#দূর_আলাপন -১
অদ্রিজা আশয়ারী
বুবু শেষ বারের মতো বলছি তোমার বন্ধুকে বলে দাও আর যেন কখনো আমাকে ছোট গিন্নি বলে না ডাকে।’ তীক্ষ্ণ মেজাজি স্বরে বলে ওঠে তিতিক্ষা।
তিহা কাঁথা সেলাই করছিলো। বোনের কথা শুনে কাঁথা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বিস্মিত হয়ে বলে, ‘নিনাদ এসেছে? কখন এলো? ও যে আজ আসবে আমাকে তো জানায় নি। আর এসেই তোর পেছনে লাগতে শুরু করেছে! দাঁড়া দেখছি আমি।’ উত্তরের অপেক্ষা না করে ত্বরিতে সে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
তিতিক্ষা ভয়ানক রেগে চোখ মুখ কঠিন করে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে খানিকক্ষণ। বোঝে বুবুর কাছে বিচার দেয়াটা তার বোকামি হয়েছে। তিহা নামক এই দয়ালু বিচারক যে নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে চোখ বুজে অবশেষে সেই নির্লজ্জ অপরাধীর পক্ষ হয়েই রায় দেবে সে কে না জানতো!
তিহা ব্যাস্ত পায়ে হেঁটে বসার ঘরে গেল। সেখানে বড় জানালাটর পাশে বেতের সোফায় একজন যুবা বসে। পড়নে কফি রঙের ফুলহাতা শার্ট, কালো জিন্সের প্যান্ট, মুখভরা অযত্নের দাড়ি। চুল এলোমেলো ভাবে একপাশে আচঁড়ানো। শার্টের হাতা খানিকটা ফোল্ড করা। শ্যাম বর্ণ গায়ে সুন্দর মানিয়েছে শার্টটা। সে তার ঘন পাপড়ি বেষ্টিত ধূসর চোখ সম্মুখে স্থাপন করে একমনে পত্রিকা পড়ছে। চোখে চশমা নেই। বোধহয় পড়তে ভুলে গেছে। ফলে পত্রিকার ছোট ছোট অক্ষর দেখতে গিয়ে চোখ দুটো কিছুটা সংকুচিত হয়ে এসেছে। তিহা আনমনে হাসল। সেই শুরুতে যেমন ছিল আজও ঠিক তেমনই আছে। একদম খামখেয়ালি।
ছেলেটি তখনই মুখ তুলল। সামনে তিহাকে দেখতে পেয়ে মুহূর্তে তার দেহে প্রাণ ফিরে এলো। তৎক্ষনাৎ পত্রিকা বন্ধ করে বলল, ‘এলি তুই? উফফ বাঁচালি আমায়! আমি তো ভেবেছিলাম তোর বোন বুঝি দা-বটি কিছু একটা আনতে গেছে। এসেই আমাকে কো’পাবে। যা অগ্নিমূর্তি রূপ দেখিয়ে গেল…’
তিহা বেশ শব্দ করেই বসল তার পাশে। মাথায় একটা গাট্টা মে রে বলল, ‘তুই ওকে খেপাতে গেলি কেন? জানিস না ও কেমন কাঠখোট্টা। ঠাট্টা বোঝে না একদম। বাবাকে যেদিন বলে দেবে সেদিন বুঝবি। ‘
নিনাদ একপেশে হাসে ‘ছোট গিন্নির ক্ষমতা যে কদ্দুর সে তো আমার জানা। নাগিনীদের মতো ফোঁস ফোঁস করা ছাড়া ও আর কিইবা করতে পারে? ‘
তিহা মুখ টিপে হাসলেও সঙ্গে সঙ্গে ফিসফিস করে বলে, ‘আস্তে বল। শুনতে পেলে কিন্তু আর রক্ষে নেই। নাগিনীর ছোবল খেতে হবে।’
ওর কথা শেষ হতেই রান্নাঘর থেকে জিনিসপত্রের ধুপ ধাপ শব্দ ভেসে আসে। মনে হয় কেউ খুব রেগে এটা সেটা রাখছে।
তিহার চুপসে যাওয়া কণ্ঠে ফের ফিসফিস, ‘সর্বনাশ! আজ আর রক্ষা নেই। তিতিক্ষা বোধহয় শুনতে পেয়েছে সব!’
নিনাদের মুখের হাসি নিভে গেল তৎক্ষনাৎ। চিন্তিত স্বরে বলল, ‘কি বলিস! আমি কি তাহলে ভাগবো?’ ওর কণ্ঠে ব্যাস্ত ভাব। হাটুর বয়সি মেয়েটিকে মনে মনে সে সত্যি খানিক ভয় পায়।
তিহা বিরক্ত কণ্ঠে বলল, ‘আরে ধুর। ভাগবি কেন? বোস তুই। ও তো তোর সামনেই আসতে চায় না। কিছু করবে আর কি?
রাগ যা দেখাবার আমাকেই দেখাবে পরে। দাঁড়া আমি দেখে আসি একবার।’
তিহা ধীর পায়ে রান্নাঘরে এসে দাঁড়ায়। পেছন ফিরে তাকে একবার দেখে নিয়ে তিতিক্ষা নামের রাগী মেয়েটা গম্ভীর মুখে বলে, ‘এগুলো নিয়ে যাও বুবু। চা বসিয়েছি। পাঁচ মিনিট পর এসে নিয়ে যেও।’
তিহা আড়চোখে বোনের দিকে তাকাল। তিতিক্ষা রাগ ঢেকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। মুখের অভিব্যক্তিতে তা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। অথচ এতো রাগের কারণ যে মানুষ, তার জন্য এতো যত্ন করে নাস্তা সাজিয়েছে।
তিহা নাস্তা নিয়ে বেতের সোফার সামনে ছোট টি-টেবিলে রাখল। নিনাদ তাকাল দরজার দিকে। কেউ আসছে না দেখে টেবিলে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হেসে বলল, ‘স্বভাব হোক যেমন তেমন। তোর বোনের মনটা বড় আছে রে। মুখ দেখে মনে হয় ফুজিয়ামা আগ্নেয়গিরি। লাভা টগবগ করে ফুটছে। কিন্তু খেতে দিতে কার্পণ্য করে না কখনো। আসতে না আসতেই নাস্তা হাজির।’
তিহা তার কথা শুনে হেসে এইবার পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিল।
‘আর তুই হলি বেশরম। তুই এলে আমার বোনটা তোকে নাস্তা দেয়ার জন্য কত ব্যাস্ত হয়ে পড়ে সবসময়। অথচ সুযোগ পেলেই তুই ওকে জ্বালাস শুধু।’
নিনাদ স্পেগেটি মুখে পুরে চিবাতে চিবাতে বলে, ‘ওকে জ্বালাতন করতে হয় নাকি? ও তো এমনিতেই একটা জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। সময়ে-অসময়ে লাভা বিস্ফোরণ হচ্ছে।
আচ্ছা, একটা কথা বল?
তোর বোন আমাকে ভালো টালো বাসে না তো?
দেখ, এমনিতে এতো রাগ দেখায়। সামনে পড়লে ঘোমটা টানতে টানতে হাটু পর্যন্ত ঢেকে ফেলে আবার ঠিকি এতো এতো নাস্তা তোর হাত দিয়ে পাঠায়। সত্যি করে বল আমার ধারণা ঠিক কিনা?’
তিহা কিছুক্ষণ বিস্মিত হয়ে নিজের বাল্যবন্ধুর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর হো হো করে হেসে উঠে বলে,’ফাজিল! তুই অসভ্য জানতাম। কিন্তু এতটা জানা ছিলো না। সবাইকে তোর মতো ভাবিস? তিতিক্ষা কে তোর ভার্সিটির ওইসব সুন্দরী ললনা মনে হয়? যে ব্রাউন আইস, সিক্স প্যাক আর রেজাল্ট দেখে প্রেমে পড়ে যাবে?
তিতিক্ষা এসব শুনলে বরং এখানে এসে মজার মজার নাস্তা খাওয়া তোমার চিরজীবনের ঘুচবে মনে রেখো।’ বলে সে উঠে ফের রান্নাঘরে চলে যায়। ফিরে আসে হাতে দু’কাপ চা নিয়ে।
নিনাদ চা’এর কাপ টেনে নিয়ে বলে, ‘তুই যাই বলিস ওটা আমি ছাড়ছি না। ছোট গিন্নির হাতে বানানো খাবার খেয়ে আলাদা একটা তৃপ্তি আছে। নইলে কি আর সেই মুহাম্মদপুর থেকে এই ঝিগাতলা এভাবে বেহায়ার মতো দুদিন পর পর ছুটে আসি!’
-‘চাপার জোর আর দেখিও না। মুহাম্মদপুর থেকে যে তুমি কোন মৌচাকের মধু খেতে আসো সেকথা সবার জানা। ‘
নিনাদ গলার স্বর খাদে নামিয়ে ভীত স্বরে বলল, ‘ছোট গিন্নি জানে না তো?’
-‘না।’
-‘তাহলেই চলবে। আচ্ছা ওসব কথা ছাড়। প্রেম পিরিতির আলাপ আজকাল আর ভালো লাগে না একদম ।
ছোট গিন্নির কথা বল। বেচারি বোধহয় আমাকে গোপনে খুব ভালোবাসে বুঝলি। মুখ ফুটে বলতে পারছে না। তাই আজ স্পেগেটি, কাল বিরিয়ানি এসব খাইয়ে আমাকে বসে আনতে চাইছে। তাই না?’
তিহা বিরস মুখে বলল,’আজ বোধহয় তোর মার খাওয়ার শখ জেগেছে খুব। না?
চুপ-যা এখন। ওদিকে আগ্নেয়গিরি ফুলে-ফেঁপে উঠছে। যেকোনো সময় বিস্ফোরণ হবে। ভাসিয়ে নিয়ে যাবে তোকে একেবারে!
তিতিক্ষার সাথে অন্য মেয়েদের তুলনা একদম করবি না। আমরা এক মায়ের পেটের বোন তবুও ওর সাথে আমারই কোন মিল নেই। ও আলাদা। ও প্রতিটা পদক্ষেপ ফেলে দ্বীনের নিয়ম মেনে। নাস্তার কথা যে বললি ওটাও তার দ্বীনি শিক্ষা। মেহমানের যথার্থ আপ্যায়ন ও কদর করা একজন মুসলমানের ঈমানি কর্তব্য। তিতিক্ষা তাই বলে। সেজন্য তোর এতো কদর। বাকি মেহমানদের মতো। বুঝলি?
ওসব প্রেম পিরিতি থেকে তিতা করলা একশো হাত দূরে। হুহ্।’
উত্তরে নিনাদ কি একটা বলতে যাচ্ছিল। কলিংবেল বেজে উঠল। নিনাদ কপাল চাপড়ে বলে উঠল,’দেখেছিস, আজ ছোট বাবার কথা একদম মনে ছিল না। এখন আমাকে দেখলেই চকলেটের জন্য ঘাড় ধরে ঝুলে পরবে।’
তিহা দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,’তুই তিতিক্ষার নামে কুটনামি করে সময় পেলে তবে তো ওর কথা মনে পরবে।
আচ্ছা শোন, আব্বা আসছে। তোর পিরিতের আলাপ দয়া করে এখন বন্ধ কর। আর বলবি না।’
নিনাদ সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।
দরজার খুলতেই পাঁচ বছরের একটা ছোট বাচ্চা ছেলে, ‘আম্মোও’ বলে চিৎকার করে উঠল। তিহা হেসে মাথা নোয়াল। ছেলেটির মুখের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘ছোটন, জানো কে এসেছে আজ বাসায়?’
-‘কে?’ চোখ বড় বড় করে বাচ্চা জানতে চাইল ছোটন।
-‘তোমার বেস্টু। ওইযে বসে আছে। কাছে যাও।’
ছোটন এবার কাধের ব্যাগ ফেলেই সেদিকে এক ছুটে চলে গেল।
-‘এইতো আমার মেয়ের জামাই এসে গেছে।’ বলে নিনাদ চোখ টিপে ছোটনের দিকে দুহাত বাড়িয়ে দেয়।
ছোটন তার কোলে ঝাপিয়ে পড়ে। পেছন থেকে একজন বৃদ্ধর শান্ত স্বর শোনা যায়।
‘কেমন আছো নিনাদ? সব ভালো তো?’
নিনাদ ছোটন কে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। বৃদ্ধের উদ্দেশ্যে সালাম জানিয়ে বলল ভালো আছে।
বৃদ্ধ হাসি মুখে বললেন, ‘বসো নিনাদ। জিলাপি খেয়ে যাও।
তিতি জিলাপি খেতে পছন্দ করে তো। রোজ রোজ অল্প করে আনতে হয়। বসো তুমি আমি যাই, ফ্রেশ হই গিয়ে। ‘
নিনাদ সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। বৃদ্ধ নিজ ঘরে চলে গেলেন। ইনি তিহা আর তিতিক্ষার বাবা মারুফ হক।অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। বর্তমানে দুই মেয়ে এবং পাঁচ বছরের ছোট নাতি নিয়ে এ বাসায় থাকেন।
নিনাদ বসলো। ছোটন তাকে মুহূর্তে তার অসংখ্য কথা, ক্রিয়া-কলাপ দ্বারা ব্যাস্ত করে তুলল। তার কথা আর শেষ হতে চায় না। নিনাদ কে পেয়ে সে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে।
তিহা এলো খানিক পর জিলাপি নিয়ে। নিনাদ উঠে দাঁড়ালো। ছোটনকে তিহার কোলে দিয়ে ব্যস্ত গলায় বলল,’বাবা জীবন, আজ আমি আসি। চকলেটের কথা একেবারে মনে ছিল না। কাল আমি তোমাকে চকলেট দিয়ে যাবো। শত হোক আমার ভবিষ্যত মেয়ে জামাই তুমি! ‘
ছোটন চোখ মুখ উজ্জ্বল করে হাসে। তিহা শব্দ করে হেসে ওঠে, ‘ফাজিল! জিলাপি খেয়ে যা।’
-‘এখন আর বসে খাওয়ার সময় নেই। আর দেরি করলে স্টুডেন্টের মায়েরা আমাকে ঝাড়ু পেটা করবে। দু একটা দে পকেটে পুরে নিয়ে যাই। রাস্তায় যেতে যেতে খাওয়া যাবে। ‘এই বলে সে সত্যি সত্যি দুটো জিলাপি নিজের প্যান্টের পকেটে পুরে ফেললো।তারপর আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেল।
পরদিন সকালে একই সময় ফের এ’বাড়িতে নিনাদের আগমন ঘটল। এবার আর ভেতরে এলো না। দরজার বাইরে থেকে ছোটন কে ডাকল। ছোটন সবে স্কুল থেকে ফিরেছে। নিনাদ কে দেখে সে ছুটে এল। পকেটে থেকে একটা বড় চকলেট বার বের করে ছোটনের হাতে দিল নিনাদ। ‘বাবা জীবন, আপাতত এটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকো। মেয়ের বিয়ের সময় আরো দেবো। খেয়ে শেষ করতে পারবে না।’
তিহা রাগতে গিয়েও হেসে ফেলে, ‘তোর সাথে থেকে থেকে ছোটনও আজকাল খুব পেঁকে যাচ্ছে। এসব কি শেখাচ্ছিস তুই! আজ থেকে না আবার নতুন জেদ ধরে। দেখা যাবে চকলেটের লোভে তোর জন্ম না নেয়া মেয়েকে বিয়ে করার জন্যই কাঁদছে এখন থেকে!’
-‘কাঁদুক না। আমার মেয়ে জন্মাতেও তো আর বেশি দেরি নেই। একবার আমার বিয়েটা হয়ে যেতে দে শুধু। তোর ওপরেই তো সব!’
তিহা অবাক হয়ে বলে, ‘কি! আমি তোর বিয়ের কি করবো? বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে আয় না..’
-‘তোর বোন আমার কথায় নাচতে নাচতে বিয়ের পিড়িতে বসে যাবে। তুই কি তাই ভাবিস?
তুই একবার রাজি করিয়ে বিয়ের পিড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দে। বাকিটা আমি দেখছি। ভেতরে আসা যাবে না এখন। সময় নেই। ‘
‘কি বললি! তুই ভাগ। যা এখান থেকে। ক্যাম্পাসে শ’খানেক ললনা রেখে এখন আমার বোনের পিছনে পরেছিস?’ তিহা জোড় পূর্বক হাসি আটকে নিনাদ কে বাইরে পাঠাল।
নিনাদ মাথায় আঙুল চালিয়ে বলে ‘চলেই তো যাচ্ছি। যাবার আগে আমার বউকে একটু ডেকে নিয়ে আয়। দেখে চোখ জুড়াই!’
‘ভাই দোহাই লাগে তোর। আমাকে আর বিপদে ফেলিস না। তিতি এসব তামাসা একদম নিতে পারে না। শুনলে খুব রেগে যাবে।’ তিহার স্বরে সত্যিকারের ভয়।
‘তবে আর কি! আমি গেলাম। বউটাকে তোর হেফাজতে রেখে যাচ্ছি। ফুলের টোকাও যেন গাঁয়ে না লাগে। ‘
নিনাদ গুনগুন করতে করতে চলে গেল। হাসি থামিয়ে তিহা দরজা বন্ধ করলো। পরক্ষণেই মাথায় তার নতুন চিন্তা এসে হাজির হলো। বাঘিনী নিশ্চয়ই এসব শুনেছে। ঘরে বসে হয়তো ফোঁস ফোঁস করছে। তাকে যা করে হোক সামলাতে হবে।
স্কুল জীবন থেকে তিহা, নিনাদ ছিল দুজন দুজনের বন্ধু। তারপর একই কলেজ আর ভার্সিটি। এর মধ্যে তিহার বিয়ে হয়েছে। এখন এক ছেলের মা সে। তার স্বামী বান্দরবানে বন বিভাগে চাকরি করে। সরকারি চাকরি। সে বেচারা চাকরি ছেড়ে আসতে পারে না। আবার সেই গহীন বনে বউ বাচ্চাকে নিয়ে যাওয়ার কথাও ভাবতে পারে না।
তিহার শ্বশুরবাড়ি গ্রামে। সেখানকার পরিবেশের সাথে শহুরে বউ নিজেকে মানিয়ে চলতে পারে না। তাই বছরের বেশিরভাগ সময় সে থাকে বাবার বাড়িতে। সেই সুবাদে নিনাদের সাথে যোগাযোগ টা এখনো অক্ষুণ্ণ। ছোট বেলা থেকে নিনাদের সাথে তার সম্পর্ক পিঠাপিঠি ভাইবোনের মতো। সারাদিন মারামারি আবার কাউকে ছেড়ে কেউ থাকতে পারতো না। তিহার বিয়ের সময় নিনাদের শোচনীয় অবস্থাটা মনে পড়লে এখনো হাসি পায়। তিতিক্ষা আর বাবাও অত ভেঙে পড়েনি যতটা নিনাদ ভেঙে পড়েছিল। নিজেদের বন্ধুত্বের এতগুলো বছরে সেদিন প্রথম বারের মতো তিহা তাকে কাঁদতে দেখেছিল। অবাক হয়ে গিয়েছিল সবাই। তারপর তিতিক্ষা আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে জোরালো এক ধমক দিতেই একবারে চুপ।
তিহার বোন হলেও তিতিক্ষা স্বভাবে পুরো উল্টো। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর গম্ভীর মেজাজের মেয়ে সে। দ্বীনের ব্যাপারে ভীষণ সিরিয়াস। অকারণ হাসি-ঠাট্টা তার একদম পছন্দ নয়। কিন্তু মনটা ভীষণ ভালো। কারো কষ্ট একবিন্দু সইতে পারে না। গোলগাল ফর্সা মুখজুড়ে আদুরে ভাব। গম্ভীর মেজাজ দিয়ে সর্বদাই সেই আদুরে ভাবটা সে ঢেকে রাখতে চায়। কখনো কখনো হয়তো বা সফলও হয়। তবে একজনের সামনে এলেই তার সব জারিজুরি থেমে যায়। মুখটা গম্ভীর করতে গিয়ে অস্বাভাবিক করে ফেলে। হাত পা কঠিন করতে গিয়ে বোঝে তারা আগে থেকেই অবশ হয়ে আছে। সব শব্দরা যেন ডানা মেলে উড়াল দেয়। মুখ দিয়ে কথা আসে না। শরীর জুড়ে অস্বস্তি শুরু হয়। চারপাশের সব মিথ্যে মনে হয় ঠিক সামনের মানুষটার মতো। তিতিক্ষা নিজ দেহ আর মনের এই নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থাকে ভীষণ ভয় করে। তার ওপর আছে নিনাদের কথার বাণ।তিতিক্ষা কে দেখলেই পৃথিবীর সব অপমান আর লজ্জাজনক কথা তার যেন মনে পড়ে যায়। নানান কথার তোড়ে তিতিক্ষাকে আহত নিহত করে সে যেন শান্তি পায়। ছোট বেলায় তিতিক্ষা অত বুঝতো না।নিনাদের নিষ্ঠুরতম আচরণ আর কথায় অপমানিত হয়ে নাক টেনে টেনে কাঁদতো শুধু। নিনাদ যখন তাকে সবার সামনে বউ বউ বলে ডাকতো দুঃখে তখন তার মরে যেতে ইচ্ছে করতো। দৌড়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতো শুধু, ‘আমি কালো বরকে একদম বিয়ে করবো না বাবা। কালো বর আমার একটুও পছন্দ না।’
বাবা হেসে বলতেন, ‘আমার এতো সুন্দর পরির মতো মেয়েকে কালো বরের কাছে বিয়ে দেব আমি ? কক্ষনো না।’
-‘বড় হলে ভুলে যাবে না তো?’
-‘আমার তিতা আম্মার কথার আমি ভুলতে পারি কখনো?’
বড় হওয়ার পর নিজের ছোট বেলাকার আচরণে তার লজ্জা হতো ঠিকি। তবে নিনাদের এসব বেহায়াপনা আচরণকে আজও সে ঘৃণা করে। নিনাদের সাথে তিহার এই সখ্যতাও তার অসহ্য ঠেকে। সে নানা ভাবে তিহাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে। শতহোক নিনাদ তার ছেলে বন্ধু। পরিবারের কাছের কেউ নয়। তাদের এই ঘনিষ্ঠতা ধর্মবিরুদ্ধ। নিনাদ তার জন্য গাইরে মাহরাম।
তিহা যে বিষয় টা বোঝে না এমন নয়। কিন্তু ছোট বেলা থেকেই নিজের ছোট ভাইয়ের আসনটা সে নিনাদকে দিয়ে রেখেছে ।রক্তের সম্পর্ক নাই বা থাকুক। ভাই ভাবে তো। হঠাৎ করে সে তাকে কিভাবে ছেড়ে দেয় ! তার এসব কথা শুনে অবশেষে তিতিক্ষাও হার মেনেছে। সে আর কথা বলে না এসব বিষয়ে।
_________________
ছোটন আগে আগে দৌড়াল। পেছন পেছন তিহাও গেল বোনের ঘরে। তিতিক্ষা বিছানায় হেলান দিয়ে বসে ছিল । তার ফর্সা মুখটা লাল হয়ে আছে। রাগে টগবগ করে ফুটছে যেন সে। আড়চোখে তিহাকে একবার দেখে তাচ্ছিল্য মেশানো স্বরে সে বলল ,’কথা শেষ হলো বুবু? চলে গেল তোমার প্রাণের বন্ধু ?’
তিহা মিনমিনে স্বরে বলল, ‘হ্যাঁ, ছোটন কে চকলেট দিতে এসেছিল। দিয়েই চলে গেছে।’
তিতিক্ষা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর সহসা প্রবল স্বরে বলে উঠল,’শোনা বুবু। নিনাদ ভাইকে বলে দেবে। তার মুখে আমার নাম আর শুনতে চাই না আমি। সে এ’বাড়িতে আসে আসুক, তোমার সাথে কথা বলুক। আমাকে যেন আর না ঘাটে। ভদ্রতার খোলস ছেড়ে নাহয় বেরিয়ে আসতে হবে আমাকে এবার । ‘
তিতিক্ষার কথা শুনে তিহা ভয় পেয়ে গেল। কোন কাজ তিতিক্ষা মুখে বলবে অথচ কাজে করে দেখাবে না। এমন মেয়ে সে নয়। সে যখন বলেছে তখন সত্যি নিনাদকে কঠিন কথা শোনাতেও তার বাঁধবে না।
চলবে….