দুই পথের পথিক পর্ব-০৩

0
360

#দুই_পথের_পথিক
#পর্বঃ৩
#বর্ষা
যাত্রা শেষে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্যে ঘুম ভাঙে কুহেলিকার‌।জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য।সমুদ্রের জলরাশিরও দেখা মেলছে দূর থেকেই।বহুদিন পর আবারো মাতৃভূখন্ডের জলরাশিকে স্বচোখে দেখা।কুহেলিকার মুখে ফুটে ওঠে মিষ্টি হাসির রেখা। আড়মোড়া ভেঙে ফোন নেয় হাতে।ম্যাসেজ এসেছে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটির।

—তোমার জন্য কাঁদছে মন, কাঁদছে নয়ন।আসছি খুব শীঘ্রই তোমার শহর।গুড মর্নিং প্রেয়সী।

কুহেলিকার মুখে হাসির রেখা দৃঢ় হয়।তবে পরমুহূর্তেই সেই রেখা মিলিয়ে যায়।আনমনেই বলে ওঠে,

—যাকে চেয়েছিলাম আমি,তাকে পেয়েছে অন্য কেউ।তবে যে চায় আমাকে সে পাবে কি আমায়?!

কুহেলিকার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।বাস থেমে গিয়েছে।পাশের সিটটা ফাঁকা।হয়তো চলে গিয়েছে।কুহেলিকা বেশি ভাবে না।বাস থেকে নেমে লাগেজ কালেক্ট করে নেয়।কিছুটা এগিয়ে যেতেই রিকশার দেখা মেলে।রিকশায় চড়ে বসে সে।শহরের মাঝেই বিশালাকার বাড়ি তাদের। গন্তব্য সেখানেই।

আপন শহরের বাতাস মন ভরে গ্রহণ করছে সে।আলাদা একটা গন্ধ আছে এ বাতাসে।প্রশান্তির পরশ একে দিচ্ছে চিত্তে।কুহেলিকা চারপাশে চোখ বুলিয়েই যাচ্ছিলো হঠাৎ চোখ আটকে যায় পাশেরই এক রেস্টুরেন্টের দোতলাতে।দ্রুত রিকশা থামাতে বলে সে।ভাড়া মিটিয়ে লাগেজ হাতে নেমে পড়ে সে।

—আয়শা?

পরিচিত কন্ঠ কানে আসতেই আয়শা ফিরে তাকায়।প্রিয় বান্ধবীকে দেখে জড়িয়ে ধরে সে।কুহেলিকাও আগলে নেয় বান্ধুবীকে।স্কুল,কলেজ লাইফের বন্ধুত্ব বলে কথা।আয়শার পাশে বসে থাকা মেয়েটা যে কৌতুহলী তা তার চোখে মুখেই স্পষ্ট।আয়শা একবার জড়িয়ে ধরছে তো একবার বান্ধুবীকে দেখছে।

—কুহু বিশ্বাস হচ্ছে না তুই আমার সামনে দাঁড়িয়ে।কুহু জানিস তোকে কত মিস করেছি। আমাকেও জানালি না বিষয়টা!

—ধূর বাদ দে না এসব।এখন তো ফিরে এসেছি।কেমন আছিস বল?

—আলহামদুলিল্লাহ। তুই কেমন আছিস?

—আলহামদুলিল্লাহ। পরিচয় করিয়ে দিবি না ওনার সাথে?

—ওফস সরি,ও হচ্ছে নায়মা হাওলাদার।আর নায়মা এই হচ্ছে আমার বেস্টু কুহেলিকা চৌধুরী।

নায়মা,কুহেলিকা পরিচিত হয়।সকালের নাস্তাটাও এখানেই করে নেয় কুহেলিকা।নায়মা,আয়শা সম্পর্কে চাচাতো বোন।একই সাথে চাকরি সূত্রে একই স্থানে থাকে।জবে যেতে হবে বিধায় খুব শীঘ্রই বিদায় নিতে হয় তাদের।তবে ক্ষুদ্র এই সময়টাও স্মৃতিতে আগলে রাখে কুহেলিকা। বিদায়বেলায় নাম্বার আদান-প্রদানও করে দু’জনে।

কুহেলিকা দাঁড়িয়ে আছে চৌধুরী ভিলার সামনে। বিশালকার ডুপ্লিক্স বাড়ি। কোহিনুর চৌধুরীর শখের ভিলা।দুই পুত্রের নামেই লিখিত সে বাড়ি।কন্যাকে তো আগেই নিজের নিকট মৃত ঘোষিত করেছেন।তাইতো জীবিত থেকেও পরিবারের কাছে মৃত উপাধিতে ভূষিত সে।

দারোয়ানকে বহুবার বলার পরও যখন গেট খুলতে নারাজ সে তখন কুহেলিকা ধৈর্য হারিয়ে ফোন দিতে বলে কায়েস চৌধুরীকে।ফোন পেয়েই কায়েস চৌধুরী ছুটে আসেন গেট সম্মুখে।বলার অপেক্ষা রাখে না তিনি রাগান্বিত না ব্যথিত‌‌। দারোয়ানকে গেট খুলতে বলেন। ঠাঁটিয়ে কয়েকটা চড় লাগান।বেড়িয়ে যেতে বলেন চৌধুরী ভিলা থেকে।তবে কুহেলিকা বেরিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে মারকে উপেক্ষা করে চৌধুরী ভিলায় প্রবেশ করে।

রুমানা আফরোজ কিচেনে ছিলেন।সদর দরজা দিয়ে কুহেলিকাকে প্রবেশ করতে দেখেই ক্ষিপ্ত হয়ে ছুটে এসে হিজাবের ওপর দিয়েই চুলের মুঠি ধরার চেষ্টা করেন।তবে তার পূর্বেই কুহেলিকা হাত ধরে ফেলে।বলে ওঠে,

—আপনাদের নরম,নাজুক কুহেলিকা আট বছর আগেই মরে গেছে।বর্তমান কুহেলিকা নিজেকে কারো দাঁড়া আঘাত পেতে দেয় না। বরং আঘাতকে সুদে আসলে ফিরিয়ে দিতে জানে।

কুহেলিকা নিজের রুমের দিকে চলে যায়।দোতলার বা’দিকের একদম কিনারার কক্ষটাই তার।ভেতরে গিয়ে লাগেজ ঠেলে মোবাইল বিছানায় ফেলে আয়নায় তাকায় সে‌।গালটা লাল বর্ণ ধারণ করেছে।তবে পরমুহূর্তেই আশ্চর্যিত হয়ে নিজের কক্ষটাকে দেখে।একদম সাফ সুতরা কক্ষ এটা।বোঝাই যাচ্ছে না যে এই রুমের মানুষ আটবছর যেন প্রতিদিনই কেউ পরিস্কার করে রেখেছে।কে আছে যে তাকে ভালোবেসে তার স্মৃতি আগলে রাখতে তার কক্ষটাকে আগলে রেখেছে!

কুহেলিকা গোসল সেরে ফজরের কাযা নামাজ আদায় করে নেয়।ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ বের করে কিছু ফাইল চেক করে‌।ফোনে কাউকে ইন্সট্রাকসন দেয় পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে।এও জানায় আগামীকাল অফিসে আসবে সে।সব ফাইল যেন রেডি থাকে। কোনো ভুলের অবকাশ নেই তার কাছে।

যোহরের নামাজ পড়ে নিচে নামতেই দেখতে পায় জয়নুবা বেগম গুসুর ফুসুর করে কিছু বলছেন রুমানা আফরোজকে‌।থেমে যান কুহেলিকাকে দেখে।মেয়েটা যে আগের তুলনায় আরো সুন্দরী হয়েছে ।

—দুপুরের খাবার প্রস্তুত হয়েছে?

—তোমার জন্য এ বাসায় কেউ রান্না করেনি।

রুমানা আফরোজের কাঠখোট্টা জবাব।কুহেলিকা কিছুক্ষণ দীর্ঘ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে নিজ থেকেই ফ্রিজ থেকে ব্রেড আর জ্যাম নিয়ে খেতে বসে।জয়নুবা বেগম কিছু একটা ভেবে ছুটে এসে বলে ওঠেন,

—আমি তোর জন্য খাবার আনছি।এসময়ে ব্রেড,জ্যাম খেলে অসুস্থ হয়ে পড়বি‌।

—আপনি আমার অসুস্থতা নিয়ে ভাবছেন?স্ট্রেঞ্জ!

কুহেলিকা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।তবে দেখা মেলেনি কায়ফাসহ চাচাতো দুই ভাইয়ের।কুহেলিকা আন্দাজ করতে পেরেছে কায়ফা নিশ্চই শশুর বাড়ি আছে।আর জাহিদ ভাই তো ব্যবসার কাজে আগে থেকেই জড়িত। জুনায়েদ ভাই তো চিকিৎসক মানুষ,ব্যস্ত মানুষ!

কুহেলিকা খাওয়া শেষ করে উঠতে নিলেই বাচ্চা একটা ছেলে ছুটে আসে।কুহেলিকার সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিলেও কুহেলিকা ধরে ফেলে। রুমানা আফরোজ কেড়ে নেন নাতিকে।কুহেলিকাকে চোখ রাঙানি দিয়ে বাচ্চাটিকে আদূরে কন্ঠে বলে ওঠেন,

—সিনান নানুভাই এভাবে ছুটছিলে কেন?যদি লেগে যেতো তখন কি হতো!

—নান জানো বাবাই এসেছে সকালে।আমার জন্য এত্তো এত্তো চকলেট এনেছে।কি মজা!

—আমাদের জন্য চকলেট আনলে না?

জয়নুবা বেগমের কথায় ছোট্ট সিনান এগিয়ে এসে বলে,

—তোমাকে দিবো না‌। তবে জাবির ভাইয়া আর রাইসা আপিকে দিবো।

সিনানকে ইগনোর করে চলে যেতে নিলেই জয়নুবা বেগম বলে ওঠেন,

—কুহেলিকা এই হলো তোর ভাগ্নে।কায়ফার ছেলে সিনান।

কুহেলিকা তাকায়।বছর চারেকের হবে বাচ্চাটা। অর্থাৎ সে নিরুদ্দেশ হওয়ার বছর দুয়েকের মাঝেই হয়তো বিয়ে হয়েছে কায়ফার।চিন্তা করে না কুহেলিকা।আবারো গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হাঁটে।সে আজ প্রচন্ড অবাকতর অবস্থায় আছে।প্রথমত এতো বছর নিরুদ্দেশ থেকে হঠাৎ আসার পর তাকে তেমন কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি,দ্বিতীয়ত ও যেন সবার আদরের দুলারি ছিলো এমন ভালো মানসিকতা দেখাচ্ছে ওকে।

—কুহেলিকা তুমি কোথাও যাচ্ছো?

কায়েস চৌধুরী সিড়ি বেয়ে নামার সময়ই প্রশ্ন করেন। সিঁড়ির দিকে তাকায় কুহেলিকা।কিছুটা সময় নিয়ে কুহেলিকা বলে ওঠে,

—হুম,কাজে বের হচ্ছি।

—কাজ না ছাই কোন পিরিতের মানুষের কাছে যাচ্ছে দেখো!এতদিন যার কাছে ছিলো তার কাছেই যাচ্ছো নিশ্চিত!চরিত্রহীন মেয়ে কোথাকার

রুমানা আফরোজ বেশ জোরে সরেই বলে ওঠেন‌।কায়েস চৌধুরী বিরক্তিকর মুখশ্রী বানিয়ে চুপ করতে বলেন তাকে।কুহেলিকার দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে বলেন,

—সিনানের আব্বু এসেছে আজ। ওদের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে দশ মিনিটের রাস্তা।আজ বিকেলে বাসায় আসবে। তাড়াতাড়ি ফিরে এসো দুলাভাই এর সাথে পরিচিত তো হতে হবে তাই নয়কি!

—চেষ্টা করবো।

কুহেলিকা ক্লান্ত পরিবার হীন জীবন কাটিয়ে। তাই আর বাত্তামিজি করলো না। অবশ্য পরিবার ছাড়াও সে বেশ ভালোই ছিলো।যাদের কাছে ছিলো তারা তো তার পরিবারেরই অংশ।তবে নিজের বাবা-মার স্থান যে কাউকেই দেওয়া যায় না।হোক বাবা-মা যতই খারাপ!

কুহেলিকা বাড়ি থেকে বেরিয়েছে ঘন্টাখানেক হলো।সূর্যের প্রকোপ অনেকটাই কমে এসেছে।বিকেলের আভা ছড়িয়ে পড়েছে।বাচ্চারা ঘুড়ি হাতে খোলা মাঠের দিকে ছুটছে।আবার কিছু ঘুড়ির দেখা আকাশেও মিলেছে। বসন্ত কালে বাচ্চা থেকে বুড়ো সবারই পছন্দের খেলা ঘুড়ি ওড়ানো।

সাফিন বসে আছে চৌধুরী ভিলায়। শশুর বাড়িতে কি আর হই হুল্লোড় করা যায় নাকি।যায় তবে থাকতে হয় ছোটো ছোটো শালাশালী।যার অভাব বেশ অনুভব করছে সাফিন।ছেলেটা মায়ের নেওটা হয়েছে। এখানে এসেছেও মায়ের পিছুপিছু চলে গিয়েছে।তবে সাফিনের দৃষ্টি খুঁজছে আরেকজনকে।কুহেলিকাকে খুঁজছে তার দৃষ্টি।বারবার মনে হচ্ছে মেয়েটা যদি এখন ওকে এখন দেখে তাহলে কেমন অনুভব করবে!

—পাপা চলো না ঘুড়ি উড়াই।

সিনানের মাসুম আবদার না রাখার মানে হয় না।তাছাড়া আজ রাতেই জরুরি তলবে ফিরতে হবে তাকে। একসপ্তাহের ভেতর আর আসার সম্ভাবনা নেই তার।তবে এরপরের বার একেবারে ট্রান্সফার নিয়ে চলে আসারই চিন্তাচেতনা আছে।ছেলের বেড়ে ওঠা না দেখতে পারলে হয় নাকি!আর স্ত্রীকেও তো সময় দিতে হবে। মনের ভালোবাসা পুরোপুরি হারিয়ে যাওয়ার পূর্বেই তো তা আগলে ধরতে হবে !

চলবে কি?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে