#দূরত্বের_আড়ালে
#পর্ব_৯
#লেখনীতে_মারিয়া_আক্তার_মাতিন
প্রণীতা রাগে গিজগিজ করছে। কিছুক্ষণ পর পর আড়চোখে ফারাজকে দেখছে। কে বলবে এই সুন্দর চেহারার আড়ালে কতটা ছলনা লুকিয়ে? কিছু কিছু মানুষের বাহ্যিক রূপ যতোটা চোখ ধাঁধানো হয়,ভিতরটা ততোটাই কুৎসিত হয়। এই যেমন তার পাশে থাকা মানুষটা। ফারাজকে দেখে সে প্রথমে কেমন এলোমেলো হয়ে গেছিলো। পরক্ষণেই সেদিনের ঘটনাটা মনে পড়তেই পুরোনো তেজ ফিরে আসে। একজন বিশ্বাসঘাতকের জন্য কেবল ঘৃণাই প্রযোজ্য,তারা ভালোবাসার ছায়া পাবারও যোগ্য নয়। প্রণীতা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। হাতদুটো নিশপিশ করছে। মনটা কেমন অস্থির লাগছে। ফারাজ সবকিছুই খেয়াল করলো। অতঃপর বলল,
-“গরম লাগছে? এসি ছাড়বো?”
প্রণীতা রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ফারাজের দিকে। গমগমে গলায় বলল,“গরম না, রাগ লাগছে। আপনার মুখটা দেখতেও ইচ্ছে করছে না।”
-“তো দেখো না। চোখে পট্টি বেঁধে দিবো?”
-“ফা’জ’লা’মো হচ্ছে আমার সাথে? এই আপনার সমস্যাটা কী শুনি? কোন মতলবে আবার আমার কাছে এসেছেন? কী ভেবেছেন সেদিনের এতো অপমানের পরও আমি আপনাকে ভালোবাসবো? আপনার শোকে কেঁদে কেঁদে মরব? তবে কান খুলে শুনে রাখুন,আমি এতোটাও বেহায়া নই। আমি নিজেকে ভালো রাখতে জানি,দুঃখ ভুলে হাসতে জানি। হ্যাঁ,প্রথম প্রথম আমার খুব কষ্ট হয়েছিল কিন্তু এখন আর হয় না। আমি আপনাকে ধীরে ধীরে এই মন থেকে মুছে ফেলছি,আপনার বিন্দুমাত্র অস্তিত্বও থাকবে না সেখানে।”
ফারাজের ভিতরটা হু হু করে উঠলো। বুকের ভিতর ভারী ব্যথায় মুচড়ে উঠলো। চোখের কোণে অশ্রু জমা হলে তা চটজলদি মুছে ফেলে। তারপর ভেঙে আসা গলায় বলে,“তুমি আমাকে যা খুশি তা বলতে পারো। আমি তাতে কিছুই মনে করব না। কারণ,তোমার দৃষ্টিতে আমি একজন প্রতারক,বিশ্বাসঘাতক। তো,এমন ধারণা হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এইযে বললে তুমি আমাকে মন থেকে মুছে ফেলছো? বিশ্বাস করো ঠিক এই জায়গাটায় গিয়ে কথাটা লাগলো।”
ফারাজ বুকের বাঁ পাশে হাত নিয়ে দেখালো। প্রণীতা হালকা কেঁপে উঠে। কিন্তু তা বুঝতে দেয় না। কঠোরতার আড়ালে চাপা পড়ে যায় তার মনে থাকা সূক্ষ্ম মায়াটুকু। ফারাজ আবারও বলে উঠে,“আমি তোমাকে সব সত্যি বলব। আর আমার বিশ্বাস সত্যিটা জানার পর তুমি আর আমায় ঘৃণা করবে না। আবারও আগের মতো আমায় ভালোবাসবে। তোমার সম্বোধনটা আবারও আপনি থেকে তুমি হবে।”
প্রণীতা বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল,“কীসের সত্যি বলবেন আপনি? নতুন প্রেমিকার কাছে ছ্যাঁকা খেয়ে এখন আবার আমাকে ব্যবহার করতে চাচ্ছেন সেই সত্যি নাকি নিজের বানানো কোনো মনগড়া সত্যি কোনটা?”
-“প্রণীতা! এতোটা অবিশ্বাস করো না আমায়। জাস্ট এতটুকুই বলব,আমি তোমায় ঠকাইনি। যা করেছি সব তোমার ভালোর জন্য করেছি। তোমাকে ভালোবেসে করেছি।”
-“ও,তাই? মাগো, এতো ভালোবাসা আমি কোথায় রাখি! যে ভালোবাসার জন্য আপনি আমায় চিনতেই পারলেন না,বলেছিলেন আমি কাকে না কাকে নিজের ভালোবাসার মানুষ মনে করেছি,এখন বলছেন সব আমায় ভালোবেসে করেছেন? মিথ্যে বলারও একটা লিমিট থাকে মিস্টার ফারাজ!”
আচমকা গাড়ির ব্রেক কষলো ফারাজ। তারপর বলল,“এসে গেছি।”
প্রণীতা তাকিয়ে দেখলো ভার্সিটি পৌঁছে গেছে। সময়ও হয়ে গেছে তাই দ্রুত সে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। চলে যেতে উদ্যত হলে ফারাজ পিছন থেকে ডেকে উঠে৷ অনিচ্ছা সত্ত্বেও পা দুটো থেমে যায় তার। ফারাজ পিছন থেকে বলে উঠে,“আই লাভ ইউ সো মাচ!”
প্রণীতা চোখদুটো বন্ধ করে ফেলে। এই প্রতারকটা আবারও নিজের ভালোবাসার জালে ফাঁসাচ্ছে তাকে। না,এবার আর ভুল করা যাবে না। ভুল করেছে একবারই করেছে,দ্বিতীয়বারের মতো সে আর ফাঁদে পা দিতে চায় না। সে কিছু না বলে দ্রুতপায়ে ভার্সিটির গেইটের দিকে এগিয়ে যায়৷ ক্লাস শুরু হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো কিন্তু সেদিকে মন দিতে পারছে না প্রণীতা। বারবার ফারাজের কথাগুলো মাথায় ঘুরছে। আচ্ছা,কীসের সত্যি বলতে চায় ফারাজ? সে কি একটা সুযোগ দিয়ে দেখবে? যতোই হোক,সেও তো পাগলের মতোই ভালোবাসতো ফারাজকে। তাকে ভুলতে যে কতোটা কষ্ট হচ্ছিল সেটা তো কেবল সে-ই অনুভব করেছে। উপরে উপরে সে যতোই রাগ দেখাক,ভিতরে ভিতরে তারও দহন হয়। সবগুলো ক্লাস তার অন্যমনস্কতায় কাটলো। ছুটি হলে সে ধীর পায়ে গেইট ছেড়ে বের হয়। ওমনি দেখতে পায় গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ফারাজকে। সে অবাক হয়। লোকটা এখন আবার এখানে কী করছে? তাকে দেখতে পেয়ে ফারাজ দ্রুত তার কাছে আসে। নরম সুরে বলো,“চলো,তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেই।”
প্রণীতা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,“আমি যাব না আপনার সাথে।”
-“না করো না,প্লিজ। আমি তোমার জন্য এতোক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলাম।”
-“আপনি আবার কেন আমার পিছু লাগলেন? সবেমাত্রই আপনাকে ভুলতে শুরু করলাম আর তখনি আমার জীবনে শান্তি নষ্ট করতে চলে এলেন?”
-“শান্তি নষ্ট করতে নয়,ভালোবাসতে এসেছি।”
-“যে ভালোবাসা আমায় কষ্ট দেয় সে ভালোবাসার আমার দরকার নেই।”
-“আমাদের মাঝে কত দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে তাই না প্রণীতা?”
-“দূরত্ব আপনিই তৈরি করেছেন।”
-“কিন্তু দূরত্বের আড়ালে ভালোবাসা ছিল।”
-“আপনার কথা বিশ্বাস করব কেন?”
-“তাহলে এতোদিনেও আমি তোমার বিশ্বাস অর্জন করতে পারিনি? এতোটাই খারাপ ভাবো আমায় যে আমাকে একটা সুযোগ দিতেও তোমার মন সায় দিচ্ছে না?”
প্রণীতা নিশ্চুপ হয়ে যায়। অস্থিরতা ফের শুরু হয়। বেহায়া মনটা আবারও ফারাজকে সুযোগ দিতে উঠেপড়ে লেগেছে। কী করবে সে? সত্যিটা কি শুনবে? পরক্ষণেই সেদিনের তার ক্ষতবিক্ষত মনটার কথা মনে পড়ে। নাহ! আর সুযোগ দিবে না সে। কী হবে সুযোগ দিয়ে? সেদিনের কষ্টের,তার চোখের জলের কি কোনো দাম নেই? সে আসলে বুঝতে পারছে না ফারাজ আসলে কী উদ্দেশ্যে তার কাছে এসেছে। যদি সত্যিই ভালোবেসে এসে থাকে তাহলে তাকেও সেই কষ্টটা অনুভব করতে হবে। তাকেও বুঝতে হবে সেদিন একটা মেয়ে কতোটা দুঃখ বুকে চেপে বাড়ি ফিরেছিল। প্রণীতা চোখমুখ শক্ত করে বলল,“দেখুন,আমার আপনার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছে নেই। আপনার সাথে কথা বলতেও আমার রুচিতে বাঁধছে। সো প্লিজ,আমাকে আর ডিসটার্ব করবেন না। আপনাকে জাস্ট বিরক্তিকর লাগছে।”
ফারাজ অবাক হয়ে বলল,“প্রণীতা!”
এই বলে সে প্রণীতার দিকে এক পা আগায়। তখনি প্রণীতা বলে উঠে,“খবরদার,আমার কাছে আসবেন না। আবারও কোলে নিয়ে নির্লজ্জতার পরিচয় দিবেন না আশা করি। আমাকে আমার মতো যেতে দিন। আমি আপনাকে ঘৃণা করি। প্রচুর ঘৃণা করি।”
এই বলে প্রণীতা আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। যতো দ্রুত সম্ভব সে স্থান ত্যাগ করলো। ফারাজ এবার আর তাকে আটকালো না। সে অসহায় দৃষ্টি মেলে প্রণীতার যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে। আনমনেই বলে উঠলো,“আমার দেওয়া আঘাতে তুমি বড্ড শক্ত হয়ে গেছো। কিন্তু এই আঘাতের পিছনে কারণটাই তুমি বুঝোনি।”
ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত একটি রুম। খোঁপের মতো ছোট একটি জানালা দিয়ে ভেসে আসছে দিনের হালকা আলো। যা অন্ধকারকে দূর করার বদলে আরও গাঢ় করেছে। সেই রুম জুড়ে পায়চারি করছে ইসহাক। কপালে শখানেক চিন্তার ভাজ। হঠাৎ বিকট শব্দ করে দরজা ভাঙার আওয়াজ হলো। যেন কেউ লা’থি দিয়ে দরজা ভেঙেছে। ইসহাক চমকে উঠে। কে এলো? এই গোপন জায়গার কথা তিনি আর অপর একজন ছাড়া কেউ জানেনা। সামনে তাকাতেই তিনি হাজার ভোল্টেজের শক খেলেন। বিস্ময়ে উনার চক্ষু চড়কগাছ। মুখ হতে আপনাআপনি বেরিয়ে এলো,“ফারাজ,তুমি?”
ফারাজের মুখে ফুটে উঠলো তীর্যক হাসি। সে এক পা এক পা করে ইসহাকের ঠিক সামনে দাঁড়ালো। তারপর বলল,“ভবিষ্যৎ শ্বশুরমশাই,এতোদিন তো অনেক জামাই আদর করলেন! এবার নাহয় একটু শ্বশুর আদর করি?”
রাগে ইসহাকের চোখমুখ লালবর্ণ ধারণ করেছে। সে প্রায় গর্জে উঠলো,“তুই তাহলে এখনো প্রণীতাকে ভুলিসনি?”
ফারাজের চোখমুখও এবার শক্ত হলো। কপালের রগগুলো ফুটে উঠেছে। সে ঠাণ্ডা স্বরে বলল,“এখন কেন আমি পরের জনমেও প্রণীতাকে ভুলব না।”
চলবে…….