#দূরত্বের_আড়ালে
#পর্ব_৮
#লেখনীতে_মারিয়া_আক্তার_মাতিন
প্রণীতা ব্যাগপত্র গোছাচ্ছিল ভার্সিটি যাওয়ার উদ্দেশ্যে। তখন রুমে প্রবেশ করেন হাফিজা। হাফিজাকে দেখে প্রণীতা ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,“মা,আজ ভার্সিটি যাচ্ছি। এসব ঝামেলার জন্য তো এতোদিন ভার্সিটি যেতে পারিনি। বাবা বোধহয় এখন বাসায় নেই। এসে আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলো কেমন।”
হাফিজা কেমন নিষ্পলক দৃষ্টিতে মেয়েকে দেখতে লাগলেন। যেন কিছু অনুমান করার চেষ্টা করছেন। প্রণীতা বোধহয় সে দৃষ্টি বুঝতে পারলো। জিজ্ঞেস করলো একটু অবাক হয়ে,“কী হয়েছে,মা? কিছু বলবে?”
হাফিজা প্রণীতার মাথায় হাত বুলিয়ে বড় নরম সুরে জিজ্ঞেস করলেন,“তুই কি এই বিয়েতে রাজি?”
সহসা মায়ের এরূপ প্রশ্নে প্রণীতা আশ্চর্য হলো। তার মনে পড়লো গতরাতে আহিয়ানের সাথে ফোনে কথা বলার ঘটনা। তার মনে এখন খটকা লাগছে এই ভেবে যে আহিয়ান কি সত্যিই তাকে বিয়ে করতে চায়? যদি চাইতোই তাহলে হঠাৎ ফারাজের কথা কেন তুলল? কেনই বা বলল যে ফারাজ তাকে ঠকায়নি? উনি কীসের ভিত্তিতে বললেন? প্রণীতা এখন আর এসব নিয়ে ভাবতে চায় না। মনের জল্পনাকল্পনা বাদ দিয়ে সে বলে,“রাজি না হওয়ার কোনো কারণ আছে,মা?”
-“আমি জানি তুই মন থেকে এই বিয়েতে রাজি নস। অন্তত আমাকে বুঝাতে আসিস না। কারণ,আমি তো মা। মা হয়ে সন্তানের মনের অবস্থা বুঝবো না?”
-“দেখো মা,সত্যি বলছি। ফারাজকে ভুলে যাওয়াটা আমার জন্য কষ্টদায়ক হলেও আমি আপ্রাণ চেষ্টা করছি তাকে মন থেকে মুছে ফেলার। আর এই বিয়েতেও আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। আমারও তো সুখে থাকার অধিকার আছে তাই না?”
-“আহিয়ানকে বিয়ে করলে কি তুই সত্যি সুখী হবি?”
-“হওয়ার চেষ্টা করব।”
-“সুখী হওয়া আর হওয়ার চেষ্টা করা এক নয় রে মা। আমি তোর সুখ চাই। তোর বাবা আমাকে অনেক বুঝালেও আমার মন কেন জানি বলছে তুই সত্যিকার অর্থে এই বিয়েতে রাজি নস। তোর মনে এখনও ফারাজের অস্তিত্ব আছে। তাই বলছি,মনের উপর জোর করে কিছু করিস না। দরকার পড়লে আরও সময় নে। তারপর বিয়ের কথা ভাব। তোর বাবাকে বুঝানোর দায়িত্ব আমার। তবুও মনে অশান্তি রেখে কিছু করিস না।”
প্রণীতা হাসলো। মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,“সময় নিলেই কী হবে মা? যদি আমি ফারাজকে মনে রাখতে চাই তাহলে আজীবনেও তাকে ভুলতে পারব না। তাই তো এখন থেকেই চেষ্টা করছি তাকে ভুলে যাওয়ার। তুমি হয়তো এখন বলতে পারো যে আরও কিছুদিন গেলে আমি তাকে পুরোপুরি ভুলে যাবো কিন্তু না,মা। যতো দিন যাবে একাকীত্ব আমায় গ্রাস করবে। আর এই একাকীত্বই আমাকে মনে করিয়ে দিবে যে আমি একজনকে ভালোবেসে চরমভাবে ঠকে গেছি। তাই আমার জীবনে এমন একজনের দরকার যে আমাকে ফারাজকে ভুলতে সাহায্য করবে। আর সেটা যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব হওয়া চাই।”
-“গতকাল যে আহিয়ানের সাথে দেখা করলি তারপর তো আর আমাদের কিছু বললি না। ছেলেটা কেমন রে?”
প্রণীতা বিষণ্ণ হাসলো৷ বলল,“ভালো। আমি এখন যাই,মা। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
এই বলে প্রণীতা দ্রুত বাসা ত্যাগ করে।হাফিজা নীরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মেয়েটার কষ্টের খুব দ্রুতই সমাপ্তি ঘটুক। মনে মনে এই কামনাই করেন তিনি।
প্রণীতা রাস্তার ধারে আনমনে হেঁটে যাচ্ছে। পথে রিক্সা,অটো কিছু না পাওয়ায় তাকে হেঁটে যেতে হচ্ছে। মনে মনে সে ভাবতে লাগলো,মাকে তো খুব করে বলে এলো যে জীবনে এমন একজন মানুষ দরকার যে মানুষটা তাকে ফারাজকে ভুলতে সাহায্য করবে,তাকে সুখে রাখবে। কিন্তু আহিয়ান কি সত্যিই তেমন? গতকাল পার্কে মনে হয়েছিল মানুষটা হয়তো সত্যিই তাকে ভালোবাসে কিন্তু রাতে কথা বলার পর থেকে কেমন খটকা লাগছে। তার ক্লান্ত মন এখন আর কাউকে বিশ্বাস করতে চায় না। ভয় হয়। যদি আবারও ঠকে যায়? তখন কী হবে উপায়? তারও তো একটা জীবন। একজীবনে একজনকে ভালোবেসে এর মূল্য দিতে হচ্ছে। দ্বিতীয়বারের মতো এমন ভুল আর সে করতে চায় না।
হঠাৎ তার সামনে এসে একটি গাড়ি থামলো। প্রণীতার পা যুগল থেমে যায়। অবাক দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো গাড়িটিকে। কেমন চেনা চেনা লাগছে! ও,হ্যাঁ এটা তো ফারাজের গাড়ি। ফারাজের গাড়ি এখানে কী করছে? এসব ভাবনার মাঝেই গাড়ি থেকে নেমে এলো ফারাজ। ফারাজকে দেখে তার বিস্ময়ের মাত্রা তরতর করে বৃদ্ধি পেলো। মনটা যেন থমকে গেল। সেইসাথে বাড়লো এতোদিনের বহুকষ্টে ভুলতে থাকা তীব্র যন্ত্রণা। মানুষটাকে তো সে কতো ঘৃণা করে। তবুও চোখের সামনে দেখে কেন এতো কষ্ট হচ্ছে? কেন মনের মাঝে উথাল-পাথাল ঢেউয়ের জাগরণ হচ্ছে? প্রণীতা অনুভূতিগুলো চেপে মাথা নিচু করে চলে যেতে চাইলে ফারাজ ডেকে উঠে,“প্রণীতা!”
প্রণীতা না চাইতেও দাঁড়িয়ে যায়। কতদিন পর ফারাজের কণ্ঠে নিজের নাম শুনেছে। এই কণ্ঠে যেন অজস্র মায়া মিশ্রিত। প্রণীতার কাছে যেন সব উলটপালট লাগছে। সে কিছু না বলে ফের হাঁটা ধরে। ওমনি ফারাজ তার একহাত টেনে ধরে। প্রণীতা চমকালো। বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে ফারাজের দিকে তাকায়। ফারাজ তার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। প্রণীতা একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলো তাকে। মানুষটা আগের চেয়েও যেন অধিক সৌন্দর্যের অধিকারী হয়েছে। কিন্তু এই সৌন্দর্যের মাঝেও যেন তাকে বড্ড অগোছালো,খাপছাড়া মনে হচ্ছে। প্রণীতা চোখ বন্ধ করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। অতঃপর চোখ খুলে দম নিয়ে বলে,“হাত ছাড়ুন।”
ফারাজ প্রণীতার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলো,“ছাড়ার জন্য তো ধরিনি।”
আচমকা প্রণীতার রাগ বহুগুণ বেড়ে গেল। শিরায় শিরায় খেলে গেল এক জ্বলন্ত লাভা। শরীরের প্রতিটি কোষ সেঁটে গেল এক তীব্র উত্তেজনায়। সেইদিনের মুহূর্তটা মাথার মাঝে ঘুরঘুর করছে। সে এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। কণ্ঠে বেজে উঠে আক্রোশের তীব্র ধ্বনি,“হাউ ডেয়ার ইউ টু টাচ মি,মিস্টার ফারাজ?”
ফারাজ অবাক হলো না এতে। যেন সে এরূপ আচরণ সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত ছিল। ফারাজ নরম সুরে বলল,“প্রণীতা,গাড়িতে উঠো।”
প্রণীতা হাসলো। হাসিতে স্পষ্টরূপে ফুটে উঠেছে বিদ্রুপ৷ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,“একটা অপরিচিত মেয়েকে নিজের গাড়িতে তুলবেন? এটা তো আপনার সাথে মানাচ্ছে না।”
-“দেখো,আমি তোমাকে সব বলব। তার আগে গাড়িতে উঠো। ভার্সিটিতে নিশ্চয়ই তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
প্রণীতা হাতঘড়ি দেখলো। সত্যিই আর বেশি সময় নেই। না থাকুক,তাই বলে সে ফারাজের গাড়িতে উঠবে? কখনোই না! সে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,“আপনিই আমাকে দেরি করাচ্ছেন। সরুন,আমাকে যেতে দিন।”
ফারাজ শীতল কণ্ঠে বলল,“আমি যেটা বলেছি সেটা করো,প্রণীতা। আমার কথার অবাধ্য হইও না।”
প্রণীতা আশ্চর্য হলো। লোকটা আজ তার উপর কীসের অধিকার দেখাচ্ছে? সেদিনের কথাগুলো কি মনে নেই? প্রণীতা পূর্বের চেয়েও দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বলল,“আপনার মতো এমন নি’র্ল’জ্জ,বে’হ’য়া লোক আমি আর দুটো দেখিনি। লজ্জা করেনা আপনার? সেদিন আমাকে এতো অপমান করলেন,আমাকে তো চিনতেই পারলেন না। আর আজ যেচে এসে নিজের গাড়িতে বসতে বলছেন? কী ভেবেছেন আপনি আদেশ করবেন আর আমিও ধেইধেই করে গাড়িতে উঠে পড়ব? শুনুন,আমার আর কিছু না থাকুক আত্মসম্মানবোধ আছে। তাই সেই সম্মানবোধের জন্যই আপনার গাড়িতে নিজের একটা স্পর্শও লাগতে দিব না।”
এই বলে প্রণীতা হাঁটা শুরু করলে ফারাজ চটজলদি তাকে পাঁজা কোলে তুলে নেয়। ফারাজের এমন কাণ্ডে প্রণীতা হতভম্ব। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো কিছুসংখ্যক মানুষ তাদের দিকেই তাকিয়ে। লোকলজ্জার ভয় তাকে আকড়ে ধরলো। সেই সাথে সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠলো রাগের অগ্নিশিখায়। সে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করতে থাকলে ফারাজ বলে,“বেশি ছটফট করলে শান্ত করার উপায়ও আমার জানা আছে। তবে লোকজনের সামনে আমি সেই উপায়টা প্রয়োগ করতে চাইছি না। তাই চুপচাপ আমি যা বলছি তা মেনে নাও।”
কথাটুকু শেষ করে ফারাজ দ্রুত পায় নিজ গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। প্রণীতাকে গাড়িতে বসিয়ে নিজেও বসে পড়ে ড্রাইভিং সিটে। প্রণীতাকে আড়চোখে একবার পরখ করে চটজলদি গাড়ি স্টার্ট দেয়। যেটি চলতে থাকে শো শো বেগে।
চলবে……..