দৃষ্টিভ্রম পর্ব-০৫

0
828

||দৃষ্টিভ্রম|| ||অংশ:০৫||

“যদি তুমি কখনো নিজ থেকে আমাকে ডিভোর্স দাও তাহলে শর্তানুযায়ী আমার সন্তানকে মোহরানা স্বরূপ গ্রহণ করতে হবে তোমাকে। তবে হ্যাঁ বাচ্চার ভরণপোষণের জন্য এককালীন তোমার একাউন্টে দশ লক্ষ টাকা দিব। আর যদি আমি তোমাকে ডিভোর্স দিই তবে আমার সম্পত্তির অর্ধেক তোমায় দিব। কিন্তু ভবিষ্যতে কখনোই আমাদের আর দেখা হবে না। ভুলক্রমে দেখা হয়ে গেলেও একে অপরের জন্য আমরা অচেনা মানুষ। এমনকি সন্তানটাও যে আমার তা কখনো দাবী করতে পারবে না।”

আবহাওয়া কিছুক্ষণ গুমট বেধে রয়। বিয়ের প্রস্তাবে রাজী এমন কথা বলতে এসে বেশ বড়সড় ধাক্কা খায় শতরূপা। বিয়ের আগেই ডিভোর্সের কথা উঠে আসছে। বিজনেসম্যান বলে বিয়েটাকেও একটা ডিল হিসেবে দেখছে হাম্মাদ। কিন্তু শতরূপার কাছে তা জীবনের নতুন অধ্যায়ের সম্পূর্ণ একটা বই। যেখানে হাসি, কান্না, আনন্দ, বেদনা সবই আছে তবুও আজীবন এই এক অধ্যায়ের বই পড়ে থাকা যায়। যদি সে এই শর্তে রাজী হয় তবেই বিয়েটা হবে নয়তো বিয়ে হবে না।

“আমি রাজী।”

হাম্মাদের ঠোঁটের কোণ ঘেষে হাসি সম্পূর্ণ মুখে ছড়িয়ে যায়। অবশেষে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে শতরূপা। এর বেশি ভাবতে চায় না সে। যা হওয়ার হবে। দেখা যাবে পরে।

“বিয়েটা যেহেতু আমাদের দু’জনের হচ্ছে সেহেতু তোমার বা আমার এসব কথা সম্পর্কে পরিবারের কাউকে আপাতত এসব কিছু জানানোর নেই। আর আরেকটা কথা, বিয়েটা এখানেই হবে। ঢাকা থেকে আমার মা বাবা আসবেন কেবল। তোমার যাদের দাওয়াত করার করে নিও। আমি খুব বেশি ঝামেলা চাই না। ছোটখাটো করে আয়োজন হোক।”

শতরূপা সম্মতি জানায়। শায়ানকে কল করে ভেতরে ডাকে সে। শায়ানের হাতে কিছু পেপার। পেপারগুলো শতরূপার সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এতক্ষণ আমরা যে আলোচনা করেছি তার সকল বর্ণনা এখানে উল্লেখ আছে। তুমি সাইন করে দাও। আগামী শনিবার আমাদের বিয়ে।”

চরম জরুরি মুহূর্তে মানুষ বোকা হয়ে যায়। তার কী করা উচিত বা কী বলা উচিত সব জ্ঞান যেন বানের জলে ভেসে যায়। মাথা শূন্য, ফাঁকা হয়ে রয়। শতরূপার মাথাটাও এখন একদম ফাঁকা। সে জানে না তার এই পদক্ষেপ কতটুকু ভুল বা সঠিক শুধু জানে সুখ পাখির জন্য তাকে এই কদম বাড়াতে হবে। শায়ানের দিকে একবার তাকায়। সে মৃদু হেসে চোখের ইশারায় স্বস্তি দেয়। পেপারটা পড়ে দেখে আসলেই হাম্মাদ এতক্ষণ যা বলেছে সবকিছু হুবহু লিখা রয়েছে। একটা মানুষ কীভাবে এমন হয় ভেবে পায় না সে। শতরূপা আর বেশি কিছু না ভেবে শায়ানের হাত থেকে কলমটা নিয়ে সাইন করে দেয়। এবার যেন হাম্মাদের চোখেও আনন্দ পরিলক্ষিত হচ্ছে।

শতরূপা বাসায় এসে তার পরিবারকে কল করে বিয়ের কথা জানালে তারা জবাবে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। কারণ সে দিন তারিখ ঠিক করে ফেলেছে। তাদের অনুমতি বা পছন্দ, অপছন্দ জানতে চায়নি। এখন এভাবে তাদেরকে জানানো কেবল একটা আনুষ্ঠানিকতা বোঝায়। মেয়ে যদি এই বিয়ে করে যদি সুখে থাকে তবে বিয়েটা করা উচিত। কিন্তু বান্দরবান বিয়ে হলে তারা সবাই উপস্থিত থাকতে পারবেন না। হয়তো খুব হলে শতরূপার মেজ বোন আসবে। শতরূপার মন খারাপ হলেও কিছু বলার থাকে না। কেননা এখন কষ্ট করলেও কিছুদিন পর সে সুখের মুখ দেখতে যাচ্ছে।

বাসার মালিক বিয়ের কথা শুনে বললেন, “শুনলাম তোমার মা-বাবা এই বিয়েতে উপস্থিত থাকছেন না কেবল তোমার বোন আসবে। চিন্তা বা মন খারাপ করিও না মা, আমরা সবাই তো আছি। আমরা সবকিছু করব। তোমার বিয়েতে কোনো কিছুর কমতি হতে দিব না।”

শতরূপার চোখে জল এসে যায়। মা-বাবার পরে এই একটা পরিবারকে সে আপন করে পেয়েছে। ইরাম এখনই নাচতে শুরু করে। অনেকদিন পর কোনো বিয়ে খাবে সে। কষ্টের মাঝেও সুখের কান্না।

রাত এগারোটা বাজে হাম্মাদ শতরূপাকে কল করে। নাম্বার সেইভ করা নয় সেজন্যে সে চিনতে পারেনা।

কল রিসিভ করে বলল, “কাকে চাই?”

“রূপাকে চাচ্ছিলাম, আমি হাম্মাদ।”

শোয়া থেকে বসে যায় শতরূপা। বুকটা কেঁপে উঠে তার। রূপা ডাক শুনতেই শায়ানের কথা মনে পড়ে যায়। কেবল শায়ান তাকে রূপা বলে ডাকে।

একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলল, “জি বলুন।”

“রূপা ডাকে কোনো আপত্তি নেই তো?”

“জি না, সমস্যা নেই কোনো।”

“তাহলে আজ থেকে আমি তোমাকে রূপা বলেই ডাকব কিন্তু এই নামে যেন আর কেউ না ডাকে। কেউ ডাকলে কিন্তু তার কপালে মন্দ আছে।”

হেসে দেয় শতরূপা। হাম্মাদ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “আমি কী এখানে হাসির কিছু বললাম? আমি যা বলি সত্য বলি। আমার কথার কখনো হেরফের হয় না। আর আমাকে যারা কথা বলে তাদের কথার হেরফেরও আমি সহ্য করি না।”

এবার একটু ঘাবড়ে যায় সে। নিশ্চুপ মোবাইল কানে ধরে বসে রয়। হাম্মাদ আবার বলল, “ভয় পেলে? নাকি রাগ করলে?”

সে নির্বিকার গলায় বলল, “কোনোটাই না।”

“আচ্ছা! সাহস আছে দেখছি। তাহলে এবার একটু সাহস দেখিয়ে নিচে আসো গেটের সামনে। আমি অপেক্ষা করছি। কাম ফার্স্ট।”

বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় শতরূপা। ভ্রুজোড়া বিস্তৃত করে বলে উঠল, “মানে!”

“মানে নিচে আসলেই বুঝতে পারবে। আমি দশ পর্যন্ত গুনবো তার মধ্যে আসতে হবে তোমাকে।”, বলেই গুনতে শুরু করে সে।

শতরূপা দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। কিন্তু গেটে তালা দেওয়া। আবার আরেক দৌড়ে উপরে উঠে যায়। রুম থেকে চাবি এনে গেট খুলে দেখে হাম্মাদ গাড়ির উপর পা তোলে বসে আছে। দুইবার সিঁড়ি বেয়ে উঠা-নামা করায় তার সামনে এসে হাঁপাচ্ছে সে। হাম্মাদ লাফ দিয়ে নামে।

“তুমি যে আমার থেকে অনেক খাটো সেটা খেয়াল করেছ?”

“হু!”

আচমকা এমন প্রশ্নে বাকহারা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। একবার হাম্মাদের দিকে তাকায় আরেকবার নিজের দিকে। আসলেই সে তার থেকে অনেক খাটো। কাঁধের বেশ কিছুটা নিচে পড়ে। তার দিকে আরো কয়েক কদম এগিয়ে এসে ক্ষীণ গলায় জিজ্ঞেস করল, “তোমার ওড়না কোথায়?”

“হু!”

চোখ বড়বড় করে বুকের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় একটুখানি হয়ে আসে তার শরীর। দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে মনে মনে নিজেকে বকে যাচ্ছে একনাগাড়ে। দু’হাত বুকের উপর রেখে নিজেকে ঢাকার বৃথা চেষ্টা করছে। আবার পরক্ষণেই হাম্মাদ বলল, “এত হু হু করো কেন তুমি?”

“হু!”

“আবার হু!”

“না মানে, আসলে।”

“হ্যাঁ তারপর?”

শতরূপা ক্ষুদ্র চোখে তাকিয়ে বলল, “এখানে আমার কোনো দোষ নেই। আপনি আমাকে এভাবে তাড়া দিয়ে এনেছেন। তার মাঝে মাত্র দশ সেকেন্ড সময়! আমি শুয়ে পড়েছিলাম ঘুমানোর জন্য। কেউ তো আর গায়ে ওড়না জড়িয়ে ঘুমায় না। তার উপর চাবি ছাড়া নেমে এসে দেখি গেট বন্ধ। আবার উঠে গিয়ে চাবি নিয়ে আসলাম। আমার রাতের খাবার এই দৌড়াদৌড়িতেই হজম হয়ে গিয়েছে। সব দোষ আপনার।”

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে থামে সে। হাম্মাদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কে বলবে এই মেয়ে এতকথা বলতে জানে! হাম্মাদের মোবাইল বেজে উঠে। মোবাইল বের করে ফোন সাইলেন্ট করে আবার পকেটে ভরে রাখে৷ গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “হাত নামাও।”

অবাক দৃষ্টিতে তাকায় সে। এই লোকটার মাথায় কোনো সমস্যা আছে নাকি ভাবছে। কোনো পাগলের পাল্লায় পড়ে গেল না তো! সে ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, “মানে! হাত কেন নামাবো?”

মাথাটা তার দিকে ঈষৎ হেলিয়ে বলল, “আমি বলেছি তাই হাত সরাবে। আর না সরালে কীভাবে সরাতে হয় তা এই হাম্মাদ খন্দকার ভালো করেই জানে।”

খালি গলায় ঢোক গিলে শতরূপা। আশেপাশে তাকিয়ে ধীরেধীরে বুকের উপর থেকে হাত নামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে আসে। লজ্জায় ঠোঁট কামড়ে ধরে। মুখ খানিকটা আরক্ত হয়। দমকা বাতাস এসে তার খোলা চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে যায়৷ হাম্মাদ তার দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে। হলুদ রঙের পায়জামা তার সাথে কলাপাতা রঙের ড্রেস। এই রাতে রাস্তার ধারে দু’জন কপোত-কপোতী দাঁড়িয়ে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তার সৌন্দর্য যেন আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। যে যুগে শহরের মেয়েরা টি-শার্ট আর টাউজার পরে ঘুমায় সে যুগে এসে শতরূপা থ্রি পিস পরে ঘুমাতে যায়। বিষয়টা বেশ মুগ্ধ করেছে তাকে। কিন্তু এটা কোনোমতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না৷

চেহারার গাম্ভীর্যতা ধরে রেখে বলল, “চলো…”

“কোথায়?”

“আমার পৃথিবীতে।”

“মানে! এই রাতে কোথায় যাব? বাড়িওয়ালা আঙ্কেল জানতে পারলে…”

হাম্মাদ শতরূপার কোমরে ধরে শূন্যে তুলে গাড়ির উপর বসায়। খানিকটা কাছে এসে বলল, “আমার পৃথিবীটাই তোমার, এই বাড়িওয়ালার বাড়ি নয়।”

মোবাইল বের করে কাকে যেন কল করে হাম্মাদ। তার থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে কথা বলে আবার ফিরে আসে। গায়ের কোট খুলে শতরূপাকে পরিয়ে দেয়। সুন্দর একটা সুগন্ধ লেগে আছে কোটের গায়ে। যা তার নাকে এসে লাগছে। মাতোয়ারা করা সেই গন্ধ চোখ বন্ধ করে উপভোগ করে সে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে একজন লোক বাইক নিয়ে হাজির হয়। লোকটা বাইক রেখে গাড়ি নিয়ে চলে যায়।

হাম্মাদ বাইকে বসে বলল, “উঠে বসো।”

কোনো কথা না বাড়িয়ে ভয়ে ভয়ে বাইকে উঠে বসে। ক্ষণকাল থেমে সে আবার বলল, “আমাকে শক্ত করে ধরে বসো।”

শতরূপার ভয় তীব্র হচ্ছে। এত রাতে মাত্র কয়েক দিনের পরিচিত কেউ একজনের সাথে সে বাইরে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে সেটাও অজানা।

চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে