#দূরত্বের_আড়ালে
#পর্ব_৬
#লেখনীতে_মারিয়া_আক্তার_মাতিন
প্রণীতা তরতর করে ঘামছে। সে যে বেশ ঘাবড়ে গেছে তার ছাপ মুখমণ্ডলে স্পষ্টরূপে দৃশ্যমান। কে দিলো এমন ম্যাসেজ? আহিয়ান কোথায় গেছে? উনার কী হবে? প্রণীতার নিজেকে ভারসাম্যহীন মনে হতে লাগলো। সে অস্থিরচিত্তে ভাবতে লাগলো বর্তমান করণীয় সম্পর্কে। সে দ্রুত সেই নাম্বারে ম্যাসেজ দিলো,“কে আপনি?”
কিন্তু দুর্ভাগ্য কোনো রিপ্লাই এলো না। সে আবারও ম্যাসেজ দিলো,“দেখুন,উনার কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করবেন না। তাহলে কিন্তু ভালো হবে না বলছি।”
এবার রিপ্লাই এলো,“কী করবেন শুনি?”
-“সেটা আপনাকে বলতে বাধ্য নই আমি। আপনি কে সেটা বলুন। আর উনাকে কেন মারতে চান?”
-“উনি আমার ব্যক্তিগত সম্পদ চুরি করেছে তাই।”
প্রণীতা অবাক হয়। আহিয়ান চুরি করেছে? আহিয়ানকে দেখে তো তেমন মনে হয়নি। তাকে ভালো,ভদ্র ঘরের ছেলে মনে হয়েছে। তার দ্বারা কী করে চুরি করা সম্ভব? সে দ্রুত আঙুল চালিয়ে টাইপ করলো,“আপনার কথা আমি কেন বিশ্বাস করব? উনি চোর হতেই পারেন না।”
-“খুব বিশ্বাস করেন বুঝি? তা কতদিন হলো উনার সাথে আপনার পরিচয়? আর উনি আপনার কে হয় যে উনার উপর এতো বিশ্বাস?”
প্রণীতা থমকালো। আসলেই তো,আহিয়ানকে তো সে তেমন ভালো করে চেনেই না। যতটুকু চেনে তা সম্পূর্ণ বাবার কাছ থেকেই। হাফিজ প্রায় সময়ই আহিয়ানের গুণগান গাইতো। ছেলেটা দেখতে ভালো,স্বভাব-চরিত্রে ভালো,সবদিক দিয়েই পার্ফেক্ট। সে তো সেই ছোটবেলায় একবার যা দেখেছিল তারপর তো বোধহয় আহিয়ানের মুখটাও দেখেনি সে। কিন্তু তাই বলে সে চুরির মতো এতো জঘন্য একটা কাজ করবে? তার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। প্রণীতা বুদ্ধি খাটিয়ে এবার ম্যাসেজ দিলো,“আপনার ব্যক্তিগত সম্পদটা কী শুনি? উনি আপনার কী এমন চুরি করেছে যে আপনি উনাকে একদম জানে মেরে ফেলতে চান?”
অপর পাশে নিস্তব্ধতা। মিনিট কয়েক পর রিপ্লাই এলো,“সেটা আপনার না জানলেও চলবে। সম্পদের আগে যেহেতু ব্যক্তিগত ট্যাগ লাগিয়েছি সেহেতু আপনার বুঝা দরকার যে কারো ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করতে নেই। এখন আপনি আমার কথা শুনে বাড়ি যাবেন কিনা সেটা বলুন।”
প্রণীতার রাগ বাড়লো। রাগান্বিত হয়ে রিপ্লাই দিলো,“আমার বাড়ি ফেরার সাথে উনাকে বাঁচিয়ে রাখার কী সম্পর্ক বুঝলাম না। আর আপনি আমার নাম্বার কীভাবে পেলেন? কে আপনি দয়া করে বলুন।”
ম্যাসেজটা সেন্ড করে প্রণীতা সব জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। নাহ! কোথাও তো আহিয়ান নেই। সেই ছেলেটা কোথায় ডেকে নিয়ে গেল? এই বয়সেই এমন ক্রিমিনালের সাথে জড়িত ভাবতেই প্রণীতার গা রিনরিন করে উঠে। নিজের উপর রাগটা তিরতির করে বাড়ছে। সে কেন বলল যেতে! কেন! ইশ! লোকটা এখন কোথায় আছে,কী অবস্থায় আছে কিছুই তো জানতে পারছে না। আজ তার জন্যই এমন হয়েছে। সে যদি তখন না যেতে বলত তাহলে আহিয়ানও যেত না,আর না এমন ঝুঁকির মুখে পড়ত। তার খারাপ লাগছে এটা ভেবেই যে আজ তার জন্য একজন মৃত্যুুর মুখে। আচ্ছা,লোকটা যে বলল তাকে বাড়ি চলে যেতে,বাড়ি চলে গেলেই কি আহিয়ানকে ছেড়ে দিবে? সে তো লোকটার কথা বিশ্বাসও করতে পারছে না। পরে বাড়ি যাওয়ার পরও যদি না ছাড়ে তখন? তখনই তার ফোনে ম্যাসেজ আসে,“কী হলো,কী ভাবছেন? যদি আহিয়ানকে বাঁচাতে চান তাহলে এখন সুরসুর করে বাড়ি যান। নতুবা কী করব বুঝতেই পারছেন। আর হ্যাঁ,কোনোপ্রকার চালাকি করার চেষ্টা করবেন না। ফল কিন্তু ভালো হবে না।”
প্রণীতা তৎক্ষনাৎ রিপ্লাই দেয়,“আপনাকে আমি কেন বিশ্বাস করব? পরে আমি বাড়ি যাওয়ার পরও যে উনার কোনো ক্ষতি করবেন না তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে?”
-“আমি আমার কথায় অটল থাকি। কথার খেলাপ করি না। বাকিটা আপনার ইচ্ছে।”
প্রণীতা ভাবলো তাহলে বাড়িই যাওয়া যাক। অন্তত একজনের প্রাণ বাঁচুক। সে চায় না তার জন্য কারও প্রাণ যাক। আজ আহিয়ানের জন্য তার অস্থির লাগছে কাল আহিয়ানের জায়গায় অন্য কেউ হলেও এমন অস্থির ভাবই হতো। সবশেষে,আমরা মানুষ। আর মানুষ মানুষের জন্যে৷ নিজের জন্য কারও ক্ষতি হোক সেটা প্রণীতা কখনোই চায় না। সে একবার ভেবেছিল পুলিশকে ইনফর্ম করবে পরক্ষণেই ভাবলো এতে যদি হিতে বিপরীত হয়?একা একা এমন পদক্ষেপ নেওয়া ঠিক হবে না। তার চেয়ে বরং লোকটার কথা বিশ্বাস করে বাড়ি যাওয়া যাক। এরপরও যদি আহিয়ানকে না ছাড়া হয় তখন সে বাবা-মায়ের সহায়তায় কঠোর পদক্ষেপ নিবে।
নিভু নিভু হলদে আলোয় পূর্ণ একটি বদ্ধ ঘর। চারপাশ থেকে ভেসে আসছে কেমন একটা ভ্যাপসা ঘ্রাণ। তার মাঝেই একটা কাঠের চেয়ারে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে আহিয়ান। আহিয়ান ধীরে ধীরে চোখ খুলল। চোখ খুলতেই সবকিছু কেমন ঝাপসা ঠেকলো তার কাছে। মাথাটা ভারী হয়ে আছে। সে উঠতে চাইলো কিন্তু পারলো না। খেয়াল করে দেখলো তার হাত-পা চেয়ারের সাথে বাঁধা। নিজেকে এমন উদ্ভট পরিস্থিতিতে দেখে ঘাবড়ে গেল সে৷ তখনই তার মনে পড়লো বিকেলের সেই ঘটনা।
আহিয়ান ছেলেটির কথামতো তার দেখানো অনুযায়ী স্থানেই গিয়েছিল। ছেলেটি তাকে একটি জনশূন্য পথে নিয়ে যায়। সে জায়গাটি ছিল একদম সুনশান-নিস্তব্ধ। পার্ক থেকে বেশ কিছুটা দূরে। একটা কাকপক্ষীও নেই যেন। আহিয়ান বিরক্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ছেলেটিকে বলে,“এখানে আনলে কেন? সাহায্য চাওয়ার জন্য মানুষ এতদূরে নিয়ে আসে? অদ্ভুত!”
ছেলেটি কিছু বলে না। মাথার পিছনে হাত দিয়ে কেবল চারপাশ দেখতে থাকে। আহিয়ান ফের বলে,“আর তুমি আমাকে চিনো কীভাবে বললে না তো? আসতে আসতে কতোবার জিজ্ঞেস করলাম কিছুই তো বললে না। মুখে কুলুপ এঁটেছো নাকি?”
ছেলেটি তখনও নিরুত্তর। ছেলেটির নিরবতা আহিয়ানের রাগ বৃদ্ধি করলো। সে পার্ক থেকে আসতে আসতে কতোবার ছেলেটিকে প্রশ্ন করেছে। অথচ একটা প্রশ্নেরও উত্তর দেয়নি সে। শুধু একবার ছেলেটি তার নাম জানতে চেয়েছিল। সে ও ভেবেছিল নাম বললে হয়তো প্রশ্নের উত্তর পাবে তাই সে তার নামটা বলে। কিন্তু না তার আশা বিফলেই পতিত হলো৷ আহিয়ান এবার বেশ উচ্চস্বরেই বলে উঠলো,“এই ছেলে তোমার মতলবটা কী শুনি? কীসের জন্য আমাকে এখানে এনেছো? বলো!”
শেষের কথায় প্রায় ধমকে উঠে আহিয়ান। আহিয়ান হঠাৎ খেয়াল করে রাস্তার অপরপাশে একটি কালো গাড়ি রাখা। সে বিষয়টাকে নিয়ে মাথা ঘামায় না। কার না কার গাড়ি থাকতেই পারে। সে বিরক্তি নিয়ে কিছু বলতে যাবে তখনই পিছন থেকে রুমাল দিয়ে কেউ তার মুখটা চেপে ধরে। ওমনি সে জ্ঞান হারায়। আর জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে এই অবস্থায় আবিষ্কার করে৷ তার তখনই সন্দেহ হয়েছিল ছেলেটিকে। ছেলেটি কোনো ভালো মতলবে আসেনি৷ কেন যে সে তার কথা শুনতে গেল! হঠাৎ আহিয়ান কারো হাঁটার আওয়াজ শুনতে পায়৷ ধুপধাপ আওয়াজ ফেলে কেউ তার দিকেই এগিয়ে আসছে। তার নত করে রাখা মুখটা উঁচু হয়। ততক্ষণে কেউ একজন তার সামনে চেয়ার পেতে পায়ের উপর পা রেখে বসে। আহিয়ান চোখদুটো ভালো করে মেলে দেখতে পায় একজন অজ্ঞাত লোককে। কোনোরকম বলার চেষ্টা করে,“আপনি কে?”
এক সেকেন্ড,দুই সেকেন্ড! এরপরই ভেসে আসে একটি ঠাণ্ডা শীতল কণ্ঠস্বর,“আহসান চৌধুরী ফারাজ!”
চলবে…….