দূরত্বের আড়ালে পর্ব-০৩

0
25

#দূরত্বের_আড়ালে
#পর্ব_৩
#লেখনীতে_মারিয়া_আক্তার_মাতিন

নিজ বাড়িতে পা রাখা মাত্রই একজোড়া হাত আগলে নেয় ফারাজকে। ফারাজের বুঝতে বিশেষ অসুবিধা হলো না এই হাতজোড়ার মালিক কে৷ সে হেসে নিজেও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,“মা,কেমন আছো?”

ফারাজের মা মহিমা চৌধুরী বলেন,“তোকে ছাড়া ভালো থাকি কীভাবে বাপ? কেন সেদিন আমাদের ছেড়ে এভাবে চলে গেলি? কোনো কারণ ছাড়া কেউ এভাবে চলে যায়? আমাদের তোকে ছাড়া থাকতে কতো কষ্ট হচ্ছিল জানিস?”

ফারাজ মায়ের বাঁধন ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তারপর মনে মনে আওড়ালো,“যার জন্য এই দেশ ছেড়েছিলাম,তাকেই যে কষ্ট দিয়ে এলাম।”

মহিমা ফের বললেন,“কীরে,কথা বলছিস না কেন?”

-“মা,তোমার সব প্রশ্নের উত্তর আমি দিবো। এখন আমার একটু রেস্টের প্রয়োজন। আর হ্যাঁ,আমি এখন কিছু খাব না। বাইরে মিরাভের সাথে খেয়ে এসেছি। তার সাথে ঘুরতে গিয়েই বাড়ি পৌঁছাতে দেরি হলো। যাই হোক,আমি এখন ঘরে গেলাম।”

কথা শেষ করে ফারাজ দ্রুত পায়ে নিজ ঘরের দিকে এগোলো। সে আগে থেকেই অবগত ছিল যে বাড়িতে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই তাকে একগাদা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। আপাদত সে কিছুই খোলাসা করতে চাচ্ছে না। গুটিটা আরেকটু সাজিয়ে নিক,তারপরই দেখা যাবে আসল খেলা। ভাগ্যিস,মা বাদে বাড়িতে এখন আর কেউ ছিল না। নাহলে প্রশ্ন শুনতে শুনতেই তার কানের বারোটা বাজতো।

মহিমা ছেলের যাওয়ার পানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। উনার কেন জানি মন বলছে,ফারাজ ভালো নেই। তার মাঝে অনেক কষ্ট আছে,দুঃখ আছে। মায়ের মন তো,সন্তানের চোখমুখ দেখেই বুঝে ফেলেন তার অন্তরের খবর। এইযে,এতোক্ষণ হাসিমুখে কথা বলল? সে হাসিটাও যেন বিষাদের হাসি। ভিতর থেকে টেনে হিঁচড়ে আনা এক টুকরো হাসি। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আজকাল নিজের সন্তানকে বুঝতে পারাটাও কেমন দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ফারাজ নিজ রুমে এসে বিছানায় বসল। বুকটা কেমন খাঁ খাঁ করছে তার। মনের অজান্তেই চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। যতোবার প্রণীতার কথা ভাবে ততোবারই মনে হয় কে যেন তার বুকে আঘাত করছে। পরক্ষণেই একজনের কথা ভাবতেই তার চোখমুখ শক্ত হয়ে যায়। বিড়বিড় করে বলে,“আপনার খেলা শেষ। এবার আমার খেলা শুরু।”

প্রণীতার বাবা-মা বেশ অবাক হলেন মেয়ের থেকে ইতিবাচক উত্তর পাওয়ায়। উনারা ভেবেছিলেন মেয়ে হয়তো কেঁদেকেটে ভাসাবে,নতুবা তাদের উপর অভিমান করবে,রাগ করবে। কিন্তু তার একটাও যখন ঘটলো না তারা যেন তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। যাই হোক,মেয়েটা রাজি হলো তো। মেয়ের সুখেই তাদের সুখ। উনাদের বিশ্বাস আহিয়ানের সাথে প্রণীতা সুখী হবে। ছেলেটা দেখতে শুনতে যেমন ভালো তেমনই বেশ অর্থের মালিক। কোনোদিক দিয়ে তাদের মেয়েকে অপূর্ণ রাখবে না। ইসহাক যখন আহিয়ানের সাথে প্রণীতার বিয়ের কথা তুলল তখন হাফিজার খানিক ভয় হয়েছিল এই ভেবে যে ছেলেটা কি তার মেয়েকে ভালো রাখতে পারবে? সত্যিকার অর্থে ভালোবাসবে তো? নাকি ফারাজের মতোই ধোঁকা দিয়ে চলে যাবে? কিন্তু ইসহাকের আশ্বাসে উনার ভীতি কিছুটা হ্রাস পায়। ইসহাক বোঝান,ছেলেটা আসলেই অনেক ভালো। প্রণীতা আগলে রাখবে সে।

মাঝে একদিন কাটে। ইসহাক চাচ্ছেন,প্রণীতা খুব দ্রুত তার জীবনে মুভ অন করুক। আর কোনো কষ্টের ছায়া তার জীবনে না পড়ুক। আর এর জন্য একমাত্র মাধ্যম হলো আহিয়ানের সাথে যতদ্রুত সম্ভব বিয়ে দেওয়া। সকালে নাস্তা খেতে বসলে ইসহাক বলেন,“প্রণীতা,তোকে একটা কথা বলতাম। রাগ করবি না তো?”

প্রণীতা খাবার চিবোতে চিবোতে বলল,“বলো।”

-“আহিয়ান তোর সাথে দেখা করতে চাচ্ছিল। মানে,বিয়ের আগে ছেলেমেয়েদেরও তো একটা মতের বিষয় থাকে। তুই এই বিয়েতে রাজি কিনা সে জানতে চাচ্ছিল। আর তাই সে তোর পছন্দের কোনো জায়গায় দেখা করার কথা বলেছে। তুই দেখা করবি?”

-“আশ্চর্য! আমি তো তোমাদেরকে বলেছিই যে আমি এই বিয়েতে রাজি। তাহলে আবার দেখা কেন করতে হবে?”

-“আমিও তাকে ফোনে এ কথা বলেছি। কিন্তু সে তোর মুখ থেকে কথাটা শুনতে চাচ্ছে। আর এমনিতেও ছেলেটার সাথে দেখা করলে সমস্যা কোথায়? দুইদিন পর যাকে বিয়ে করবি তার সাথে একদিন দেখা করতেই পারিস। তাহলে তুইও বুঝতে পারবি ছেলেটা কেমন।”

প্রণীতার কাছে এই বিয়ের ব্যাপারটা বিষের মতো অসহ্য লাগে। কিন্তু জেদের বশে সে আজ সব মেনে নিয়েছে। সে কাউকে দেখিয়ে দিতে চায় তাকে ছাড়াও প্রণীতা থাকতে পারে। প্রণীতা গম্ভীর স্বরে বলল,“বেশ,আমি দেখা করব।”

ইসহাক খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন,“সত্যি? তাহলে শোন,আজ বিকেল ৩টায় তোর পছন্দের কোনো জায়গায় দেখা করিস। তো,তুই কোথায় দেখা করতে চাচ্ছিস?”

প্রণীতা মনমরা হয়ে জবাব দিলো,“আমার আর পছন্দের জায়গা! উনাকে বলে দাও উনি যেখানে বলবেন আমি সেখানেই দেখা করব।”

মেয়ের মন খারাপটুকু হাফিজার কলিজায় গিয়ে লাগল। তিনি বেশ বুঝতে পারছেন প্রণীতা সম্পূর্ণরূপে ফারাজকে ভুলতে পারেনি। নাহলে একটাদিন কেটে গেলো মেয়েটার মুখে হাসি নেই,উচ্ছ্বাস নেই,চপলতা নেই। আগের সেই বাড়ি মাতিয়ে রাখা প্রণীতা নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু না ভুলতে পারলেই বা কী? বিয়ে তো একদিন না একদিন করতে হতোই। তার চেয়ে বরং এখনই একজন বিশ্বস্ত লোকের হাতর তুলে দিতে পারলেই শান্তি। যে কিনা প্রণীতাকে ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখবে।

ইসহাক জানালেন আহিয়ান তার সাথে শিশুপার্কে দেখা করতে চায়। শিশুপার্ক নাম শুনতেই প্রণীতার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠে। এই পার্কেই ফারাজের সাথে তার প্রথম সাক্ষাৎ,এই পার্কেই প্রথম প্রেম নিবেদন,মনের আদান-প্রদান। তার সবচেয়ে প্রিয় একটি স্থান হলো শিশুপার্ক। এখন কিনা সেই পার্কেই অপর একজনের সাথে তার দেখা করতে হবে? একসময় তাকে বিয়েও করতে হবে? তার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সে কাঁদে না। কেন কাঁদবে? কার জন্য কাঁদবে? যে তাকে কষ্ট দিয়ে সুখে আছে তার জন্য? কক্ষনও না। কিন্তু সে জানতেও পারলো না সেই মানুষটা তার চেয়েও দ্বিগুণ কষ্ট সহ্য করছে,তার মনের ব্যথাটুকু শুষে নেওয়ার চেষ্টা করছে।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে