দুই পথের পথিক পর্ব-২২

0
325

#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ২২
#বর্ষা
বাকশক্তি হারিয়েছে কুহেলিকা।কখনো কথা বলতে পারবে কিনা ডক্টররা নিশ্চিত নয়। কেননা কুহেলিকা কেমন নিশ্চুপ হয়ে রয়েছে।কথা বলার চেষ্টা করছে না।যেন তার নিজেরই কোনো ইচ্ছে নেই।কুহেলিকাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে কায়েস মির্জার কথাগুলো।উনি আত্মসমর্পণ করেছে।যত যাই করুক না কেন ওর সাথে,ওদের সাথে একসময় তো ওনাকে আব্বু ভেবে কত অভিযোগ লুকিয়ে রেখেছে।খুব কি দোষ হতো উনি নির্দোষ হলে!

সেই ঘটনার দুইদিন পেরিয়ে গেছে।কুহেলিকার তো টানা দুইদিন জ্বরে চোখ খোলার অবস্থাই ছিলো না।আজ জ্বর ছেড়েছে। ইমার্জেন্সি রুম থেকে আবারো কেবিনে দিয়েছে।ডাক্তাররা তো ভেবেই নিয়েছিল কুহেলিকাকে হয়তো আর বাঁচানো যাবে না। একেতো গলা চিপে ধরায় কন্ঠনালির ক্ষতি,দ্বিতীয়ত কোনো প্রকার মেন্টাল ট্রমা থেকে জ্বর।

কুহেলিকা আজ চোখ মেলে তাকিয়েছে।টুলে বসে কুহুর হাত দুটো আঁকড়ে কাদছিলো নাহিন।কুহু মুচকি হাসার চেষ্টা করে‌।কথা বলার চেষ্টা করে।তবে কন্ঠ বের হয় না।কুহেলিকা আতংকিত হয়ে বারবার চেষ্টা করতে থাকে।যা ওর জন্য আরো মারাত্মক পরিণতি সৃষ্টি করতে পারে। নাহিন ওকে শান্ত করতে জড়িয়ে ধরে।কুহেলিকা নেতিয়ে পড়ে।নার্স তাকে ইনজেকশন দিয়েছে।এই অবস্থায় উত্তেজিত হওয়া মোটেও কাম্য নয়।তবে এভাবে যদি বারবার ওকে ইনজেকশন দিয়ে শান্ত করতে হয় তাহলে এটা ড্রাগের মতো কাজ করবে।

তানজিল চৌধুরী মেয়ের এই কষ্ট দেখতে পারছেন না। তিনি নিজেকে দায়ী করছেন এসবের জন্য। তিনি বারবার ভাবছেন কেন তিনি পরিবারের খুনিদের ধরতে মেয়েকে আনলেন এর মাঝে! কাসফিয়া চৌধুরী নিউরোলজিস্ট হওয়ায় কুহুর কন্ঠ ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করতে না পারলেও মানসিক সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করছে।নাহিন গতরাত থেকে না খেয়ে বসে থাকায় বহু বলে কয়ে ওকে খেতে পাঠিয়েছে।আর কুহুর জন্য খাবার আনতেও বলেছে।

সাতদিন পর,,,

দেখতে দেখতেই পার হয়নি সাতদিন। কুহুর কষ্ট,আবেগ সব যেন মিশে আছে।তানজিল চৌধুরীর সাথেও পরিচিত হয়েছে নাহিন।নাহিন জোভানের নামে কেস করেছে।তবে সে কেস গ্রহণ করা হলেও কার্যকর হয়নি। কেননা জোভানের অবস্থা এখনও ভালো হয়নি।

কুহেলিকা এখন অনেকটাই নিজেকে সামলে নিয়েছে।সে যে কথা বলতে পারবে না এটা সে মেনে নিয়েছে।বাড়ি ফিরেছে আজ তারা‌।রাব্বি মুনতাসির কুহুকে চড় মারতে নিলেই হাত ধরে ফেলে নাহিন।হুমকির স্বরে বলে,

”চাচা ভুল করো না।চাইলে তুমি আর তোমার স্ত্রীকেও জেলে ঢুকাতে পারি।আমি কিন্তু জানি তোমরা লামিয়ার সাথে কি করেছে!”

রাব্বি মুনতাসির থেমে যান। রাস্তা থেকে সরে দাঁড়ান। ফাতেমা বেগমকে টেনে রুমে নিয়ে যান।রাকিব মুনতাসির এগিয়ে আসে।ওর মা আর বোনকে ও নানাবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে সপ্তাহ আগে।আজ ও চলে যাবে।এখানে থাকলে ওর বোন আরো মানসিক সমস্যাও সাইকো হয়ে উঠবে তাই এই সিদ্ধান্ত।জারিফ আদালতে নিজের আরো অপকর্মের মাঝে লামিয়াকে মেন্টালি উইক করে পাগলা গারদে পাঠিয়েছে।

রাকিব বেরিয়ে যায়। নাসরিন সুলতানা ছুটে এসে কুহুকে আগলে নেন।দূর থেকেই বউমাকে অবলম্বন করে নাহিনের বাবা।এতোদিন পর মেয়ের অপরাধীদের ছাড় দেওয়ার আফসোস তার হচ্ছে।মেয়ের জন্য মনটা কাঁদছে।নাহিনের বাবা সেখান থেকে সরে যান।

তানজিল চৌধুরী মেয়েকে রেখে ফিরে যেতে পারেন না।তবে বেয়াই বাড়িতেও থাকেন না।কিছু দূরে হোটেলে উঠবেন বলেই সিদ্ধান্ত নেন।মেয়ে কাগজে কলমে লিখে জানায় যে চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রি যেন রিওপেন করা হয়। কাগজ পত্র দেয় কুহেলিকা।আর বাবাকে এও জানায় বাবা যেন দায়িত্ব নেয় এর।

দেখতে দেখতে আরো দুইমাস কেটে যায়।জোভান দশবছরের জন্য জেলে আছে।আর জারিফের তো ফাঁসি হয়েই গেছে।কুহেলিকাও আগের থেকে এখন অনেকটা ইমপ্রুভ করেছে।জিহানের কোনো খোঁজ খবর নেয়।তবে রাব্বি মুনতাসির আর ফাতেমা বেগমের আচরণ সন্দেহজনক।এই দুইমাস ভালো ব্যবহার করে মন জয়ের চেষ্টা করে চলেছেন।

”নাহিন,নাহিন,নাহিন”

কুহেলিকা ডাকতে থাকে নাহিনকে। অল্পস্বল্প কথা সে বলতে পারছে এখন। পুরোপুরি খত না হওয়ায় ধীরে ধীরে কন্ঠস্বর ফিরছে।নাহিন বাইরে থেকে মাত্রই এসেছে।বউয়ের এমন চেঁচামেচিতে ছুটে আসে।

”কি হয়েছে বউ?”(নাহিন)
”নাহিন গেস করো তো কি হয়েছে?”(কুহু)
”উমমম…পারছি না তো তুমিই বলো ”(নাহিন)
”তুমি বাবা হতে চলেছো নাহিন”(কুহু)
”ওহ..কি!”

নাহিন প্রথমে খেয়াল না করলেও পরবর্তীতে অবাক হয়ে যায়।কুহেলিকার কপালে চুমু খায়।চোখ দিয়ে তার অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।এই অশ্রু আনন্দের।

তানজিল চৌধুরী সুখবর জানতে পেরে মেয়ের জন্য হাত ভরে বাজার করে এনেছে।মেয়ের পছন্দের সব চকলেট,মিষ্টি,ফল সব এনে সামনে রেখেছে।বাবার এমন কাজে কুহেলিকা তো হাসতে হাসতে শেষ।আর ওর বাবা তো কতশত কথা বলছে।এই বলছে আমার একটু ছোট বোন আসবে আবার বলছে আমার একটা ছোট ভাই আসবে।

”আম্মা শোন মেয়ে হলে কিন্তু নাম রাখবি কিনায়া আর ছেলে হলে নাম রাখবি কায়ান। সুন্দর না কি বলো নাহিন?”(তানজিল)
”আব্বু নামগুলো তো সুন্দর।তবে আপনিই তো রাখবেন।”(নাহিন)
”হুম নাহিন ঠিক বলেছে আব্বু”(কুহু)

তানজিল চৌধুরী হাসেন।তবে সেই হাসির মানে বুঝতে কুহেলিকার লেগে যায় আট মাস।তানজিল চৌধুরী মারা যান।কারণ খুঁজলে পাওয়া যায় তিনি ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত ছিলেন। অপারেশন করেননি।মারা গেলেন শেষমেশ।কুহেলিকা নয়মাসের প্রেগন্যান্ট।বাবার মৃত্যুতে ভেঙে পড়ে ও।কবর দেওয়ার সময় নাহিন নেয়নি তাকে।

নাসরিন সুলতানা সাধ্যমতো কুহেলিকাকে সামলে রেখেছেন।মেয়েটা আবারো নিশ্চুপ হয়ে গেছে।বাবার মৃত্যুর সপ্তম দিনে কুহেলিকা কবর স্থানে যাওয়ার সুযোগ পায়।নাহিন বউকে নিয়ে যায়।কবর স্থানে গিয়ে বাবার কবরের কাছে বসে পড়ে কুহেলিকা। কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করে,

”আব্বু কেন আমায় জানালে না যে তোমার ব্রেন টিউমার!আব্বু আমায় একা করে কেন ভিন্ন পথে চলে গেলে আমায় রেখে!আব্বু তোমার আমার পথ কেন আবারো আলাদা হলো!আব্বু আমার ভালোবাসার মানুষেরা কেন হারিয়ে যায়?”

কুহেলিকা অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়ে। নাহিন কুহেলিকাকে ওখান থেকে নিয়ে আসে।বাসায় ফিরে নাহিন দেখে জিদান ফিরে এসেছে।মুখে তার ক্রুড় হাসি।নাহিন লক্ষ্য করে।কুহেলিকার মাথা থেকে সবই বেড়িয়ে যায়।

আরো চারদিন পেরিয়ে গেছে।নাসরিন সুলতানা কোনো কাজে বাইরে গিয়েছেন।আর একদিন আগেই নাহিন চট্টগ্রাম গিয়েছে কোনো এক কাজে।বাসায় কুহেলিকা একা।হ্যা মানুষ আছে তবে শত্রুপক্ষ জিদান,রাব্বি মুনতাসির আর ফাতেমা।

কুহেলিকা বাবাকে হারিয়ে সাইকোতে রুপান্তরিত হয়েছিলো।কাউকে আর আগের মতো নিজের কাছে ঘেঁসতে দেয়নি।একাই বিরবির করে কি জানি‌ বলে।আজ বাড়ি ফাঁকা দেখে জিদান বন্দুক হাতে কুহেলিকার ঘরে যায়। বিছানায় কাউকে শুয়ে থাকতে দেখে কুহেলিকা মনে করে গুলি চালায়। বন্দুকের গুলি রিভার্স মোডে তার দিকেই ফিরে আসে।মাটিতে লুটিয়ে পড়ে জিদান।কুহেলিকা বারান্দায় ছিলো। বন্দুকের শব্দে আঁতকে ওঠে সে।দ্রুত বেরিয়ে এসে দেখে জিদান মরে পড়ে আছে। একদম বুক বরাবর লেগেছে।ফাতেমা বেগম আর রাব্বি মুনতাসির তো ক্ষেপে যান।কুহেলিকাকে মারতে এগিয়ে আসতে নিলেই চাকু দেখিয়ে ভয় দেখাতে থাকে সে।রাব্বি মুনতাসির পুলিশে ফোন দেন। ফাতেমা বেগম কাঁদতে থাকেন।

পুলিশ আসার মিনিট দশেক পরেই সিআইডি টিম উপস্থিত হয়।কিছু এনালাইসিস করে বডি নিয়ে যায় ফরেনসিক টিম।তবে যাওয়ার আগে সুইসাইড বলেই ধারণা বলে যায়।জিদানের লাশের হাতে তখনও শক্ত করে বন্দুক ধরা।কুহেলিকাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিলো তবে সে মোটামুটি সবই পজেটিভলি বলেছে।তাই তারা ফিরে গিয়েছেন।তবে সংবাদ মাধ্যম তার কাজ করেছে।আর ইতিমধ্যে নাসরিনও ফিরে এসেছেন। ফাতেমা জাকে জড়িয়ে বউমার নামে কু্ৎসতা রটাতে থাকে।আর কোনো এক অজানা কারণে প্রথমবারের মতো কুহেলিকার গায়ে হাত তোলেন তিনি।বলে ওঠেন,

”তোর মতো মেয়ে অভিশাপ।যেদিন থেকে এ বাড়িতে এসেছিস সব শুধু ধ্বংস করছিস! নিজের মা-বাবাকে খেয়েছিস।এখন এই বাড়ির ছেলেগুলোকেও খাচ্ছিস।ডাইনি”

কুহেলিকা ভেঙে পড়ে। নাহিন কুহেলিকাকে সারপ্রাইজ দিতে দ্রুত এসেছিলো।তবে এয়ারপোর্টে নেমে খবর শুনা মাত্রই আর অফিসে না গিয়ে বাসায় এসেছে।মায়ের কথাগুলো তারও কানে ঢুকেছে।নাহিন যেন অবাকতা কাটিয়ে উঠতে পারে না।একেতো সে তার মায়ের দায়িত্বে বউকে রেখে গিয়েছিলো সে তো তার দায়িত্বে অবহেলা করেছে আবার তার মানসিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়া মেয়েটাকে আরো দূর্বল করে দিচ্ছে!

”কুহেলিকা ওঠো,আমরা….!”

চলবে কি?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে