দূর আলাপন পর্ব-২৮+২৯

0
428

দূর আলাপন ~ ২৮

————————————
বিয়ে ঠিক হলো। আশু দিনটিকে ঘিরে আয়োজন চলল অত্যন্ত মন্থর ভাবে। কোথাও কোনো হইচই নেই, আগত খুশির উচ্ছ্বাস নেই। নিভৃতে একে একে সমস্ত কাজ গুছিয়ে আনলেন শিউলি। বিয়ের মূল নিয়ন্তা হওয়া সত্ত্বেও শিউলি একবারের তরে এবাড়ির কারো সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ পর্যন্ত দেখালেন না। বিয়ের দিনক্ষণ সহ যাবতীয় বিষয়াদী নিয়ে কথা হলো ফোনকলে।

স্পষ্টতই তিহা বোঝে, এসব ছোটখাটো ত্রুটি মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই। মসজিদে বিয়ে পড়ানো হবে ঠিক হয়েছে। মলিন এই উৎসবে আসবে না কোনো বাড়তি লোকজন। শিউলি, আফরিন, ওর স্বামী মিনহাজ আর এদিক থেকে তিহা, রওশান, মারুফ। এর বাইরে নিনাদ তিহার কজন বন্ধুদের জানানো হয়েছে। প্রত্যেকেই নিজের জীবন নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। তবু তিহার আশা শেষ সময়ে হলেও হয়তো ওরা আসবে।

এত সাদামাটা আয়োজন মানতে একটু কষ্টই হয় হুল্লোড় প্রিয় তিহার। তারপর দীর্ঘ নিশ্বাস গোপন করে এই ভেবে যে ওদের বিয়েটা তো ঠিক সুখের বিয়ে নয়। কত জলঘোলা হয়েছে, হাঙ্গামা ঘটেছে। এবার যত অনাড়ম্বরে কাজটা সম্পন্ন করা যায় ততই ভালো।

এক বিকেলে অবশ্য শিউলি কিছুক্ষণের জন্য এলেন। সেটা বিয়ের তিন দিন আগে। শত হোক বিয়ে তো। বউয়ের জন্য অল্প সল্প কিছু কেনাকাটা করতেই হয়। শিউলি এলেন আঙটির মাপ নিতে। কাবিন নিয়েও একটু কথা বলে যাবেন। মিনহাজ দেশের বাড়ি থেকে ফিরেছে। আজ সকালে ওরা দুটিতে কোথায় যেন ঘুরতে গেছে। শিউলি তাই জোর করে নিনাদকেই সঙ্গে নিয়ে এলেন। আঙুলের মাপ নিয়ে নিউমার্কেট যাবেন৷ সন্ধ্যের পর মিনহাজকে নিয়ে আফরিনের সেখানেই আসার কথা।

বিকেলে শিউলি আসবেন শুনে তিহা বেশ ভালো আয়োজন করেছে। শিউলি তো এখন কেবল পাতানো ফুআম্মা নন, কিছুদিন পর হতে যাচ্ছেন তিতিক্ষার ফুফু শাশুড়ী।
এত আপ্যায়ন, সৌজন্য তবু কোথায় যেন সুর কেটে গেছে। শিউলি চেয়েও স্বাভাবিক হতে পারছেন না। সামনের টেবিল ভর্তি নাশতা। তিনি কিছুই ছুঁয়ে দেখলেন না। এমনকি মেয়ের স্থান দেয়া তিহার জন্যে তার চোখে সদাসর্বদা যে বাৎসল্য মাখা ভাবখানা জ্বলজ্বল করতো তারও আজ অনুমাত্র ছাপ পাওয়া গেল না।

একেকবার তিহার মনে ক্ষীণ সন্দেহ হয়, ফুআম্মা সম্ভবত এই বিয়েতেই নারাজ। তিনি বোধহয় ভাবছেন বিয়ের সব তোড়জোড় সম্পন্ন হবার পর অন্তিম মুহুর্তে এসে তিহাই বোনের কথা বলে নিনাদের মাথাটা বিগড়েছে। এমন ভাবা তো অসম্ভব না। নিনাদ যেভাবে হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে এরকম সন্দেহই বরং স্বাভাবিক।

একসময় চা আনার কথা বলে তিহা ওঠে। রান্নাঘরে এসে দেখে তিতিক্ষা চুপচাপ উত্তপ্ত চুলার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁচের কেতলিতে ওঠা বুদবুদ দেখছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো তিতিক্ষার সারা শরীর কালো আচ্ছাদনে ঢাকা। তিহা হতবাক গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে কি করছিস এখানে? ‘

‘কিছু না। ‘ বলতে বলতে তিতিক্ষা পেছন ফেরে, ‘একটা কথা ছিল বুবু।’

‘কি কথা?’

‘নিনাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। শিউলি ফুআম্মাকে কিছুক্ষণের জন্য তোমার রুমে ডেকে নিয়ে যেতে পারবে?’

বোনের কথা শুনে তিহা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকল কয়েক পল। এই ধাঁতের কিছু ও বলতে পারে তা ধারণাতেও ছিল না। অথচ তিতিক্ষার মুখ ভাব অবিচল। দেখে ক্রমশ লীন হয়ে আসে তিহার বিহ্বলতা।

‘তুই নিনাদের সঙ্গে দেখা করবি?’

‘হ্যাঁ করবো। এতে এতো অবাক হবার কি আছে? বিয়েটা যদি সত্যিই হয় তবে তার আগে কিছু কথা বলে রাখা প্রয়োজন।’

‘কি…. কি কথা?’ ঈষৎ ভয় জাঁকিয়ে বসে তিহার মনে। আদতে কি বলতে চায় মেয়েটা? শেষ কালে বিয়েটা ভাঙবে না তো?

তিতিক্ষা যেন ওর মনের আশঙ্কাটাই ঠিক ঠিক টের পেয়ে গেল, ‘ভেবোনা। বিয়ে ভাঙে এমন কিছু বলবো না। কাজটা করতে পারবে?’

‘হ্যাঁ… ‘ তিহা একটু ইতস্তত করল। ‘দেখছি কি করা যায়… ‘

.

তিহার সকাতর অনুরোধে বাসার অন্দরে এলেন শিউলি। মনের তেতো ভাব কিছুটা কমেছে। ভেবেছিলেন এখানে এসে চোখের সামনে নানান বেহায়াপনা দেখেও মুখ বুজে সহ্য করতে হবে। শহুরে প্রেমিক প্রেমিকারা বিয়ে নিয়ে যেসব নখড়া করে তেমন কিছু। নিনাদ তিতিক্ষার দেখা হবে। চোখে চোখে বিনিময় হবে হাসি৷ একসময় হয়তো তিহা বলে বসবে ‘আঙটি কিনতে আমারাও আসি?’

তেমন কিছু ঘটল না দেখে শিউলি মনে মনে বেশ স্বস্তি পেলেন। বিয়ের আগের ছেলেমেয়ের নখড়া তিনি একদম সহ্য করতে পারেন না। দুজন দুজনকে আঙটি পড়িয়ে দাও, হলুদ সন্ধ্যা, মেহেদি সন্ধ্যার নামে একসাথে নাচানাচি করে বেহেয়ামির চূড়ান্ত করো আরো কত কি…

আল্লাহর কাছে শুকরিয়া, আর যাই হোক এরা ঠিক অমন হালকা মেজাজের নয়। আঙটির মাপ নেয়ার নিমিত্তেই তিহার সঙ্গে আসা। শিউলি বসলেন বিছানার একপাশে। শান্ত স্বরে বললেন, ‘তা কই তিতিক্ষা?’

ম্লান হাসলো তিহা, ‘ ও আসছে…’

নিঃশব্দে অপেক্ষা করছেন শিউলি। তিহা অবাক চোখে খেয়াল করছে অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে অপরিচিত হয়ে ওঠা পুরনো সেই প্রিয় পরিচিত মানুষটিকে। মাত্র কিছুদিন আগেও এই শিউলি ফুআম্মার প্রতিটি কথায় তিহার জন্য চুইয়ে পড়তো ভালোবাসা। আর আজ.. যেন আজকের আগে তাদের আর দেখাই হয়নি কখনো।
মিনিট দুয়েক যেতেই শিউলি হঠাৎ ব্যস্ত স্বরে বললেন, ‘আইচ্ছা ও আসুক। তার আগে বরং কাবিনের ব্যাপার ডা শেষ করি।’

‘জি, নায়হ তাই বলুন। ‘ তিহা দ্রুত প্রতুত্তর করল।

.

বসার ঘরে তখন তিতিক্ষা সত্যি গেছে নিনাদের সঙ্গে কথা বলবে বলে। অন্যমনস্ক ভাবে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিল নিনাদ। সালামের শব্দে সহসা মাথা তুলে বোরকা পরিহিতাকে দেখে ঠিক ঠাওর করতে পারল না মানুষ টা কে। অল্পকাল পর বুঝতে পারা মাত্রই চা রেখে উঠে দাঁড়াতে উদ্দ্যত হলো।
‘আপনি বসুন। কয়েকটা কথা বলেই আমি চলে যাব।’

নিনাদ বসলো। অপেক্ষা করল তিতিক্ষা কি বলে শোনার জন্য।

‘ আমাকে বিয়েটা করতে হচ্ছে পরিবারের কথা ভেবে। যেন ওরা বাকি জীবনের জন্য নিশ্চিন্ত হতে পারে। আপনি নিশ্চয়ই এটা জানেন?’

নিনাদ জানে। কিন্তু সেকথা এখন মুখে বলা অজরুরি।

‘আমার ব্যাপার টা ঠিক আর সকল মেয়েদের মতো নয়। কিছু তিক্ত বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছি বলেই সবাই যা পারে অনায়েসে আমি তা পারি না। তাই বিয়ে হলেই সমস্ত অধিকার আপনার হয়ে যাবে, এরকম আশা না করাই ভালো। আমার সময় প্রয়োজন।’
কথা শেষে তিতিক্ষা প্রতুত্তরের অপেক্ষা করে। কিন্তু ওপাশের মানুষ টা নিরব। মনে কিঞ্চিৎ সন্দেহ হয় তিতিক্ষার। লোকটা আসলেই ওর কথা শুনছে তো?

‘আপনি কি আমার কথা শুনছেন?’ অনিশ্চয়তা নিয়ে প্রশ্ন করে সে।

‘শুনছি।’

কয়েক মুহুর্ত কি যেন ভেবে বোনের আশঙ্কা বিস্মৃত হয়ে হঠাৎ একটা সাহসী পদক্ষেপ নেয় তিতিক্ষা।
‘আমার দাবি মানতে না পারলে আপনি সাচ্ছন্দ্যে এই সম্মন্ধ ভেঙে দিতে পারেন। আমি বা আমরা পরিবার এর জন্য কখনো আপনাকে অভিযুক্ত করবো না।’

নিনাদ এবারেও উত্তর দিতে বিলম্ব করছে। তিতিক্ষার একটু রাগ চড়ে যায়। লোকটা ওর সাথে তামাশা করছে নাকি? কথার বিপরীতে কথা নেই। এদিকে সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। শিউলি ফুআম্মা হঠাৎ চলে এলে দুর্বোধ্য এক দৃশ্যের অবতারণা হবে। কিছু না বুঝেই তিনি হয়তো ওকে বেহায়া উপাধিতে ভূষিত করবেন।

তিতিক্ষা বিরক্ত গলায় বলল, ‘কিছু বলছেন না কেন? দাবি শুনে বিয়ের ভূত পালালো বুঝি?’

ওর তিরিক্ষি কথার বিপরীতে নিনাদ সহজ ভাবে একটু হাসলো।
‘জি না। ভূত পালায় নি। বরং মাথায় আরো জেঁকে বসেছে।’

শেষ কথাটা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকে গেল তিতিক্ষার। ‘যা বলার স্পষ্ট করে বলুন। আমার হাতে অত সময় নেই।’

‘সময় না থাকলে ভেতরে চলে যাও। বাকি কথা পরে হবে।’

‘পরে কবে?’ সন্দিহান প্রশ্ন তিতিক্ষার।

‘সেটা সময় বলে দেবে।’

—————

ওদের বিয়েটা হল শুক্রবারে। সেদিন শেষ মধ্যাহ্নে আকাশ অন্ধকার করল ভীষণ। ঈশান কোণে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ গজরাচ্ছে কালো মেঘ। খরশাণ বাতাসের সাথে দলছুট মেঘেরা ধেয়ে যাচ্ছে আকাশের এমাথা থেকে ওমাথা।
যেন হঠাৎ ভীষণ হুঙ্কারে আজ বান ডাকবে বৃষ্টির ক্ষরস্রোত। এইরকম এক ঝড়ো আবহের মধ্যেই মসজিদে বিবাহ কার্য সমাধা করে খেজুর বিলিয়ে ফিরে এলেন মারুফ ও বাকি ছেলেরা। বাইরের পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হচ্ছে দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সবাই। ফেরার চিন্তা গ্রাস করে নিল মিনহাজ আফরিন সহ বিয়েতে আগত তিহা নিনাদের বন্ধুদের। আবহাওয়ার বৈরিভাব দেখে ওরা শেষ পর্যন্ত বেরিয়েই পড়ল খাওয়া দাওয়ার পর। বাকিরা ব্যস্ত হলো তিতিক্ষা নিনাদের বিদায়ের তোড়জোড়ে। এই বেলা না বেরোলেই নয়। দেরি করলে পথিমধ্যে ঝড়ের কবলে পড়ার আশঙ্কা।

দীর্ঘক্ষণ তিতিক্ষার পাশে বসে থেকে একসময় বসার ঘরের এলেন শিউলি। এককোণে বসলেন নিঃশব্দে। ডাইনিং থেকে ভেসে আসছে তিহা রওশান আর আফরিন মিনহাজের সম্মিলিত হাসির শব্দ। ছোটন হুটোপুটি করছে বাবার কোল জুড়ে। নিমিষেই আবার নেমে ছুটে যাচ্ছে বউয়ের সাজে সজ্জিত মিমির কাছে। অনেকদিন পর এবাড়িতে এত মানুষ আর আনন্দের ফোয়ারা দেখে সে ভীষণ খুশি।

প্লেটে প্লেটে আইসক্রিম সাজাচ্ছে তিহা। তা সবার হাতে হাতে তুলে দিচ্ছে আফরিন। ফাঁকে ফাঁকে চলছে ওদের আড্ডা। রওশানের সাথে মিনহাজের বেশ ভাব জমে গেছে এর মধ্যেই। তিহা আফরিনের ভাব তো আগে থেকেই ছিল।
নিনাদ দেখল নব আর পুরাতন যুগলের মাঝে রসায়ন টা বেশ ভালো জমেছে।
তবে ওদের সঙ্গে আজ নিনাদ ঠিক একাত্মাবোধ করতে পারছিল না। ওরা আড্ডা দিচ্ছে যুগলবন্দী হয়ে। অথচ নিনাদের পাশে কেউ নেই। তাছাড়া ওদের আড্ডার বিষয়বস্তুও দাম্পত্য সম্পর্কিত। সেখানে থেকে ও করবেটা কি? তিহা অভিযোগ করছে রওশানের মতো সুতার্কিক নাকি দেশে আর দুটো নেই। ঝগড়ায় রওশানকে কোনোদিন সে পরাস্ত করতে পারেনি। শুনে হাসতে হাসতে আফরিন বলল তাদের বেলায় ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। মিনহাজটা এতই সরলসিধে যে মুখের ওপর একশো কথা বললেও বেচারা সামান্য প্রতিবাদটুকু করতে পারে না।

নিনাদ উঠে এলো। বন্ধুরা চলে যাওয়ায় হঠাৎ বেশ শূন্য শূন্য বোধ হচ্ছে। আনমনে এসে বসলো ফুফুর পাশে। ফুআম্মার সাথে আজ সারাদিনে খুব কম কথা হয়েছে। তিনি সারাক্ষণই কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত। নিনাদের অন্যমনস্ক মুখের পানে একবার আড়চোখে তাকালেন শিউলি। ধীরে ধীরে ব্যাগের ভেতর থেকে একগোছা চাবি বের করে বাড়িয়ে দিলেন ওর দিকে।
‘নিনাদ, শুন আব্বা, এইযে রইলো তোর বাসার চাবি। ঘরবাড়ি গোছানই আছে। আলমারির চাবি রাখা আছে তোর ওয়ারড্রবের উপরের তাকে। রাতের খাবারদাবার সবই আছে। বউমারে শুধু একটু গরম কইরা নিতে কইস। আর.. ‘ শিউলি একটু থামলেন। ‘আর তোরার সংসার খুব সুখের হোউক। আল্লাহ দুইজনরে চিরকাল একসাথে ভালা রাখুক। আমিন। ‘

সচকিত হয়ে শিউলির দিকে ফেরে নিনাদ। ফুআম্মার সব নির্দেশ ব্যতিরেকে একটা ব্যপারে ওর মনযোগ আটকে যায়। ফুআম্মা এভাবে কথা বলছেন কেন? তিনি কি তাদের সাথে যাবেন না?
‘চাবি আমায় দিচ্ছো কেন? তোমার কাছেই তো থাকা ভালো।’

শিউলি সরল হাসলেন। যেন খুব একটা ছেলেমানুষী কথা বলে ফেলেছে নিনাদ। ইচ্ছে হলো এই মুহুর্তে কিছু তিক্ত কথা ওকে শুনিয়ে দেন। কিন্তু নিজেকে রুখলেন। আজ ছেলেটার জীবনের একটা বিশেষ দিন। এইদিনে কিছু তিক্ত সত্যি নাই-বা বললেন। সব কষ্ট তো তিনি আগেই বুকে চাপা দিয়েছেন। হৃদয় খুঁড়ে সেসব আবার জাগিয়ে তুলে কি লাভ?

‘তা কি আর হয় বাজান? ছোট একখান বাসা। তোমরারই জায়গা অসংকুলান। সেখানে এখন আমি গিয়া থাকি কেমনে?’

‘কি বলছো এসব! তুমি আমাদের সাথে যাবে না এ কখনো হয় নাকি?’

‘হয় গো বাজান। সময় মানুষ রে কত কিছু করতে বাধ্য করে।’

‘না না। আমি কোনো কথা শুনবো না। তুমি যাচ্ছো ব্যাস।’

শিউলি একদৃষ্টে চেয়ে থাকলেন নিনাদের অস্থির মুখটার পানে। তাকে ফিরিয়ে নিতে কি ব্যস্তই না হয়ে উঠেছে। অথচ এসব কথা যে তিনি ওরই কারণে ওরই প্রতি তীব্র অভিমান থেকে বলছেন বোকা ছেলেটা তা বুঝতেও পারছে না। না বুঝলেও নিনাদের এখনদার দাবিটা সত্যিই ওর অন্তর থেকে করা। এ-ই তো সে, নিসন্তান জীবনে যাকে তিনি সবচেয়ে বেশি স্নেহ মমতায় নিজের পুত্রের মতো বড় করেছেন।

আর ছেলের বউ, নাতিনাতনির মধ্য দিয়ে সেই ভালোবাসা ফিরে পাওয়ার সময় যখন হলো, নিনাদ কষ্ট দিল তাকে। সিদ্ধান্ত তিনি সেদিনই নিয়েছিলেন, যেদিন নিনাদ নাকোচ করেছিল শিউলির পছন্দ করা মেয়েটিকে। ছেলের বিয়ে নিয়ে মায়েদের কত স্বপ্ন থাকে। নিনাদ সেসবের ধারই ধারল না। তবু মাঝে মাঝে শিউলির ইচ্ছে হয়, তীব্র ভাবে মন চায় ছেলের দেয়া সমস্ত কষ্ট ভুলে গিয়ে ওকে মার্জনা করে দিতে। কিন্তু শতবছরের জমানো অভিমান কি একদিনের ক্ষমা ভিক্ষায় শেষ হয়?

.

জীবনের শ্রেষ্ঠ কান্নাটা মারুফ আজ কাঁদলেন। যেমন কেঁদেছিলেন রেহনুমা মারা যাবার পর, যেমন কেঁদেছিলেন তিতিক্ষার জীবনের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় সংঘটিত হবার দিনে। প্রাণপ্রিয় মেয়ের সঙ্গে অবস্থানের দূরত্বের কথা ভাবতে গিয়ে বুক চিড়ে বেরিয়ে আসছে সুতীব্র হাহাকার। সঙ্গে সদর দরজা পর্যন্ত একসাথে গিয়ে মারুফ থামলেন। নিনাদ নম্র স্বরে বলল, ‘আসি বাবা।’
মারুফ কথা বলতে কিছুটা সময় নিলেন। ডানদিকে মাথাটা হালকা কাৎ করে চাপা স্বরে বললেন,’এসো।’
আবার নিরবতা। তিহা রওশান দাঁড়িয়ে আছে বাবার পেছনে। তাদের সামনে, সিড়ির প্রথম ধাপে নিনাদ, তার পাশে তিতিক্ষা। আর সবার পেছনে এককোণে শিউলি। নিনাদটা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না তাকে ছাড়া যেতে। শেষকালে আফরিন এসে বিপদ থেকে উদ্ধার করল। বলল, ‘চাচি আম্মারে অনুরোধ কইরা লাভ নাই। আমিই জোর করছি আমার সাথে যাবার জন্য। চাচি আম্মার কাপড়চোপড় তো আগেই নিয়া গেছি। কয়দিন চাচি আম্মা আমার কাছে থাকুক।’
তবুও কি নিনাদ মানতে চায়? কত কি বলতে হলো, কত মিথ্যে আশাভরসার কথা শোনাতে হলো। তবে ও গম্ভীর মুখে নিমরাজি হলো।

ঘরভরা মানুষের সামনে বৃদ্ধের চোখের জল বড় বেমানান। দীর্ঘ শ্বাসটা চেপে, গম্ভীর মুখটাতে বহুকষ্টে খানিক হাসি ফুটিয়ে মারুফ ডাকলেন, ‘নিনাদ।’
নিনাদ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাতেই তিনি ওর হাত ধরলেন। সাথে সাথে অপর হাত দিয়ে তিতিক্ষার হাতটাকেও টেনে আনলেন। থেমে থেমে বললেন, ‘আমার মা মরা মেয়ে…
জীবনে খুব বেশি কিছু ওকে কখনো দিতে পারিনি। মা হীন ঘরে অযত্নে, অবহেলাতেই একরকম বড় হয়েছে। তবুও অনুযোগ করেনি কোনদিন। ধৈর্য ধরে গেছে সব সময়। সেটুকুর পরও..
আল্লাহর বোধহয় অন্যকিছু ইচ্ছা ছিল। যে অভিশপ্ত মুহুর্তের কথা ভাবলেও বাবা মায়ের বুক কাঁপে, আমি বেঁচে থাকতে আমার মেয়েকে সেইদিনও দেখতে হলো। আজকাল মাঝেমধ্যে বাবা হিসেবে বড় ব্যর্থ মনে হয় নিজেকে। যাইহোক, শোকর আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ তোমাকে ওর অভিভাবক হিসেবে মনোনীত করেছেন। এইবার আমি দায়িত্ব থেকে অব্যহতি নিলাম। মনে রেখো এই বেলা থেকে ওর ভালো মন্দের সব দায়ভার তোমারি।
শোনো বাবা, নিজের মেয়ে বলে বলছি না। আমার মেয়েটা সত্যিই খুব ভালো। শুধু ওই রাগটা যা একটু বেশি। ওর প’রে সবসময় ক্ষমার পরোয়ানা জারি করে রেখো তুমি। যদিও স্বইচ্ছায় অপরাধ করার মেয়ে সে নয়। তবুও নাহয়…
আমার বিশ্বাস তুমি ঠকবে না। পারানী হিশেবে আমার মেয়ে ছাড়া আর কোনো মূল্যবান সম্পদ দিতে পারলাম না তোমাকে।’ বলে নিনাদের হাতে তিতিক্ষার হাত রেখে নিজের হাতটাকেও তিনি তার ওপর রাখলেন। চোখের কোণে অশ্রু লুকিয়ে মৃদু হেসে আস্বস্ত করলেন তাদের।

মধ্যাহ্ন শেষের সেই ভীষণ অন্ধকার আকাশের নিচে পুরো পৃথিবীটাতে যেন হঠাৎ ঘোর সন্ধ্যা নেমে এল। ধূলো উড়ছে বাতাসে, আকাশে গজরাচ্ছে মেঘ। তিতিক্ষা মাঝ উঠোনে দাঁড়িয়ে শেষ বারের মতো তাকাল দরজা ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা তার সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ গুলোর দিকে। ক্রমশ ঝাপসা হয়ে এলো দৃষ্টি। ধূলোময় বাতাসে, অপ্রতিরোধ্য অশ্রুতে চোখ বারবার বুজে আসছে। গালে জল গড়াচ্ছে। তার মন চাইছে একটা গগনবিদারী চিৎকার করে, সব ছেড়ে সেদিকে ছুটে যেতে। কিন্তু পারল না। অদৃশ্য এক শিকল যে তার পায়ে বাঁধা। তাই সে শুধু চেয়ে রইল। ঠোঁটের কোণে তার মলিন হাসি ফুটল। আজ সে মুক্তি দিয়েছে। সেথায় দাঁড়ানো তার সব প্রিয় মানুষকে। এইবার জীবনে তার যাই ঘটুক। আর ভয় নেই বাবার প্রেসার বেড়ে যাওয়ার, বোনের গুমরানো কান্নার চাপা আর্তনাদের। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে সে ঘুরে দাঁড়ালো। নিনাদ তখনো তার হাত ধরে আছে। সে হাটতে শুরু করল নিনাদের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে।

চলবে…….

দূর আলাপন ২৯

__________________________________
সকালের কফিটা তিতিক্ষা একা খেতেই ভালোবাসে। এবাড়ি এসে গড়েছে ওর এই নতুন অভ্যেস। এখানে তিহা নেই যে চুলায় পানি বসাতে দেখলেই মিঠে হেসে কফির আবদার জুড়বে। ঘর ছেড়ে দু পা সামনের বারান্দায় এসে রোজ সকালে বাজরিকা দুটোর মিষ্টি ঝগড়া দেখতে দেখতে সে কফির স্বাদ আস্বাদন করে। কোলে থাকে রিনরিন। পেজা তুলোর পুটুলির মতো একফালি রিনরিনকে কোলে নিয়ে ঘুরতে ভীষণ ভালো লাগে তিতিক্ষার।

কফির পর ছোট খাট গৃহস্থলি কাজ সেরে তিতিক্ষা বসে ওদের ছোট্ট ডাইনিং এ নাশতা খেতে। আজ ডিম ভাজি মুখে দিতেই সে কোচকায় মুখ। অতিরিক্ত লবণ। ভাজাটাও কেমন ন্যাতন্যাতে হয়েছে। ভাজি পাশে সরিয়ে খালি পরোটা চিবোতে চিবোতে তিতিক্ষা ঠিক করে দুপুরে ডালের সঙ্গে ভাজিটা খেয়ে নেবে।

নাশতা শেষ করে ওকে ভাবতে বসতে হয় রান্নার কথা। দুপুরের রান্নার দায়িত্বটা পড়েছে তার ভাগে। খায়ও সে একা। কিছুদিন হলো নিনাদের চাকরি জুটেছে একটা বেসরকারি কোম্পানিতে। পদমর্যাদা মন্দ নয়। পাশাপাশি বেশ সনামধন্য একটা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং সেন্টার এ পড়ানোর পুরনো কাজটাও আছে। দুইয়ে মিলে অর্থের দিক দিয়ে নিনাদ এখন বেশ নির্ভার।

তবে ব্যস্ততাটা অসম্ভব বেশি। তাতে অবশ্য
তিতিক্ষা খুশিই হয়। চব্বিশ ঘন্টার প্রায় চৌদ্দ ঘন্টাই বাসায় তার একার রাজত্ব। নিনাদ এলেও যে খুব অসুবিধে তা নয়। ও বেচারাকে ফিরেই জুড়তে হয় রাতের রান্নার আয়োজন। নিয়মটা শুরু থেকেই এভাবে গড়েছিল। কোনো পরামর্শ ছাড়াই ওদের মধ্যে ঠিক হয়েছিল সকাল ও রাতের রান্না নিনাদ করবে আর দুপুরের রান্নাটা তিতিক্ষা। সবকিছুতে কেন এই ভাগাভাগির ব্যবস্থা সে প্রশ্নের উত্তর জানা নেই তিতিক্ষার। হয়তো ওর আন্তরিকতার অভাবই নিনাদকে এমন সাবলেটে থাকা ভাড়াটিয়ার মতো আচরণ করতে উদ্যোগী করেছে। তাছাড়া আর করবে কি? দু একটা দরকারী কথার ব্যাতিরেকে
সারাদিনে তাদের মধ্যে বাড়তি একটা বাক্যবিনিময় পর্যন্ত হয়না যেখানে।

রাতে নিনাদ রান্নাঘরে খুটখুট শব্দ তুলে কাজ করে যখন, তিতিক্ষা তখন ইচ্ছে হলে নিজের ঘরের খিল এঁটে বসে থাকতে পারে আনমনে, কখনো বা পাখি জোড়ার সঙ্গে জুড়ে দেয় খুনসুটি। সে সময় রিনরিন থাকে বাবার কাছে। শুরু থেকে সে নিজেকে বাবা ভাবতে শিখিয়েছে রিনরিনের কাছে। তিতিক্ষা আবডাল থেকে দেখে। ভারি অসহ্য লাগে ওর, একটা খরগোশ ছানাকে ঘিরে নিনাদের আহ্লাদপনা।

.

ওর থাকার ঘরটা সুন্দর। বলা যায় এই ঘরটাই বাড়িই প্রধান ঘর। একা একা ঘুরে ঘুরে বেডরুমটা গোছাতেও তিতিক্ষার ভালো লাগে। অথচ প্রথম দিন এসে তিতিক্ষা কিনা ভেবেছিলো পাশের ওই মলিন এলোমেলো ঘরখানি হবে তার স্থায়ী আশ্রয়।

বলতে নেই নিনাদ যে সেধে ওকে এই ঘরখানাতে থাকবার অনুমতি দিয়েছে তাতে সে যারপরনাই কৃতজ্ঞ। নিজের একান্ত আরামের আবাস ছেড়ে পাশের ঘরে ছন্নছাড়া ভাবে নিনাদকে থাকতে হচ্ছে ভেবে মাঝে মাঝে যদিও তিতিক্ষার একটু অনুশোচনা হয়। তবে সেটা নিতান্ত সাময়িক। তাছাড়া রাজত্ব হারিয়ে রাজা বেচারা যে বেজায় দুঃখ আছে ওর হাবভাবে তো তেমন কিছু ফোটে না!

.

রাত আটটায় বেল বাজল। তিতিক্ষা খেয়াল করেছে এই সময়ের গড়বড় নেই। রোজ আটটা বাজতেই লোকটা ফেরে। কখনো কি সময়ের একটু হেরফের হতে নেই?
বেল শুনেও সঙ্গে সঙ্গে উঠল না তিতিক্ষা। কিঞ্চিৎ বিলম্ব হলে ক্ষতি কিছু নেই। বরং সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলে লোকটা অন্যরকম ভাবতে পারে। ঢিমেতালে ওড়না মাথায় জড়াতে জড়াতে তিতিক্ষা আশ্চর্য হয়ে ভাবে মানুষটার সমস্ত ব্যপারে তার এমন উৎসন্ন হওয়া কেন? আগে আগে দরজা খুললেই ওকে হ্যাংলা ভাববে আর বিলম্বে গেলেই আত্মাভিমান বজায় থাকবে ষোলো আনা, এমন সস্তা ধারণা হঠাৎ কেন হলো ওর?

দরজা খুলে সরে দাঁড়ায় তিতিক্ষা।
‘আসসালামু আলাইকুম’

নিনাদ নিবন্ত চোখে একঝলক তাকায়।
‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম’

জুতা খুলতে খুলতে বলে, ‘বাসায় কোনো অসুবিধা হয়নি তো?’

তিতিক্ষা খেয়াল করল এই প্রশ্নটাও নিত্যকার। কিঞ্চিৎ বিরক্তি জাগে মনে। যেন এই একঘেঁয়ে রোবটিক প্রশ্ন গুলো ছাড়া লোকটা আর কথা জানে না।

‘না’

‘ফুআম্মা কল দিয়েছিল?’

আবারো একটা ‘না’ বলে দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে ফিরে যেতে যেতে তিতিক্ষা শোনে ওর শেষ কথা।

‘ওহ, আমাকেও দেয়নি।’

.

শূন্য ডাইনিং এ একা খেতে বসে তিতিক্ষা ফের একটু মনস্তাপের দংশনে নিপতিত হলো। নিনাদ ওর সাথে খেতে বসে না। খিদে নিশ্চয়ই ওরও পেয়েছে? তবু তিতিক্ষা না উঠলে আসবে না কখনো। তার কারণ বিয়ের দ্বিতীয় দিন একসাথে খেতে বসে খাবার নিয়ে তিতিক্ষার পাশের ঘরে চলে যাওয়া। এটুকু বোধহয় বাড়াবাড়ি। নিনাদ শত্রু তো নয়। তবু যেন কি হেতু শুরু থেকে অসহ্য বোধ হয় ছেলেটাকে। বিয়ের শুরু থেকে, পরিচয়ের শুরু থেকে আর মনোভাব জানার শুরু থেকেও।

তিতিক্ষার ঘরের লাগোয়া বারান্দায় এককোণে একটা কাঠের খুপরি তে নরম কাপড় বিছিয়ে হয়েছে রিনরিনের থাকার ব্যবস্থা। যদিও তিতিক্ষা জানে বারান্দার আশ্রয় ফেলে রিনরিন প্রায় রাতেই বাবার সঙ্গে ঘুমায়। খাওয়া শেষে সিঙ্কে প্লেট ধুতে ধুতে তিতিক্ষা খেয়াল করল রিনরিনকে নিয়ে নিনাদ খেতে বসেছে। ওরা দুজন ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে বলছে কিছু। মূলত বলছে নিনাদ। তবে রিনরিনের হাবভাবও ফিসফিসিয়ে কথা বলার মতই।

‘আফরিন বলল ফুআম্মা ওর বাসায় নেই। বিয়ের দুদিন পরই নাকি গ্রামে ফিরে গেছেন। অথচ আমি জানলাম আজ। কে জানে কেন, ফুআম্মা আজকাল কলও ধরেন না। তুমি কিছু জানতে?’ একনাগাড়ে অনেক গুলো কথা বলে নিনাদ থামে।

তিতিক্ষা হতচকিত হয়ে ওর পানে তাকায়। হঠাৎ লোকটার মনে এই প্রশ্নের উদয় হবে কে জানতো? তবে ফুআম্মার কথা বলতে গিয়েই নিনাদ যে সহসা অনেকখানি বিষণ্ণ হয়ে পড়েছে দূর থেকেও সে তা টের পেল। এইমাত্র নিনাদ বলল ফুআম্মার কল না ধরার কারণ নাকি ও জানে না। আসলেই তাই? লোকটা এত নিরেট নাকি? ওদের বিয়ের প্রসঙ্গ ওঠার পর থেকে যে মানুষটার রাগের উৎপত্তি, এতদিন পরে এসেও সেসম্পর্কে কোনোকিছু জ্ঞাত নয় সে?

তিতিক্ষা আবছা ভাবে বলে,’ না। আমাকেও তো কেউ বলেনি।’

উত্তর টা যেন নিনাদ শোনেই না৷ অন্যমনে বলতে থাকে নানান কথা, ‘হঠাৎ কি যে হলো। ফুআম্মা কেন..’ বাক্যটা শেষ করে না। থেমে ক্লেশজড়িত ভাবে মৃদু নিশ্বাস ফেলে।

তিতিক্ষা দেখে ভাবনায় ডুব দিয়ে অকারণ নাড়াচাড়া করতে করতে নিনাদ চারপাশে ভাত ছেটাচ্ছে। আজ নিশ্চয়ই ঘুমের মধ্যেও ফুআম্মার চিন্তা ওকে তাড়া করে বেড়াবে। ক্ষীণ নিশ্বাস ফেলে ও চলে আসে নিজের ঘরে। করুক যা খুশি। ও নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলে৷ নিনাদের ব্যপারে নাক গলানো নিশ্চয়ই ওর এখতিয়ারভুক্ত নয়?

.

দুখানা কামরার এই ছোট্ট ফ্ল্যাট বাড়ির সবেতে ছড়িয়ে আছে শিউলির অস্তিত্বের রেশ। গাঢ় রঙের পর্দা, চকচকে চাদর আর নানান ঝকমারি সরঞ্জামে চারদিক সাজানো। গাঢ় রঙ তিতিক্ষার অসহ্য লাগে ভারী। নরম রঙের ফুলতোলা চাদর, মিহি সাদা অথবা আকাশী পর্দা ওর চিরকালের পছন্দ। অভিরুচির এই সুস্পষ্ট তারতম্যে শুরুতে নিজের ঘর ভাবতে বেজায় কষ্ট হয়েছিল এই ঘরটাকে। সাহস করে দুএকবার গিয়েছিল সাজসজ্জা অদলবদলের অভিপ্রায়ে। কিন্তু কোত্থেকে একঝলক ভাবাবেগ এসে প্রতিবার বিক্ষিপ্ত মনকে তরলে পরিণত করে দিল। হোক রুচির হেরফের, না হোক পছন্দসই তবুও এসব তো সেই বৃদ্ধা মানুষটি নিজ হাতে সাজানো মমতার শেকলে বাঁধা সংসার। তার একান্ত স্বস্তির জন্য অন্য কারো ভাবাবেগের নিদারুণ অবমূল্যায়ন কি যথোচিত কাজ হবে?

‘নাশতা করেছিস?’

‘না বুবু। তুমি কি দিয়ে খেলে?’

‘গরম গরম চাপটি আর চেপা ভর্তা।’

তিতিক্ষা করুণ মুখে স্ক্রিনে তাকায়।

‘কি হলো? ‘

‘আমারো খেতে ইচ্ছে করছে।’

‘শেষ হয়নি তো। এক কাজ কর। নিদুকে পাঠিয়ে দে। আরো কয়েকটা চাপটি বানিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

‘রাখো তো বুবু।’ তিতিক্ষার কড়া প্রত্যাখ্যানে মনে হল এ যেন এক অসম্ভব প্রস্তাব।

‘তুই রাখ তো। নিদু কই? ওকে ডাক। আমি ওকে আসতে বলে দিচ্ছি।’

নিনাদকে ডাকার কথাতে এবার ও আরো বিরক্ত হয়।
‘নিদুকে ডেকে কাজ নেই। নাশতা বানানো হয়ে গেছে। আমি এক্ষুনি খেয়ে নিচ্ছি।’

‘ওমা, নাশতা বানালি কখন? ঘন্টা খানেক ধরে তো ভিডিও কলে আছিস আমার সঙ্গে!’

বিপাকে পড়ে কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে তিতিক্ষা।
‘আ.. আমি বানাইনি তো।’

‘তবে?’

‘তবে আর কি? নাশতা তোমার নিদুই বানিয়েছে।’ তিতিক্ষা দায়সারা স্বরে বলল।

বোনের কথায় অবাক মানল তিহা। সাত বছরের সংসার জীবনে কখনো এককাপ চা তৈরি করাতে পারেনি রওশানকে দিয়ে। আর বিয়ের এক মাস হতে না হতে এই নিয়ে পঞ্চম বারের মতো শুনলো নিদুর রান্নার কথা।

‘নিদু নাশতাও বানিয়েছে! কোথায় ও? ওকে একটু দে তো।’

পুনরবার বিরক্তি ভর করে তিতিক্ষাকে। আড়চোখে একবার তাকায় পাশের ঘরে। নিনাদ পত্রিকা পড়ছে।
‘ওকে ডেকে কি হবে বুবু? আমি তো রয়েছিই।’

‘তুই আছিস ঠিকি। তবে তোর ঘাড়ের একটা রগ বাঁকা। তাই আমার নিদুকে প্রয়োজন।’

‘আর সেই আদরের নিদু তোমার জন্য মাহরাম না। কথাটা বুঝি ভুলে যাও বারে বারে?’

একটু আমতা আমতা করে তিহা, ‘আ..আমি কি আর অত পরহেজগার নাকি। একটুআধটু আমল ইবাদত শুরু করেছি মাত্র। যদি আল্লাহ কবুল করেন…’

‘সবাই অল্প থেকেই শুরু করে বুবু। তবে চেষ্টাটাকে অল্পতেই আটকে রাখলে হাশরের ময়দানে রব্বুল আলামিনের সামনে আমরা কি নিয়ে দাঁড়াব বলোতো? কবুলের মালিক সুমহান রব, তবে তাঁর সৎকর্মশীল বান্দা হবার জন্য আমাদের চেষ্টা করে যাওয়াটাও ভীষণ জরুরি। অন্তত আল্লাহ তাঁর বান্দার জন্য যেসব বিধিনিষেধ নির্ধারণ করে দিয়েছেন সেসবের অবাধ্য হয়ে কি করে আমরা প্রতিবার আল্লাহর কাছ থেকে রহমত আর ক্ষমা আশা করতে পারি?’

তিহা চুপ করে আছে। হঠাৎ খেয়াল হয় তিতিক্ষার।
‘বুবু, তুমি কি রাগ করলে? আমি শুধু তোমার ভালোর জন্যই… ‘ থেমে বলে, ‘বন্ধুর প্রতি তোমার স্নেহটা ভাতৃসম আমি জানি। তবে পৃথিবীর কোনো সম্পর্কই আল্লাহর নিষেধের ঊর্ধ্বে নয়। একটা সময় তুমি অনেক কিছু জানতে না। আজ যখন জানো, মানলে তোমার এই ত্যাগটা হবে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া একজন মুমিনের জীবনে আর কি আছে বলতো?’

খানিকক্ষণ ভাবলো তিহা। একসময় নিশ্বাস ফেলে বললো, ‘সত্যিই কিছু নেই রে।’

‘তাহলে কি তুমি আমার কথা মানছো?’ ফিঁকে একটু হাসির রেখা দেখা দেয় তিতিক্ষার মুখে৷

‘মানছি।’

‘আমার মিষ্টি বুবু। ভালোবাসি তোমাকে। ছোটবাবা কোথায়? ওকে ডাকো।’

বোনের আদুরে কথা শুনে হেসে ফেললো তিহা৷
‘ডাকছি বাবা!’

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে