#দূরত্বের_আড়ালে
#পর্ব_৪
#লেখনীতে_মারিয়া_আক্তার_মাতিন
বেশ অনেকক্ষণ ধরে পার্কে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনছে প্রণীতা। হাতে থাকা ঘড়িটির দিকে তাকালো। সময় ৩টা বেজে ৩০মিনিট। মানে,আধঘন্টা লেইট! মনে মনে অবশ্য বিরক্ত হলো না সে। বসে থাকতে তার মন্দ লাগছে না। এখানে তার কতো প্রেমময়,সুখময় স্মৃতি। সেই স্মৃতির পাতায় ডুবে পূর্বের মুহূর্তগুলোর স্মৃতিচারণ করছে সে। অন্তরের গহীনে লুকিয়ে থাকা দীর্ঘশ্বাসটুকু ফোস করে ছাড়লো। এখন আর সেসব মনে করে কী লাভ? জীবনে যা হারাবার তা তো হারিয়েছেই। চাইলেই কি আর ফিরে আসবে? তবুও কেন জানি,আজ পুরোনো স্মৃতিগুলোর উপর থেকে পর্দা সরে গিয়ে স্বচ্ছ আয়নার মতো জ্বলজ্বল করছে সেগুলো। দিনকে দিন ফেলে আসা স্মৃতির উপর ধুলো পড়ে,তবে মন থেকে মুছে যায় না কখনো। একসময় না একসময় সেগুলো স্পষ্ট রূপে হানা দেয় চিত্তমাঝারে। আচমকাই চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেইদিনের মুহূর্তটা যেদিন ফারাজের সাথে তার প্রথম দেখা হয়েছিল।
সেদিন ছিল রবিবার। প্রণীতাদের বাড়িতে অতিথির বাহার। তার খালাতো বোন,বোনের শ্বশুরবাড়ির লোকজন সকলের সম্মিলিত উপস্থিত তাদের বাড়িতে। সেই উপলক্ষে জম্পেশ খাওয়াদাওয়া চলছিল। প্রণীতার খালাতো বোনের মেয়ে রিমি হঠাৎ বায়না ধরলো সে প্রণীতার সাথে পার্কে ঘুরতে যাবে। প্রণীতার এসব পার্কে যাওয়ার প্রতি কোনো আগ্রহ নেই,ছোট থাকতে সেই কবে না কবে গিয়েছিল,কিন্তু ভাগ্নির আবদারও ফেলতে পারছিল না। এমন আদুরে মেয়ে শখ করে আবদার করেছে আর সে সেটা পূরণ করবে না? সেটা কখনোও হয়? তাই সেদিন বিকেলে রিমিকে সাথে নিয়ে শিশুপার্কে ঘুরতে এসেছিল। পার্ক মানেই নানারকম মানুষের সমাহার। গাছগাছালিতে চারপাশ ভরপুর। আশপাশ থেকে ভেসে আসছে বিভিন্ন রাইডে চড়া শিশুদের মনমাতানো উচ্ছ্বাস। ধারে ধারে বিক্রি হচ্ছে ফুচকা,চটপটি,আচার,আইসক্রিম। রিমি বায়না ধরলো সে ও রাইডে চড়বে। প্রণীতাও একবাক্যে রাজি হয়ে গেল। ছোটদের আনন্দে সে কোনোরূপ বাঁধা সৃষ্টি করতে চায় না। রিমি পছন্দের রাইড হিসেবে বেবি কার সিলেক্ট করলো। সে গিয়ে বেবি কারে চড়ে বসে। সেখানে আরও বাচ্চারা বেবি কার চালাচ্ছে। রিমি শুরুতে খুব আনন্দ,উত্তেজনার সহিত বেবি কারে চড়াটা উপভোগ করলেও কিছুক্ষণ পর পিছন থেকে কেউ একজন বারবার তার কারে ধাক্কা দিচ্ছে। সে পিছু ঘুরে দেখে তারই সমবয়সী একজন ছেলে স্বেচ্ছায় এমন করছে। রিমি রেগে গিয়ে বলল,“তুমি আমার কারে ধাক্কা দিচ্ছো কেন?”
সেই ছোট ছেলেটিও বলে উঠলো,“এটা কি তোমার কার নাকি? আমি একশোবার ধাক্কা দিবো।”
এই বলে ছেলেটি আরও জোরে ধাক্কাতে শুরু করলো। ফলস্বরূপ রিমি ভয় পেয়ে কান্না শুরু করে। প্রণীতা তা লক্ষ্য করে যেই না রিমির কাছে যাবে তার আগেই কেউ একজন সেখানে গিয়ে রিমিকে কোলে করে নিয়ে আসে। সাথে সেই ছেলেটিকেও কান ধরে নিয়ে আসে। রিমি কান্না করতে করতে প্রণীতার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে,“আংকেল,ওইযে আমাকে সেখানে নিয়ে যাও।”
পুরুষটি তা অনুসরণ করে প্রণীতার কাছে আসে। রিমিকে কোল থেকে নামিয়ে চোখ হতে সানগ্লাস খুলে বলে,“এইযে আপনার মেয়ে। আসলে,আমার ভাইয়ের ছেলেটা দুষ্টুমি করে বারবার আপনার মেয়ের কারে ধাক্কা দিচ্ছিল। যার দরুণ বাচ্চা মেয়েটা ভয় পেয়ে যায়। কিছু মনে করবেন না আপনি। আমি ওর হয়ে মাফ চেয়ে নিচ্ছি।”
এই বলে ছেলেটির কানে মোচড় দিয়ে বলল,“তোর বাঁদড়ামি করার স্বভাবটা আর গেলো না!”
ছেলেটি কাঁদো কাঁদো ফেইস করে বলল,“আহ! লাগছে চাচ্চু। আমার ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো এমন হবে না।”
-“এক্ষুণি তাহলে এই মেয়েটার কাছে মাফ চা।”
-“কী! এই আদিব ফারহান একটা মেয়ের কাছে মাফ চাবে? কাভি নেহি! আমার কি মানসম্মান বলতে কিছু নেই?”
প্রণীতা ছেলেটির দিকে অঢেল বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। এতটুকু পুচকে ছেলে অথচ কথার কী ধাঁচ! তবে,আজকালকার ছেলেপুলেরা এমনই। এ নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই। পুরুষটি চোখ পাকিয়ে বলল,“তুই তাহলে মাফ চাবি না? ঠিক আছে,আমি ভাবিকে ফোন করছি।”
ছেলেটি তৎক্ষনাৎ পুরুষটির হাত ধরে বলল,“না,না আম্মুকে ফোন করো না চাচ্চু। এইযে,আমি এক্ষুণি মাফ চাচ্ছি।”
অতঃপর ছেলেটি গোমড়ামুখ করে রিমির দিকে তাকিয়ে বলল,“সরি,আমার ভুল হয়ে গেছে।”
রিমি প্রণীতাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়েছিল। ছেলেটির কথায় একবার তার দিকে তাকিয়ে মুখে ভেংচি কেটে ফের মুখ ঘুরিয়ে নেয়। প্রণীতা বলল,“আপনি শুধু শুধু ছেলেটার সাথে এমন করলেন। বাচ্চা মানুষ একটু আকটু দুষ্টুমি তো করবেই।”
পুরুষটি জবাব দিলো,“সব জায়গায় দুষ্টুমি করা সাজে না মিসেস। যাই হোক,নিজের মেয়েকে একটু দেখে দেখে রাখবেন। ছোট মানুষ এদিক ওদিক ছুটোছুটি করতে গিয়ে কোথায় চলে যায় তার তো ঠিক নেই।”
প্রণীতার এতোক্ষণে মাথায় এলো, আরে লোকটা সেই শুরুতেও বলেছে আপনার মেয়ে, এখনও বলছে। আচ্ছা,তাকে দেখে কি একবাচ্চার মা মনে হচ্ছে? যেখানে তার ফ্রেন্ডসরা বলে তাকে এখনো বাচ্চা বাচ্চা লাগে সেখানে কিনা এই লোক পুরোই তাকে বাচ্চার মা বলে সম্বোধন করছে? লোকের কি চোখদুটো কানা? তাকে কোনদিক দিয়ে এমন মনে হয়? যদিও খালারা মায়ের মতো তাই বলে কি লোকের চোখে কোনো আন্দাজ নেই? প্রণীতার ভিতর ভিতর রাগ হলেও তা সামলে নিয়ে বলল,“ও আমার ভাগ্নি রিমি। আমার খালাতো বোনের একমাত্র মেয়ে।”
পুরুষটি বলল,“ওহ আচ্ছা। সরি,আমি তো ভেবেছিলাম আপনার মেয়ে মনে হয়।”
প্রণীতা কিছুটা তেজপূর্ণ কণ্ঠে বলল,“আপনার কি আমাকে দেখে বাচ্চার মা মনে হয়? আর একটু আগে আপনি আমাকে মিসেস বললেন না? ওটা মিসেস নয়,মিস হবে।”
-“ওহ,আই সি! রাগ করলেন বুঝি?”
প্রণীতা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,“না।”
-“আমার মনে হচ্ছে আপনি রাগ করেছেন। চলুন,আপনার রাগ ভাঙাই।”
-“মানে?”
-“মানে চলুন, আপনাদের আজ ফুচকা খাওয়াবো।”
-“লাগবে না।”
-“কেন? ফুচকা খেতে পছন্দ করেন না? আমি যতদূর জানি মেয়েরা ফুচকা খেতে বেশ পছন্দ করে।”
-“মেয়েদের নিয়ে গবেষণা করেন নাকি?”
-“এটাও গবেষণার জিনিস? রাস্তাঘাটে মেয়েদের অহরহ ফুচকা খেতে দেখা যায়। ইভেন,আমার ভাবিও ফুচকা বলতে অজ্ঞান।”
শেষোক্ত কথাটি শুনে প্রণীতা হেসে ফেলল। সেই হাসির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সামনে থাকা পুরুষটি। মুহূর্তের মাঝেই নিজেকে সামলে নিলো সে। তারপর বলল,“আপনার হাসা শেষ হলে চলুন।”
প্রণীতা হাসি থামিয়ে বলল,“না,না। আপনি যান। আমি এখন এসব খাবো না।”
-“আপনার রাগ ভাঙানোর একটি সুযোগ তো দিন।”
-“আমি রাগ করিনি তো!”
-“করেছেন। যদি আপনি না খান তাহলে বিষয়টা আরও স্পষ্ট।”
প্রণীতা পড়লো বিপাকে। আচ্ছা লোক তো! সে বারবার বলছে খাবে না তবুও জোর করছে। এভাবে খানিক সময়ে একটা মেয়ের সাথে কথা হলো আর মুহূর্তের মাঝেই তার রাগ ভাঙানোর জন্য একদম ফুচকার অফার! প্রণীতা মনে মনে গর্ববোধ করলো। মেয়ে মানুষের কতো দাম! আজ যদি তার জায়গায় একটা ছেলে থাকতো? তাহলে সেও কি এমন অফার পেতো? কখনোই না। প্রণীতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,“বেশ,চলুন।”
প্রণীতার উত্তরে পুরুষটির মুখে হাসি ফুটল। তাদের থেকে কিছুটা দূরেই একটি ফুচকার দোকান। সেখানে যেতে যেতে পুরুষটি বলল,“আপনার পরিচয়টাই যে জানা হলো না।”
প্রণীতা বলল,“আপনি আগে পরিচয় দিন। তারপর আমি।”
-“বেশ। আ’ম আহসান চৌধুরী ফারাজ। এন্ড ইউ?”
-“মাহিরা রহমান প্রণীতা।”
-“বাহ! নাইস নেইম!”
-“থ্যাংকস!”
হঠাৎ চোখের সামনে কারও তুড়ি বাজানোতে প্রণীতার ধ্যান ভাঙে। সামনে অপরিচিত একজন পুরুষকে দেখে কিছুটা বিব্রত হলে পুরুষটি বলল,“সরি,লেইট হয়ে গেলো। রাস্তায় এতো জ্যাম! কী আর বলবো! যাই হোক,আমি আহিয়ান। আমাকে চিনতে পেরেছো প্রণীতা?”
প্রণীতা মনে করার চেষ্টা করে৷ রহমান চাচা তার বাবার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই সুবাদে একে অপরের বাসায় প্রায়ই আসা-যাওয়া হতো। প্রণীতা ছোট থাকতে একবার আহিয়ানকে দেখেছিল। বড়ো হওয়ার পর সে কখনো দেখেনি। তাই প্রথমে চিনতেও পারেনি। সে সৌজন্যমূলক হেসে বলল,“আমি তো আপনাকে সেই ছোটবেলায় দেখেছিলাম। তাই চিনতে পারিনি।”
আহিয়ান প্রণীতার পাশে বসলো। প্রণীতার দিকে তাকিয়ে বলল,“আমি কিন্তু তোমাকে খুব ভালো করেই চিনি। জানো,আঙ্কেল আমাকে তোমার ফোন নাম্বারও দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমি নেইনি। কেন জানো?”
প্রণীতা কোনো আগ্রহবোধ করছে না কথা বলতে। তবুও মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আস্তে করে বলল,“কেন?”
-“আমি প্রথমে তোমার মনে স্থান করে নিতে চাই প্রণীতা। মানুষটা আগে আমার হোক,ফোন নাম্বার তো পরের আলাপ।”
প্রণীতা অবাক হয়ে তাকালো আহিয়ানের দিকে। এই লোকটার কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন তাকে আগে থেকেই ভালোবাসতো। আহিয়ান জিজ্ঞেস করলো,“প্রণীতা,তুমি কি এই বিয়েতে রাজি?”
প্রশ্নটা যেন প্রণীতার কলিজায় লাগলো। তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করলো,“না,আমি রাজি নই। আপনি চলে যান। আপনি এই বিয়ে ভেঙে দিন। আমি একজনকেই ভালোবাসি।”
কিন্তু আফসোস সে তা বলতে পারলো না। আচমকা সে তার হাতের উপর কারো হাতের ছোঁয়া পেল। তাকিয়ে দেখতে পেল আহিয়ান তার হাত রেখেছে। আহিয়ান প্রণীতার চোখের দিকে চোখ রেখে বলল,“আঙ্কেল আমায় বলেছিলেন তুমি এই বিয়েতে রাজি। তবুও আমি তোমার মুখ থেকে শোনার জন্য ছুটে এসেছি। প্রণীতা,বিয়ে আমাদের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা কোনো ছেলেখেলা নয়। বিয়ের বাঁধনে একবার আটকা পড়লে সেখান থেকে আর ছুটে আসা যায় না। তাই,তুমি সম্পূর্ণ মন থেকে জবাব দিবে,তুমি কি এই বিয়েতে রাজি?”
প্রণীতার খুব কান্না পাচ্ছে। এই কথাগুলো তো সে অন্য একজনের মুখ থেকে শুনতে চেয়েছিল কিন্তু ভাগ্য তার সাথে একি নির্মম খেলা খেলল! প্রণীতা নিজেকে খুব কষ্টে সামলে নিয়ে বলল,“আমি রাজি।”
আহিয়ান স্বস্তির শ্বাস ফেলল। বুকের উপর থেকে ভারী পাথরটা যেন সরে গেল। সে প্রণীতার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,“সত্যি বলছো তো?”
-“হু।”
-“দেখো,একবার বিয়ে হয়ে গেলে আমি কিন্তু তোমায় আর ছাড়ছি না। তুমি তখন চাইলেও আমার,না চাইলেও আমার।”
বহুদিন পর শিশুপার্কে পা রাখলো ফারাজ। এখানে,তার আর প্রণীতার কতো স্মৃতি। এখানেই তাদের প্রথম দেখা। সেই স্মৃতিগুলো,অনুভূতিগুলো অনুভব করতেই তার এখানে আসা। এইযে পার্কে আসলো? মনে হচ্ছে প্রণীতা এখানেই আছে,তার চারপাশে কোথাও হয়তো। সে হাঁটতে হাঁটতে আরও কিছুটা এগোলো। হঠাৎ সামনে চোখ পড়তেই বিস্ময়ে থ বনে যায় ফারাজ। সে ভাবতে পারছেও না প্রণীতা এখানে। প্রণীতার পাশে অপর একটা ছেলেকে দেখে তার বিস্ময়ভাব যেন আকাশ ছোঁয়। সে সত্যি দেখছে তো? এমনও তো হতে পারে প্রণীতার মতো দেখতে অন্য কেউ? সে আরও কিছুটা এগিয়ে তাদের দৃষ্টির আড়ালে দাঁড়ায়। এবার স্পষ্টই দেখতে পারছে তার প্রাণপ্রিয় প্রেয়সীকে। কিন্তু পাশে বসা ছেলেটা কে? আগে দেখেছে বলে তো মনে হচ্ছে না। ঠিক তখনই তার দৃষ্টি গেলো,ছেলেটা প্রণীতার হাত ধরে আছে। এটা দেখামাত্রই তার চোখদুটো জ্বলে উঠে। এতো সাহস? প্রণীতার হাত ধরা? রাগে সে হাসফাস করতে থাকে। পরক্ষণেই সে এমন একটা দৃশ্য দেখলো যা সে কল্পনাও করতে পারেনি।
চলবে……….