দূর আলাপন ~ ৪
___________________________
শ্রাবণের আরও একটি বিষন্ন দুপুর। আকাশ জুড়ে ভেসে থাকা ছিন্ন কিছু সাদা মেঘ আর সোনালী রোদ। শহর জুড়ে ছড়িয়ে আছে দুপুরের ঝিকরিমিকরি রোদের লুকোচুরি খেলা। কখনো বা ছাদের এককোণে, কখনো গাছের ডালে, পাতায় পাতায় নেচে বেড়ায় একফালি রোদ্দুর।
তিতিক্ষাদের বাড়ির উঠোন এখনো পুরোপুরি শুকোয়নি। সকালের ঝুম বৃষ্টির রেশ রয়ে গেছে আদ্র মাটিতে। অতিবৃষ্টির ফলেই কিনা এই অসময়েও নাকে এসে লাগে কামিনীর গন্ধ। ঝুমদুপুর, বাড়ির সবাই নিশ্চিন্তে ভাতঘুম দিচ্ছে। ঘুমের পরোয়া নেই শুধু একজোড়া আঁখির। শান্ত শিথিলে দুপুরের রোদ ডিঙিয়ে সে সোঁদা গন্ধ ওঠা ভেজা মাটির উঠোনে ধীর পায়ে হেটে বেড়ায়। স্বাদ পরিবর্তনের জন্য আজ হাতে নিয়েছে একখানা ইংরেজি কবিতার বই। চোখ বুজে মাঝে মাঝে আওড়াচ্ছে কবিতার একটা দুটো পঙক্তি।
As I looked into his eyes
And found his longing stare
I stopped myself from saying words
That would show how much I care….
লোকে ভাবে, যে ধর্ম নিজেকে আড়াল করতে শেখায়, অট্টহাসিতেও নিষেধ দেখায় সে ধর্ম তো সন্ন্যাসেরই নামান্তর! যে নামায পড়ে, কোরআন পড়ে, সে হাতে তবে কেন অন্য বই উঠবে? তিতিক্ষা চোখ বুজে কথাটা ভেবে আনমনে হেসে ওঠে। এই ধারার কথা জীবনে সে কম বার তো শোনেনি। স্কুলের দিনগুলোতে টিফিন টাইমে বাকিরা যখন কানামাছি খেলতে ছুটে মাঠে যেত, তিতিক্ষা তখন সেই ফাঁকা ক্লাসে বসে ফরজ সালাতটুকু শেষ করে গল্পের বইয়ে পাতা ওল্টাতো। মেয়েরা মুখ ভেঙচিয়ে বলত, ‘ঢং দ্যাখ! দিনরাত হাদিসের বুলি ঝেড়ে এখন আবার গল্পের বই পড়া হচ্ছে! যুগে যুগে আর কত কি যে দেখবো….’
কথাগুলো ভেবে তিতিক্ষার এখন দুঃখ হয়না আর। সবাই ত্যাগ করেছে ওকে। সমাজ… আত্মীয়… বন্ধু-বান্ধব… ছাড়তে পারেনি শুধু সে নিজেকে নিজে। গোটা ‘আমি’ টাকে নিয়েই সবার আড়ালে চলে গেছে। অথচ আজও সমাজের কাছে তার ভুলের কোনো অবধি নেই। যত্রতত্র তরল কথাবার্তায় যোগ দেয় না, অট্টহাসিতে ঘর ভরে তোলে না, গায়ে জড়ায় না জাঁকজমকের মোড়ক বসানো পোশাক…. তাই নাকি সে দাম্ভিক, হিংসুক, পরশ্রীকাতর, গেয়ো ভূত আরো কত কি! অতএব সমাজে তার স্থান অতি ন্যূন।
সেই নিস্তব্ধ দুপুরে বিষন্ন মনের অনুকূল আবহাওয়ায় তিতিক্ষা আরো অনেক কথা ভাবে। নানান ভাবনার মাঝে একটা অপ্রিয় ভাবনাও উঁকি মেরে যায় থেকে থেকে। তিতিক্ষা ভাবতে চায় না। আবার এই অভেদ্য রহস্য ভেদ করতে না পেরে শান্তিও পায় না। কি ভীষণ জ্বালা!
ওড়না প্রান্তে হেচঁকা টান পড়তেই তিতিক্ষা ঘুরে তাকায়। ছোটন দাঁড়িয়ে আছে। ঘুম ভাঙা ফোলা ফোলা চোখ মুখ, এলোমেলো হয়ে থাকা মাথার চুলে তাকিয়ে বাৎসল্যের উষ্ণ ঢেউ তিতিক্ষার ভেতর উথলে ওঠে। বাচ্চাটাকে কাছে ডেকে আঙুল চালিয়ে চুল ঠিক করে দেয়। কবিতার বই সিড়ির ওপরের ধাপে নামিয়ে রেখে কোলে তুলে নেয় ওকে।
‘ছোট মিয়ার ঘুম এতো জলদি শেষ? মা জানলে পিঠে যে দুরুম দুরুম পড়বে। সে খেয়াল আছে তো?’
ছোটন ভেংচি কাটে। ভাবটা এমন দেখায় যেন মায়ের শাসনের অনুমাত্র পরোয়া ও কখনো করে না।
তিতিক্ষা স্মিত হাসে।
‘তা এই ভরদুপুরে কি চাই? এর চেয়ে কি মায়ের সাথে ঘুমানোটাই ভালো ছিল না? ‘
ছোটন ডানে-বামে মাথা নাড়ে। বলে, ‘আম্মো তো ঘুমায় না। আম্মোর মন খারাপ। তাই রাগ করে আমাকে শুধু মারে। সেজন্যই তো চলে এসেছি। আর যাবোই না।’
মারের কথা শুনে তিতিক্ষার ভুরু বাঁকলো। বুবুর এই বাজে স্বভাব যে কবে ফিরবে… কিছু হলেই ছেলের পিঠে কিল-চড়… অতটুকু বাচ্চা কিইবা বোঝে? তার সব কথায় অত রেগে যেতে আছে? তিতিক্ষা ছোটনের গালে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
‘ফের মেরেছে তোমাকে? ভারি অন্যায় তো! বুবু দেখছি এবার শাসন না করলেই না। তুমি মন খারাপ কোরো না বাবু। পরের বার ঠিক বকে দেব।”
সায় পেয়ে মিমির কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে ছোটন।
মৃদু পায়ে উঠোন জুড়ে হাটতে থাকে তিতিক্ষা। অনেকক্ষণ পর জিজ্ঞেস করে,’ছোট মিয়া?’
‘হু’
‘তোমার আম্মোর আজ খারাপ কেন বলতো?’
তিতিক্ষা উত্তরের অপেক্ষা করে না। মনের খেয়ালেই প্রশ্নটা সে করেছিল।
ছোটন অত কিছু বোঝে না। সেদিন রাতে ভবিতব্য শ্বশুর নিনাদ ওরফে তার বেস্টু ফোন রাখার পর থেকেই সে দেখছে মায়ের মন খারাপ। সেটাই তিতিক্ষাকে বোঝাতে লাগলো। এর আগেও কয়েকবার নানান কথা দিয়ে ব্যাপার টা মিমিকে বোঝাতে চেয়েছে। তবে ছাত্রীটি নিতান্ত অচতুর হওয়ার দরুন বারবার ব্যার্থ হয়েছে। তিতিক্ষা কিছু বোঝেনি। শুধু টের পেয়েছে আড়ালে কি যেন একটা ঘনিয়ে উঠছে। গুরুতর কিছু। তবে আনন্দদায়ক নয়!
এইটুকু বুঝতে গত দুদিনে বুবুর হাবভাবের রকমসকম লি যথেষ্ট ছিল। শুরুতে ভেবেছিল রওশান ভাই চলে গেছে বলে হয়তো মন খারাপ। কিন্তু রওশান ভাইয়ের এই চলে যাওয়াটা তো অকস্মাৎ নয়। নিয়ম করে সে আসছে, চলে যাচ্ছে। কখনো তো বুবুকে এমন গুম মেরে থাকতে দেখেনি!
আজ, ছোট মিয়ার কথায় এইমাত্র সে বুঝলো ব্যপার যা-ই হোক ওতে নিনাদ জড়িত। এর মাঝে থাকা তার চলে না। ফলস্বরূপ তিতিক্ষা আগ্রহ হারালো। দেখাই যাক না কি হয়!
ক্রমে ক্রমেই বেলা পেরিয়ে জ্বলজ্বলে দুপুর অদৃশ্য হয়ে শহরের আকাশে ধূসর অপরাহ্ন নেমে এলো। তিতিক্ষা সোফায় হেলে একটা বাচ্চাদের গল্পের বই জোরে জোরে পড়ে শোনাচ্ছে। ছোটন তার পাশে আধশোয়া হয়ে বই পড়া শুনছে। তখন শেষ মধ্যাহ্নে উঠোনে হাটাহাটির পর আসরের আযান পড়তেই তারা দুজন ঘরে ফিরে এসেছিলো। তারপর তিতিক্ষা ছোটনকে পাশে নিয়েই সলাত আদায় করেছে। এরপর থেকেই এখানে বসে এরূপে তাদের বইপড়া চলছে। মারুফ সাহেব এখনো মসজিদ থেকে ফেরেননি। তিহা রান্নাঘরে আলুর চিপস ভাজছে।
ক্রিংক্রিং করে টেলিফোনটা বেজে উঠল। তারপর অনবরত বাজতেই থাকলো। ছোটন গভীর মনোযোগে শুনছিল রাজকন্যার রাক্ষসপুরীতে বন্দী হওয়ার কাহিনি। তাই হঠাৎ এভাবে বাঁধা পরায় সে যেন একটু বেশিই বিরক্ত হলো। চোখ ছোট করে ভীষণ একটা ভ্রুক্ষেপ করল টেলিফোনের দিকে। ওটার প্রকট সুর তখনো ঘরময় বিরাজমান। তিতিক্ষা বই উল্টে রেখে হাত বাড়িয়ে ফোন কানে তুললো, ‘আসসালামু আলাইকুম। কাকে চাই?’
ওপাশে নিরবতা।
‘হ্যালো, কে বলছেন? ‘
আবারো নিরবতা।
তিতিক্ষা টেলিফোন মুখের সম্মুখে এনে সন্দিগ্ধ হয়ে তাকায়। ভুরু কুঁচকে নাম্বার টা দেখে নিয়ে ইশারায় কাছে ডাকে ছোটনকে। মাঝে মাঝেই বাজে ছেলে ছোকরারা এভাবে রং নাম্বার থেকে কল করে ডিস্টার্ব করে। ছোটন কাছে এলে টেলিফোনে হাত চেপে সে ফিসফিস স্বরে বলে, ‘দেখো তো ছোট মিয়া কি বলে।’
এতবড় দায়িত্ব পেয়ে আত্ম অহামিকায় ছোট মিয়ার বুক তখন ফুলে উঠেছে। টেলিফোন হাতে নিয়ে সে যতটা সম্ভব গলার স্বর কঠিন করে বলে, ‘হ্যালো।’
এবারেও ওপাশে নিরবতা অবিচল।
ছোট মিয়া ফের ‘হ্যালো’ বলল। উত্তর নেই। অতএব ছোট মিয়ার রক্ত গরম হতে বেশি সময় লাগলো না। ছোট্ট শরীরের সর্বশক্তি এক করে চেঁচিয়ে বলল,’হ্যালোওওওওও।’
কাজ হলো বোধহয়। ওপাশ থেকে একজন বৃদ্ধার খড়খড়ে গলায় আওয়াজ শোনা গেল। বিষম বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘ও মারে মা…. আমার কানডা শ্যাষ…. ওই নিনাইদ্দা! এইডা কার নাম্বারে ফোন করছস তুই? চিককুর পাইরা আমার কানের পুক লারায়ালছে! ওরে আল্লাহ!’
নিনাদ লাফিয়ে ফোন হাতে নিল। কল করে প্রথমে তিতিক্ষার কণ্ঠ শুনেই সে চুপ করে ছিল। তারপর বৃদ্ধার হাতে ফোন দিতে যতটা সময় লাগে। এর মাঝেই কি আবার হলো!
‘ হ্যালো। ‘
তিতিক্ষা ছোটনের দিকে কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে ছিল। জিজ্ঞেস করলো, ‘কে ছোট মিয়া?’
ওপাশে বৃদ্ধার খড়খড়ে গলার কথা শুনে ছোট মিয়ার ততক্ষণে মুখ শুকিয়ে এসেছে। সে টেলিফোনে কান থেকে নামিয়ে নিয়েছিল তৎক্ষনাৎ। বললো, ‘জানি না। ‘ বলেই টেলিফোন মিমির হাতে ছেড়ে ভোঁ দৌড়। তিতিক্ষা পড়ল মস্ত বিপদে। ছোটন কেন এভাবে হঠাৎ ভয় পেয়ে পালালো? ওপাশে কে আছে? না জেনে একদম কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ওদিকে তার হাতে থাকা টেলিফোন তখনো ভাইব্রেট হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ ওপাশে নিশ্চয়ই কেউ কিছু বলছে। তিতিক্ষা সংকোচ নিয়ে ফোন কানে তুললো,’হ্যালো। আপনি কে বলছেন?
এই স্বর চিনতে নিনাদের দেরি হয় না। তৎক্ষনাৎ পাশে থাকা বৃদ্ধার হাতে পুনর্বার ফোন হস্তান্তর করে সে,’ধরেছে, নাও কথা বল।’
বৃদ্ধা ফোন নিলেন। মুখের বিরক্ত ভাব গায়েব, সরল হেসে বললেন, ‘তিহা নাকি তুমি? কেমুন আছো? কউ তো আমি কেডা?’
তিতিক্ষা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। কে এই বৃদ্ধা? এভাবে পরিচিতের মতো কথা বলছেন। অথচ সে চিনতে পারছে না…. যেই হোক, বুবুর খুব কাছের কেউ নিশ্চয়ই!
মিনমিনে স্বরে বলল, ‘জ্বি……আসলে। আপু তো এখানে নেই। আমি ওর ছোট বোন। একটু অপেক্ষা করুন, এক্ষুনি আপুকে ডেকে দিচ্ছি।’
ভদ্র মহিলা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বললেন,’ও তুমি তাইলে তিতিক্ষা বুঝি? প্রথমে ঠাওর করতে পারি নাই। তোমারেও তো আমি চিনি। কেমুন আছো মা?’
‘জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি ভালো আছেন? ‘
‘আল্লায় রাখছে এক রকম। তোমার আপায় কই? তারে ডাকো। বল শিউলি ফুআম্মা ফোন দিসে। ‘
‘জ্বি….জ্বি…. এক্ষুনি ডেকে দিচ্ছি।’ বলে ফোন নামিয়ে রেখে তিতিক্ষা বাঁচলো হাফ ছেড়ে। পরক্ষণে ছুটে গেল রান্নাঘরে তিহাকে ডাকতে। ওকে বাইরের ঘরে পাঠিয়ে এবার চিপস ভাজায় নিযুক্ত হল নিজে। বাবা এলেন, ছোটন ঘরের লুকোনো কোণ ছেড়ে বেরোলো। ওদের সঙ্গে বসে চা বিস্কিট আর গরম চিপস ভাজা খেল তিতিক্ষা। অথচ তখনো তিহার টিকিরও দেখা নেই! সে এলো বিস্তর সময় পর মুখে একরাশ হাসি নিয়ে।
‘কে ছিলো বুবু? এতো সময় ধরে যে কথা বললে?’ স্বাভাবিক কৌতুহল থেকে তিতিক্ষা চায়ে চিনি মেশাতে মেশাতে শুধাল।
‘শিউলি ফুআম্মা কে মনে আছে তোর? একবার স্কুলে থাকতে তোকে নিয়ে গিয়েছিলাম নিনাদের বাসায়। তখন এসেছিল।’
নিনাদের নাম শুনেই তিতিক্ষার সমস্ত উৎসাহ মুহুর্তে উড়ে গিয়ে রাশি রাশি বিরক্তি এসে জমা হয়েছে। বিরস মুখে বলল,’মনে নেই বুবু।’
নিজের খুশিটুকু যেভাবেই হোক প্রকাশ করতে তিহা উতলা তখন। চুপসে না গিয়ে দিগুণ উৎসাহে চেঁচালো,’ ফুআম্মা কে ভুলে গেলি! নিনাদের বাসায় গেলদ কত যত্নআত্তি করতো… একদম নিজের আপন চাচি-ফুফুর মতো…. তোকেও তো সেবার কত আদরযত্ন করল। সব ভুলে গেলি?’
