দূর আলাপন ~ ৩
(সম্পুর্ন গল্পের লিংক কেন ওপেন হচ্ছে না, এই নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করছেন। সবাইকে অনুরোধ করবো একটু ধৈর্য ধরতে। গল্পটা দু বছর আগে লেখা। অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে। সেসব ঠিক করে এখন প্রতিদিন একটা করে পর্ব দেয়া হবে ইন শা আল্লাহ। গল্প নিয়মিত পেতে পেজে চোখ রাখুন। পুরনো লিংক ওপেন হবে না। প্রথম কারণ আগের কাঁচা হাতের লেখা আর কেউ পড়ুক আমি চাইছি না, দ্বিতীয়ত আমার আইডি ডিএক্টিভ।)
___________________________
নিনাদ এসে তিহার পানে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। চাপা রাগ ঝরে পড়ে ওর স্বরে, ‘লিলি কি বলতে এসেছিল ওকে?’
তিহার মুখ ততক্ষণে ফ্যাকাসে, ‘কি আবার! তার যা কাজ। ফোন নাম্বার নিতে এসেছিল।’
‘তোর বোন কি করলো? দিয়ে দিল ফোন নাম্বার? ‘
‘তাই তো করেছে দেখলাম। আমি ইশারায় নিষেধ করছিলাম। ও বুঝতে পারেনি।’
‘বাহ! তাহলে তো আর কথাই নেই। এবার তাহলে রং নাম্বার থেকে কল এলে বলিস তোর বোনকে জমিয়ে পিরিত করতে !’
বন্ধুর কথায় আরো চুপসে যায় তিহা, নিনাদ আরো দু কথা শুনিয়ে না দেয়। সেজন্য তাড়াতাড়ি বলে, ‘আচ্ছা বাদ দে। লিলির স্বভাবই তো অমন। এর-তার জন্য মেয়ে খুঁজে বেরানো। কেউ ডিস্টার্ব করলে সে নাহয় তখনি দেখা যাবে। তুই তো আছিসই।
জানিস, এই মেয়ের চক্করে পরে আমার খাওয়াটা ঠিকঠাক হলো না! ‘
‘খাওয়া হলো না! আর কত খাবি তুই? সেই কখন থেকে দেখছি শুধু খেয়েই যাচ্ছি। তোর আর খেতে হবে না। প্লেটে এখনো একটা আস্তো লেগ পিস রয়েছে দেখা যায়! দে প্লেটটা আমায় দে। কামলা খাটতে খাটতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল করে ফেললাম। এখনো কিছু খেতে দিলো না ওরা।এত পরিশ্রমের বিনিময়ে এই! ভেবে দেখ একবার! পাপড়িটারও কি হুশ আছে? ছবির পোজ দিতে দিতে মুখ বেঁকে যায় অবস্থা। পুরাই আজিব চিজ এরা সব!’ বলে তিহার আধখাওয়া প্লেট টেনে নিল নিনাদ। তখনক ঘুরে বসতে যেতেই ঘটে গেল ভয়ানক একটা দুর্ঘটনা।
তিতিক্ষা হাত ধুয়ে ফিরছিল। নিনাদ খেয়াল করেনি। তিতিক্ষাও ভেবেছিল পেছনেই অপেক্ষা করবে। নিনাদের সঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আসর জমানোর কোনো ইচ্ছে তার নেই। কিন্তু এরকম অকস্মাৎ পিছিয়ে আসবে কে জানতো!
দুজন মুখোমুখি হতেই ঘটে গেল সংঘর্ষ। নিনাদের হাতে থাকা খাবারের প্লেট গিয়ে পড়লো তিতিক্ষার গায়ের ওপর। সবকিছু এত দ্রুত ঘটল দুর্ঘটনা এড়ানোর সুযোগ টুকু তিতিক্ষা পেল না। নিজেকে বাঁচানোর সামান্য প্রচেষ্টায় সে চোখ বুজে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলেছিল। চোখ খুলে এবার যা দেখলো তাতে ওর কান্না পেয়ে গেল। ঝকঝকে বোরকাটা মাংসের লাল ঝোলে মাখামাখি, খানিকটা ঝোল চুইয়ে ক্রমে ওর পায়ে গড়িয়ে পড়ছে। অদূরেই কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে তাকিয়ে আছে নিনাদ। মুখেচোখে প্রবল অনুতাপবোধের ছাপ। বেচারার হতভম্ব ভাব কাটা মাত্র কি অঘটন ঘটিয়েছে বুঝতে পেরে ও ব্যাস্ত হয়ে উঠল।
টেবিল থেকে একসাথে অনেক গুলো টিস্যু টেনে নিয়ে তিতিক্ষার বোরকা পরিষ্কারে মনোযোগী হলো।
তিতিক্ষা নির্বাক। চেষ্টা করেও হঠাৎ সরে যেতে পারলো না। তার বোরকা টেনে ধরে আছে নিনাদ। টিস্যু দিয়ে ঝোল পরিষ্কার করছে। আপাতত আর কোনো খেয়াল নেই বেচারার। বারবার বলেছে ‘সরি। খুব ভুল হয়ে গেল। একদম খেয়াল করিনি আমি।’
তিতিক্ষা নিরুপায় হয়ে কাঁদোকাঁদো মুখে বোনের দিকে তাকালো। তিহা তখনো সম্বিত ফিরে পায় নি। তাকিয়ে ওদের দেখছে হা করে।
আশেপাশে বেশ একটা শোরগোল পড়ে গেছে ব্যপার টা নিয়ে। বিয়ে বাড়ির হাজার লোক, হাজার রঙের কথা!
যে যেখানে ছিল সেখানে দাঁড়িয়ে ব্যাপার টা উপভোগ করছে। মুখ দেখা যায় না, চুল দেখা যায় না, কালো বেশধারী এমন এক মেয়ে র সারা গায়ে মাংসের ঝোল মাখানো। কাছেই একটি আসমানি রঙা পাঞ্জাবি পড়া গাঢ় শ্যামবর্ণের, ঝাকড়া চুলের ছেলে বসে ব্যাস্ত ভঙ্গিতে সেসব পরিষ্কার করছে। কেউ কেউ এদের স্বামী-স্ত্রী ভেবে নিয়ে নিনাদকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘লাভ নাই ভাই। এভাবে পরিষ্কার হবে না। ভাবিরে নিয়ে বাসায় যান।’
একটুকু হলেও বোধহয় চলতো। কিন্তু তিহার বন্ধুমহলের সবাই যখন একসাথে এসে জুটলো, তাদের কথায় তখন তিতিক্ষার কান আঙুল দেয়া ছাড়া পথ রইল না। পূর্ব থেকেই তিতিক্ষাকে নিনাদের কথা তুলে খেপাতে ওরা বেশ মজা পেত। আজ সুযোগ পেয়ে ওদের মশকরা চরমে এসে পৌঁছালো। কথার সাথে সাথে কেউ কেউ আবার শিশ বাজাচ্ছে।
তিতিক্ষা শেষ বারের মতো চাইল বোনের দিকে।তিহা এখনো বুঝতে পারছে না কি করা উচিত। বন্ধুদের কে থামানোও যাচ্ছে না। বিয়ে বাড়ির সবেতেই হাসিঠাট্টা করার একটা অমোধ বিধান যেন নির্ধারিত হয়ে আছে। বন্ধুরা সেই সুযোগে যাচ্ছেতাই ভাবে ওর রাগী বোনটাকে পচাচ্ছে। নিতান্ত স্বাভাবিক একটা বিষয় যে নিনাদ-তিতিক্ষা কে কেন্দ্র করে হতেই এতো অস্বাভাবিক হয়ে যাবে স্বপ্নেও ভাবেনি তিহা।
বোরকাটা মোটামুটি ঝোলমুক্ত করে নিনাদ সরে এলো। ছাড়া পাওয়া মাত্র কারো পরোয়া না করে হাওয়ার বেগে আসর ছাড়ল তিতিক্ষা। তৎক্ষনাৎ ছোটনের হাত ধরে বোনের পিছু পিছু ছুটল তিহা। বুঝলো বাড়ি ফিরে আজ তুফানের মুখোমুখি হতে হবে…
.
নিজের ঘরে এসে দ্বার রুদ্ধ করলো তিতিক্ষা।অনেক ধাক্কাধাক্কিতেও আর দ্বার খুললো না সে রাতে। মারুফ খানিক পর পর এসে মেয়ের ঘরের সামনে চিন্তিত মুখে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন।মেয়েকে তিনি জানেন। বড্ড রাগী আর অভিমানী। কিছু একটা তো হয়েছে নিশ্চই। অকারণে গাল ফোলানোর মেয়ে ও নয়। শেষতক ডাকার সাহসটা করে উঠতে পারলেন না ঠিকঠাক। বড় মেয়ের কাছে গেলেন। এই ভেবে যে তিহা হয়তো তার অভিমানী কন্যার হঠাৎ হওয়া অভিমানের কারণ জানে। তিহা বাবাকে চিন্তামুক্ত করতে হেসে ব্যাপার টা খুব হালকা ভাবে উড়িয়ে দিল। কিন্তু সবকিছু উড়িয়ে দিতে চাইলেই যে অক্লেশে উড়ে যাবে এমন তো নয়। সেদিনের ঘটনার রেশ কাটলো না সহজে। তিতিক্ষার বিক্ষুদ্ধ ধমর্ঘটে বাড়ির আবহ শীতল রইল বেশ কিছুদিন। এই কদিন প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকেই বেরোলো না ও। তারপর একদিন ফজরের সালাতের পর তিহা রান্নাঘরে চা করছিল। সহসা তিতিক্ষার আগমন। ঘুমভাঙা
পেলব চোখ মেলে চাইল বুবুর দিকে। বুবুর মুখখানা আজ বেশ মলিন। অনুতাপে দগ্ধ হলো যেন তিতিক্ষা। কি দরকার ছিল বুবুর সঙ্গে অত রাগ দেখানোর! বুবুর তো দোষ ছিল না। ইতস্তত মৃদু গলায় প্রথম কথা বলল তিতিক্ষা,’আমাকে চা দেবে বুবু?’
তিহার চোখেমুখে চমকিত ভাব।
‘তুই! রাগ ভাঙল তবে মহারানীর? দিচ্ছি। ডাইনিং এ গিয়ে বোস।’
দুইবোন মুড়ি দিয়ে চা খাচ্ছে। তিতিক্ষা পরিতোষ চিত্তে হঠাৎ ঠিক যেন আবদারের সুরে বলল,’আজকের আবহাওয়াটা বেশ! হাটতে যাবে বুবু?’
তিহা মনে মনে খুশি হলো। এই তো তিতিক্ষার প্রকৃতি রূপ। গম্ভীর অথচ কি সারল্যে ভরপুর। এমনিতে বোনটা তো তার বেশ ভালোই। শুধু যা একটু রাগের বেলা মাথা ঠিক থাকে না। তিহার মনের খুশি মুখে প্রকাশ পেল না বিন্দুমাত্রও। তিতা করলাকে আরো একটু অনুতপ্ত বোধ করাবে সে। দুখী দুখী চেহারা করে বলল, ‘যাবি হাটতে? কিন্তু… ‘
‘কোনো কিনতি না বুবু। প্লিজ চলো না..। ছোটনের স্কুলেও তো আজ ছুটি।’
‘এত করে বলছিল যখন…. আচ্ছা চল।’
বোনের কথা চতুরতার সন্দেহ তোলা তখন অমূলক। বরং বুবুর নিষ্প্রভ মুখখানি দেখে তিতিক্ষা মনে ততক্ষণে অপার করুণা জাগ্রত হয়েছে। এই কদিন বুবুর সাথে দূরত্ব রেখে চলার পরিতাপে সে পুড়ে খাক হচ্ছে।
ছি! অত প্রিয় বুবুর সঙ্গে কিভাবে যে করতে পারলো এত রাগ। তার দ্বীন তো কখনো এমন বেপরোয়া অভিমানের শিক্ষা দেয় না!
বুবুর হাত ধরে সেদিন সকালে অনেকক্ষণ ঘুরে বেরালো তিতিক্ষা। হাটল ভোরের স্নিগ্ধ-শীতল শান্তিময় আবহাওয়ায় এক পথ থেকে অন্য পথে। দুদিনের অবিরত বর্ষণে ধানমন্ডি লেকের স্বচ্ছ পানি তখন আরও স্বচ্ছ, ঝলমলে হয়ে উঠেছে।ভোরের তরুণ সূর্য পুরো লেক জুড়ে ছড়িয়ে রেখেছে তার সোনালী আলোর বিচ্চুরণ। ওরা লেকের পাড়ঘেঁষে হাটল, বসে সুখ,দুঃখের গল্প করল খানিকক্ষণ। বাড়ি ফিরে তিতিক্ষা আবার আগের মতো হাসিখুশি, প্রানবন্ত হয়ে গেল। মেয়ের হাসিমুখ দেখে ঝলমলিয়ে উঠলেন মারুফ।
সেই বিয়ের একমাস কেটেছে। এরমধ্যে একবারো তিতিক্ষাদের বাড়িমুখো হবার সাহস দেখায়নি নিনাদ। ধাক্কা খেয়ে ভুলবশত গায়ে খাবার ফেলে দেয়া ঘটনা হিসেবে তেমন কিছু না। তিতিক্ষার জায়গায় অন্য যেকোনো মেয়ে হলে হয়তো হেসে উড়িয়ে দিতো সবটা। তবে দূর্ভাগ্যবশত মেয়েটা তিতিক্ষা ছিল এবং সেখানে বন্ধু রূপী কিছু শত্রুর উপস্থিতিও ছিল। তাদের কথাগুলো জ্বলন্ত অগ্নিতে ঘৃতাহুতির কাজ করলো। যদিও নিনাদের বন্ধুরা শুধুমাত্র কৌতুক করেই কথাগুলো বলছিল। কিন্তু তাদের হয়তো ধারণা ছিল না সে কথাগুলো কারো অন্তঃকরণে এতো গভীর আঘাত হানতে পারে। নিনাদও অনুতপ্ত। অপরাধ সে জেনে-বুঝে কিছুই করেনি। তবু তিহার সঙ্গে কিঞ্চিৎ দূরত্ব বাড়ালো। মন খারাপ হলো তিহার, শেষে কিনা নিনাদটাও ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে? সেও আগ বাড়িয়ে করবেনা যোগাযোগ। দেখবে কি হয়!
এই সব দূরত্ব এক লহমায় দূর করে দিল একটা ফোন কল!
তিহার স্বামী রওশান বান্দরবান থেকে ফিরে তিহার মুখে সবকিছু শুনলো।নিনাদ কে সে বিশেষ পছন্দ করতো। নিনাদের সোজাসাপ্টা কথা বলার ধরনের জন্য। তাছাড়া ভার্সিটিতে তুখোড় মেধাবী হিশেবে যথেষ্ট সুনাম থাকলেও আচরণে তার কিছু অপরিপক্কতা রয়েই গেছিলো।সেই দূর্বলতা দিয়ে সে খুব সহজে অন্যের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারতো। তদতিরিক্ত! যে সুদর্শন, মেধাবী, বাক্যে পটু অথচ নীতিতে সরল। অন্যের ভালোবাসা অর্জনে তার কিই বা বাঁধা !
রাতে খাবার পর স্ত্রী পুত্র নিয়ে ছাদে হেল রওশান। ছাদের মাঝখানে কাঠের বেঞ্চি পাতা। রওশান তিহা দুজন দু’দিকে বসা। মাঝে ছোটন তার ছোট ছোট হাত দিয়ে বাবা-মা দুজনেরই হাত চেপে ধরে বসে আছে। খুশিতে ঝিকিমিকি দুটি চোখ, প্রফুল্লতায় ভরপুর ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসি। সুদীর্ঘ দিবস রজনী অপেক্ষার পর বাবা মাকে একসঙ্গে কাছে পেয়েছে সে।
অনবরত কল বেজে চলেছে। ছেলেটা ফোন কানে তুলছে না। রওশান ভাবলো সে বোধহয় কল টা অসময়ে করেছে। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে ছেলেটা। এর আগে দু’বার রিং বেজে বেজে কেটে গেছে ।এবার রওশান নিজেই কল কেটে দেয়ার কথা ভাবলো। তখনই ওপাশ থেকে একটা ক্লান্ত বিষন্ন গলার স্বর ভেসে এলো,’আসসালামু আলাইকুম। কি অবস্থা ভাইয়া?’
আমুদে ভাব চলে এলো রওশানের কথায়। এই ছেলেটার সঙ্গে কথা বললে হাসি আপনাতে ওর ঠোঁটে চলে আসে।
‘তোমার সহচার্য যার নিত্য অভ্যাস, তার সাথে মানুষ যেমন অবস্থায় থাকতে পারে আমিও তেমন অবস্থায়-ই আছি। হাটছি, ফিরছি, খাচ্ছি, ঘুরছি। আর মুখ দিয়ে তার’ অপছন্দনীয় কথা কিছু বের হওয়া মাত্রই পিঠে আঘাত অনুভব করছি। এইতো! ‘
কথা শেষ হওয়া মাত্র তিহা হেসে ওর পিঠে আবারো মৃদু আঘাত করল। রওশান সাথে সাথে ওপাশের মানুষটাকে উদ্দেশ্য করে বললো , ‘এইতো! মাত্রই আমার কথা আবারো সত্য প্রমাণিত হলো। কিযে এক ঝামেলা তোমরা চাপিয়েছ আমার ওপর শালাবাবু… তপমার বোনের মার খেতে খেতে চিড়েচেপ্টা হয়ে যাচ্ছি…’
নিনাদ আর মুখ গোমড়া করে থাকতে পারলো না। ওপাশ থেকে হাসির শব্দ ভেসে এলো। নিশ্বাস ফেললো রওশান।
‘যাক! অবশেষে মেঘ কাটলো। এই ভাগ্যবান শ্রবণেন্দ্রিয় জোড়া শালাবাবুর সুমধুর হাসির শব্দ শুনতে পেল!’
নিনাদ ফের হাসলো। ‘আর লজ্জা দিয়েন না ভাইয়া। ঢাকায় এলেন কখন? কবে দেখা করছেন তাই বলুন।’
‘আমার আসার আবার সময়-অসময়! যখন ইচ্ছে করছে তখনই হুট করে চলে আসছি। এখন আর আগের মতো পাহাড় দেখলেই কবিতা আসে না। ওখানে থেকে কি করি বলো!
আচ্ছা ছাড়ো এসব। আমার কথা বাদ দাও।তোমার আলাপ বলো। আমার রেজিস্ট্রি করা সত্যিকারের ছোট গিন্নির সাথে নাকি কিসব গন্ডগোল বাঁধিয়েছ? একেবারে নাকি ফিল্মি ব্যাপার স্যাপার? ‘
নিনাদের কাটা ঘাঁয়ে নুনের ছিটা পড়ার মতো অবস্থা হলো। সে লজ্জিত হয়ে চুপ করে রইল।
ব্যাপার টা বুঝতে পেরে ফোনের এপাশে রওশান ফিচেল হাসে। তিহাও যোগ দেয় সে হাসিতে।ছোটন একমনে আকাশের তারা গুনছিল। গোনা বাদ দিয়ে অবাক হয়ে তাকাল বাবা মায়ের মুখের দিকে।
বন্ধুকে নিয়ে মজা নিলেও তিহার মনের একটা পাশ ঠিক ওর জন্য কাতর হচ্ছিল। রওশানের হাত থেকে ফোন নিয়ে প্রথমেই নিনাদকে বিশাল আকারের একটা ঝারি দিল আজকাল তার দেখা পাওয়া এমন অসম্ভব হয়ে উঠেছে কেন তা জানতে চেয়ে। তারপর তুললো ট্যুরের কথা। বললো এবার শীতে ওরা বান্দরবানে ট্যুর দেবে।রওশান তো সেখানে আছেই। ও ই তাদের সবাইকে ঘুরে ঘুরে দেখাবে সব। এবার যাওয়াটা ফাইনাল করে ফেলতে হবে। কে কে যাচ্ছে, কতদিনের জন্য যাচ্ছে….
নিনাদকে এবিষয়ে খুব একটা আগ্রহী দেখালো না। নিরবে সায় দিয়ে মাত্রাতিরিক্ত গাম্ভীর্যের সাথে হু হা করে যেতে লাগলো। ওর অবস্থান্তরে তিহা অবাক। নিনাদ যাই করুক যত ঝড়ই বয়ে যাক এর ওপর। বরাবর হাসিখুশি ছেলে ও। এতটা নির্লিপ্ত তো কখনো থাকে না।
‘কিরে, হু বললি যে শুধু?’
নিনাদের শীতল প্রতুত্তর,’ আর কি বলবো? তোরা প্ল্যান করতে থাক।’
‘প্রতিবছর তো তুই-ই সবকিছু প্ল্যান প্রোগ্রাম করিস। বরং আমরাই থাকি চুপচাপ। এবার উল্টো নিয়ম যে? কি এমন হলো হঠাৎ?’
‘কি হবে? কিছু না। তোরা প্ল্যান চালিয়ে যা।’
কিসের যেন একটা সামান্য আভাস পেল তিহা। স্বরে সন্দিগ্ধতা এনে বলল,’সত্যি করে বলতো নিনাদ কি হয়েছে তোর? কথা এমন ভাবে বলছিস যেন এবার আমাদের ট্যুর আসার আগেই তুই দেশ ছেড়ে পগারপার হবি!’
নিনাদ স্থির কণ্ঠে বলল,’হতেও পারে। ‘
‘ফাজলামো ছাড়। আসল কথাটা বল। অনেকক্ষণ ধরেই মনে হচ্ছে খুব বড় কিছু একটা তুই আমাদের থেকে লুকোচ্ছিস।’
নিনাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলো তিহা জানে না নিজের অজান্তেই কখন সে নিনাদের না বলা কথাটা বলে ফেলেছে।
রাত বারছে। সেই সাথে ধীরে ধীরে বারছে রাতের বাতাসের শীতল ভাব। শ্রাবণের অনাকাঙ্ক্ষিত স্বচ্ছ রাতের আকাশে ছোট বড় অসংখ্য তারা জ্বলজ্বল করছে।পশ্চিম আকাশ থেকে ভেসে আসা সাদা মেঘের আড়ালে মাঝে মাঝে ঢাকা পড়ছে তারাগুলো। কি আশ্চর্য সুন্দর এই মধ্যরাতের আকাশ, পৃথিবী ! শুধুমাত্র এই সৌন্দর্য দেখার জন্য কি কেউ কখনো জাগতে পারে? রাতের পর রাত? যে পারে সে নিশ্চয়ই প্রেমিক! প্রেমিক ছাড়া আর কার চোখই বা এই রাতের কাব্য বোঝে!
তিহা আর রওশান দুজনেই এবার বুঝলো কিছু একটা গন্ডগোল নিশ্চয়ই আছে নিনাদের সাথে। আজ তার কথাগুলো কেমন যেন খাপছাড়া। বড় এলোমেলো। স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলে নিনাদকে ধরলো। যে করেই হোক নিনাদের গোপন কথাটা আজ তারা জেনে তবে ছাড়বে। তিহা তো ফোনেই প্রায় নিনাদের গলা চে পে ধরতে চাইল! নিনাদ ভয় পেল, হার মানলো। বুঝলো এরা নাছোড়বান্দা। না বললে আর এই যন্ত্রণার মুক্তি নেই। ফলাফল, সে রাতে নিনাদ তাদের দুজন কে একটা বিস্ফোরক তথ্য জানাতে বাধ্য হল!
চলবে………