দূরত্বের আড়ালে পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0
30

#দূরত্বের_আড়ালে
#পর্ব_১০ (অন্তিম পর্ব)
#লেখনীতে_মারিয়া_আক্তার_মাতিন

পুরোনো স্মৃতির পাতায় ডুবে আছে প্রণীতা। সেই স্মৃতিগুলোই কল্পনার জগতে ঘুরপাক খায়। সে কী ভাবতে পেরেছিল যে সেদিন পার্কে দেখা হওয়া লোকটাকেই সে একদিন মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসবে? আসলে,আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অবগত নই। যদি হতাম তাহলে হয়তো জীবনটা অনেক সুখের হতো। প্রণীতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার জীবনটায় কতকিছু ঘটে গেল। তার বিন্দুমাত্র আঁচ যদি আগে থেকে টের পেতো,তাহলে নিজেকে আর এমন ভালোবাসা নামক অনুভূতিতে জড়াতো না।

ছাদের রেলিং ধরে একাকী দাঁড়িয়ে আছে আহিয়ান। সে নিজের জীবনের হিসেব কষতে ব্যস্ত। সব কষ্ট মেনে নেওয়া যায় কিন্তু আপন মানুষের দেওয়া কষ্ট কখনো মেনে নেওয়া যায় না। তার উপর তিনি যদি হন নিজের আপন বাবা। আহিয়ানের ভাবতেও ঘৃণা হচ্ছে যে সে এমন এক পিতার সন্তান। সে ভাবতে লাগলো জীবনে সে কী পেল! পিতা তাকে হাতের গুটি হিসেবে ব্যবহার করতে চায়,জীবনে একজনকে ভালোবেসেছিল কিন্তু সেও অন্য একজনের। যাকে বলে মরিচীকার পিছনে ছুটা। হঠাৎ সে অনুভব করলো তার চোখের কোণে জল। আজ আহিয়ানের চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কাঁদছে না। কষ্টগুলো বুকের মাঝেই চাপা দিয়ে রেখেছে। সেদিনের ঘটনা…

আহিয়ান বন্দি অবস্থায় ফারাজের নাম শুনে ভীষণ অবাক হলো। তার আর বুঝতে বাকী রইল না যে এই পুরুষটাই প্রণীতার ভালোবাসা। ইসহাক আহিয়ানকে ফারাজের ব্যাপারে সব বলেছিল। সাথে মশলা মিশিয়ে হাবিজাবি অনেক কিছু বলেছে। যার দরুণ ফারাজের সম্পর্কে একটা বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হয় তার মনে। সে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফারাজকে বলে,“তার মানে আপনিই আমাকে এখানে তুলে এনেছেন?”

ফারাজ মুচকি হাসে৷ তারপর বন্ধু মিরাভ ও অপর একজনের নাম ধরে ডাক দেয়। ডাক দেওয়ার সাথে সাথেই তারা এসে হাজির হয়। আহিয়ান মিরাভকে চিনতে না পারলেও সাথে থাকা ছেলেটিকে চিনতে পারে৷ কারণ,এই ছেলেটিই তো তাকে সাহায্যের নাম করে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। সে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,“বয়স তো বেশি না তোমার। এই বয়সেই এসব কাজে যুক্ত হয়েছো?”

ছেলেটি দাঁত কেলিয়ে হাসে৷ অতঃপর বলে,“আপনি আমার বসের কলিজাকে ভুলে যান,তার পিছু ছেড়ে দিন। তাহলেই আর আপনাকে এসব জালে ফাঁসাব না।”

আহিয়ান অবাক হয়ে তাকায়। তখনই শুনতে পায় ফারাজের কণ্ঠস্বর,“আমার শিষ্যের কিন্তু বুদ্ধি দারুণ। আপনাকে যখন সে নিয়ে আসছিল তখন কৌশলে আপনার নামটা জেনে নেয় ফলে আপনার আসল পরিচয় পেতে আমার সুবিধা হয়।”

তারপর ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলে,“শিষ্য! কীভাবে জানি নামটা জেনেছিলে?”

ছেলেটি তৎক্ষনাৎ বলতে থাকে,“হ্যাঁ,হ্যাঁ! আসলে আমি তো উনাকে বলেছিলাম যে উনাকে আমি আগে থেকেই চিনতাম তাই হুট করেই যদি জিজ্ঞেস করি যে আপনার নাম কী তাহলে তো উনি সন্দেহ করবেন! যে উনাকে চিনি অথচ উনার নাম জানি না৷ তাই আমি এভাবে জিজ্ঞেস করেছিলাম,আচ্ছা,আপনার নামটা যেন কী? এই মুহূর্তে ঠিক মাথায় আসছে না। কী যেন নামটা,উফ মনে পড়ছে না কেন!”

আহিয়ান নিস্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। ছেলেটার মাথায় কী বুদ্ধি! আজকালকার ছেলে না ওরা? বুদ্ধি তো থাকবেই। ফারাজ বলে,“এই হলো আমার বন্ধু মিরাভ। সে-ই আপনাকে পিছন থেকে মুখে রুমাল চেপে ধরেছিল৷”

এই বলে মিরাভের দিকে তাকিয়ে বলে,“যাহ ব্যাটা! তোকে আজ তোর ইচ্ছেমতো ট্রিট দিবো।”

মিরাভ আহিয়ানের দিকে তাকিয়ে হাসে। বলে,“ভালো আছেন?”

আহিয়ান রাগে কটমট করে৷ উত্তপ্ত স্বরে বলে,“আপনাদের এসব ড্রামা দেখার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। আমাকে এখানে কীসের জন্য আনা হয়েছে?”

ফারাজ গম্ভীর স্বরে বলল,“আমার শিষ্য একটু আগে কী বলেছে শুনেননি? আমার কলিজার পিছু ছাড়ুন তো আপনাকেও ছেড়ে দেওয়া হবে।”

-“আপনার কলিজা মানে?”

-“নাটক করছেন আমার সাথে? আপনি যে আমার ব্যাপারে সব জানেন তা আমার ভালো করেই জানা আছে। ভালোই ভালোই বলছি প্রণীতার পিছু ছেড়ে দিন। নাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”

-“আমি প্রণীতাকে ভালোবাসি। আপনার মতো একজন বিশ্বাসঘাতকের কথায় নিজের ভালোবাসাকে ছেড়ে দিব?”

-“ও তাই? আমি বিশ্বাসঘাতক? আর আপনি যে একজন বিশ্বাসঘাতকের সন্তান? আপনার রক্তে মিশে আছে এক বিশ্বাসঘাতকের রক্ত তার বেলায়?”

আহিয়ানের রাগ বেড়ে যায়। সে হুংকার ছাড়ে,“খবরদার! আমার বাবা বা মায়ের নামে বাজে কথা বলবেন না!”

-“আপনার মা কেমন তা জানা নেই। তবে আপনার বাবা একজন সেরা ক্রি’মি’না’ল। এটাই সত্য। আর আমি সত্য বলতে ভয় পাই না। আপনার নাম শুনেই চিনতে পেরেছিলাম যে আপনি এই ক্রি’মি’না’লে’র সন্তান।”

-“আপনি কীসের ভিত্তিতে আমার বাবাকে ক্রি’মি’না’ল বলছেন? কী প্রমাণ আছে আপনার কাছে?”

তারপরই বেরিয়ে এলো প্রমাণ সহ সমস্ত সত্য। চোখের উপর থেকে পর্দা সরে গিয়ে ঝলমল করে উঠল এতোদিনের লুকায়িত কিছু কর্মকাণ্ডের প্রমাণ। আহিয়ানের এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে তার বাবা এমন কাজ করতে পারে? এমন নি’কৃ’ষ্ট কাজের সাথে কিনা তার বাবা জড়িত? সে এটাও বুঝতে পারলো প্রণীতার জন্য সে নয় ফারাজ-ই উপযুক্ত। তার ভালোবাসার কোনো তুলনা নেই। তার মতো করে প্রণীতাকে কেউ ভালোবাসতে পারবে না হয়তো সে নিজেও নয়। সে যখন বলেছিল,“আমি তো প্রণীতাকে পার্কে একা রেখে এসেছি। মেয়েটা হয়তো আমার জন্য অপেক্ষা করছে।”

ফারাজ বলেছিল,“সে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না৷ তার সব ব্যবস্থা আমি করেছি।”

তারপর অন্য নাম্বার দিয়ে প্রণীতাকে ম্যাসেজ দেওয়া,বারবার আহিয়ানের বিপদের কথা বলে বাসায় পৌঁছানোর তাগিদ দেওয়া- সবকিছু খুলে বলল সে। এমনকি,প্রণীতা যখন বাসায় যাচ্ছিল তখন সে ও পিছনে একটা গাড়ি করে তার সাথে সাথে যায়, সে ঠিকঠাক যেতে পারল কিনা তা দেখার আশায়।

আহিয়ান ছাদ থেকে নিজের রুমে আসলো। করবে না করবে না ভেবেও প্রণীতাকে ফোন করে বসল। ফোন রিসিভ হতেই সে জিজ্ঞেস করলো,“কেমন আছো,প্রণীতা?”

হঠাৎ এমন প্রশ্নে প্রণীতা কিছুটা বিস্মিত হলো। তবে তা বুঝতে না দিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বলল,“আলহামদুলিল্লাহ! আপনি?”

-“আলহামদুলিল্লাহ! আমার উপর কি এখনো রাগ করে আছো?”

-“নাহ! আপনার উপর রাগ করবো কেন? তবে,আপনি আমাকে বিয়ে করবেন না সেটা শুরুতে বললেই পারতেন।”

আহিয়ান চোখদুটো বন্ধ করে ফেলে। যন্ত্রণা আগুনে দগ্ধ হচ্ছে তার হৃদয়। সে কী করে বোঝাবে যে সে তাকে কতোটা ভালোবেসেছিল! কিন্তু সে তা বলবে না। ফারাজ প্রণীতাকে ভালোবাসে,প্রণীতাও ফারাজকে ভালোবাসে। এখন হয়তো ঘৃণা করছে কিন্তু সত্যিটা জানার পর আর করবে না। হয়তো আগের চেয়েও তখন ভালোবাসা বাড়বে। আহিয়ান বলল,“তুমি আমাকে ভুল বুঝছো,প্রণীতা৷ আমার উদ্দেশ্য তেমন নয়। আমি তোমাকে যা বলেছি সব সত্য।”

প্রণীতা অস্থির কণ্ঠে বলল,“আপনার কাছে কোনো প্রমাণ আছে?”

-“আমার কাছে নেই। তবে ফারাজ নিজেই একটা জলজ্যান্ত প্রমাণ। তুমি তার কাছে যাও। সে তোমায় প্রমাণ সহ সব সত্য বলবে।”

-“আপনি মিথ্যে বলছেন। আপনি আর ফারাজ মিলে আবার আমার জীবনটাকে নষ্ট করতে চাইছেন। আমি আপনাদের বিশ্বাস করি না।”

-“বিশ্বাস করা না করা তোমার ব্যাপার। তবে সত্য তুমি বদলাতে পারবে না। তোমার সবচেয়ে কাছের মানুষই তোমাকে ধোঁকা দিচ্ছে অথচ সেটা তোমার চোখে পড়ছে না। আর যে তোমায় নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে তার একদিনের দেখানো একটা রূপেই তাকে চিরতরের জন্য ঘৃণা করতে শুরু করলে। একটিবার সত্যতা যাচাই করবে তো? তাকে নির্দোষ প্রমাণের একটা সুযোগ তো দিবে তাই না?”

প্রণীতা চুপ হয়ে গেল। আহিয়ানের কথাগুলো গভীরভাবে তার মস্তিষ্কে গেঁথে বসল। সে কি একটা সুযোগ দিবে? ফারাজ কী বলতে চায় শুনবে? কিছুক্ষণ নীরবতা পালনের পর সে জবাব দিলো,“বেশ,আমি ফারাজকে সুযোগ দিবো। তাকে সব সত্যি বলার সুযোগ দিবো।”

-“শুনে খুশি হলাম। বেস্ট অফ লাক,প্রণীতা।”

এই বলে ফোন কাটল সে। তারপর বলে উঠল,

“পৃথিবীর সবাই ভালো থাকুক
মন দিয়ে করি এই প্রার্থনা
একলা আমি যেমনই থাকি
কেউ তার খোঁজ রাখবে না।”

আহিয়ানের সাথে কথা শেষ হতেই পুনরায় প্রণীতার ফোন বেজে উঠে। প্রণীতা বিরক্ত হলো। কীসের যে ফোন আসা শুরু হয়েছে! সে বিরক্তির সাথে ফোন হাতে নিলো। হাতে নিতেই তার ভ্রু কুঁচকে এলো। কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করলো। আরে,এটা তো সেই নাম্বারটা যে নাম্বার থেকে সেদিন মেসেজ এসেছিল। সে দ্রুত ফোনটা রিসিভ করে। অজানা বিপদের আশংকায় তার মন ছেয়ে যায়। ফোন রিসিভ হতেই ভেসে আসে সেই চেনা কণ্ঠস্বর,“জান! চিনতে পেরেছো আমায়?”

প্রণীতা বিস্ময়ে হা হয়ে গেল। এটা তো ফারাজের কণ্ঠ। তার মানে এটা ফারাজের নাম্বার! আর সেদিন ফারাজ-ই তাহলে আহিয়ানকে আটকে রেখেছিল? কিন্তু কেন? সে কি কোনোভাবে আহিয়ানের সাথে তার বিয়ের কথা জানতে পেরেছে আর তার জন্যই কী….
সে আর ভাবতে পারলো না। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,“আপনি!”

-“প্লিজ জান,আমায় আর আপনি ডেকো না। তোমার মুখে সেই মিষ্টি তুমি ডাকটা শুনতে চাই।”

প্রণীতা কিছুটা হতভম্ব হলো। কী ব্যাপার,ফারাজ কি এসব বলার জন্যই তাকে ফোন দিয়েছে? নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য? তার ধ্যান কাটে ফারাজের পরবর্তী কথায়,“শুনতে পারছো,জান? শুনো,তোমাকে একটা এড্রেস ম্যাসেজ করে পাঠাচ্ছি। অল্প কিছুক্ষণের মাঝেই আহিয়ানকে সাথে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হবে। তোমাদের দুজনের জন্য একটা বড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে।”

-“সারপ্রাইজ?”

-“হ্যাঁ। অবশ্য সারপ্রাইজটা দেখে খুশি হবে না। কিন্তু সত্যিটা তোমায় অবশ্যই জানতে হবে। যদি এই অধমকে শেষবারের মতো একটি সুযোগ দিতে পারো,তাহলে আমার কথা বিশ্বাস করে এসে পড়ো। কেমন?”

কথাটুকু শেষ করে ফোন কাটল ফারাজ। প্রণীতা কথা বলার আর সুযোগ পেল না। সে পড়েছে দ্বিধায়। এই সত্যি সত্যি শুনতে শুনতে তার মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কীসের এতো সত্যি লুকিয়ে? সে বুঝতে পারে না। তার মস্তিষ্ক শূণ্য হয়ে যায়। সে ধপ করে বসে পড়ে বিছানায়।

__________________________

আহিয়ানকে নিয়ে ফারাজের পাঠানো এড্রেসে উপস্থিত হলো প্রণীতা। তাদের আসতে দেখে ফারাজ আনমনে হাসলো। তবে খারাপও লাগল একটু। নিজেদের জন্মদাতার এরূপ পরিস্থিতি কোন সন্তানই বা সহ্য করতে পারে? ফারাজ তাদের নিয়ে নির্দিষ্ট রুমের দিকে অগ্রসর হয়। রুমে প্রবেশ করা মাত্রই প্রণীতার শরীর কেঁপে উঠে। স্তব্ধ হয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য। তার সামনেই তার বাবাকে একটা চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। সাথে আহিয়ানের বাবাকেও। আহিয়ান কষ্ট পেল তবে অবাক হলো না। কারণ,সে এমন পরিস্থিতির কথা আগে থেকেই ঠাহর করতে পেরেছে। ফারাজ যে এতো সহজে তাদের ছাড়বে না তা সেদিনই সে বুঝতে পেরেছে। ইসহাক ও আহিয়ানের বাবা রহমানকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন পুলিশ। প্রণীতা চিৎকার করে উঠে,“বাবা! তোমার এই অবস্থা কেন? তোমাকে বেঁধে রাখা হয়েছে কেন?”

ইসহাক মাথা নিচু করে বসে আছে। দুচোখ হতে টুপটুপ করে অশ্রু ঝরছে। প্রণীতা দৌড়ে ইসহাকের কাছে যেতে চাইলে ফারাজ তার হাত টেনে ধরে। বলে,“দাঁড়াও৷ এতদূর এসেছো,সত্যিটা শুনবে না?”

প্রণীতা ক্ষিপ্ত চোখে চেয়ে বলল,“আপনিই আমার বাবাকে এখানে বেঁধে রেখেছেন তাই না? আপনার এতো বড় সাহস যে আপনি আমার বাবার সাথে শেষমেশ শত্রুতা শুরু করেছেন? কী চান আপনি? আমার জীবনের সুখ শেষ করে আপনার শান্তি হয়নি? এখন আমার বাবার পিছনে লেগেছেন?”

ফারাজ স্থির চোখে চেয়ে বলল,“শান্ত হও,প্রণীতা…

প্রণীতা উচ্চস্বরে বলে উঠে,“কীসের শান্ত হব আমি? আপনি একটা ঠকবাজ,প্রতারক,বিশ্বাসঘাতক। আমার জীবনের একটা বাজে অধ্যায় আপনি। আপনি..

-“প্রণীতা!”

ফারাজ ধমকে উঠে।

-“এতোক্ষণ ধরে তুমি কথা বলেছো। এখন আমায় বলতে দাও। এর মাঝে একটা কথাও তুমি বলবে না।”

ফারাজ সকলের দিকে চোখ বুলিয়ে নেয়। আহিয়ানকে বিশেষভাবে দেখে। ছেলেটা কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফারাজের মায়া হলো। তবে কিছুই করার নেই। অন্যায়কে সে কখনো প্রশ্রয় দেয় না। সে নিজেকে ধাতস্থ করে বলতে শুরু করে,“ইসহাক উদ্দিন উরফে আমার হবু শ্বশুরমশাই আর উনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রহমান সাহেব,এই দুজন দীর্ঘদিন যাবৎ অবৈধ কালোবাজারের সাথে যুক্ত। তারা বিদেশের এক মাফিয়া গোষ্ঠীর সাথে চুক্তিবদ্ধ। সেখানে তারা আমাদের দেশের খাদ্যদ্রব্য,ওষুধ এবং বিভিন্ন মূল্যবান সম্পদ পাচার করছে। ফলস্বরূপ,আমাদের দেশের মানুষের কপালে জুটছে নকল ওষুধ,ফরমালিন যুক্ত খাবার এবং খাবারের দাম অগণিত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এসবের মূলে রয়েছে এরা দুজন। এই অবৈধ ব্যবসাটা প্রথমে শুরু করেন রহমান সাহেব। তিনিই এই কাজে ইসহাক উদ্দীনকে পার্টনার হিসেবে রাখেন এবং টাকার লোভে তিনিও রাজি হয়ে যান। এখন কথা হচ্ছে আমি এতসব জানলাম কী করে?”

এই বলে ফারাজ থামে। ফের বলতে শুরু করে,“আমি আমার বাবার ব্যবসা টুকটাক দেখাশোনা করি ঠিক আছে। কারণ,ভাইয়ার উপর বেশি চাপ পড়ে যায় তাই আমিও একটু সহযোগিতা করার চেষ্টা করি। কিন্তু তার পাশাপাশি আমার আরও একটা পরিচয় আছে। সেটা হলো আমি একজন ইন্টিলিজেন্স অফিসার। এই পরিচয়টা আমি গোপন রেখেছিলাম সবার কাছে। তখন,আমাদের সংস্থা থেকেও এই কালোবাজারের সাথে যুক্ত আসামীদেরকে খোঁজার দায়ভার আমাদের একটা দলের উপর দেওয়া হয়েছিল। আমরা খুঁজতে শুরু করলাম৷ এবং ভাগ্য ভালো থাকায় আমিই সর্বপ্রথম তাদের খোঁজ পেলাম। কিন্তু হাতে যথাযথ প্রমাণ না থাকায় কোনো স্টেপ নিতে পারছিলাম না। তখন আমাদের দলের সদস্যরা জানতে পারে তারা বাইরের একটা দেশের মাফিয়া গোষ্ঠীর সাথে চুক্তিবদ্ধ। ব্যস,সেই থেকেই আমার খেলা শুরু।”

-“আপনি মিথ্যা বলছেন। আমার বাবা কখনো এমন কাজ করতেই পারে না। আপনার কথা সব মিথ্যে,সব।”

প্রণীতার কণ্ঠে জেদ। আহিয়ান ফোস করে শ্বাস ছাড়ল। তারপর বলল,“ফারাজ কিছুই মিথ্যা বলছে না। তার কাছে প্রমাণ আছে।”

ফারাজ বলে,“আমার শ্বশুরমশাই বড্ড চালাক ছিলেন। এই এতোসব কিছু আমি জানতে পারি যখন আমার জীবনে প্রণীতার প্রবেশ ঘটে। প্রণীতার বাবাও আমাকে চিনতেন। তিনি একদিন বুঝে ফেলেন যে উনার এসব কারসাজির কথা আমি জেনে গেছি। কিন্তু আমার আসল পরিচয়টা বুঝতে পারেননি। যার ফলে তিনি একদিন আমায় থ্রেট দেন যেন আমি প্রণীতার জীবন থেকে চলে যাই,তাকে যেন ভুলে যাই। আর এই সত্য ফাঁস করলে তিনি নাকি আমাকে আর আস্ত রাখবেন না। তিনি এটা জানতেন না যে আহসান চৌধুরী ফারাজ এসব হুমকিতে ভয় পায় না। আমি সেদিন উনাকে কিছু বলিনি। আর উনিও আবার উনার বন্ধু রহমান সাহেবের ছেলে আহিয়ানের সাথে প্রণীতার বিয়ের কথা ভাবতে থাকেন। কারণ,এতে করে উনাদের মাঝে সম্পর্কের ভিত্তিটা আরও মজবুত হবে। রহমান সাহেব উনাকে বলেন প্রণীতাকে যদি উনার ছেলের কাছে বিয়ে দেওয়া হয় তাহলে উনি মোটা অঙ্কের টাকা দিবেন। আর সেই লোভে ইসহাক উদ্দীনও রাজি হয়ে যান। এদিকে,রহমান সাহেবের কু’নজর পড়েছিল প্রণীতার উপর। তিনি খারাপ উদ্দেশ্যেই মূলত প্রস্তাবখানা রাখেন। কী তাইনা রহমান সাহেব?”

রহমান মাথা নিচু করে রেখেছে। মুখ দিয়ে একটা টু শব্দও বের হচ্ছে না। কী বলবেন তিনি? বলার মতো কোনো ভাষা আছে? ফারাজ হাসে। বলে,“একদিকে তখন প্রণীতার চিন্তা অন্যদিকে সেই দেশটিতে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা,এই দুইয়ের মাঝে পড়ে নিজেকে কেমন পাগল পাগল মনে হচ্ছিল। আমি চাইলেই প্রণীতাকে সব বলতে পারতাম। কিন্তু নিজের বাবার সম্পর্কে প্রমাণ ছাড়া কথা কি সে বিশ্বাস করবে? তাই বলিনি। তখন আমার বন্ধু মিরাভ আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। আমি যখন বাইরের দেশে চলে গেলাম,সে তখন প্রণীতার উপর নজর রাখতো। প্রণীতা কোথায় যাচ্ছে,কী করছে,তার কোনো বিপদ হচ্ছে কিনা সবকিছুর খেয়াল রাখতো। তার উপর আমার বিশ্বাস ছিল প্রচুর। এদিকে আমি বাইরের দেশে এসে বিপদে পড়ি। যে অবস্থা দেখতে পাই তাতে মনে হয় দীর্ঘদিন থেকে তারপর সত্য উদ্ধার করতে হবে৷ তখন আমার মনে চিন্তার উদয় হয়। এতোদিনে যদি প্রণীতার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়? প্রণীতার উপর আমার বিশ্বাস ছিল যে সে আমায় ছাড়া আর কাউকেই বিয়ে করবে না। কিন্তু তবুও ভয় হতো। তখনও মিরাভ আমায় আশ্বাস দেয়। সে বলে,প্রণীতার যদি বিয়ে ঠিকও হয় তাহলে সেই বিয়ে ভাঙার দায়িত্ব তার। আমি মূলত তার উপর আর আমার আল্লাহর উপর ভরসা করেই মিশনে নেমেছিলাম। আর দেশে ফেরার পর প্রণীতাকে না চেনার ভান করেছিলাম কারণ এতে করে ইসহাক উদ্দীন বুঝেছিলেন আমি হয়তো সত্যিই প্রণীতাকে ভুলে গেছি। তাই তিনি আর আমাকে বিশেষ পাত্তা দেননি। আর উনার এই পাত্তা না দেওয়াটাই আমার কাজে এসেছিল। আমি আরও কিছু প্রমাণ সংগ্রহ করতে পেরেছি।

প্রণীতা কেমন নিস্তব্ধ হয়ে সব শুনছে।।পুরো জগতটাকেই কেমন বিষাক্ত মনে হচ্ছে। নেতিয়ে আসা শরীরটা পড়ে যেতে চাইলে ফারাজ তৎক্ষণাৎ ধরে ফেলে। অস্থির কণ্ঠে শুধায়,“প্রণীতা,তুমি ঠিক আছো?”

