#দু্ই_পথের_পথিক
#পর্বঃ১
#বর্ষা
আটবছর পর কুহেলিকা বাংলাদেশের ভূখণ্ডে। উদ্দেশ্য ছেড়ে যাওয়া বাড়িতে অধিকারের সন্ধান,পরিচয়ের সন্ধান।অনেক তো শুনেছে সে অকর্মার ঢেকি,বংশের কলঙ্ক আরো কতকিছু! অনেকগুলো দিনও তো হলো কেউ কি স্মৃতিতে রেখেছে তাকে?
চট্টগ্রামের পথে দীর্ঘ বাস জার্নি।চাইলে হয়তো যেতে পারতো এয়ারক্রাফটে।হয়তো ইচ্ছে নেই,নয়তো তাড়া অনেক। মানুষের তাড়া হয় কয়েক ধরনের।কারো তাড়া জলদি পৌঁছানোর,আবার কারো তাড়া সময় আগলানোর!তেমনি কুহেলিকার তাড়া স্মৃতি আগলানোর।
কালো রঙা কুর্তি সমেত হিজাবে বেশ মায়াবতী লাগছে তাকে। বিদেশীদের মতো নীলচে চোখের অধিকারী সে।দেহের সাদা চামড়া যেন আরো বিদেশী রূপ দিয়েছে তাকে।বিদেশিনী দ্বিভাষীনি কন্যে যে রাত্রী গমন করছে মাতৃভূখন্ডগামী।বাসটা এখনো প্রায় ফাঁকা।হয়তো ঢাকা পেরোনোর পূর্বেই ভর্তি হবে বাস।
—এক্সকিউজ মি মিস এই সিটটা আমার।প্লিজ যদি একটু সরে বসতেন।
কুহেলিকা ওপরে তাকায়।শুভ্র শার্ট পরিহিত এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে।তার যে তাড়া অনেক চেহারায় প্রকাশিত।কুহেলিকা সরে বসে জানালার দিকে।সে চেনে,চেনে এই পুরুষটিকে। প্রকৃতি কি চাচ্ছে তার ছেড়ে যাওয়া সবাইকে আবারো তার জীবনে আনতে!
জানালায় মাথা এলিয়ে শুতে গিয়ে বাঁধে আরেক বিপত্তি। কন্ট্রাক্টরের ধমকি শুনতে হয় তাকে। অবশ্য সে তো ভুলেই গিয়েছিলো এখানে গাড়ি,গাড়ি নয় বরং প্ল্যান।কখন কোথা দিয়ে ধাক্কা দেয়!কুহেলিকার নিশ্চুপতা আড়ালে অবলম্বন করে নেয় সাফিন মেহতাব।
সাফিন আড়চোখে মাস্ক পরিহিতা মেয়েটাকে সম্পূর্ণ অবসার্ভ করে নেয়।কারো সাথে বড্ড মিল মিল লাগছে তার।তবে সে যে নিরুদ্দেশ রমনী।আদৌ এ জন্মে মিলবে কি তার খোঁজ!আর ভাবে না সে।দীর্ঘ যাত্রা ঘুমই পারে শুধু দ্রুত পৌঁছে দিতে।
কুহেলিকা একবার ফিরে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়।মোবাইল হাতে কাঙ্ক্ষিত আইডিতে ম্যাসেজ দেয়।’বাংলাদেশে এসেছি’।মিনিট দুয়েকের অপেক্ষাও করতো হয়না রিপ্লাইয়ের।উদ্দিগ্নতা মিশ্রিত বার্তা প্রেরিত হয় ওপাশ থেকে।’আমাকে জানালে আমিই তো নিয়ে যেতাম। সাবধানে থেকো।খুব শীঘ্রই এখানের কাজ গুছিয়ে আমিও আসছি।’কুহেলিকা চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে আটবছর পূর্বের ঘটনাদী।
আট বছর পূর্বে..
বাড়িভর্তি বাইরের লোকের সামনে কায়েস মির্জা চড় লাগান কুহেলিকার কপোলে।ছিটকে পড়ে কুহেলিকা।বয়সে তখন সে অষ্টাদশী।সদ্য এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়া শিক্ষার্থী।দোষটা তার একটাই বিয়ে অমুঞ্জরী।মির্জা বংশের মতে,মেয়েদের পড়াশোনা করতে হয়, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হয়।তবে কুহেলিকার ক্ষেত্রে সবই বিপরীত।না কখনো তাকে দেওয়া হয়েছে পড়াশোনায় সাপোর্ট,না স্নেহ আদর।উল্টো কলেজ টপকানোর পরই বিয়ের পিঁড়িতে বসানোর গল্প বুনানোর কাজ করেছে।
—তোমার সাহস কি করে হয় মির্জা বংশের মেয়ে হয়ে বড়দের মুখে মুখে তর্ক করো?
—আমি তর্ক করছি না আব্বু।আমি শুধু আমার মতামত প্রকাশ করেছি।আমি বিয়ে করবো না।
—মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছো তখন বিয়ে তো তোমায় করতেই হবে।
—কায়ফা আপুকে বিয়ে দেও।সে তো আমার থেকে আরো পাঁচ বছরের বড়। অবিবাহিত।
—থাপ্পড়ে তোমার গাল লাল করে ফেলবো।কায়ফা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।সামনে ওর বিশাল ভবিষ্যৎ।তুমি ওর বিয়ের কথা বলছো কি করে?
স্যাত করে উঠে বলেন রুমানা আফরোজ।কায়েস মির্জা স্ত্রী,দুই কন্যা সন্তানের মাতা। অবশ্য তাদের এক কন্যাই বলা যায়।তারা তো কখনো কুহেলিকার বেড়ে ওঠাকে খেয়াল করে দেখেনি।আদৌতে তারা কি জানে কুহেলিকার জন্মদিবস কবে?!
—আম্মু আব্বুকে তাহলে বলো যে আমিও তো পড়ছি। আমারও তো ভবিষ্যৎ সামনে।আমায় কেন বিয়ে দিতে চাচ্ছে।
—চুপ করো বেয়াদব মেয়ে।বাড়িভর্তি লোকের সামনে তুমি তোমার বাবার মাথা নিচু করছো।
—আম্মু তুমি আর আব্বু শুধু আপুকেই ভালোবাসো আমাকে কেন একটু ভালোবাসো না?আমি কি তোমাদের মেয়ে না!
—কুহেলিকা ঘরে যাও অনেক সহ্য করেছি তোমার বেয়াদবি।
বাবার ধমকে ওপরের সিঁড়িতে পা রাখে সে।কায়েস মির্জা ক্ষমা চান অতিথিদের নিকট।বিদায় জানান।তারাও বিনা বাক্যব্যয়ে চলে যায় কেননা এতক্ষণের ঘটনায় তারা এ বেশ ভালোই বুঝেছে মেয়ের মতামত নেই।কুহেলিকা তখনো দোতলার করিডোরে দাঁড়িয়ে।নিচ থেকে ভেসে আসা কন্ঠ তাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়।তার বড় চাচা কাসেম মির্জা আর বড় চাচি জয়নুবা বেগমের কন্ঠ।
—ভাই শোনো আগেই বলছিলাম তোমার এই মেয়ের কারো সাথে চক্কর চলে।নয়তো বিয়েতে রাজী হবে না কেন?সময় থাকতে বিয়ে দেও নয়তো দেখবা নাক কাটছে আমাদের ।
—বড় ভাবী একদম ঠিক বলছে তুমি এই নোংরাটা তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে বিদায় করো!
মিসেস জয়নুবার কথায় তালে তাল মিলিয়ে রুমানা আফরোজ বলেন।কলিজায় দাগ টানে ‘নোংরা’ শব্দটা।সে কি এতোটাই নোংরা!কই সে যদি নোংরাই হয় তবে পুরুষের আকর্ষণের কারণ কিভাবে সে!কেন পুরুষেরা তাকে ইমপ্রেস করতে চায়,বিয়ে করতে চায়?
রাতে খাবার টেবিলে কায়ফা,জাহিদ, জুনায়েদ খেতে বসেছে।কুহেলিকার অধিকার নেই ওদের সাথে খাওয়ার। রান্না ঘরে সে খাচ্ছে।থালা ধুয়ে যেই বেরিয়েছে তখনই দেখা কায়ফার সাথে।কায়ফা এমন ভঙ্গিমায় এড়িয়ে গেল যেন সে তার ছোট বোনকে নয় বরং দূর্গন্ধযুক্ত আবর্জনার পাশ দিয়ে যাচ্ছে!
পরিবারের এত এত অবহেলার পরও সুন্দর পৃথিবীটা সে উপলব্ধি করতে চায়। রহস্যময় পৃথিবীর রহস্য উন্মোচন করতে চায়।জীবনের মায়া নেই দেখেই হয়তো এই টান।তবে সবার মতো তারও যে এক দূর্বল স্থান আছে।তবে তা সম্পূর্ণ পাপ।শিক্ষক তো পিতা সমতুল্য।আর সেখানে সে নিজের শিক্ষককেই স্বামী বানাতে চায়।এ যে শুধু পাপ নয় বরং মহাপাপ।
পরদিন বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে কুহেলিকার দেখা হয় কাঙ্ক্ষিত পুরুষের সাথে। শিক্ষকতা পেশাতেই নিবদ্ধ সে।না আছে পিছুটান আর না আছে বিরাট পরিবার।একাকী থাকে এই চট্টগ্রামে। অবশ্য চট্টগ্রামে থাকলেও কুহেলিকার ভাষা চয়ন গুলো কি করে যেন বইয়ের ভাষা।
—আসসালামু আলাইকুম স্যার,কেমন আছেন?
—ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
—স্যার কোথায় যাচ্ছেন?
—টিউশনিতে।তা তুমি এই ভর সন্ধ্যায় বাইরে যে?
—বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে ছিলাম।
—এইচএসসি তো শেষ।তারপর কি করার ইচ্ছা আছে?
—যদি আজ কালকের মাঝে জোরজবরদস্তির বিয়ের পিঁড়িতে না বসি তাহলে খুব শীঘ্রই পালিয়ে যাবো এখান থেকে।
—ছিঃ পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা ভুলেও মাথায় এনো না।পরিবার যা করে ভালোর জন্যই করে।পরিবারকে মানিয়ে পড়াশোনা কন্টিনিউ করে।আসি এখন।
—স্যার..
—কিছু বলবে?
—স্যার আমি আপনাকে ভালোবাসি।আপনি কি আমায় বিয়ে করবেন?
চোখ বন্ধ করে মনের ব্যাকুল আর্জি জানিয়ে দেয় কুহেলিকা।তবে সামনে থেকে কোনো জবাবই সে পায়নি। সেকেন্ড কয়েক বাদে চোখ খুলে দেখে সামনের দিকে হেঁটে চলে যাচ্ছে তার মনের মানুষটা।হয়তো মুখের ওপর না বলতে পারেনি তাই এড়িয়ে যাওয়া।
সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ি ফিরতেই রুমানা আফরোজ চুল ধরে ইচ্ছে মতো মারতে থাকে কুহেলিকাকে।জয়নুবা বেগম চেঁচিয়ে বলেন,
—বেলাজ মেয়েকে আরো মারো।কোথাকার মাস্ক পড়া ছেলের সাথে সাঁঝের সময় দেখা করতে যাওয়া না!জাহিদ ঠিক করেছে ছবি তুলে এনে।বেলাজ, বেয়াদব মেয়ে কোথাকার!রুমানা তোমার উচিত ছিলো এই মেয়েকে বড় না করে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা।
কথাগুলো মারের থেকেও বেশি ক্ষতবিক্ষত করছিলো কুহেলিকাকে।দুইদিনে দুইবারের মতো মার।আজ তার দাদী বেঁচে থাকলে এমনটা কিছুতেই করার সাহস হতো না এদের।আগে সব শুনতো তারপর কি পদক্ষেপ নেবে তা ভাবতো।আজ দাদা-দাদি মৃত বলে!
কুহেলিকা মার খেয়ে ঘরে এসে গোসলে ঢোকে।মনের জ্বালা গায়ের জ্বালার চেয়েও বেশি।প্রথমত প্রিয়তমের নিকট নিরব প্রত্যাখান,দ্বিতীয়ত পরিবারের সদস্যদের আচরণ রাস্তার কিটগুলোর মতো হয়ে উঠেছে তার প্রতি।কুহেলিকা বাঁচতে চায়।তবে এখানে থাকলে তাকে মরতে হবে।যদিওবা এতদিন আশ্রয়ের স্থান ছিলো না বলে যায়নি কোথাও সে।তবে আজ তার আত্মসম্মান পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত,হৃদয় ভংগুর,দেহ রক্তাক্ত আর যে সহ্যের সীমানায় নেই কিছু!
—ভালোবাসা নাকি কষ্ট দেয়!তবে আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা আমায় মুক্তির পথ দেখালো।আপনার থেকে,পরিবার থেকে, এককথায় সবার থেকে আড়ালে মিলিয়ে যাবো আত্মগোপনে।তবে ফিরবো নিশ্চিত নিজেকে সুখী করে!আমি স্বার্থপরতা করবো ঠিকই তবে তা নিজেকে বাঁচাতে।
চলবে কি?