দূর আলাপন পর্ব-০২

0
486

দূর আলাপন ~ ২

____________________________
রাতে এশার সলাতের পর তিতিক্ষা বারান্দায় হাটছিল। যদিও শ্রাবণ মাস। আকাশে তবু মেঘের দেখা নেই। রুক্ষ রাতের আবহ থমকে আছে জানালার বাইরে। চারিদিকে গুমোট একপশলা বাতাস। তাপদাহে ঘরে টেকা দায়।এদিকটা তবু কিছু ঠান্ডা। তিতিক্ষা গ্রীল ধরে দাঁড়ায়। বাইরে তখন শ্রাবণের অন্ধকার রাতের আকাশে, ভীষণ কালো মেঘেদের আনাগোনার বদলে অসংখ্য তারা জ্বলজ্বল করছে। বাড়ির পাশেই একটি বড় কামিনী গাছ । বহু বছর ধরে গাছটি এবাড়িতে রাজত্ব করছে। তার সরু সরু ডালপালা আর গাঢ় সবুজ পাতা দিয়ে সে ঘিরে রেখেছে বাড়ির সামনের চারপাশ। গাছের ফুলের মাদকতাময় গন্ধে ছেঁয়ে গেছে সারা বাড়ি। থেমে থেমে বাতাস ভেসে আসে। শরীর হিম করে দেয়া শীতল বাতাস নয়। আদ্র বাতাসে কামিনী ফুলের গন্ধ আরও জোড়ালো হয়ে নাকে এসে লাগে।

তিহা পেছনে এসে দাঁড়ালো। মুখ ফিরিয়ে তাকে এক ঝলক দেখে নিয়ে তিতিক্ষা হাসে। তিহা যেন বোঝে পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে আছে। রাগী বোনের সাথে কথা বলাই যায়।
‘এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছিস, ওদিকে ছোটন তোকে খুঁজে হয়রান। ‘

‘একটু আগেই তো দেখলাম বাবার সাথে খেলছে।তাই আর ডাকি নি।’

তিহা বোনের আরেকটু কাছে এসে দাঁড়ালো।’ আজ পাপড়ি ফোন দিয়েছিল। জানিস কি বলল… ‘

‘তুমি বললেই জানবো! তার আগে বলো এশার সলাত শেষ করেছো?’

‘করেছি তো! তুই কি ভাবিস। তুই একাই আল্লাহর ইবাদত করিস শুধু? ‘

তিতিক্ষা হাসলো,’একদমই ভাবি না। আমার ধারণা তো আমি আল্লাহর অতিশয় নিকৃষ্ট এক বান্দা। আচ্ছা যাক সে কথা, পাপড়ি আপু কি বললো ?’

পাপড়ি কথা উঠতেই পুনরায় তিহার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে,’ওর বিয়ের কথা চলছে বলেছিলাম না? বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।’

‘বলেছিলে নাকি ? কই মনে পড়ছে না তো!’

‘ফাজলামি করবি না একদম। তোকে বলেছিলাম আমি। মনে আছে আমার। ‘

‘কিন্তু আমার মনে নেই যে!’

‘সত্যি মনে নেই? এত ভুলো মনা কেন তুই? এখন কাজের কথা শোন, পাপড়ির বিয়ে পরের শুক্রবার। কাল আমরা শপিংয়ে যাবো।’

‘আচ্ছা যেও… থামো থামো… আমরা কারা বুবু?’

‘ওমা! কারা আবার! তুই আমি আর নিমিরা বোধহয় যাবে দু একজন.. ‘

‘আমি গিয়ে কি করবো?’

‘বিয়েতে যাবি। শপিং করবি না?’

‘আমি বিয়েতে যাচ্ছি কেন বলল?’

‘ওমা! তুই যাবি না? পাপড়ি আমাকে ফোনে বিশেষ করে তোর কথা এতবার বলে দিল। আর তুই বলছিস যাবি না!’ তিহার বিস্ময় মাখা চাহনি স্থির হয়ে রইল তিতিক্ষার মুখের ওপর।

বুবুর উদ্বেল হাবভাবের সামনে কিছুটা সংকুচিত বোধ করে তিতিক্ষা। সেই পুরনো কথা বুবুকে আবার বোঝাও…. বিয়েতে যেতে ভালো লাগে না।
‘তুমি তো জানো বুবু। মানুষের ভীড় ভালো লাগে না আমার। বন্ধুর বিয়ে, তোমরা সবাই একসাথে যাও।’

‘তুই সত্যি যাবি না?’

তিতিক্ষা নিরুপায় হয়ে মাথা নাড়ল। সে যাবে না। তিহা তার বোন কে চেনে। জানে এই মেয়ে যখন না বলেছে, শেষে সত্যি যাওয়া নিয়ে টালবাহানা শুরু করবে। মুহূর্তকাল কড়া দৃষ্টিতে বোনকে পরোখ করে সোজা বাবার কাছে চলে গেল।
কিঞ্চিৎ সময় পর বাবা মেয়ে একসাথে এসে তিতিক্ষাকে ঘিরে দাঁড়াল। মারুফ বরাববের ন্যায় গম্ভীর মুখে বললেন, ‘কি ব্যাপার তিতি। তুমি নাকি বিয়েতে যাবে না বলেছো? মেয়েটা নিজে আমাকে বলেছে বিয়ের দুদিন আগে যেন ওর বাসায় তোমাদের পাঠিয়ে দিই। সে নাহয় এড়ানো যাবে। তা বলে বিয়েতে যাবে না? কেন মা? কোনো সমস্যা?’

বাবার সামনে তিতিক্ষা সবসময় সুবোধ বালিকা। ব্যস্ত হয়ে মাথা নাড়ল,’তেমন কিছু নয় বাবা। এমনিই… ভালো লাগছিল না..’

মারুফ নিশ্বাস ফেললেন,’তিতি, তুমি তো ছোট নও মা। বড় হয়ে গেলে এমন অনেক কিছু আমাদের করতে হয় যা আমাদের ভালো লাগে না। তুমি যত বড় হবে পরিস্থিতির সঙ্গে তোমাকে মানিয়ে নেয়া শিখতে হবে। মাঝেমাঝে নিজের পছন্দের চেয়ে অন্যের চাওয়াটাকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বিয়ে বাড়ির কোলাহল তোমার পছন্দ না সে আমি জানি ।কিন্তু সে আবেগটুকু কি একজনের স্নেহের আবদারের থেকেও বেশি? ভালোবাসা এভাবে তুচ্ছ কারনে পায়ে ঠেলতে নেই মা। নাহয় সে ভালোবাসা একসময় পিছু ছেড়ে দেয়। হাতড়ে বেরালেও তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
তবু আমি জোর করছি না। তুমি যেতে না চাইলে যেও না। এখন খেতে চলো। আমার নানুভাই টেবিলে একা অপেক্ষা করছে।’

বাবা চলে গেলেন। পিছু পিছু বেরিয়ে গেল বুবু।জানালার গ্রিল ধরে একা দাঁড়িয়ে রইল তিতিক্ষা।ওর চোখে খানিকটা জ্বালা করছে। তুচ্ছ একটা কারনে বাবা তার ওপর রুষ্ট হয়েছেন। তিতিক্ষা জানে। বাবার রাগী মুর্তিটাও এমনি শান্ত, কোমল। অথচ এত এত উপদেশ না দিয়ে বাবা নিজে শুধু একবার বললে সে এমনিতেই চলে যেত। সবসময় বাবার বাধ্য মেয়ে হয়েই তো তিতিক্ষা। বাবা কি তা বোঝেন না ?

শত শত তারার আড়ালে কাস্তের মতো চিকন যে চাঁদটা লুকিয়ে ছিল তিতিক্ষা এবার তার দিকে চোখ তুলে তাকায়। আজ যে চাঁদটা চোখে দেখা না যাওয়ার মতোই সামান্য, দিন কয়েক পর সে চাঁদ টাই তার রূপোরঙা আলো দিয়ে পৃথিবীর রাতের আকাশকে সর্গীয় আভায় ভরে তুলবে। কি আশ্চর্য সুন্দর এইসব রহস্যে ঘেরা অলীক একেকটা রাত!

.

পরদিন সকালে ওরা শপিং এ বেরোল। তিহা তিতিক্ষা আর ছোটন। রিকশায় বসে ঢাকার বিখ্যাত জ্যামে আটকা পড়ে তিহা একসময় জানাল পাপড়ির বিয়েতে তারা সব বন্ধুরা এক রঙের পোশাক পড়ছে।
তিহার এই সহজ কথার পেছনে অন্য ইঙ্গিতটা তিতিক্ষা বুঝল সঙ্গে সঙ্গে। বোনের দিকে ঘুরে বসে ভুরু কুচকে বলল, ‘তোমার বন্ধুরা কি আসছে?’

সাজগোজের বিষয়ে বরাবরই তিহার দূর্বলতা। একরঙের পোশাক কিনবে যখন ওদেরকেও তো আসতেই হবে। বন্ধুদের কথা শুনলে মুখচোরা তিতিক্ষা হয়তো আসতোই না। তার কিছু কেনাও হতো না। তারপর হয়তো এ অজুহাতেই বিয়েতে যাওয়া ক্যান্সেল করে দিতো। এসব ভেবেই ও আগেভাগে খোলাসা করে কিছু বলেনি বোনকে। এখন আমতা আমতা করল।
‘বোধহয় আসবে দু’একজন।’

তিতিক্ষা রাগতে গিয়েও সামলে নেয়,’নিমি আপুরাই তো? কোনো ছেলে বন্ধুকে খবর দাওনি তো বুবু?

তিহা মুখ বাঁকায়,’ছেলে বন্ধু আমার আর কই? নিমিরাই তো আসবে।

তিতিক্ষা নিশ্বাস ফেলে। বুবুর কথায় কিছু গোলমালের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এই সবে শুরু… এজন্য এসব অনুষ্ঠান এড়াতে চায় সে….

.

তিহা তিতিক্ষা নিউমার্কেটের এক দোকানে বসে শাড়ি দেখেছে। নিমি কল করে জানিয়েছে ওরা পথেই আছে। তিহা আড়চোখে একবার বোনের মুখ দেখে নিমিকে জিগ্যেস করে তার সাথে আর কে কে আছে। নিমি ওপাশ থেকে কি বলল বোঝা গেল না। তিহা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ফোন রেখে হাসি মুখে বলে,’শুধু নিমি আর নিনাদ। বাকিদের সাথে কথা বলা হয়ে গেছে। আমরা যা পছন্দ করবো ওরা তাই পরবে। দেখেছিস, আমি আগেই বলেছিলাম আমার ছেলে বন্ধু একেবারে নেই… শুধু নিনাদ…. আর দু চারটা…’

তিতিক্ষা কিছু না বলে সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফেরাল। রাগে রি রি করছে সে। বোনের অগ্নিমূর্তির দিকে নজর করতে করতে দেখা গেল দূর থেকে নিনাদ আর নিমি হেঁটে আসছে। চওড়া হাসি ফুটল তিহার মুখে আর পাশে দাঁড়িয়ে বিব্রত ভাবে মাথা নোয়াল তিতিক্ষা। ছোটনের হাত ধরে বোনের পেছনে এসে দাঁড়াল। নিনাদকে কাছে আসতে দেখে ছোটন তিতিক্ষার হাত ছেড়ে ততক্ষণে ভোঁ দৌড় দিয়েছে। ছোটনকে পেয়ে নিনাদ তাকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল ।

.

নিমির সঙ্গে কথা বলছিল তিহা। তিহার পেছনে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ স্বরে তিতিক্ষা নিমির সাথে কুশল বিনিময় করলো।
অদূরে ছোটনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে নিনাদ হাসল মনে মনে। হঠাৎ মাথায় একটা দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল। তিতিক্ষার দিকে ইশারা করে বেশ গম্ভীর ভঙ্গিতে তিহাকে বলল,’তোর পেছনে কালো ভূতের মতো ওটা কে রে? ভূতের মতো দেখাচ্ছে। দিনেদুপুরে মানুষের হার্ট অ্যাটাক করাবি নাকি?’

তিহার ভ্রুতে পড়ে বিশাল কুঞ্চন। আর তিতিক্ষা রাগে মুখটাই ঘুরিয়ে ফেলে, ‘এখানে এসেও তোর বাদরামি! আমার বোন অনেক দামি, তাই প্যাকেট করে নিয়ে এসেছি।
ও কি তোর ইয়েদের মতো যে টপ আর শর্টস পরে নাচতে নাচতে শহর ঘুরে বেড়াবে?’

নিনাদের কথাশুনে তিতিক্ষার রাগ হচ্ছিল।এবার তিহার কথা শুনে তার কান্না পেয়ে গেল। বুবুটা এসব কি বলছে! টপ শর্টসের কথাটা কি না বলতে হতো না? এভাবে সবার মাঝখানে মান ইজ্জত ডোবানো টা কি খুব জরুরি ছিল?’

ইয়েদের কথা ওঠা মাত্র নিনাদও চুপসে গেল।এ বিষয়ে কথা বাড়তে না দেয়াই ভালো। বলা যায় না কখন তিহা মুখ কখন বাকিটাও বলে বসে। কিছু ঘনিষ্ঠ মেয়েবন্ধু নিনাদের আছে সত্যি। তা সিরিয়াস কিছু নয়। কিন্তু তিতিক্ষা এসব বোঝার মেয়ে! শুনলেই যে ছিছিক্কার জুড়ে দেবে!

নানান বিষয় নিয়ে তিহা, নিনাদের মধ্যে তর্ক চলতে থাকল। নিনাদ যা-ই বলে তাতেই তিহা তার পিঠে একটা করে কিল বসিয়ে দেয়। তিহা, নিমি চলে গেল একদলে।শপিংমলে নিনাদকে মাঝে রেখে দুটি সুন্দরী রমণী দু’দিক থেকে ঘিরে হাটছে। মাঝে মাঝে একটা দুটো কিল পড়ছে তার পিঠে। পেছন থেকে এই দৃশ্য দেখে তিতিক্ষা হা হয়ে রইল।এদের মারামারি দেখে মনে হচ্ছে এরা এখনো স্কুলের গন্ডি পেরোয় নি। মনে মনে চুড়ান্ত বিরক্ত বোধ করল তিতিক্ষা। এরকম শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের পথেঘাটে এ কি আচরণ! আশ্চর্য!

মারামারির মাঝেই নানান কথা বলতে বলতে পোশাকের কথাটা ওঠা মাত্র নিমি জানালো বিয়েতে তারা সবাই আকাশী রঙা পোশাক পরবে।ছেলেরা আকাশী পাঞ্জাবি, মেয়েরা আকাশী শাড়ি। কাল রাতে আলাপ আলোচনা পর এটাই ফাইনাল হয়েছে।তারপর দুপুর পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে ওরা সবকিছু কিনলো। তিতিক্ষা শুরু থেকে শেষ অবধি চুপ রইল। মাঝে মাঝে তিহাকে খোঁচা দিয়ে বাড়ি ফেরার তাড়া দিল শুধু ।শপিং শেষে বাইরে বেরিয়েই নিনাদ বলল, ‘ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে রে।তোদের কিল খেতে খেতে পেটের খাবার সব হজম হয়ে গেছে আমার।এখানেই চল কোথাও বসে খেয়ে নিই।’

সঙ্গে সঙ্গে তিহা উৎসুক গলায় বলে ওঠে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ সামনের ওই রেস্তোরাটায় বসি চল।’

তিতিক্ষা পেছন থেকে তিহার পিঠে মৃদু চিমটি কাটে। ‘উউউ’ চেচিয়ে পেছন ফেরে তিহা। বোনের মুখপানে তাকায় সপ্রশ্ন চোখে।
তিতিক্ষা ক্রুদ্ধ ফিসফিসানো স্বরে বলল , ‘ এইবার কিন্তু বারাবাড়ি হচ্ছে বুবু। যোহরের সলাতের ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাচ্ছে। তোমার কথায় অনেক থেকেছি। এবার আমি বাড়ি ফিরবো। ওদের সাথে রেস্তোরায় যাওয়ার হলে একাই যাও। আমি ফিরছি…’

বোনের হুমকিতে দমে গেল তিহা। ওর ম্লান মুখে চেয়ে নিনাদ ভ্রু কোঁচকায়, ‘কি কানপড়া দিচ্ছিলো ও তোকে? খেতে যাওয়ার ব্যাপার নিয়ে। না? ‘

মাথা নাড়ল তিহা,’তোরা যা রে। আজ আমি আর যাব না। নামাযের ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাচ্ছে।বাড়ি ফিরে নামায পড়তে না পারলে ছোটনের মিমি আমাকে চিবিবে খেয়ে ফেলবে।তাই না ছোটন ?’
ছোটন হাসি হাসি মুখ করে মাথা নাড়লো। বললো, ‘হ্যাঁ নামায পড়তে না পারলে খুব রেগে যায় মিমি। কান্নাও করে।’

বাকিটুকু আর বলা হলো না ছোটনের। তিতিক্ষা ওর মুখ চে পে ধরেছে। খানিকটা ক্রুর চোখে তাকাচ্ছে ভাগ্নের পানে। এই ছেলে পুরো মায়ের মতো। ক বলতে বলা হলে কলকাতা পর্যন্ত বলে ফেলে।
‘আর কিছু বলতে হবে না ছোটন। আমরা বুঝতে পেরেছি।’ বাঁকা সুরে বলল নিনাদ। নিমি তার পাশে দাঁড়িয়ে হাসতে লাগলো মুখ টিপে।

.

শুক্রবার তিহার বান্ধুবির বিয়ের দিন একটা দারুন ব্যাপার ঘটে গেল! বরাবরই তিহা বন্ধু পাগল আর ভীষণ ছটফটে। সেকথা তিতিক্ষার অজানা নয়।তাই সে বিয়ে বাড়ি যাবার আগে বারবার করে বোনকে বলে রাখল। যেন বিয়ে বাড়িতে বন্ধুদের পেয়ে তাকে একা ছেড়ে না দেয়। এবং সবিশেষ! তাকে নিয়ে তার বন্ধুমহলে যেন কোন কথা না ওঠে। তিহা ওকে আশ্বাস দিল। অনুক্ষণ তার পাশে পাশেই থাকবে এবং এবিষয়ে কথার কোনো নড়চড় করবে না।

বিয়ে বাড়ি এসে তিতিক্ষা আড়ষ্ট হয়ে তিহার পেছন পেছন হাটতে লাগলো। তার পড়নে বোরকা। বোনের পাশে আজ সে বড্ড বেমানান! তিহা যেন রৌদ্র দিনের উজ্জ্বল সাদা-নীল আকাশের সমস্ত সৌন্দর্য নিজের গায়ে নামিয়ে নিয়ে এসেছে! পরনে আকাশী রঙা জামদানী, সাদা ব্লাউজ, হাতে এক-গাছি সাদা রেশমি চুড়ি, খোপায় বেলীফুলের গাঁজড়া আর গলায় একটা ভারি চিক। কাছেপিঠে যারাই আসছে ওর সাজের আমূল প্রশংসা করছে। আত্মগৌরবে সহাস্যে সামনে পা বাড়াল তিহা। তিতিক্ষা অস্বস্তিতে আরো গুটিয়ে গেল। ওপর বড় নিকাব,হাত-পা মোজায় ঢাকা।সে অস্বস্তিতে আরো গুটিয়ে গেল। হঠাৎ এই দৃশ্য দেখলে যে কেউ বিচলিত হয়ে পরবে সন্দেহ নেই। তবে অদূরে দাঁড়ানো তিহার বিশাল বন্ধুর দল একটুও হলো না।তারা এক উদর থেকে জন্ম নেয়া, পৃথিবীর দুই মেরু সমান পার্থক্য বিশিষ্ট এই বোনদের চেনে।
তিহা দূর থেকে হাত নাড়ল বন্ধুর দল কে দেখে। উত্তেজনা দমাতে না পেরে শপথ ভঙ্গ করেই ছোট বোন কে একা ফেলে ছুটে গেল সেদিকে। বিয়ে বাড়ির বিশাল জনকলরোলের মধ্যেখানি জাঁকানো বিড়ম্বনা নিয়ে ভাগ্নের হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইল তিতিক্ষা। আশেপাশের অনেক গুলো চোখ অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওকে দেখছে। নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করছে। বোধহয় ওর বেশভূষা নিয়েই… তিতিক্ষা বুঝল আজ দিনের মধ্যে আরও অসংখ্যবার তাকে এই অপমানের ভাগ নিতে হবে। ছোটনের কাছেও মায়ের এই ছেলেমানুষী , বেখেয়ালী স্বভাব অপরিচিত নয়, এসব দেখে সে অভস্ত্য। সে তার মিমির হাত ধরে সুবোধ বালক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

পুরো সময় বন্ধুদের পাশে থাকলেও খাওয়ার বেলায় তিহাকে তিতিক্ষার কাছে ফিরতে হলো। তিতিক্ষা তার বন্ধুদের সঙ্গে একসাথে বসে খাবে না একথা সে আগেই জানিয়েছিল।তিহা তাই বোনকে নিয়ে একদম কোণার দিকে কোলাহল থেকে আড়ালে খেতে বসলো। তিতিক্ষার পর্দা রক্ষার জন্য এই ব্যবস্থা। খাওয়া শেষ হতেই কোথা থেকে এক মেয়ে এসে হাজির। তিহা তাকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে কথা শুরু করলো। তিতিক্ষা তিহার সব বন্ধুদের চিনতো কিন্তু এই আগন্তুক কে বুঝতে না পেরে চুপচাপ বসে রইল। তিহার সাথে কথা শেষ করে মেয়েটি এবার তার দিকে ফিরলো। তিহাকে ইশারায় জিগ্যেস করে জানল এ তিহারই ছোট বোন। তারপর তিতিক্ষার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলা সহসা তার ফোন নাম্বার চেয়ে বসলো। তিতিক্ষা অস্বস্তি নিয়ে মেয়েটির পেছনে দাঁড়ানো তার বোনের দিকে তাকালো।দেখলো তিহা তাকে ইশারায় বারবার নিষেধ করছে নাম্বার দেয়ার জন্য।ওদিকে মেয়েটি তখনো ফোন নাম্বার দেয়ার জন্য তাড়া দিয়ে যাচ্ছে।তিতিক্ষা একপ্রকার বাধ্য হয়েই তাকে ফোন নাম্বার দিয়ে হাত ধোয়ার কথা বলে সেখান থেকে উঠে চলে গেলো।এই পুরো ব্যাপারটা একজন দূর থেকে প্রত্যক্ষ করছিল।তিতিক্ষা কে যেতে দেখে এবং তারপর ওই মেয়েটিকেও জায়গা ছাড়তে দেখে সে এবার সতেজে তিহার সামনে এসে দাঁড়ালো।
চলবে……
অদ্রিজা আশয়ারী

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে