#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ২৬
#বর্ষা
কুহেলিকা বাচ্চাদের গোসল করিয়ে দরজা আটকিয়ে নিজেও গোসলে ঢুকেছে। তখনই বাইরে থেকে চেঁচামেচির হালকা হালকা আওয়াজ পায় সে।তবে ভিজে যাওয়ায় তো আর ওভাবে বের হতে পারে না।তাই দ্রুত গোসল করে পোশাক পাল্টে নেয়।নাহিন অফিসে গেছে।রাইসা ভাবী অবশ্য আছেন।তিনি কয়েকদিন আছেন বলেই তো নাহিন অফিসে যেতে শুরু করেছে।
রুম থেকে বেরিয়ে কুহেলিকা দেখে বাইরে জিনিস পত্র অগোছালো।যেন কেউ এমন করেছে।কুহেলিকা দেখে দরজার লক ভাঙা।রাইসার রুমে গিয়ে দেখে সে কাঁদছে।কারণ! জুনায়েদ এসেছিলো এখানে।রাইসাকে দেখে পাগলামি যেন আরো বেশি শুরু করে।রাইসাকে শত্রু দাবী করে বেরিয়ে যায়।তবে জুনায়েদের এই রুপ দেখে ভয় পেয়েছে রামায়সা।বাবাকে দেখে ছুটে গিয়েছিলো তবে জুনায়েদ তখন নিজের নেশায় বুঁদ ছিলো। ভাঙচুর শুরু করে।রাইসা এগিয়ে যেতে কত কথা বলে।রামায়সা এসব দেখে কান্না করে দেয়। চিৎকার করে বলে,
”পাপাই আই হেইট ইউ। ইউ আর অ্যা বেড হিউম্যান।মাম্মাম ইজ রাইট।আই অনলি লাভ ভালো বাবাই এন্ড মাই মাম্মাম।জাস্ট আউট ”
রামায়সার কথায় স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল জুনায়েদ।তারপর বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে গেছে।রাইসা কাঁদছে।কুহেলিকার হঠাৎ মনে পড়ে দরজার লক তো ভাঙা কেউ যদি বাচ্চাদের ক্ষতি করে!দৌড়ে ঘরে ফিরে আসে।
আল্লাহর রহমতে বাচ্চারা সহি-সালামতেই আছে।কুহেলিকা দরজা আটকে ঘরে বসে পড়ে।ফোন দেয় নাহিনের কাছে।ঘটনার বিশ্লেষণ করে।নাহিন এখনই বেরবে বলে জানায়।
কুহেলিকা আবারো আওয়াজ পায়।তবে এবার শব্দটা অন্যরকম।কুহেলিকা দরজা খুলে দেখে অপরিচিত একজন যুবক এসেছে।রামায়সাকে বুকের সাথে লেপ্টে রেখেছে।কুহেলিকাকে বেরিয়ে আসতে দেখলে রাইসা জানায় এই হলো তাকদির। পরিচিত হয় কুহেলিকাও।তাকদির বোন বানিয়ে নেয় কুহেলিকাকে।তার নিজের আপন কোনো বোন নেই।আর ছোট চাচার দুই মেয়ে ছিলো রাইসা আর রোহানী।রাইসা তো এখন ওর বউ আর রোহানী শালী। সেক্ষেত্রে রোহানী মেয়ের খালা হয়। তাহলে মেয়ে তার পিপি পাবে কোথায়?তাইতো কুহেলিকাকে বোন পাতানো।
তাকদির আজই বউ,বাচ্চা নিয়ে চট্টগ্রাম ফিরতে চায়।রাইসা বাঁধা দেয়।তবে কুহেলিকাই বলে রিস্ক নিয়ে এখানে থাকার প্রয়োজন নেই।আগে সব ঠিকঠাক হোক তারপর নাহয় পুরো একবছর থাকবে।রাইসা এসেছে দশদিন। সেক্ষেত্রে আজ বাচ্চাদের বয়স সতেরো দিন।
বাচ্চাদের কান্নার শব্দে ছুটে আসে কুহেলিকা।কিনায়া উঠে পড়েছে। মা কোলে নিতেই কান্না বাদ দিয়ে পিটপিট করে তাকিয়ে আছে। বারোটা দশবাজে।দুপুর প্রায় হয়েই এসেছে।কিনায়াও সজাগ থাকায় গোসল করিয়ে দেয় কুহেলিকা।বাচ্চার মা হওয়ায় সবই শিখে নিতে হচ্ছে তাকে। বাচ্চাদের ড্রেসের পার্সেল এসেছে কাল।খোলা হয়নি।কিনায়াকে গোসল করিয়ে খাইয়ে দোলনায় শুইয়ে দেয় সে।কিয়ানকে আরো আগেই গোসল করানো হয়েছে।এখন সে ঘুমাচ্ছে।আর কিনায়া তাকিয়ে তাকিয়ে আশেপাশের সব দেখছে।
পার্সেল নামিয়ে সবগুলো খুলতে বসে ইলিয়ানা।চারদিন আগে অর্ডার করেছিলো।কাল এসে পৌঁছেছে।ইলিয়ানা সবগুলো ড্রেস খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখে নেয়।বাচ্চাদের জন্য আরামের হবে কিনা তাও দেখে নেয়।হ্যা,যা যা বলা ছিলো ঠিক তেমনই পোশাক এসেছে।ফর্ড ছিলো না।ফর্ডদের ইনকাম হলো একবারের জন্য।গ্রাহক ধরে রাখা ওদের লক্ষ্য না। তবে অধিকাংশ ভালো পণ্যই দেয়।মুখের বুলির সাথে কর্মেও মিল রাখে।
বেবি ওয়ারড্রোবে প্রতিটা কাপড় আলাদা আলাদা করে গুছিয়ে রাখে সে।রাইসা রান্না করছে।নাহিন আসলে পরে ওরা যাবে।ড্রয়িংরুমেই বসে আছে তাকদির ভাই।
”বনু?”
তাকদির ভাইয়ের আওয়াজ পেতেই পোশাক ঠিক করে মাথায় ওরনা লেপ্টে দরজা খুলে দেয় কুহেলিকা।রাইসাও সঙ্গে আছে দেখে অস্বস্তি মুক্ত হয় কুহু।ভেতরে আসতে বলে।কিনায়াকে কোলে নিয়ে হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বলে,
”মামার তরফ থেকে মুখ দেখার জন্য বকশিশ।”(তাকদির)
”ভাইয়া এগুলো প্রয়োজন ছিলো না।”(কুহু)
”চুপ করো মেয়ে।আমি আমার ভাগ্নে ভাগ্নিকে দেবো তুমি বলছো কেন?”(তাকদির)
কিনায়া কান্না শুরু করতে কুহেলিকা কিনায়াকে নিয়ে নেয়।আর কিনায়ার কান্নায় জেগে ওঠে কিয়ান।কিয়ানকে কোলে নিয়েও একই কাজ করে তাকদির।কুহেলিকা আবারো নিষেধ করতে নিয়েছিলো তবে তাকদির আগেই চুপ করিয়ে দিয়েছে।রাইসা হাসছে কুহেলিকার মুখের অবস্থা দেখে!
নাহিন রুমে প্রবেশ করে তাকদিরকে দেখে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে।কুহেলিকা নাহিনকে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে নাহিনকে ডাকে।পার্শে ফিরে তাকায় তাকদির।প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে দেখে কিঞ্চিত চমকায়।কিয়ানকে কুহেলিকার কোলে দিয়ে তাকদির নাহিনকে জড়িয়ে ধরে।
”বন্ধু কেমন আছিস?কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি?”
”এইতো আলহামদুলিল্লাহ।আর ছিলাম আশেপাশেই তোরা খুঁজে পাসনি শুধু ”(নাহিন)
”শালা ঢং বন্ধ কর আর তুই এখানে?”(তাকদির)
”আমার বউ বাচ্চারা এখানে তো আমি কোথায় থাকমু!”(নাহিন)
”তার মানে আমি তোর শালা?”(তাকদির)
”কেমনে!রাইসা ভাবীর যেহেতু তুই জামাই সেহেতু তুই তো আমার ভাই লাগোস”(নাহিন)
”আরে ছাগল কুহেলিকা আমার পাতানো বোন।তাইলে আমি তো তোর শালা লাগি ”(তাকদির)
”ভাইয়া আপনারা অন্য কোথাও গিয়ে কথা বলুন।আমরা মেয়েরাও কিন্তু এখানে আছি!”
কুহেলিকা কথাটা বলেই হেসে দেয়।তাকদির আর নাহিন মাথা চুলকায়। তাকদির রাইসাকে ইশারা করে বাইরে আসতে।তা দেখে আবারো হেসে দেয় কুহেলিকা।নাহিন ফ্রেশ হতে চলে যায়।তবে তার পূর্বে একজনকে দরজা ঠিক করতে আসতে বলে।
★
★ ★
★
জুনায়েদ ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।ভয়-ডর কিছুই যেন ওকে ছুঁতে পারছে না। মানুষ যখন সর্বোচ্চ মাত্রায় ভেঙে পড়ে তখন তাকে আর কোনো ভয়-ডর ছুঁতে পারে না।জুনায়েদের ভাবনায় শুধু ভাসছে তার মেয়ের বলা কথাগুলো।এতো ছোট মনেই সে নিজের প্রতি বিতৃষ্ণা জাগিয়েছে!কেমন বাবা সে। মানুষ হিসেবে জঘন্য,বাবা হিসেবে সে ঘৃণ্য!জুনায়েদের মস্তিষ্কে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে ছোট্ট রামায়সার কথা।
”পাপাই আই হেইট ইউ। ইউ আর অ্যা বেড হিউম্যান।মাম্মাম ইজ রাইট।আই অনলি লাভ ভালো বাবাই এন্ড মাই মাম্মাম।জাস্ট আউট ”
জুনায়েদ কাঁদতে থাকে। হঠাৎ ঝাঁপ দেয় ব্রিজের ওপর থেকে।নিচে ছোটখাটো একটা নদী।তবে গভীরতা অনেক।আরো ওপরে হচ্ছে ব্যস্ত ব্রিজ।কেউ আর দেখবে তাকে!জীবনটা কি ত্যাগ করলো সে?হয়তো।
★
★ ★
★
মুনতাসির ভিলায় রাব্বি মুনতাসির হার্ট অ্যাটাক করেছেন।প্রথমে আরো একবার করেছিলেন।এই নিয়ে দুইবার। হসপিটালে টানাটানি হচ্ছে ওনাকে নিয়ে।বাড়িতে নেই কোনো ছেলে।সবাই তো জেলেই।নাহিনের বাবা বাসায় থাকা আর না থাকা একই কথা!সেই গুমোট হয়েই থাকে সে।
বাড়ির মেয়ে জয়া আর রুহি দাদুকে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছে।রাব্বি মুনতাসিরের আবার মেয়ে বাচ্চাকাচ্চা অপছন্দের তাইতো বাড়িতে রাখতে দেননি কাউকে।আর আজ সেই মেয়েরাই আজ তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে!
”দাদু আরেকটু সহ্য কর এইতো চলে এসেছি”
রুহির কথায় এই অবস্থাতেও রাগ দেখান রাব্বি মুনতাসির।রুহির রাগ লাগে।এই লোকটা মরার সময়ে এসেও রাগ দেখাতে ভুলছে না।জিনিয়া বাবার সাথে রাগ করে বাড়ি ছেড়েছে। ভাইদের অন্যায়ের কথা শুনে বাবাকে সে বলেছিলো ওদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে।চড় পড়েছিলো গালে।সেদিন রাগ করে এই যে বেড়িয়েছে আর এমুখো হয়নি।কোথায় আছে কেউই জানে না।তবুও পুরনো নাম্বারে কল দেওয়ার চেষ্টাও এতোদিন কেউ করেনি।তবে আজ জয়া কল দেয় জিনিয়াকে।
কল রিসিভ হতেই জয়া বলে ওঠে,
”পিপি রাগ করে থাকলে থাকো।তবে শুনো তোমার বাবা পরলোক গমনের পথে হাঁটছে।হার্ট অ্যাটাক করেছে।মুখ দর্শন করতে চাইলে ***** হসপিটালের সেকেন্ড ব্রাঞ্চে চলে আসো।”
জয়ার কথা শোনা মাত্র জিনিয়ার হাত থেকে ফোন পড়ে যায়।মুফতি জিনিয়াকে ধরে ফেলে।জিনিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে,
”মুফতি বাবা,বাবা অসুস্থ!আমি বাবার কাছে যাবো।আমায় বাবার কাছে নিয়ে চলো”
কুহেলিকার বেষ্টু মুফতিই হচ্ছে এই মুফতি।জিনিয়ার সাথে ছয়মাসের অনলাইন রিলেশন এখন বিয়ে অব্দি গড়িয়েছে মাত্র তিনদিন।ঢাকাতেই সংসার জুড়েছে দু’জনে।মুফতিও শ্বশুরের অসুস্থতার খবর শুনে চিন্তিত হয় তবে ব্যতিব্যস্ত হয় না। কেননা এই লোকটা একটা জঘন্য মানুষ মুফতির কাছে।মুফতির কাছে অনেক ওল্ড রিপোর্টই আছে রাব্বি মুনতাসিরের। গোয়েন্দা বিভাগের পুরনো সদস্য।ট্রান্সফার নিয়ে চলে এসেছে ঢাকাতে।
”আচ্ছা তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নেও। শশুরকে দেখে আসি চলো”(মুফতি)
”রেডি হতে হবে না।এভাবেই যাবো চলো প্লিজ”(জিনিয়া)
মুফতি জিনিয়াকে জড়িয়ে ধরে প্রথমে শান্ত করে। চোখের পানি মুছে দিয়ে রেডি হয়ে আসতে বলো।জিনিয়াও মুফতির কথা মেনে নেয়।তবে হাতে মুখে পানি দিয়ে মুখ মুছে হিজাব পড়ে বেরিয়ে আসে।মুফতি গাড়ি বের করে।
চলবে কি?