#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ২৩
#বর্ষা
কুহেলিকার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে নাহিন।নাহিনের মনে বিতৃষ্ণা জেগেছে মায়ের প্রতি।কি এমন কারণ যে তার মা তার স্ত্রীর প্রতি এমন আচরণ করবে!যেই মেয়ের কারণে আজ সে সুস্থ তার সাথে তিনি কি করে এমন অকৃতজ্ঞের মতো ব্যবহার করতে পারে!নাহিন কুহেলিকাকে উঠায়।চলে যাবে সে।তবে কুহেলিকা কিছু সময় স্থির থেকে গম্ভীর হয়ে বলে ওঠে,
”আমি সম্পূর্ণ ভাবে অনাথ হয়ে গিয়েছে নাহিন।আমি চাইনা তুমি অনাথ হয়।আর আমাদের বাচ্চা দাদা-দাদির আদরহীন বড় হোক। তুমি চিন্তা করো না আমি ঠিক আছি।আমার কিছু হলে যে আমি আমার বাবাকে দেওয়া কথা রাখতে পারবো না।”
নাহিন অবাক হয়ে যায়। ক্ষণিকের মাঝেই কি এমন হলো যে কুহেলিকা এতোটা পরিবর্তন হয়ে গেল!কুহেলিকা রুমের দিকে পা বাড়ায়।ভাবতে থাকে দুইমাস আগের ঘটনা।
বিজনেস মিটিং থেকে ফেরার পথে একটা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করতে বসে কুহেলিকা আর তানজিল চৌধুরী। তানজিল চৌধুরী মেইন কোর্স আসার পূর্বে কুহেলিকাকে বলে,
”আম্মা জানিস মানুষ দীর্ঘদিন বাঁচে না।তবে একজন মৃত মানুষের জন্য যদি তুই নিজের স্বাভাবিক জীবনে প্রভাব ফেলিস তাহলে সে কষ্ট পায়।”
”আব্বু হঠাৎ এসব বলার কারণ কি?”(কুহু)
কুহেলিকার প্রশ্নকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তানজিল চৌধুরী আবারো বলে ওঠেন,
”মৃতের জন্য কান্না করতে নেই মানুষের সামনে। মানুষ মানুষের শত্রু যা তুই ইতিমধ্যে উপলব্ধি করেছিস। মানুষ তো শুধু কাঁচা ঘাতে ক্ষত করতে পারে।ভরতে পারে না।তাই কখনো যদি আপন কাউকে হারাস তাহলে একদম দূর্বল হবি না।আর যদি দূর্বল হোস তাহলে দেখবি এই দূর্বলতাকে কেন্দ্র করেই তোকে শেষ করে দিতে চাইবে।তাই সবসময় স্ট্রং থাকবি।বুঝলি?”
”হুম আব্বু।তবে..”(কুহু)
”আর কথা নয় খাওয়া শুরু কর।আর শোন আমি বাসায় ফাইল পাঠিয়ে দিবো বিজনেস হ্যান্ডওভার করবো তোকে।এই বয়সে ব্যবসা সামলাতে ভালো লাগে না।তোরটা তুই বুঝে নে”
তানজিল চৌধুরীর এতটুকু স্পষ্ট কথা ছিলো।পরে তিনি বিরবিরিয়ে আরো অনেক কিছুই বলেন তবে তা কুহেলিকার শোনার বাইরে ছিলো।আজ কুহেলিকা বুঝেছে তার বাবার প্রতিটা কথার মানে।সত্যিই দূর্বলতা কারো সামনে প্রকাশ করতে নেই। দূর্বলতা কেন্দ্র করে মানুষ খেলে।কুহেলিকা পেটে হাত বুলায়।আস্তে আস্তে বলে,
”তোরা চিন্তা করিস না মা আছে তো।আমি হয়তো আমার মা-বাবাকে বাঁচাতে পারিনি।তবে তোদের কিছুই হতে দিবো না ইনশাআল্লাহ।মা তোদের সুস্থ জীবন দিবে।”
কুহেলিকা ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নেয়।অনেক ঝড় গেলো আজ তার ওপর দিয়ে। বিছানার দিকে তাকায় একবার সে।এখনো বিছানায় পড়ে আছে রিভার্সিবলের তৈরি ব্ল্যাংকেট।কুহেলিকা তা দেখে মুচকি হাসে।তবে রক্তের গন্ধে গা গুলিয়ে আসে ওর। তলপেটে হালকা হালকা ব্যথাও অনুভব হচ্ছে।কুহেলিকার ব্যথা ক্রমশ বাড়তে থাকে।
”নাহিন,নাহিন আমি পারছি না।নাহিন ”
কুহেলিকা চেঁচিয়ে ওঠে।নাহিন ছুটে আসে।কুহেলিকা মেঝেতে রক্তের মাঝেই বসে পড়েছে।নাহিন বুঝতে পারে কুহেলিকার লেবার পেইন উঠেছে।তবে ডেইট তো ছিলো সামনের মাসে!নাহিন কুহেলিকাকে কোনো মতে উঠিয়ে কাঁধে ভর দিয়ে গাড়ি অব্দি নিয়ে আসে। ওর বাবা কিংবা মা একবারের জন্যও বের হয়ে দেখে না কি হয়েছে!
কুহেলিকার ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে।ব্যথা সহ্য করতে না পেরে ঠোঁট কামড়ে ধরেছে সে।নাহিন ড্রাইভ করছে।পারছে না কুহেলিকাকে আগলে ধরতে।কুহেলিকা আজ হারে হারে বুঝতে পারছে মা থাকা সত্যিই একটা মেয়ের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ!মা যতই রাগ করে থাকুক না কেন মেয়ের কষ্টে ঠিকই এগিয়ে আসে।তবে অন্যরা কি আদৌ খোঁজ নিয়ে দেখে!
কুহেলিকার নরমাল ডেলিভারি হয়েছে। কাসফিয়া চৌধুরী আর নাহিদ খানও ইতিমধ্যে এসে পৌঁছেছে।জমজ হয়েছে কুহেলিকার।একটা মিষ্টি মেয়ে আর একটা মিষ্টি ছেলে। অবশ্য এইটা তো কুহেলিকারা আরো আগে থেকেই জানতো।
নাহিন বাচ্চা দু’টোকে কোলে নিয়েছে।ছেলেটা একদম কুহেলিকার মতো দেখতে হয়েছে।মায়ের চোখ পেয়েছে।এমা একি কান্ড মেয়েটাও তো মায়ের চোখ পেয়েছে। তবে কাসফিয়া চৌধুরী বলেন মেয়েটা দেখতে নাকি নাহিনের মতো হয়েছে।কুহেলিকাকে এই নিয়েই সব বলছে নাহিন।
বাচ্চা কোলে না নিয়ে বউয়ের অবস্থা নিয়ে চিন্তিত ছিলো সে।কুহেলিকাকে বেডে দিছে তারপর বাচ্চা কোলে নিয়েছে সে।বাচ্চার কানে আজান দিয়েছে।পাগল একটা!কুহেলিকা নার্সের মুখে স্বামীর এমন কথা শুনে এমন অবস্থাতেও হেসে ফেলেছে।নাহিন দু’জনকে নিয়ে এসেছে।
নরমাল ডেলিভারিতে আটঘন্টা অতিক্রম হওয়ার পর কষ্ট অনেকাংশ কমে এসেছে কুহেলিকার।তবে দূর্বলতা জেঁকে বসেছে তাকে।বাচ্চা দুটো ঘুমিয়ে আছে।নাহিন খাবার আনতে গিয়েছে একটু আগেই। কাসফিয়া চৌধুরীর ইমার্জেন্সি চট্টগ্রাম ব্যাক করতে হয়েছে।আর নাহিদ খান রয়ে গেছেন। কেননা তার এমনিতেও এখানে থাকতে হতো। অপারেশন ছিলো তার পাশের একটা হসপিটালে। সেখান থেকেই চট্টগ্রাম ব্যাক করবেন তিনি।
কুহেলিকার অনেক একা লাগছে।ভাবছে আজ যদি আব্বু বেঁচে থাকতো তবে নিশ্চই কুহেলিকাকে বেড থেকে নামতে দিতো না।মা বেঁচে থাকলে হয়তো ওকে খাইয়ে দিতো জোর করে। বাচ্চাদের দেখে রাখতো।কুহেলিকার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।তবে কপোল পেড়নোর পূর্বেই কুহেলিকা অশ্রুরেখা মুছে নেয়।
একটু চোখ বুজেই ছিলো তখনই হুড়মুড়িয়ে কয়েকজন ঢোকে কেবিনে।নাসরিন সুলতানা আর নাহিনের বাবার সাথে রাব্বি মুনতাসির আর ফাতেমা বেগম।এসেই কুহেলিকার বাচ্চাদের দিকে হাত বাড়াতে নেবে তখনই প্রবেশ করে নাহিন।
”দাড়ান।কি করছেন আপনারা এখানে?”
নাহিনের কন্ঠস্বর পেতেই নাসরিন সুলতানা বলে ওঠেন,
”নাহিন এ কেমন ব্যবহার!আমি দাদি হই ওদের।কোলে নিতেই যাচ্ছিলাম”
নাসরিন সুলতানা বাচ্চা মেয়েটাকে কোলে নেয়।নাহিন বাঁধা দিতে চেয়েছিলো।তবে কুহেলিকা বাঁধা দিতে নিষেধ করে।যেমনই হোক মায়ের ভালোবাসা তো পেয়েছে ওনার থেকে তাই টানটা রয়েই গেছে।নাসরিন সুলতানা বাচ্চা মেয়েটাকে দুলাতে থাকেন।
”নানু ভাইয়ের নাম কি হবে ভেবেছিস নাহিন?”
কুহেলিকা অবাক হয়।সবাই শুধু তার মেয়েটার দিকেই এটেনশন দিচ্ছে।ছেলেটার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না।কারণ কি?মেয়ে হারিয়ে বলে কি শুধু নবজাতক মেয়েই আদর পাবে আর ছেলেটা ফেলনা হবে!নাহিন ওর বাবার কথার জবাব তার পূর্বেই ফাতেমা বেগম বলে উঠে,
”কি বলো ভাই! ওরা তো বাচ্চা মানুষ।ওরা কি নাম রাখতে পারে।নাম তো রাখে বাড়ির বড়রা।কি বলো নাসরিন?”
ফাতেমা বেগমের কথায় তাল মিলিয়ে ‘হুম,ঠিক বলেছেন আপা’ বলে ওঠেন নাসরিন সুলতানা। তবে কুহেলিকা চুপ থাকে না।বাচ্চা মেয়েটা কাঁদতে থাকে।কুহেলিকা ছিনিয়ে নেয় নিজের কোলে।পরিষ্কার করে দেয়।তারপর আলতো করে বলে ওঠে,
”কিনায়া কি হয়েছে মাম?আর কান্না করে না।তুমি তো আমার কিনায়া,আমার কিনায়া পাখি”
”এ কেমন বেয়াদবি কুহেলিকা?বাচ্চাটা তো ব্যথা পেতো।কিভাবে ছিনিয়ে নিলে তুমি!আর কেমন নাম কিনায়া!আমার নানুর নাম ভাই জ্যোতি। পরিবারের বাকিদের নামের সাথে মিলিয়ে। আমাদের জ্যোতি”
নাসরিন সুলতানার কথায় কুহেলিকার রাগ ওঠে।এতদিন তার মানে মুখোশের আড়ালে ছিলো। মানুষ পারেও বটে।ওহ, মুখোশ আড়ালে থাকার কারণও তো ছিলো।তখন তো কুহেলিকার বাবা ছিলো,একজন ক্ষমতাধর বিজনেস ম্যান!কুহেলিকা রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় না।দেখতে চায় নাহিন কিছু বলে কিনা।তবে নাহিন চুপ থাকে এই জ্যোতি নাম শোনামাত্রিক।কুহেলিকার রাগে যেন তা ঘি ঢালার মতো।
”দুঃখিত আম্মু, আপনাদের দেওয়া নাম রাখতে পারবো না।আমার যেহেতু ছেলে-মেয়ে সেহেতু নাম রাখার অধিকারও আমার”(কুহেলিকা)
”বাহ,কুহেলিকা এতদিন তো আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝতি না আর এখন আমার মুখে মুখে তর্ক করছিস!আর বাচ্চা কি তোর একার?বাচ্চা তো আমার ছেলেরও।আর আমাদের ছেলের মানে আমাদেরও অধিকার আছে”(নাসরিন)
”আপনাদের ছেলের বাচ্চা যেহেতু তাহলেই ওই পেটে ধরতো!নয়মাস পেটে ধরলাম আমি।আর অধিকার চলে গেল আপনাদের কাছে।বাহ”(কুহেলিকা)
”নাহিন,তুই কিছু বলবি!তোর বউ কথায় কথায় তোর মা’কে অপমান করছে”(নাহিনের বাবা)
”অপমান করার সুযোগ করে দিছো কেন তোমরা?কি বলবো আমি ওকে?তোমার ভাই-ভাবী,ছেলে মিলে আমার বউকে মারার প্ল্যান করে নিজে মরে যায়।আর দোষ হয় আমার বউয়ের।আমার অন্তঃসত্ত্বা বউয়ের দায়িত্ব দিয়ে আসি মায়ের কাছে,তিনি কোথায় যেন চলে যান!বসায়া এসে ডাইনি উপাধি দেন আমার বউকে। অধিকার, অধিকার যে করছো তোমাদের কোনো অধিকার নেই তো কুহেলিকার বাচ্চাদের ওপর।আমিও যে অধিকার দেখাতে পারছি না ওদের ওপর।আমার রক্ত হয়তো ওদের ওপর বইছে কিন্তু শেষ সময়ে তোমরা কুহুর সাথে যা করেছো তার কারণে আমি যে সেই অধিকার হারিয়েছি।জাস্ট তোমাদের কারণে।তোমরা হয়তো আমার ওপর অধিকার দেখাতে পারো।তবে ওদের ওপর পারবে না”
নাহিন কাঁদতে থাকে।কুহেলিকা স্থির বসে থাকে।তার ছেলেটা এবার কেঁদে ওঠে।সবার দৃষ্টি এবার ওর দিকে যায়।এতোক্ষণ তো ওনারা এক বাচ্চা নিয়েই মাতোয়ারা করেছে।নাহিনের কষ্ট যেন তা দেখেই আরো বেড়েছে।তবে তা নিয়ে আর বলেনি।এদের সাথে কথা বলতেই এখন রুচিতে বাঁধছে ওর।তবে যত যাই হোক মা’কে তো ও ভালোবাসতো। ফেলে দিবে কি করে! বাচ্চারা আরেকটু বড় হলেই দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে নাহিন।
”দোস্ত,দোস্ত আমি মামা হইছে”
কেবিনে হুড়মুড়িয়ে ঢোকে মুফতি। কিছুক্ষণ আগেই কুহেলিকা তাকে জানিয়েছে।এখনই এসে হাজির।ঢাকাতেই ছিলো। অবশ্য ডেটে যাবে বলে এসেছিলো।তবে ভাগ্য ওকে এখানে আনলো।হাতে কয়েকটা ব্যাগ।তবে এতো লোকজন দেখে শান্ত হয়ে গেছে বেচারা।নয়তো চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে খুশিতে বলতো,
”দোস্ত আমাদের ছোট্ট বেলায় খেলা পুতুলঘর তোর মনে আছে?আমরা ওদের নিয়ে আবার পুতুল পুতুল খেলবো।”
”পরপুরুষের যে হারে এই মেয়ের সাথে ওঠাবসা আদৌ এই বাচ্চা আমার ছেলের তো!”
নাসরিন সুলতানা এই বাক্য উচ্চারণ করেই চলে যান।নাহিন মায়ের কথায় ধিক্কার জানায়। মুনতাসির পরিবারের সবাই বেরিয়ে যায়।নাহিন গিয়ে মুফতিকে হাগ করে। জিজ্ঞেস করে,
”কেমন আছো?”(নাহিন)
”সুপারভ ভাই।তবে তুমি নাকি কান্নাকাটি করছো!”(মুফতি)
”কে বলছে!”(নাহিন)
”কে আর তোমার গুণধর বউ আমাকে বলছে! আচ্ছা সরো তো আমি আমার মামাদের সাথে একটু সাক্ষাৎ করি।নয়তো ভবিষ্যতে বলতে পারে যে মামা তুমি আমাদের থেকে আমার মা-বাবাকে বেশি ভালোবাসো”(মুফতি)
”হ্যা ,হ্যা এই নে তোর বড় মামাকে!”
কুহেলিকাকে কিনায়াকে এগিয়ে দেয়।কিনায়া দুই মিনিটের বড় ছেলের থেকে।মুফতি কিনায়ার গালে চুম্বন করতে গিয়েও করে না কেননা বড়দের মুখে অনেক ধরনের জীবাণু আছে যা নবজাতকের জন্য ক্ষতিকর।কিনায়াকে দিয়ে ছেলে বাবুকে কোলে নিয়ে বলে ওঠে,
”আমার মামাদের নাম কিরে ফকিন্নী?”
ফকিন্নী শব্দ শোনা মাত্রই কাঁদতে থাকে ছেলে বাবুটা।মুফতি বলে ওঠে,
”সরি মামা তোমার মা তো রানী।আর তুমি রাজপুত্র। কাঁদে না মামা”
নাহিন-কুহেলিকা হেসে দেয় মুফতির সরি বলা দেখে।তবে কিয়ান কাঁদছিল অন্য কারণে।তাই নাহিন কিয়ানকে নিয়ে পরিষ্কার করে দেয়।আর কুহেলিকা বলে ওঠে,
”মেয়ের নাম কিনায়া মুনতাসির আর ছেলের নাম কিয়ান মুনতাসির ”
চলবে কি?