‘তোমার স্কুলে পড়ার সময়। সে অনেককাল আগের কথা বুবু। মনে না থাকাটাই স্বাভাবিক।’
‘ছাই!’ তিহা মুখ বাঁকাল। ‘আচ্ছা শোন না। আসল কথাটাই তো বলা হয়নি তোকে! ফুআম্মা কেন ফোন করেছিল জানিস?
নিনাদ তো চলেই যাচ্ছে… সেজন্য ফুআম্মা
কে বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে। নিনাদের চলে যাওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকবেন। ও যাবার আগে ওর সাথে সাথে আমাদের সঙ্গে একবার দেখা করতে চান। তাই নিজেই দাওয়াত দিলেন। সামনের শুক্রবার নিনাদের বাড়িতে। আমি, ছোটন আর তুই। ইশশ কি দারুণ হবে, তাই না? ফুআম্মার হাতের রান্না কত বছর ধরে যে খাই না… এই সুযোগ!’
এসব কোন কথাই তখন আর তিতিক্ষা বিশেষ খেয়াল করে শুনছিল না। বুবুর বলা ওই একটা কথাতে আটকে আছে সে। বুবু যে বলল নিনাদ চলে যাচ্ছে! এর মানে কি? হঠাৎ কোথায় যাচ্ছে সে? কেনই বা যাচ্ছে? এজন্যই বুঝি বুবুর আজকাল এত মন খারাপের বাড়বাড়ন্ত?
কোথায় যাবে নিনাদ? দূর? খুব দূর?
তা কি করে হবে! হয়তো পাহাড় টাহাড় কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে….
নিনাদ কি আর ছেলেমানুষ? যদি দিন কয়েকের জন্য সেখানে যায় ই, তবে সবার এত আদিখ্যেতার কি আছে? আর সেই সুদূর গ্রাম থেকে নিজের ফুফুকে আনিয়ে এত আয়োজনই বা কেন?
ধুর…. যেখানে ইচ্ছে চলে যাক অভদ্র বেহায়া ছেলেটা… তিতিক্ষার তাতে কিইবা এসে যায়?
তিহা তখনো দারুণ উত্তেজনায় হড়বড় করে একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছে। কিছু মন দিয়ে শুনছে না তিতিক্ষা। ভাবছে… কি নিয়ে যে তার অত ভাবনা…. তবে আর যাই হোক! বুবুর ওই বেহায়া বন্ধুর হঠাৎ চলে যাওয়া নিয়ে মোটেও ভাবিত নয় সে।
ওকে ভাবাচ্ছে যাওয়ার এই আগাম আয়োজন, সকলের ব্যস্ততা, বুবু আর রওশান ভাইয়ের অস্থিরতা… সবার তোড়জোড় দেখে মনে হয় যেন বহুদিনের জন্য, বহু দূরের কোনো মুলুকে হারাচ্ছে নিনাদ… সাথে একটা সুখস্বপ্ন নিয়ে। যেকারণে এই বিচ্ছেদও সবার কাছে এতটা আনন্দের!
________________________
সেদিন রাত্রিবেলা তিহা, রওশানের জোরের কাছে হেরে বাধ্য হয়ে সব জানাতে হয়েছিল নিনাদকে। শান্ত ধীর স্বরে ও বলল কিছুদিনের জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার হঠাৎ প্রয়োজন পড়েছে। বাইরে মানে আমেরিকায়। ঢাবিতে অনার্স-মাস্টার্স শেষে একমাত্র যে লক্ষ্যটার পেছনে দিনরাত সে মরিয়া হয়ে ছুটেছিল। আজ সে লক্ষ্যপূরনের দোর গোরায় নিনাদ দাঁড়িয়ে। জিআরই আর আয়েল্টস এর রেজাল্টের পর আমেরিকার তিনটা ইউনিভার্সিটিতে এপ্লাই করেছিল। এরমধ্যে টলেডো থেকেই শুধু গ্রীন সিগনাল আসে। তার প্রোফাইলও পছন্দ হয় ওদের। ভিসা আবেদন করা শেষ। এবার শুধু ভিসা ইন্টারভিউ টা বাকি। আর দিন পনেরোর মধ্যে বোধহয় সেটাও হয়ে যাবে। এরপর সামনের মাসেই কোন একটা দিন আকাশে উড়াল দেবে সে।
নিনাদের কথা শেষ হতেই ফোনের এপাশে তিহা রওশান সমস্বরে চিৎকার করে উঠল। ফোন লাউড স্পিকারে ছিল। তিহা চেচিয়ে বলল,’তুই সত্যি বলছিস? সত্যি তোর স্কলারশিপ টা হয়ে গেছে? আমি একটুও বিশ্বাস করি না। তুই এক্ষুনি কসম কাট তো।’
নিনাদ অস্ফুটে হাসলো,’কসম কাটতে পারবো না। ভয় ডর নেই নাকি আমার?’
‘যদি সত্যি যেতে পারিস তাহলে একটা কসমে তোর কি সমস্যা? আমি কিছু শুনবো না। তুই কসম কাট জলদি।’
‘আচ্ছা, যা কাটলাম। আল্লাহর কসম বলছি সত্যি যাবো…. যদি না শেষ সময়ে ওরা আমাকে বাতিল করে দেয়। এমনটা যদিও হওয়ার সম্ভবনা নেই…. তবু কসমই যখন কাটব রিস্ক রেখে লাভ কি এখন ঠিক আছে তো?’
তিহা হাসলো। আর কিছু বলা হলো না ওর। খুশিতে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে হাসছে, একইসাথে চোখে জলে ভিজে যাচ্ছে গাল। ও জানে, ওর এই বন্ধু রূপী ভাইটার পুরো জীবন কেমন শূন্যতায় মোরানো। মা, বাবা, ভাই, বোন কাছের আত্মীয়স্বজন… যা কেউ নেই। সবাই তাকে রেখে বহু আগেই ওপারে নৌকা ভিরিয়েছে। শুধু রয়ে গেছে সে একা। জীবনের লড়াইটা সে তাই একাই লড়ে গেছে সবসময়। নিজের সর্বোচ্চ টা দিয়ে। নিনাদ ওপাশ থেকে তিহার নাম ধরে ডাকছে। তিহা চোখ মুছল। সে কাঁদলে নিনাদ কষ্ট পাবে ভীষণ।
নিনাদের কথা শুনে রওশান তখন থেকে হা হয়েই ছিল কিছুক্ষণ। এবার বলল, ‘শালাবাবু, মাথা টাথা ঠিক আছে তো তোমার? ‘
নিনাদ কিছু বুঝতে না পেরে বলে, ‘কেন ভাই?’
‘নাহয় এমন একটা খবর কি আর কেউ এমন মুখ গম্ভীর করে দেয়! মনে হচ্ছে স্কলারশিপ পেয়ে নয়। তুমি নিতান্ত অনিচ্ছায় আমেরিকার কোনো এক কারাগারে দাসত্ব বরণে যাচ্ছো!
একথার উত্তর নিনাদ মুখে দিল না। তার গগনবিদারী হাসি মধ্যরাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে চূড়ে খানখান করে দিল।
তিহার ধ্যান তখন এখানে আর নেই। সেই অন্ধকার রাত্রিতে, সবার মাঝে থেকেও যেন সে খুব একা অনুভব করলো। দু’হাত একত্রে তুলি আকাশের দিকে তাকিয়ে বারবার শুকরিয়া জানাতে লাগলো আরশের মালিকের দুয়ারে।
বহুদূরের কোনো এক অন্ধকার রাতের নিচে বসে নিনাদের হঠাৎ করা গগনবিদারী হাসির শব্দ কি আর কারো কানেও এসে পৌঁছেছিল? সেও কি কেঁপে উঠেছিল অজানা অনুভূতির শিহরণে। কে সে? তিতিক্ষা নয়তো? কে জানে!
চলবে……