দূরত্বের আড়ালে পর্ব-০১

0
106

#সূচনা_পর্ব
#দূরত্বের_আড়ালে
#লেখনীতে_মারিয়া_আক্তার_মাতিন

দীর্ঘ তিনবছর পর প্রিয় মানুষকে চক্ষু সম্মুখে দেখে নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন মনে হলো প্রণীতার। রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেই একই অনুভূতি,একই টান। হৃদকম্পন শুরু হলো ফের। সে আর একমুহূর্তও দেরি করলো না। দৌড়ে গিয়ে ঝাপটে ধরলো পুরুষটির বুক। বুকে মাথা রেখে অশ্রুসিক্ত নয়নে বলতে লাগল,“আমি জানতাম,আপনি ফিরে আসবেন! আমি জানতাম! কারণ,আপনিও যে আমায় ভালোবাসেন আর নিজের ভালোবাসা ছেড়ে কেউ কি দূরে থাকতে পারে? পারে না তো! তাকে তো ফিরতেই হয় তার প্রিয় মানুষের কাছে।”

-“এক্সকিউজ মি! আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আপনি যাকে ভেবে এই কথাগুলো বলছেন আমি সেই ব্যক্তি নই। আপনি হয়তো গুলিয়ে ফেলছেন সব।”

এইতো সেই চিরচেনা কণ্ঠ! চিরচেনা সুর! কিন্তু মুখের বুলি ভিন্ন! প্রণীতা অবাক দৃষ্টিতে বুক থেকে মাথা তুলে। জড়িয়ে রাখা হাতের বাঁধন হালকা করে। সামনে থাকা পুরুষটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েকপল। নাহ! সে নিজের ভালোবাসার মানুষকে চিনতে ভুল করবে? এ কখনো হতে পারে? তার ভালোবাসা এতোটাও দুর্বল ছিল না যে সে যাকে তাকে দেখে নিজের ভালোবাসার মানুষ মনে করবে। সে চোখের জল মুছে আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বলল,“তুমি আমাকে চিনতে পারছো না,ফারাজ? আমি প্রণীতা,তোমার ভালোবাসা।”

সামনে থাকা লোকটি ভ্রু কুঁচকালো। নিশ্চিত হতে শুধালো,“প্রণীতা? হু আর ইউ? আমি কি আপনাকে চিনি?”

প্রণীতা হতভম্ব দৃষ্টি মেলে পরখ করতে থাকে ফারাজকে। এসব কী বলছে সে? তাকে চিনতে পারছে না? সে একটু হেসে বলতে লাগল,“জানি,তুমি আমার সাথে মজা করছো,ফারাজ। দেখো,আমার সাথে একদম মজা করবে না। আমি এই ধরণের মজা পছন্দ করি না। তুমি জানো,তুমি এই দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আমার কী অবস্থা হয়েছিল? আমি কতো কেঁদেছি,কত না খেয়ে থেকেছি,কতো নির্ঘুম রাত্রি কাটিয়েছি,তোমার কোনো ধারণা আছে?”

ফারাজ গম্ভীর স্বরে বলল,“দেখুন,আপনি কীভাবে আমার নাম জানেন আমি সে বিষয়ে অবগত নই। আর না আপনি কীভাবে দিনরাত কাটিয়েছেন সেসব শুনতে ইচ্ছুক। সো,প্লিজ আপনি আমার পথ থেকে সরে দাঁড়ান। আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে।”

-“ফারাজ! তুমি কি ভুলে গেলে আমায়? তোমার মনে নেই তোমার কাছে আমি এক বুক ভালোবাসা নিয়ে এসেছিলাম? তুমিও তো আমার ভালোবাসা গ্রহণ করেছিলে? তাহলে আজ কেন এমন করছো?”

ফারাজ কিছু বলতে যাবে তার আগেই সেখানে হাজির হয় প্রণীতার বাবা-মা। প্রণীতার মা হাফিজা বেগম বললেন,“তুই এখানে কী করছিস? তোকে এদিকে খুঁজতে খুঁজতে আমরা শেষ!”

প্রণীতা কান্নারত কণ্ঠে বলল,“মা,দেখো না,ফারাজ আমায় চিনতে পারছে না। সে আমায় ভুলে গেছে। সে আমার ভালোবাসা ভুলে গেছে।”

প্রণীতার বাবা ইসহাক উদ্দীন ফারাজের দিকে চেয়ে বললেন,“আরে,এটা তো ফারাজ!”

তারপর ফারাজের দিকে এগিয়ে গিয়ে কাঁধে একহাত রেখে বললেন,“কেমন আছো,বাবা? অনেকদিন পর তোমার সাথে দেখা হলো।”

ফারাজ স্থিরকণ্ঠে জবাব দিলো,“জি,ভালো। তবে আপনারা আমায় চেনেন কীভাবে সেটাই বুঝতে পারছি না!”

ইসহাক অবাক হলো। পরক্ষণেই বলল,“আমাদের তুমি না-ই চিনতে পারো। সেই কবে না কবে একবার দেখা হয়েছিল। কিন্তু প্রণীতাকে তো তোমার ভালো করেই চেনার কথা কারণ তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো। তাকেও কি চিনতে পারছো না?”

ফারাজ প্রণীতার দিকে এক পলক তাকায়। মুহূর্তের মাঝেই দৃষ্টি সরিয়ে বলল,“না,চিনতে পারছি না। আমি কাউকেই চিনতে পারছি না। আপনারা প্লিজ সরুন। আমায় যেতে দিন। কাকে না কাকে এই মেয়ে ভালোবাসে আর ভাবছে আমিই তার সেই ভালোবাসার মানুষ। আশ্চর্য!”

প্রণীতা ফারাজের কলার শক্ত করে চেপে ধরে। কান্নারত মুখশ্রীতে স্থান নিয়েছে ক্রোধের পাহাড়। রাগে চোখদুটো লাল বর্ণ ধারণ করেছে। সে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,“নাটক করছো আমার সাথে? নাটক? বুঝতে পেরেছি,বাইরের দেশে গিয়ে নতুন কাউকে পেয়ে গেছো তাই এখন আর আমাকে চিনতে পারছো না? তাই না? ছি! এতোটা অধঃপতন হয়েছে তোমার? নিজের ভালোবাসাকে ভুলে গেলে?”

ফারাজ গম্ভীর মুখে তার কলার হতে প্রণীতার হাতদুটো সরায়। অতঃপর প্রণীতার চোখের দিকে চোখ রেখে শীতল কণ্ঠে বলল,“মেয়ে মানুষ বলে ছেড়ে দিলাম। ছেলে হলে এতোক্ষণে নিজের আসল রূপটা দেখাতাম।”

এই বলে প্রণীতার সাইড কে’টে সে যাওয়ার চেষ্টা করে। প্রণীতা তার একহাত টেনে ধরে। আজ আর অশ্রুরা বাঁধ মানছে না। মানবেই বা কীভাবে? যার অপেক্ষায় এই তিনটা বছর সে কাটিয়েছে,যাকে মনে করে সে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছে,যার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে সে সুখ খুঁজার চেষ্টা করেছে,আজ সেই মানুষটা তার সামনে। অথচ তাকে চিনতে পারছে না। অস্বীকার করছে তার এতোদিনের হৃদয়ে বোনা ভালোবাসাকে। এ দহন সে কীভাবে সহ্য করবে? প্রণীতা কাঁদতে কাঁদতে বলে,“দোহাই লাগে তোমার। এভাবে আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি তোমাকে ছাড়া তিনটা বছর কাটিয়েছি,আর পারব না। আর পারব না তোমাকে ছাড়া থাকতে। তোমায় বড্ড ভালোবাসি,ফারাজ। আমাকে এভাবে নিঃস্ব করে দিও না।”

ফারাজ তপ্ত চোখে চেয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,“ব্যস,অনেক হয়েছে এসব মেলোড্রামা! এতোক্ষণ ধরে ভালো ব্যবহার করছিলাম দেখে একদম মাথায় চড়ে বসেছেন দেখা যায়! লোক হাসানোর খুব শখ আপনার তাই না? একটা কথা কান খুলে শুনে রাখুন আমি না আপনাকে চিনি আর না আপনাকে ভালোবাসি। দয়া করে কোনো প্রকার সিনক্রিয়েট করবেন না।”

ইসহাক ফারাজের দিকে তেড়ে গিয়ে বললেন,“তোমার এত্তো বড়ো সাহস? তুমি আমার মেয়েকে অপমান করছো? কী দোষ ওর? তোমাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিল এটাই তার দোষ? ঠিক আছে,এই দোষ কীভাবে উপড়ে ফেলতে হয় তা অনেক ভালো করেই এই ইসহাক উদ্দীন জানে। শুধু একটা কথা মনে রেখো,আমার মেয়েকে কষ্ট দিয়ে তুমি একদমই ভালো করোনি। কাউকে কষ্ট দিয়ে কেউ কখনো সুখী হতে পারে না ঠিক তেমনই তুমিও পারবে না।”

অতঃপর তিনি প্রণীতার হাত ধরে বললেন,“চল,মা। এই বিশ্বাসঘাতকের জন্য একদম চোখের জল ফেলবি না। যার কাছে তোর ভালোবাসার মূল্য নেই তার জন্য তুই কেন কাঁদবি? তোর চোখের জলের মূল্য নেই? একদম কাঁদবি না। চল,এখান থেকে।”

প্রণীতা ফারাজের দিকে চেয়ে বলতে লাগল,“না,বাবা। আমি ফারাজকে ভালোবাসি। আমি ওকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। আমাকে ছেড়ে দাও। আমি আমার ফারাজের কাছে যাবো।”

ইসহাক উদ্দীন,হাফিজা বেগম দুজন প্রণীতার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগলেন। প্রণীতা চিৎকার করে বলতে লাগল,“ফারাজ,আমি তোমাকে ভালোবাসি। দেখো না,তারা আমায় নিয়ে চলে যাচ্ছে। তুমি একটিবার এসে আমায় আটকাও,একটিবার এসে বলো তুমি আমায় ভালোবাসো। ফারাজ,আমি তোমাকে ছাড়া কীভাবে থাকবো? আমায় এতো বড় শাস্তি দিও না তুমি।”

প্রণীতার এরূপ শত অনুরোধ,শত আকুতি মিনতি যেন পাষাণ পুরুষটির হৃদয়ের একাংশও টলাতে পারছে না। কিন্তু আসলেই কি তাই? প্রণীতাকে নিয়ে এতোক্ষণে তার বাবা-মা সে স্থান ত্যাগ করেছে। প্রণীতা এখন দৃষ্টিসীমার বাইরে। ফারাজ অনুভব করলো তার চোখে জল। সে চোখের জল মুছে বলল,“আমায় মাফ করো,প্রণীতা। মাঝে মাঝে ভালোবাসার ভালোর জন্যও দূরে চলে যেতে হয়। ঠিক ততোটাই দূরে যতোটা দূরে গেলে আর তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। আমিও ঠিক ততোটাই দূরে গিয়েছিলাম কিন্তু এখন সময় এসেছে কাছে আসার। আমাকে আর কিছুদিন সময় দাও দেখবে তোমার ফারাজ তোমার কাছেই ফিরে এসেছে।”

ফারাজ এলোমেলো পায়ে সামনের পথ ধরে হাঁটছে। সে এখন নিজের মাঝে নেই। তার কানে বাজছে প্রণীতার বলা প্রতিটা কথা,প্রতিটা আর্তনাদ। মেয়েটা তাকে ভালোবেসে কতো কষ্ট পেল,সেও পাষাণের মতো কষ্ট দিল। কিন্তু এছাড়া যে আর উপায় ছিল না তার। সুখ পেতে হলে দুঃখকে করতে হয় জয়। সেই দুঃখকে জয় করতে গেলে সহ্য করতে হয় অবর্ণনীয় কষ্ট,বেদনা। তবেই না জীবনে সুখের আলো ফুটবে, সুখপাখিরা ডানা মেলে উড়বে।

ফারাজ আজই দেশে ফিরলো। পথে এক বন্ধুর সাথে দেখা করার কথা ছিল। তাই বন্ধুর ঠিকানা অনুযায়ী সেই পথে এসে গাড়ি থামায়। দীর্ঘক্ষণ পেরিয়ে গেলেও তার আসার কোনো নামগন্ধ নেই বিধায় সে গাড়ি ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়। আর তখনই তার বুকে এসে ঝাঁপটে পড়ে প্রণীতা। ব্যস,মনে হলো হৃদপিণ্ডে কেউ ধারালো ছুড়ি ধারা আঘাত করেছে,হৃদপিণ্ডটাকে দুভাগ করে ফেলেছে যখন দেখলো প্রণীতা কান্না করছে। যার কষ্টে সে দ্বিগুণ কষ্ট পায় তার সাথে কড়া কণ্ঠে কথা বলা যে কতোটা কষ্টদায়ক,কতোটা বেদনাদায়ক সেটা যদি কেউ বুঝতো! ফারাজ সহজে কাঁদে না। কিন্তু আজ কাঁদছে। চোখ হতে টুপটুপ করে পানি ঝরছে। হঠাৎ কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে সে তড়িঘড়ি করে চোখ মুছে পিছু ফিরে তাকায়। যাক,এতোক্ষণ ধরে যার অপেক্ষা করছিল অবশেষে তিনি হাজির হলেন। মিরাভ বিস্মিত কণ্ঠে বলল,“দোস্ত,তুই কাঁদছিলি?”

ফারাজ নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,“কোথায় কাঁদছিলাম? বাদ দে,বল তোর কী অবস্থা? কতোদিন পর দেখা হলো তোর সাথে।”

মিরাভ সে কথার জবাব না দিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,“সত্যি করে বল,তুই প্রণীতার জন্য কাঁদছিলি তাই না?”

ফারাজ জবাব দিলো না। তার নিরবতা বুঝিয়ে দিলো সব। মিরাভ সেদিক চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ধীর কণ্ঠে বলল,“আর কতো কষ্ট দিবি মেয়েটাকে? সত্যিটা বলে দে এবার।”

-“সময় হোক।”

-“তোর সময় আর কবে হবে? দেখিস আবার এমন সময়ে বলিস না যখন মেয়েটা আর তোর থাকবে না। হয়ে যাবে অন্যকারো বউ।”

ফারাজ বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকায়। মিরাভের দুই কাঁধ ঝাকিয়ে বলে,“এমন কথা বলার সাহস করিস না,মিরাভ। প্রণীতা আমার,শুধুই আমার। ওকে আমি আর কারো হতে দিবো না। তাকে এই ফারাজ চৌধুরীর হয়েই থাকতে হবে চিরকাল।”

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে