#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ২৪
#বর্ষা
বাসা থেকে বড্ড দূরে হোটেলে উঠেছে কুহেলিকা-নাহিন বাচ্চাদের নিয়ে।কুহেলিকার মন বিষিয়ে গেছে শাশুড়ি মায়ের ব্যবহারে!মুনতাসির পরিবারে থাকলে জাস্ট শুধু তার মেয়েই একটু ভালোবাসা পাবে।আর ছেলেটা শিখবে কনসপারিসি আর বৈষম্য। তারচেয়ে ভালো দুইজনকেই একাকী বড় করা। এতে একাকী বড় হলেও নৈতিক গুণাবলী গড়ে উঠবে দুজনের মাঝে।
কিয়ান প্রচন্ড শান্ত যা কুহেলিকার মনে ভয় বাড়িয়েছে।কেন বাচ্চাটা শান্ত থাকবে!কিনায়া একটু পরপরই কেঁদে ওঠে।কুহেলিকার চাই দু’জনেই এভাবে কাঁদবে।মায়ের মন ভয় তো করবেই।
নাহিন যতই সাহায্য করুক না কেন তবুও তো একটা মেয়ে মায়ের কমতি জীবনে উপলব্ধি করে এইদিনে।কুহেলিকারও মনে হচ্ছে আজ মা থাকলে কত ভালো হতো!আজ বাবা বেঁচে থাকলে কেউ তার সাথে এমন করার সাহস পেতো না।
”কুহু তুমি বেবিদের নিয়ে থাকো।আমি আমাদের ফ্লাটটা পরিষ্কার করতে বলেছি।ফ্লাটে উঠবো।কাজ কতদূর দেখে আসি”
”আচ্ছা, সাবধানে যেও। আল্লাহ হাফেজ ”
নাহিন বেরিয়ে যেতেই মুফতি রুমে প্রবেশ করে।কুহেলিকার হাতে ফাইল তুলে দেয়। বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
”দোস্ত আরেকবার ভেবে নে। তুই যা করতে যাচ্ছিস তা অনেক রিস্কি। বাচ্চাদের জীবনের বিষয়”
”ওদের ভালোর জন্যই রে।আমি যদি আজ উঠি না দাঁড়াই তাহলে ওরা কিভাবে দাঁড়াতে শিখবে!”
কুহেলিকা ল্যাপটপও আনিয়েছে। বাচ্চা দুইজন ঘুমাচ্ছে। আজকে কুহেলিকার মিটিং ছিল। তবে গত পরশু সে সন্তান জন্ম দিয়েছে।তবে আর যাইহোক বাবার স্বপ্ন পূরণ যে তাকে করতেই হবে।দীর্ঘক্ষণের এই মিটিং।তবে বাচ্চারা অনেক ছোট। তাদের তো একটু পরপরই মায়ের প্রয়োজন।
কুহেলিকা মুফতি বেরিয়ে যেতেই রুম লক করে দেয়। মিটিং শুরু হতে আরো ঘন্টাখানেক।কিয়ান তাকিয়ে আছে মিটিমিটি করে।কুহেলিকা বাচ্চার সাথে একটু কথা বলে।যেহেতু কাঁদছে না তাই আগেভাগেই রেকর্ডের প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে থাকে। প্রেজেন্টেশন দেওয়ার সময় তো আর প্রশ্ন করা হয় না।তখন নাহয় রেকর্ডেড ভিডিও ছেড়ে দিবে।তাও মিনিট পনেরোর ব্যাপার স্যাপার।
প্রেজেন্টেশন তৈরি শেষে কুহেলিকা লেপটপ সাইডে রেখে দেয়।কিয়ানকে কোলে নিয়ে খেলতে থাকে।গল্প শোনাতে থাকে।তখনই কিনায়া কেঁদে ওঠে।কুহেলিকা কিয়ানকে সুইয়ে কিনায়াকে কোলে নেয়।খাওয়াতেই আবারো ঘুমিয়ে পড়ে।কাল রাত জেগেছে তাই দিনে ঘুমাচ্ছেন মহারানী।আর যুবরাজ তো রাতে ঘুমিয়েছে তাই এখন মিটিমিটি তাকিয়ে আছে।
”মাম্মামের যুবরাজ কি মাম্মাম কে দেখে?আমার যুবরাজ,উম্মাহ”
দরজায় টোকার শব্দে এগিয়ে যায় কুহেলিকা।রুম সার্ভিস এসেছে।কুহেলিকা দরজা খুলতে গিয়েও খোলে না।তার মনে আছে ঘন্টা দুই আগেই তো রুম সার্ভিস এসে সব ক্লিয়ার করে গেছে।আবার আসবে কেন?কুহেলিকা দরজা খোলে না। বরং লোকটার মতিগতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।কেমন যেন অস্থির অস্থির।এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। হঠাৎ দৌড়ে পালায় সে।
কুহেলিকা অবাক হয়।একটু পরেই উপস্থিত হয় নাহিন। দরজায় নক করে।কুহেলিকা নাহিনকে দেখে দরজা খুলে দেয়।দরজার সাথে ওকে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করে,
”কে কে জানে আমরা এখানে আছি?”
”কে জানবে?আমি, তুমি,মুফতি আর বাড়ির মানুষেরা”(নাহিন)
”বাড়ির সবাইকে যখন বলেই দিয়েছেন কোথায় আছি তাহলে দূরে থেকে লাভ কি! তাদের সাথে গিয়েই থাকি চলুন। ক্রিমিনাল ফ্যামিলি”(কুহু)
”কুহেলিকা”(নাহিন)
”একদম ধমকাবেন না আমায়”(কুহু)
”কুহুপাখি কি হয়েছে?এমন খেপছো কেন?কেউ এসেছিলো?”(নাহিন)
”এসেছিলো কেউ। তবে জানি না কে এসেছিলো।বলেছিলো রুম সার্ভিস ”(কুহু)
”তাহলে আমার সাথে রাগ দেখাচ্ছো কেন?(নাহিন)
”বেকুব একদিনে কয়বার রুম সার্ভিস আসে?”(কুহু)
নাহিন ভাবনায় পড়ে যায়।দুইবার রুম সার্ভিসের ব্যবস্থা আছে এখানে।তবে তাও আটঘন্টা পরপর।তাহলে এখন কে এসেছিলো?নাহিন ল্যান্ডলাইনে ফোন দেয় রিসেপশনে।তবে অবাক হয় জেনে যে কোনো রুম সার্ভিসের লোক আসেনি তিনতলাতে।
*****
মাস্ক খুলেছে জুনায়েদ। বাঁকা হাসি হাসছে।বড্ড কষ্টে পালিয়েছে ওই নরক থেকে।আবার যদি সেখানে যেতেই হয় তবে কুহেলিকাকে খুন করেই যাবে।তাইতো চট্টগ্রাম থেকে ট্রাকের পেছনে করে চলে এসেছে এতদূর অব্দি।
জুনায়েদ হোটেল থেকে বেরিয়ে পুকুরের মতো একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।পাশেই পড়ে থাকা নুড়ি পাথর তুলে পুকুরে ছুঁড়ে মারছে।জলরাশিতে পানিরা আকৃতি বানিয়ে যে খেলছে।জুনায়েদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।সে দ্বিধায় আছে।জেল থেকে না পালিয়ে যে উপায় ছিলো না চৌদ্দ বছরের জেল ছিলো।পুরো জীবনটাই তো জেলে বসেই কেটে যেতো!মেয়ের বেড়ে ওঠা দেখা হয়ে উঠতো না।
জুনায়েদ জেল থেকে পালিয়ে সবার আগে মেয়েকে দেখতেই গিয়েছিলো।তবে রাইসা জুনায়েদকে দেখেই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে।রামায়সার দেখাও দেয় না।জুনায়েদকে ধিক্কার জানিয়ে বলে ওঠে,
”তোমার কারণে এমনিতেও আমাদের জীবনটা জাহান্নামে পরিণত হয়েছে।এখন কি আমাদেরকে জাহান্নামের আগুনেও জ্বালাতে চাও! চলে যাও এখান থেকে ”
জুনায়েদ অনুরোধের সুরে বলেছিলো,”জাস্ট একবার রামায়সার দেখা দিয়ে দেও।আমি সত্যি বলছি আমি চলে যাবো।”
”আমার মেয়ে কোনো খুনির সাথে দেখা করবে না।চলে যাও তুমি।আমি চাইনা আমার বাচ্চার ওপর আবারো তোমার প্রভাব পড়ুক।”(রাইসা)
”প্লিজ রাইসা জাস্ট একবার”(জুনায়েদ)
”তুমি যাবে নাকি আমি পুলিশকে কল করবো”(রাইসা)
জুনায়েদ মেয়ের দেখা না পেলেই চলে আসতে বাধ্য হয়।সে তো জানে তার জেলে যাওয়ার পেছনে হাত রয়েছে কুহেলিকার। তাইতো ওর জন্য শুধু মাত্র ওর জন্য আজ ও ওর মেয়ের দেখা পায়নি। জুনায়েদ পাগলা কুকুরের মতো খোঁজ লাগায় কুহেলিকার।লোক লাগিয়ে খোঁজও পেয়ে যায়।আর ট্রাকের পেছনে লুকিয়ে চলে আসে স্বপ্নের শহর ঢাকাতে।
****
মুনতাসির পরিবারে আনন্দের বহার।এতো সব দুঃখের মাঝেও আনন্দের বিষয় জিহানের ছেলে আজ বাসায় আছে।জোভানের বউ ইরুসি সব কাজ একাহাতে করছে।জোভান জেলে যাওয়ায় তার যে খুব একটা কষ্ট হচ্ছে তা মনে হচ্ছে না।প্রতিদিন ছেলে মেয়ের সাথে কথা বলছে।আগে যেমন গম্ভীরভাবে বসে থাকতো।এখন আর তেমন নেই।হাসে,প্রাণ খুলে বাঁচে।
”মেঝ বউ তোমার মাঝে তো কোনো দুঃখই নাই।আমার মেঝ পোলাটায় জেলে।আর তুমি আরো হাসিখুশি থাকতে আছো”
ফাতেমা বেগমের কথায় মুচকি হেসে ইরুসি বলে ওঠে,
”আম্মা তিনদিন আগেই না বড় ভাইজান মারা গেলো আর আজই আপনি ধ্যাই ধ্যাই করে বাইরে থেকে ঘুরে আসলেন।”
ফাতেমা বেগম গালাগালি করতে শুরু করেন।সত্য সবসময় তিতা হয়।ইরুসির মাঝে মাঝে মনে হয় এই তিনভাই হয়তো কিনে আনা কোথাও থেকে।নয়তো কেউ কি তার সন্তানদের খারাপ শিক্ষায় দিক্ষিত করতে চায়! ফাতেমা বেগম চলে যেতে আবারো রান্নার কাজে লেগে পড়ে ইরুসি।আজ বড় ভাবী আসবে।বড় ভাবী স্বামীর মৃত্যুর দিনও আসতে পারেনি। কেননা লাশই তো এখনও ফেরত দেওয়া হয়নি।পুলিশের কাছ থেকে চেয়ে আনাও হয়নি। বরং ওদের বলা হয়েছে নিজেদের মতো কোথাও দাফন করতে!
”মা ও মা ”
রুহি গতকাল বাড়ি ফিরেছে। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মা’কে ডাকছে।ইরুসি সাড়া দিতেই ছুটে আসে এদিকে।মা’কে রান্না করতে দেখে আরো খেপে ওঠে।রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে ওঠে,
”মা তোমার তো এলার্জির সমস্যা।এতো গরমে রান্না করছো কেন তুমি? মুনতাসিরদের কি টাকার কমতি পড়েছে যে কাজের লোক রাখতে পারছে না?”
”তোর বাপে কাড়িকাড়ি টাকা রেখে যাই নাই যে তোদের পেছনেও ঢালমু আবার বাসায় কাজের লোকও রাখমু!”
ফাতেমা বেতন গ্লাসে পানি ঢালতে নিয়ে বলে ওঠেন। রুহি আরো রেগে যায়।তার বাবা কি কিছুই করেনি!যেমনই মানুষ হোক।টাকা উপার্জন তো কারিকারি করেছে তাদের জন্য। তাহলে এখন কেন তারা কথা শুনবে!রুহি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেই ফেলে,
”আমার বাবা তো টাকা কামায়নি তুমি এতদিন বিজনেস সামলিয়েছো।”
”ইরুসি মেয়েকে তো বেয়াদব বানিয়েছো!”(ফাতেমা)
”রুহি চুপ থাক মা”(ইরুসি)
রুহি চুপ থাকার পরিবর্তে আরো রেগে যায়।তেড়ে এসে জানায় পানির গ্লাসটা কেড়ে নেয় হাত থেকে। ছুঁড়ে মারতে গিয়েও মারে না। কেননা সেই কাচ তার মা’কেই পরিষ্কার করতে হবে।তাইতো পানি খেয়ে উল্টো করে গ্লাস রেখে ফাতেমা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
”আমার মা’কে তো সময়ই দেওনি আমাকে শিক্ষা দেওয়ার।তার পূর্বেই তো আমাকে,ইয়ামানকে বোর্ডিং এ পাঠিয়েছো কনসপারেসি করে।এখন তাহলে আমার মা’কে দোষারোপ করছো কেন! নিজেদের ভাগ্যকে দোষারোপ করো।আমি আর বোর্ডিং এ যাচ্ছি না।”
রুহি বেরিয়ে আসে রান্নাঘর থেকে।শরীরের জ্বালা মিটছে না।বাবাকে নিয়ে বলবে কেন তারা?তারা নিজেরাই তো তার বাবাকে লালন-পালন করেছে। তাহলে বাবার দোষের দোষী তো তারা নিজেরাই।রুহি রাগ নিবারণে ছাদে চলে যায়।চিৎকার করতে থাকে।সামনে দিয়ে সাইকেলে করে যাচ্ছিলো এক যুবক।রুহির চিৎকারে হুমড়ি খেয়ে নিচে পড়ে।রুহি নিচে তাকিয়ে শ্যাম যুবকে এভাবে পড়তে দেখে হাসতে শুরু করে।আর যুবক লজ্জায় লাল হয়ে দ্রুত কেটে পড়ে সেখান থেকে!
চলবে?