প্রণীতা কিছু বলে না৷ কোনোরকম দাঁড়ানোর চেষ্টা করে৷ দুচোখভর্তি অশ্রু নিয়ে বলে,“আপনি সব সত্যি বলছেন? আমার বাবা আর রহমান চাচা এতোটা খারাপ?”

ফারাজ অসহায় কণ্ঠে বলে,“আমি জানি,তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এটাই সত্যি।”

ফারাজ তারপর একটা সিসিটিভি ফুটেজ অন করে। সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ইসহাক ও রহমান মালামাল গাড়িতে তুলছে। সাথে একটা গুদামও আছে যেখানে তারা সব মাল সংরক্ষণ করে রাখে। এছাড়াও তার কাছে প্রমাণস্বরূপ আছে অবৈধভাবে লেনদেন হওয়া বিশাল অঙ্কের টাকার রেকর্ড,বিদেশে ইসহাক গোপনে একটা একাউন্ট খোলেছিল সেই একাউন্টের তথ্য। সাথে আছে মাফিয়া গোষ্ঠীর লিডার যে কিনা সবকিছু নিজ মুখে স্বীকার করেছে তার একটি ভিডিও ক্লিপ। কারণ,লিডারের সাথে তারা শেষে প্রতারণা করেছিল যার দরুণ তিনি সব স্বীকার করেন। এসবকিছু সংগ্রহ করতে ফারাজের বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।

প্রণীতা অশ্রুসিক্ত নয়নে বাবার দিকে এগিয়ে গেল। হাঁটুমুড়ে বসে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,“বাবা,ও বাবা! ফারাজ এসব কী বলছে? আমি,আমি জানি এসব মিথ্যা,এসব ওর বানানো৷ আমি জানি তুমি কখনো এসব কাজ করতে পারো না। তুমি বলো না যে তুমি নির্দোষ,একটিবার বলো বাবা!”

ইসহাকের পিতৃজীবনের হয়তো এখানেই ইতি ঘটবে। তিনি আজ ভুগছেন চরম অনুশোচনায়। এইযে সন্তানের চোখের সামনে অপরাধী হওয়াটা যে উনাকে কতোটা কষ্ট দিচ্ছে এটা যদি আগে বুঝতে পারতেন! কিন্তু লোভের বশে তিনি ছিলেন অন্ধ। আহিয়ান তার বাবাকে বিশেষ কিছু বলল না। বাবা ডাকলেন তবুও গেল না। সে সেখান থেকে চলে গেল। অতঃপর আর কী,দুজনকে ধরে নিয়ে গেলেন পুলিশ দল। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নয়তো ফাঁসিই হবে তাদের পনিণতি। প্রণীতা চিৎকার করে কাঁদল কিন্তু বাবাকে আর পেল না।

______________________

কেটে গেছে বেশ অনেকদিন। কারো জন্য কারো জীবন আটকে থাকে না। সবাই যার যার মতো দিন অতিবাহিত করছে। প্রণীতার মা হাফিজা ও স্বামীর শোক কাটিয়ে উঠেছেন। আহিয়ানের মা ও তাই। পাপিষ্ঠ ব্যক্তিদের শাস্তি হওয়াই প্রযোজ্য। তাদের জন্য কষ্ট পাওয়া সাজে না।

আজ ফারাজ আর প্রণীতার বিয়ে। ইতিমধ্যেই বিয়ে পড়ানো শেষ। তারা এখন স্বামী-স্ত্রী। হাফিজাকে তারা সাথে নিয়ে যাবে। হাফিজা প্রথমে আপত্তি করলেও ফারাজের জোরাজোরিতে রাজি হন। তিনি এখন থেকে মেয়ের সাথেই থাকবেন। আহিয়ান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল সব৷ বিড়বিড় করে বলল,“আমার ভালোবাসার সুখ মানেই আমার সুখ। সে সুখী হলেই আমি সুখী। নাই বা হলো আমার,হোক না সে অন্যকারো। তার মুখে হাসি তো ফুটেছে। এটাই আমার জন্য যথেষ্ট।”

বাসর ঘরে ফুল দ্বারা সজ্জিত বিছানায় বসে অপেক্ষা করছে প্রণীতা। বুকের ভিতর দ্রিমদ্রিম আওয়াজ হচ্ছে। হঠাৎ দরজা লাগানোর আওয়াজ এলো। না তাকিয়েও বুঝতে পারলো ফারাজ এসেছে। ফারাজ যতোই তার দিকে এগোচ্ছে,তার হৃদকম্পন ততোই বাড়ছে। হাত-পা অনবরত কাঁপছে। ফারাজ বিছানায় এসে তার কাছে বসল। দুহাতে ঘোমটা সরিয়ে কপালে শব্দ করে চুমু খেল। ঘোরলাগা কণ্ঠে বলল,“আমার বউ!”

প্রণীতা লজ্জায় হাসফাস করে উঠে। মুখ রক্তিমবর্ণ ধারণ করে। সে কিছু বলতে চাইলে ফারাজ তার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলে,“হুশ! কোনো কথা নয়। আজ আমি কোনো কথা শুনব না৷ অনেক কষ্ট করে পেয়েছি তোমায়। আমার অনেক কষ্টের ফল তুমি। তাই আজ সারারাত শুধু ভালোবাসা চলবে। আমার আদরে তোমার প্রতিটি অঙ্গ সিক্ত হবে।”

ফারাজ যতোই কাছে আসছে প্রণীতার নিঃশ্বাসের পরিমাণ গাঢ় হচ্ছে। ফারাজের তপ্ত শ্বাস তার গায়ে আছড়ে পড়ছে। ফারাজ ধীরে ধীরে প্রণীতার গা হতে সমস্ত গহনা খুলে রাখলো। তারপর তার মাথা ঠেকলো বালিশে। মুহূর্তের মাঝেই প্রণীতার অধরে অধর মেশালো ফারাজ। ধীরে ধীরে সেই চুম্বন ঠোঁট হতে গলায়,গলা হতে সমস্ত দেহে নেমে আসলো। প্রণীতা বিছানার চাদর খামচে ধরে। নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে সমার্পিত করে তার ভালোবাসার মানুষটির কাছে যার প্রতিটি স্পর্শে সে সুখ খোঁজে পায়।

ভোরের আলো ফুটেছে এই কিছুক্ষণ হলো। সেই সাথে শুরু হয়েছে পাখিদের কিচিরমিচির। প্রণীতার ঘুম ভাঙলে সে নিজেকে কারো বাহুডোরে আবদ্ধ দেখতে পায়। ফারাজ তাকে শক্তপোক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। যেন ছাড়লেই পালিয়ে যাবে। নিজেদের বস্ত্রবিহীন অবস্থা দেখে লজ্জায় জান যায় যায় অবস্থা তার। একটুতেই সে লজ্জা পায়। তার উপর রাতে যা হলো….
সে আর ভাবতে পারলো না। সে নিজেকে কোনোমতে ছাড়িয়ে গোসল করলো। গোসল করে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই হুট করে ফারাজ পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। চুলে নাক ঘষে বলে,“আমাকে ছেড়ে উঠলে কেন?”

-“তো সারাদিন তোমার সাথে শুয়ে থাকব নাকি?”

-“তাই করবে।”

-“অসভ্য একটা!”

-“তোমার জন্য।”

প্রণীতা মুচকি হাসলো। ফারাজ গাঢ় স্বরে ডাকলো,

-“প্রণীতা?”

-“হু।”

-“আমায় আর কখনো ভুল বুঝবে না তো? আর কখনো ছেড়ে যাবে না তো? বিশ্বাস করো,আমি মরে যাব তোমায় ছাড়া।”

প্রণীতা ফারাজের দিকে ঘুরে তার মুখে হাত দিয়ে বলে,“একদম বাজে কথা বলবে না।”

এই বলে সে ফারাজের পায়ে নিজের পা রেখে একটু উঁচু হয়ে কানে কানে বলে,

“তোমায় ছেড়ে বহুদূরে যাবো কোথায়,
একজীবনে এতো প্রেম পাবো কোথায়?”

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে