকা থেকে তীব্র শীত পড়তে আর বেশি দেরি নেই। আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে বন্দি জীবনের ব্যস্ত দিনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে সে। হাম্মাদ বিভিন্নভাবে অত্যাচার করে যায় তাকে। তার এই অত্যাচারের ভিন্নতা দেখে অবাক হয় শতরূপা। এমনও দিন গিয়েছে সারাদিন না খেয়ে থেকেছে। আজ সকালে যখন ওয়াশরুমে গেল, সে ট্যাংকের পানি খালি করে অফিসে চলে গেছে। এই শীতের মধ্যে এক ঘন্টা বসে থাকার পর পানি পায়। রাগে কষ্টে কান্না করেছে কিন্তু এসবের শেষ এখানেই নয়। তার কপালে যে এতটা খারাপ লিখা আছে শীঘ্রই তা সে টের পেতে চলেছে জানতোই না।
লাইব্রেরির বইগুলোতে বেশ ধুলো জমেছে। শতরূপা প্রায়ই অবসর সময়ে এসে বই পড়ে। আজও বই পড়তে এসেছিল কিন্তু এত ধুলো দেখে পরিষ্কার করতে লেগে যায়। একটা বই পড়তে পড়তে কখন যে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে আসে টেরই পায় না। হাম্মাদ বাড়িতে এসে দেখে খাবার টেবিল খালি। রান্নাঘরে গিয়ে দেখল শতরূপা কোথাও নেই। এখনো রান্নাও হয়নি। ক্ষুধায় তার পেট জ্বলে যাচ্ছে। লাইব্রেরিতে এসে দেখে বইয়ের তাকে হেলান দিয়ে সে নীরবে বই পড়ছে।
হাম্মাদ দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “মহারানীর গুরুত্বপূর্ণ বই পড়া কী শেষ? যদি শেষ হয় এবং আজ্ঞা দিলে একটা কথা বলতাম।”
বইটা বন্ধ করে তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ায় শতরূপা। হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে গেছে তার। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে। কোনো শব্দ বেরুচ্ছে না। খালি গলায় ঢোক গিলে চুল কানের পেছনে গুঁজে মাথা নিচু করে তাকায়। আজ কী ভুল করেছে সে নিজেও জানে না। ঠোঁট জোড়া ঈষৎ কাঁপছে।
“দুপুর গড়িয়ে যে বিকেল নামতে লেগেছে সে খেয়াল কী আছে? তোমার ক্ষুধা না লাগলেও আমার তো লাগে। আমি যে একটা মানুষ আছি তা কী ভুলে গেছ?”, বলেই পাশের ফুলদানিটা লাথি মেরে ফেলে দেয়।
শরীর কেঁপে উঠে শতরূপার। চোখ-মুখ লাল হয়ে আসে। হাম্মাদ তেড়ে এসে বইয়ের তাকে হাত দিয়ে জোরে একটা থাবা মারে।
কম্পিত গলায় অস্ফুটস্বরে বলল, “যাচ্ছি আমি, যাচ্ছি। আধা ঘণ্টা সময় দিন প্লিজ।”
পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলেই হাম্মাদ তার হাত শক্ত করে ধরে। অশ্রুসিক্ত চোখে মাথা ঘুরিয়ে তাকায় সে। যতই বাজে ব্যবহার করুক কিন্তু কখনো গায়ে হাত তুলেনি কেন জানি আজ ভয় করছে তার। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পর কি যেন ভেবে হাতটা ছেড়ে দেয়।
রান্নাঘরের দিকে দ্রুত পায়ে ছুটে যায় সে। হাম্মাদ তার পেছন পেছন আসে। শাড়ি কোমরে গুঁজে দিয়ে চুলগুলো হাতখোঁপা করে নেয়৷ দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে হাম্মাদ। কী এক সৌন্দর্য ভর করেছে তার মাঝে। একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায় সে। নিজের অজান্তেই পা বাড়ায়। শতরূপা ছুরি দিয়ে সবজি কাটছিল। তার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে একটা হাত কোমরে ধরে ঘাড়ের মধ্যে গভীর চুমু এঁকে দেয়। আচমকা এমন কিছু হয়ে যাবে ভাবতেই পারেনি সে। হাত থেকে ছুরিটা মেঝেতে ছিটকে পড়ে।
হাম্মাদের দিকে দ্রুত ফিরে তাকিয়ে বলল, “আপনি এসব কী করছেন?”
এতক্ষণে তার ঘোর কাটে। মাথাটা এলোমেলো হয়ে আসে। কী উলটাপালটা করে বসেছে সে। লজ্জায় মুখ দেখাবে কীভাবে! তার সামনে অপমানিত বোধ করছে। এই অপমান থেকে বাঁচতে শতরূপার একটা হাত ধরে টেনে টেনে উপরে নিয়ে যাচ্ছে।
“কী করছেন আপনি? ছাড়ুন আমার হাত। ব্যথা পাচ্ছি আমি। এমন জানোয়ারের মতো কেন ব্যবহার করেন?”
কদম থমকে যায় হাম্মাদের। চোখ লাল হয়ে আসে। এতবড় কথা সে তার এতটা বয়সে এসে শুনেনি। বাবা-মায়ের মুখেও কখনো কোনো গালমন্দ শুনেনি সে। আর আজ এইটুকুন মেয়ের এত সাহস যে তাকে জানোয়ার বলল। জানোয়ারের কিই কাজ দেখেছে সে। আজ সে হাড়েহাড়ে টের পাবে জানোয়ার কাকে বলে, কত প্রকার এবং কী কী!
টেনে লাইব্রেরিতে নিয়ে মেঝেতে ছুড়ে মারে। চেয়ার তুলে লাইট ভেঙে ফেলে। সাথে সাথে সম্পূর্ণ রুম অন্ধকারে ছেয়ে যায়। কাঁচ পরার শব্দ হয়। মোবাইলের লাইট জ্বালিয়ে শতরূপার কাছে এসে চুল মুঠোয় ধরে তার নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। ক্রমশ চুম্বনে ঠোঁট খানিকটা কেটে যায়। গুঙিয়ে কেঁদে গাল ভেজাচ্ছে সে। যথেষ্ট চেষ্টা করে নিজের থেকে দূরে ঠেলে দেওয়ার কিন্তু পুরুষের শক্তির সাথে পেরে উঠে না। কিছুক্ষণ পর তাকে ছেড়ে হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। দরজা বাইরের দিকে লক করে দেয়৷ কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতেই শুয়ে পড়ে সে। শরীর ও মনে ব্যথা জমেছে। ইচ্ছে করছে মরে যেতে নয়তো দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে। কিন্তু সত্য উদঘাটন না করে সে কিছুই করবে না। এই কষ্ট কতদিন সহ্য করতে পারবে সে জানে না। তবু সহ্য করে পড়ে থাকবে যতদিন না সত্যটা জানতে পারে।
টেলিফোন বেজে যাচ্ছে একনাগাড়ে। মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ায় শতরূপা। এক কদম সামনে বাড়াতেই পায়ে কাঁচ ঢুকে কেটে যায়। অন্ধকারে রক্তের বন্যা চোখে লাগে না তার তবে মেঝে পিছিল হয়ে গেছে তার পা থেকে ঝরা রক্তে। সারাদিনে নাওয়া-খাওয়ার ঠিক হয়নি তার। ভীষণ দুর্বল লাগছে। একটুখানি জায়গা হেঁটে যেতে পারছে না। তবু কষ্ট করে টেলিফোনের কাছে যায়। কল রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপর পাশ থেকে পরিচিত একটা পুরুষ কণ্ঠ ভেসে আসে।
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা