দূর আলাপন পর্ব-৩০

0
420

দূর আলাপন ৩০

____________________________
প্রতি শুক্রবার তিতিক্ষাদের বাড়ি কিছু বিশেষ খাবারের আয়োজন হতো। আর শুক্রবারের সেই বিশেষ রান্নায় দু বোনের সাথে যোগ দিতেন বাবাও। খিচুড়ির সাথে বাহারি পদের ব্যাঞ্জন, কখনো দম বিরিয়ানি, কখনো আবার সাদা ভাতের সঙ্গে ঝাল ঝাল গরুর মাংস।
ঘরের সাফসুতরো করতে করতে পুরনো কথা মনে করে তিতিক্ষার খেয়াল হয়, সকালের কলে বুবুকে জিজ্ঞেস করা হয়নি আজ ওবাড়িতে স্পেশাল কি রান্না হচ্ছে। গরুর মাংস আর সাদা ভাত হওয়াই বেশি যুক্তিযত। এটা বাবার সবচেয়ে প্রিয় খাবার।

চপল হাতে কাজ করে আর আনমনে চিন্তা করে তিতিক্ষা, শুক্রবারের নিমিত্তে বিশেষ কি রান্না করবে আজ। খিচুড়ি আর মাংস নিনাদের পছন্দের খাবার। রান্না হলে কেমন হয়? ওর ভাবনার পরিসর খেয়াল করে সে নিজেই অবাক মানে। পছন্দের কথা বলতে শুরুতেই কেন নিনাদের নাম এলো! এবাড়ির কর্তা ও বলেই বুঝি?

বোধহয় তাই। এইতো স্বাভাবিক। নিনাদ এবাড়ির কর্তা, তারও কর্তা। নিনাদের সমস্ত কথা মাথা পেতে মেনে নেয়াই এখন ওর কর্তব্য। অবাধ্য মেয়েও তিতিক্ষা নয়। কিন্তু ওর ঠিক ভালো লাগে না মানুষ টার ধরনধারণ। পূর্বেও লাগেনি না কখনো। কে জানে লোকটা এখনো তেমনি আছে কিনা! ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবসময় বন্ধুদের নিয়ে হুল্লোড়ে মেতে থাকা, যাকে তাকে হাসির পাত্র বানিয়ে উপহাস করা মানুষেরা যে সহজে প্রিয়র তালিকাভুক্ত হয় না।
তাছাড়া কৈশোর থেকেই নানান উপায়ে সকলের সামনে তিতিক্ষাকে পরিহাসের উপজীব্য করতে পছন্দ করতো নিনাদ। পাশাপাশি ওর মনে বোধহয় তিতিক্ষার জন্য আলাদা একটা অনুভূতির প্রকোষ্ঠও ছিল। যেমন ছিল রাজনের। দুজনের ভাবাবেগের পন্থা হয়তো ভিন্ন কিন্তু আলাদা হয়েও উদ্দেশ্য টা যেন ঠিক আলাদা নয়।

তিতিক্ষার কৈশোরের জাদুময় দিনগুলোকে আতঙ্কে রুপান্তরিত করতে ওদের কারো জুড়ি ছিল না। স্কুলের রাস্তায় রাজন দাঁড়াতো ওর পথ আগলে। রাজনের বাজে কথা, বাজে ভাষায় লেখা চিঠি ক্রমশ ওর কঠিন বাস্তবতা বিবর্জিত নিকষিত মনকে দুঃসহ করে তুলছিল।

অপরদিক থেকে ছিল নিনাদের দেয়া মানসিক পীড়ন।
নিনাদ তিহা তখন সবে ভার্সিটির গন্ডিতে প্রবেশাধিকার পেয়েছে। জীবনটা ওদের কাছে বায়োস্কোপের বর্ণিল ছবির মতই রঙের একখানা পসরা।

—–

‘তিতিকে নিয়ে হয়েছে আরেক বিপদ বুঝলি!’

‘ছোট গিন্নিকে নিয়ে বিপদ? কোনো ছেলের সাথে নটঘট বেঁধে যায়নি তো?’

‘আরে দূর! ও অমন মেয়ে নাকি? স্কুলে গিয়ে ক্লাসের এককোণে চুপচাপ বসে থাকে। ওর সঙ্গে মেয়েরাই মেশে না ঠিক করে আর ছেলে! একেই মুখচোরা, তাতে আবার টিচারের সামনে সবসময় পড়া পারে বলে আড়ালে মেয়েরা নানারকম কটুক্তি করে। শুধু এটুকু হলেও চলতো। কিন্তু… স্কুল থেকে আসার সময় পথে একা পেয়ে রাজন আজকাল আবারো বাজে কথা বলতে আরম্ভ করেছে। গেল সপ্তাহে ওর ব্যাগ টেনে জোর করে চিঠি রেখে দিয়েছে।’

‘কিহ! ফের এসব করছে? এত সাহস ওই ছেলের!’

‘শুধু কি এই? পুরোটা শোন। স্কুলের মেয়েরা দূর থেকে এই ঘটনা দেখে কেড়ে নিয়ে সেই চিঠি পড়েছে। কিসব উল্টোপাল্টা কথা নাকি লেখা ছিল। তাই নিয়ে স্কুলে বিরাট হইচই। মেয়েরা ছড়িয়েছে তিতি ওই বাজে ছেলের সাথে প্রেম করে। শেষমেশ ব্যপার টা টিচার্স রুম অবদি গড়ালো। হেড মাস্টারের রুমে ডাক পড়ল তিতির।
আমার বোনটাকে তো চিনিস। মান অপমান বোধ ভীষণ প্রবল। বাড়ি ফিরল চোখ মুখ লাল করে। সেদিনই পড়ল জ্বরে। প্রথমে কিছু বলতে চায়নি৷ খুব খাটুনি করে কথা বের করতে হয়েছে। তারপর এক সপ্তাহ গত হলো। তিতি স্কুলে যাচ্ছে না। কিছু বললেই মুখ গম্ভীর করে ঘর বন্ধ করে বসে থাকে। বাবা তো চিন্তায় অস্থির। ওদিকে তিতি সব কথা ফাঁস করার আগে ওয়াদা করিয়েছে এসব কিছু বাবাকে জানানো যাবে না। তাহলে নাকি ও লজ্জায় মরে যাবে। আমি পড়েছি মহা যন্ত্রণায়। না পারি বলতে, না পারি সইতে। কি বিপদে আছি এবার চিন্তা কর! ‘

এর বেশ কিছুদিন পর স্কুলে যাবার পথে আবারো তিতিক্ষার পথ আটকায় রাজন। সেদিন তিতিক্ষা বাড়ি ফেরে ভীষণ এক গম্ভীর মুর্তিতে। এসেই দরজা বন্ধ। পরদিন তিহার ভার্সিটির অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেবার শেষ তারিখ ছিল। ভার্সিটির কাজ নিয়ে তিহা মহাব্যস্ত। বোনের মনোদূর্যোগের খবর রাখার সময়ই হলো না। পরদিন সকালে তাড়াহুড়ায় নাশতা খেতে গিয়ে তিহার প্রথম খেয়াল হলো বিকেলের পর থেকে বোনটাকে দেখেনি আর। খেয়েছে কিনা সে খবরও নেই জানা।

অনেক ধাক্কানোর পর দরজা খুলেছিল তিতিক্ষা। বোনের ফোলা মুখ দেখে তিহা ঘাবড়ালো ভীষণ। তারপর অনেক মান ভাঙানো কথার শেষে বোনের কাছ থেকে যেসব তথ্য আদায় করা গেল তাতে এমনকি তিহার নিজেরো প্রিয় বন্ধুর ওপর রাগ না এসে পারেনি।

সেদিন তিহার মুখে সব শুনেই নাকি মহাখাপ্পা হয়ে নিনাদ দেখা করেছিল রাজনের সঙ্গে। ওর অপকর্মের জন্য ওকে শাসানোর পাশাপাশি দৃঢ় গলায় বলে এসেছে তিতিক্ষা ওর ভবিষ্যৎ বউ। কাজেই তিতিক্ষাকে ভুলে যাওয়াই ওর জন্য সর্বদিক থেকে মঙ্গলকর। তাছাড়া আজ হোক কাল হোক বউই যখন হবে, তাই ওর সব ব্যপারে নিনাদের কথাই শেষ কথা।

সহজাত ভাবেই রাজনের চিন্তাধারা ঋণাত্মক খাতে চলে। নিনাদের ওই হুমকির পর ক্রোধে অপমানে আর স্বপ্ন ভঙ্গের দুঃখে নিনাদ তিতিক্ষা কে জড়িয়ে কিছু বিশ্রী ধারনা রাজনের মাথায় স্থায়ী হয়ে গেল। সেসবই উগরে দেবার জন্য পুনরায় এক দুপুর শেষে ছুটির লগ্নে স্কুলে এসেছিল রাজন।

‘এত কাণ্ড করেছে নিনাদ! ওকে সব বলাই দেখছি আমার মহা ভুল হয়েছিল। তা ওর কীর্তি তো শুনলাম এবার রাজন কি বলেছে সেটা বল?’
চোখের জল মুছে রাগে গজরাতে গজরাতে তিতিক্ষা বলল, ‘ওইসব জঘন্য কথা উচ্চারণের রুচি আমার নেই। তবে তুমি শুধু একটা কথা জেনে রাখো বুবু, যে ছেলেটার জন্য আজ এতো বিভৎস একটা স্মৃতি আমার জীবন খাতায় যুক্ত হলো, পৃথিবীতে ছেলের মহা আকাল পরলেও কখনো ওকে আমি বিয়ে করবো না। চিনিনা জানিনা কোত্থেকে দুদিনের এক বৈরাগী এসে ঘোষণা দেবে সে আমার হবু বর, শুনে সঙ্গে সঙ্গে নাচতে নাচতে আমি ছুটে যাব পদসেবার জন্য, এমন কিছু কখনো হবে না, কোনোদিন না।’

.

কৈশোরের সেসব আলোড়নময় দিন কবে পেরিয়েছে। কত নতুন নতুন অভিশঙ্কায়, দূর্যোগে ফেনিল হয়েছে তিতিক্ষার জীবনআকাশ। জটিল সেসব বোঝাপড়ার কবলে পড়ে ওর নির্মল অন্তঃকরণ আজ হয়েছে বিক্ষিপ্ত। সময়ের ঘেরান্তে জীবনবোধের ঝুলি হয়েছে অভিজ্ঞতায় পূর্ণ। এতসবের প্রভাব কি পারে একদিনের তরে মুছে যেতে? প্রকৃতির নিয়মে যে অধিকারনামা হস্তান্তর হয়, তারই সাথে সাথে কি মনের হলফনামাও হস্তান্তর হয়ে যায়? এই কি নিয়তি? হয়তো তাই। নইলে পৃথিবীর শত শত নারী আর যুবা কাবিননামায় সাক্ষরের পরই পারে কি করে সুস্থিরচিত্তে বাস করতে এক ছাদের নিচে? এটা নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তায়ালার অপার রহমা’রই এক নিদর্শন। তার নিজের বাবা মায়ের গল্পটাও তো ভিন্ন নয়। বিয়ের আগে তারা কখনো একে অপরকে দেখেন নি। অথচ কাবিননামায় সাক্ষরের পর প্রথম দেখা মানুষটিকে চিরকাল শ্রদ্ধার সাথে ভালোবেসে গেছেন। গায়ের রঙের জন্য বিয়ের দিন থেকে সবার কাছে নিগৃহীত ছিলেন তিতিক্ষার মা।কিন্তু বাবা গোটা পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে শুরুর দিন থেকে সহানুভূতিশীল ছিলেন সেই মেয়েটির প্রতি।

হাহ্.. বড় আফসোস হয় আজ তিতিক্ষার। কেন তার মনস্তত্ত্ব হলো না আর দশজনের মতো স্বাভাবিক? কেন সে এত সুক্ষ্ম দর্শনে, সুক্ষ্ম ভাবাবেগে বিশ্বাসী হলো? মানব প্রকৃতির যা কিছু উৎকৃষ্ট শৌখিনতা চরিত্রভেদে খুঁজে পাওয়া যায় তার সবই কি চিরনির্মল? যে লোকটা নিজের শৌখিন ভাবাবেগের প্রতি যত্ন দেখাতে গিয়ে একুরিয়ামে লক্ষ টাকার রঙিন মাছ পোষে অথচ তার পাশের বাড়িতে মানুষ মারা যায় বিনে চিকিৎসায়, সেই ভাবপ্রবনতার মূল্য আদতে কত?

অথচ নিজের এই সুক্ষ্ম দর্শন নিয়েই তিতিক্ষার আত্মঅহম ছিল এককালে। সেই আত্মগৌরব, সেই বিলাসবহুল শৌখিনতার অন্ধ পর্দা বুঝি এখনো লেপ্টে আছে ওর স্বপ্নভঙ্গ পরাহত দুই চোখের ডানায়। তাই অপ্রিয় মানুষটা আজ স্বামী হলেও তাকে সে এড়াতে পারে স্বাচ্ছন্দ্যে।

এতকাল মানুষ টাকে ব্যক্তিগত ভাবে অপছন্দ করায় কিছুই যায় আসেনি। না ছিল ধর্মীয় কোনো প্রতিবন্ধকতা। রক্তসম্পর্কীয়.. দূরাত্মীয়.. কিছুই তো নয় মানুষটা। অথচ এই মানুষ টিকে ঘিরে আজ তার সমবায় বর্তমান আর ভবিষ্যতের ভাবনা নিহিত। এরকম অবস্থায় যারা পড়ে নিজের ভালোর জন্য হলেও তারা একসময় সংসারে মন ফেরায়। স্থায়ী একখণ্ড আশ্রয়, নিশ্চিত নিরাপদ আবাস, আর্থিক আনুকূল্য ইত্যাদির সমন্বয় যে একটা বয়সের পর সব মেয়ের জন্য ভীষণ দূর্লভ প্রাপ্তি। অনেক অপমান, অনেক বিষাদিত অধ্যায় শেষে আজ এর প্রত্যেকটা অর্জন করেছে তিতিক্ষা। অথচ তার মনের প্রাচীরে একখণ্ড শীতল শান্তির হাওয়া পর্যন্ত নেই। রঙহীন সে আকাশে কেবল বিষাদভারাতূর মেঘেরা গম্ভীর জলযোগে গজরায়। সহস্র অভিশপ্ত ঘাতকিনীর কিন্নর কান্না আছঁড়ে পড়ে ওর মন সংলগ্ন সায়র তটে। নিজের শৌখিন অন্তঃকরণে নিজের প্রতি স্থিত কট্টর দাসত্বের এই স্বরূপ উদঘাটিত হতেই সহসা তিতিক্ষার অনুমেয় হলো কতটা স্বৈরাচারী হয়ে উঠছে সে ক্রমে ক্রমে। গভীর এক নিশ্বাস ফেলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল তিতিক্ষা।

আজ শনিবার, এখন সন্ধ্যে সাতটা। বাইরে রাত্রির গাঢ় তমসা। জানালার পর্দা সরিয়ে সে অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকে। এলোমেলো ভাবে খানিকক্ষণ কি যেন চিন্তা করে। হঠাৎ ফোন নিয়ে ডায়াল করে একটা নাম্বারে। আলাপচারিতার সমাপ্তি শেষে কল করে দ্বিতীয় আরেকটি নাম্বারে। এই মানুষটি ওর প্রিয়দের তালিকার ওপরের দিকে থাকা একজন। দীর্ঘক্ষণ কথার শেষে বেশ কিছুক্ষণ ইতস্ততর পর শেষতক একটা অসচরাচর নাম্বারে কল করে ফেলে তিতিক্ষা। ওপাশের মানুষ টা কিঞ্চিৎ বিস্ময় নিয়ে ওঠায় ফোন। শোনা যায় তার ব্যস্ত স্বর, ‘বাসায় সব ঠিক আছে? কোনো ঝামেলা হয়নি তো?’ স্বরটা হঠাৎ অনেক নিভে আসে, ‘আর তুমি ঠিক আছো তো?’

‘আছি।’

‘তাহলে? ‘

‘কি তাহলে? ‘

‘না মানে হঠাৎ কল.. কখনো তো দাও না। তাই ভাবলাম কোনো ঝামেলা হলো কিনা..’

‘নাহ, কোনো ঝামেলা হয়নি তো!’ একটু খাপছাড়া ভাবে বলে ওঠে তিতিক্ষা।

‘ও আচ্ছা। ‘ ওপাশেও কথা হারিয়ে যায়।

‘কি ও আচ্ছা?’

‘হুম?’ মানুষ টা অন্যমনস্ক ভাবে শুধায়।

‘কিছুনা। কখন ফিরবেন?’

‘রোজ যখন আসি। আটটায়। আচ্ছা আজ কি কেউ আমার খোঁজে এসেছিল?’

‘না তো!’

‘ও আচ্ছা। ‘

‘হঠাৎ এই প্রশ্ন?’

‘তোমার এমন হুট করে কল করার কারণ টা বোধগম্য হচ্ছে না। সেজন্যই মনে হলো…’

‘মনে হয় খুব অসময়ে কল টা গেছে। আফওয়ান। আমি এখনি রেখে দিচ্ছি।’

‘আরে না না.. তাই বললাম নাকি? আ..আমি তো ফ্রিই আছি।’

‘কাজের জায়গায় বসে ফ্রি! ভারি আশ্চর্য তো!’

‘না মানে ছুটির সময় হয়ে গেছে তো। এজন্য কাজের চাপ এখন কিছু কম।’

‘ভালো’

মানুষ টা বোকার মত উত্তর করে, ‘হ্যাঁ… ‘

হাসি পায় তিতিক্ষার। সামলে নিয়ে গম্ভীর আঁচে বলে, ‘কাজ করুন। রাখছি।’

‘এখনি রাখবে?’

‘তো আর কি করবো? ‘

‘না না রেখেই দাও।’

‘আচ্ছা’

‘ঠিকাছে’

একের পর এক বোকা জবাবে হাসি থামানো দায় হয়ে পড়ে তিতিক্ষার জন্য। গট করে কল কেটে মৃদু শব্দে হো হো করে সে হাসে। ওপাশের মানুষ টা নিতান্ত নির্বোধের ন্যায় তখনো ফোন কানে চেপে রাখে। লাইন কেটে যাওয়ার শব্দটা আজ হঠাৎ তার কাছে বড় নির্দয় মনে হয়। মনে হয় এপাশের মানবী ইচ্ছে করেই, ওকে ভীষণ অপছন্দ করে বলেই এত রুক্ষ ভাবে কাটল কল!

.

টেবিলের নিচে খুট করে একটা শব্দ হতেই খাওয়া ফেলে সেদিকে ঝুঁকলো নিনাদ। একটা তেলাপোকা কুটকুট করে কি যেন খাচ্ছে। চোখে বিরাগ নিয়ে সে মুখ ঘোরায়। রিনরিন ভেবে হঠাৎ অনেকখানি আশান্বিত হয়ে উঠেছিল। একা খেতে বসার এই সময়টা বড় বিরক্তিকর। মানুষ না হোক অন্তত খরগোশ ছানাটা আশেপাশে থাকলে একাকীত্ব কিছু কম বোধ হয়।
কিন্তু আর আজ বাড়ি ফিরে শুরুতেই রিনরিনকে আবিষ্কার করেছে তিতিক্ষার কোলে। রুদ্ধ কপাটের ওপাশে রিনরিনকে নিয়ে তিতিক্ষা বোধহয় এখনো আহ্লাদ করছে।

‘ফুআম্মার ব্যপার নিয়ে কিছু ভেবেছেন?’

হঠাৎ উড়ে আসা প্রশ্নে একটু হতচকিত হয়ে নিনাদ পাশ ফেরে।
‘না.. না তো।’

‘উনি আর কল করেছিলেন?’

‘উহু। তোমাকে?’

‘আমাকেও না। আপনি নিজে একবারও কল করেননি?’

‘করেছি। কখনো ধরেন না।’ উত্তর দিয়ে নিনাদ মাথা নুয়ায়। ভাতের প্লেটে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে উদাসীন হয়ে।

‘আপনি কি ফুআম্মার ব্যপার টা কিছু আঁচ করতে পারছেন?’ বলতে বলতে অবশিষ্ট শেষ চেয়ার টেনে তিতিক্ষা পাশে বসে। ভাতের প্লেটটা আলতো করে নামিয়ে রাখে সামনে।

‘কি আঁচ করবো?’ ভাবলেশ শূন্য চোখে তাকাল নিনাদ।

‘বিয়ের দিনই ফুআম্মা কেন চলে গেলেন, কেন আর আসলেন না ইত্যাদি…’ আধপোড়া আলুভাজি নিঃসাড়ে প্লেটে তুলে নিয়ে তিতিক্ষা বলে চলে।

‘এখানে আঁচ করার মতো কি আছে? ফুআম্মা সম্ভবত সুযোগ পাচ্ছেন না। গ্রামের বাড়িতে অনেক রকম কাজ থাকে। আর নাহয় তিনি বোধহয় অসুস্থ… ‘

‘ব্যস এই! আর কিছু মনে হয়না আপনার? এতদিনে আপনি কি কিছুই টের পাননি?’

‘কি টের পাব? আশ্চর্য! ‘

লম্বা একটা প্রশ্বাস টানে তিতিক্ষা। শান্ত গলায় হুকুম করে।
‘ভাত ঠান্ডা হচ্ছে। দ্রুত খান। আমি কিছু বিষয় আপনাকে বলব। ভেবে দেখবেন।’

পোড়া আলুভাজি সমেত ভাত মুখ দিয়ে আরো ম্নান হলো নিনাদের মুখ। গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আচ্ছা’

‘শুরুতেই জানিয়ে রাখছি, এসব স্রেফ আমার অনুমান নির্ভর কথা নয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁর মুমিন বান্দাদের কে বেশি অনুমান থেকে দূরে থাকতে বলেছেন।’

একটু থামে তিতিক্ষা। পুনরায় বলতে আরম্ভ করে, ‘ফুআম্মার আচরণে সুক্ষ্ম কিছু পরিবর্তন বোধকরি আপনার নজরে এসেছে। শুরুটা আমাদের বিয়ের কথা ওঠার পর থেকে। ছেলেমেয়ের বিয়ে নিয়ে মায়েদের নানান স্বপ্ন থাকে। ফুআম্মারও ছিল। সেসব পন্ড হয়েছে আমার জন্য। ফুআম্মার নিজের পছন্দ করা সুরূপা, সয়ংসম্পূর্ণা মেয়েকে প্রত্যাখ্যান করে আপনি একটা.. ‘ দুজনের মধ্যে মুহুর্তের স্তব্ধতা।

‘যা হোক, ফুআম্মা আমাদের প্রতি অভিমান থেকে যোগাযোগ বন্ধ করেছেন। আমি ভেবেছিলাম একটা সময় ব্যাপার টা আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন। এক মাস পেরিয়ে যাবার পরও পারছেন না বলেই নিজ থেকে বলতে হলো।
আমি যথা সম্ভব নিশ্চিত হবার চেষ্টা করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত আফরিনের দারস্থ হতেই সবটা জানা গেল।’

‘কি জানলে?’

‘এই যে, উনি নিজেই আফরিনের বাসায় ওঠার প্রস্তাব করেছিলেন। যাতে সেখান থেকে নির্বিঘ্নে গ্রামে ফেরা যায়।’

নিনাদের হতবাক ভাবটা কাটছেই না। অনেকক্ষণ মাথা নিচু করে বসে আকাশপাতাল নানান ভাবনা ভাবল সে। ভাত মাখতে মাখতে আড়চোখে সেসব খেয়াল করল তিতিক্ষা। পর পর দু গ্লাস পানি গলাধঃকরণ করে ক্ষণকাল পরে নিনাদ হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,’এবার কি করবো? কিভাবে ফিরিয়ে আনব ফুআম্মাকে।’

প্রকৃতির সুক্ষ্ম ইশারাতেই হয়তো অপ্রিয় মানুষটাকেও আজকাল কিঞ্চিৎ বুঝতে শুরু করেছে তিতিক্ষা। মাতৃসম শিউলি কে ছাড়া নিনাদ আদতেই কতটা অসহায়, অল্প দূরে বসে ওর দিকে একঝলক তাকিয়েই সে বুঝে নিল। চাইল অন্যসময়ের মতো দৃপ্ত স্বরে পরের কথাগুলো বলতে। অথচ কণ্ঠে আওয়াজ আসতেই তিতিক্ষা অবাক হয়ে শুনলো ওর নিজের স্বরে ঝরে পড়ছে সহমর্মিতার মেদুর আভা!
‘অত জটিল তো হবার কথা নয়। মায়ের মন, একটু করুণ ভাব দেখালেই হয়তো দূর্বল হয়ে যাবে। আমার মাথায় একটা প্ল্যান আছে।’

‘কি প্ল্যান?’ নিনাদ মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করে।

নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে সম্মুখে মুখ ফেরায় তিতিক্ষা। ধীর সুস্থে এক চামচ তরকারি নিজের প্লেটে তুলে নেয়। মনোযোগ সহকারে ভাতে মাখতে থাকে। মহাবিরক্ত হয়ে অপেক্ষারত নিনাদ ওরপানে চেয়ে রইল। তিতিক্ষা কয়েকবার ভাত মুখে দিল। লবণ কম হয়েছে বলে একটু কাঁচা লবণ নিয়ে পুনরায় ভাতে মাখলো। পুরটা সময় ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করল নিনাদ। ক্ষীণ একটা
রাগের হলকা চনমনিয়ে মাথার অভিমুখে ছুটছে। অমর্ষণ ফেটে পরবে এই মুহুর্তে তিতিক্ষা হালকা গলায় বলল,’অফিস থেকে কিছুদিনের ছুটি নিন। আমরা নিজে মানিকগঞ্জ গিয়ে ভুলের জন্য ক্ষমা চাইলে ফুআম্মা কিছুতেই ফেরাতে পারবেন না।’

উত্তাপটা ক্রমশ সরে যেতে লাগলো নিনাদের মুখ থেকে। হঠাৎ গুরুতর ভঙ্গিতে ঝুঁকে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,’সত্যি কাজ হবে? কদিনের ছুটি নেব?’

তিতিক্ষার হঠাৎ মনে হলো বিয়ে করে, বউয়ের অত্যাচারের সঙ্গে যুঝতে না পেরে লোকটা বোধহয় সত্যিই বোকা বনে গেছে। কদিনের ছুটি নেবে, সে ভাবনাটাও এখন নিজে ভাবতে পারছে না।

‘অন্তত এক সপ্তাহ। ফুআম্মার মান ভাঙিয়ে আমরা আমাদের সাথে করে নিয়ে আসবো। এসবে একটু সময় তো লাগবেই।’

‘এখানে নিয়ে আসার কথা তুমি বলছো? ফুআম্মা যদি পার্মানেন্টলি আমাদের সাথেই থাকতে চান..’

তিতিক্ষা বিস্ময় নিয়ে তাকায়, ‘উনিতো পার্মানেন্টই থাকবেন!’

‘ফুআম্মা পার্মানেন্ট থাকবেন, একথা জেনেও আসতে বলছো?’

‘কি আশ্চর্য! আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন?’

একটু থতমত খেয়ে যায় নিনাদ। ওর বলার ধরনটাতে হয়তো কিছু গড়বড় ছিল। কিন্তু কি আর করা, তিতিক্ষার সদ্য বলা কথাটা এতই অবিশ্বাস্য যে না বলে পারল না। ফুআম্মার নিজের পছন্দ করা মেয়ে পর্যন্ত যেখানে শর্তারোপ করেছিল বিয়ের পর ফুফু শাশুড়ির সঙ্গে এক হাড়িতে খাবে না, সেখানে তিতিক্ষা নিজ থেকে এমন একটা প্রস্তাব সত্যিই কি কখনো মন থেকে করতে পারে?

‘কি হলো? ‘

‘না কিছু না। তুমি ফুআম্মাকে নিয়ে থাকতে চাইছো এটা বিশ্বাস হচ্ছিল না।’

‘থাকতে চাইব না এটা কেমন কথা! উনি আপনাকে মায়ের মতো করে মানুষ করেছেন। আমার শাশুড়ী সম। এমন একজন মানুষ আমাদের পাশে সর্বদা থাকবেন এইতো সৌভাগ্যের কথা।’

বিমূঢ় ভাব কাটিয়ে নিনাদ বলল,’ও আচ্ছা। তাহলে আ.. আমিই বোধহয় ভুল ভেবেছিলাম। ‘

‘কি ভেবেছিলেন?’

দৃষ্টি এদিক সেদিক ফিরিয়ে ইতস্তত করে নিনাদ বলে, ‘ভেবেছিলাম ফুআম্মা আমাদের বিয়েতে খুশি হননি তাই তুমি ফুআম্মাকে পছন্দ করো না।’

‘একটু আগেই তো বললাম অধিক অনুমান করা থেকে আল্লাহ তায়ালা আমাদের দূরে থাকতে বলেছেন।’

‘মনে ছিল না। ‘

শূন্য থালা নিয়ে তিতিক্ষা চেয়ার ছেড়ে ওঠে। যেতে যেতে স্বর মেদুর করে বলে, ‘এবার থেকে মনে রাখবেন।’

চলবে…
অদ্রিজা আশয়ারী

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে