দুই পথের পথিক পর্ব-০২

0
440

#দুই_পথের_পথিক
#পর্ব২
#বর্ষা
বাসের হঠাৎ ঝাঁকুনিতে ঘুম ভাঙে কুহেলিকার।অতীত ভাবতে গিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তার খেয়ালই নেই।হাত ঘড়িতে একবার সময় দেখে চারপাশটা দেখে নেয় সে।জানতে পারে এখন কুমিল্লাতে আছে বাস। ছোট্ট ব্রেকের ব্যবস্থা আরকি!পাশের সিটটা ফাঁকা।বুকটা ধুক করে ওঠে তার।তবে কি কিঞ্চিত সময়ের নিকটত্বও সহ্য হলো না নিয়তির!

কুহেলিকা শীতল চাহনিতে বাইরের পরিবেশটা দেখতে থাকে।মাঝের দিকে সিট পড়েছে তাদের।সেফ জার্নির জন্য নাকি মাঝের সিটগুলোই নিরাপদ এমন কথা প্রচলিত আছে লোকমুখে।তবে এমন কোনো ধারণায় যেন বিশ্বাস নেই কুহেলিকার।

—আম্মু আস্তে ছোটো নয়তো পরে যাবে।

শব্দগুলো বাক্যে প্রতিধ্বনিত হতেই কুহেলিকা কেঁপে ওঠে।বাসের বাইরে উঁকি দেয়।বছর ত্রিশের লোকটা বাচ্চা মেয়ের পেছনে ছুটছে।আর তাদের থেকে কিঞ্চিত দূরেই দাঁড়িয়ে আছেন বোরখা পরিহিতা রমনী‌।সুখী পরিবার!কুহেলিকারও তো স্বপ্ন।

—কি দেখছেন বাইরে?

—মিষ্টালো সম্পর্ক।

কুহেলিকা জবাব দিয়েই ফিরে তাকায়।সাফিন কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে।কুহেলিকা দ্রুত দৃষ্টি সরায়।সাফিন সিটে বসে বলে ওঠে,

—মিস যাত্রা তো অনেক লম্বা হতে চলেছে।যদি একে অপরের সাথে গল্প করে কাটাই তাহলে হয়তো সময়টা দ্রুত কাটবে।কি বলেন?

কুহেলিকা ঘেমে একাকার।দীর্ঘ যাত্রায় মাস্ক এখনো খোলা হয়নি‌।তার ওপর সাফিনের গল্প করে কাটানোর বিষয়টা হজম হয়না তার‌।সাফিনকে বলে সাইট কেটে বাস থেকে নেমে আসে সে।ওয়াসরুমে গিয়ে মুখে পানি দেয় সে।উত্তেজনাকে কাবুতে করতে চায় সে।

বাসে বসে এক অভাবনীয় ভাবনায় ব্যস্ত সাফিন।কেন জানি পার্শবর্তী অজানা রমনীকে তার বড্ড চেনা লাগছে।মনে হচ্ছে এই সে মেয়ে যাকে সে মনে প্রাণে কোনো একসময় অনুভব করেছে।সাফিনের ভাবনার মাঝেই ফোনটা বেজে ওঠে তার।রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মেয়েলী কন্ঠে কেউ বলে ওঠে,

—কতদূর আপনি?খাওয়া দাওয়া করেছেন?আর আপনার পাশের সিটে কে বসেছে?

একসাথে এতগুলো প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সাফিন শুধু বলে,—আরো ঘন্টাখানেক লাগবে।ভোর নাগাদ পৌঁছে যাবো‌।

কল কেটে দিয়ে সিটে মাথা এলিয়ে দেয় সাফিন।মাথাটা অনেক ধরেছে।বসে ঘুমানোতে মেরুদন্ডের ওখানেও ব্যথার সৃষ্টি হয়েছে। শক্তপোক্ত দেহটা যেন আর কথা শোনে না‌। সাফিন ললাটে হাত ঠেকিয়ে ফিরে যায় অতীতে।

পিকনিক বাসে প্রথমবারের মতো মেয়েদের বাসে সে।তাও পছন্দের রমনীর অনুরোধে।মেয়েটা অনেক রিকোয়েস্ট করায় শেষমেশ যাওয়া।আবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাসনও ছিলো হৃদয় ছোঁয়া।সিটের কমতিতে বাসের দরজায় ঝুলেই যাচ্ছিলো সে।মেয়েটা হয়তো আমলে নিয়েছিলো তা।ম্যাসেজ দিয়ে অধিকার দেখিয়ে আর্জি জানালো দেখবে তাকে।আসতে হবে মেয়েদের বাসে।আসলো তবে একবারেই শেষ মুহূর্তে।মেয়েটার বাচ্চাপনা তখনো যায়নি।

বান্ধুবীদের সাথে নাচ-গানে আছে সে ধুমধাড়াক্কা। অবশ্য অবাক হয়েছে বেশ সাফিন সেদিন‌।মেয়েটাকে সে সর্বদা এসব থেকে দূরেই দেখেছে তবে হঠাৎ নাচ -গানে তার আবির্ভাবে অবাক হবারই কথা।হিজাবী মেয়েটা সেদিন বান্ধুবীদের তাড়নায় হিজাব ছেড়ে খোলা চুলে আসলো তার সামনে।কি মায়াবতীই না লাগছিলো তাকে। কাছাকাছি ফ্লিড ট্যুরে যাচ্ছিলো তারা।তাইতো হয়নি বেশি সময়ের দেখাদেখির খেলা।

সাফিন ম্যাসেঞ্জারে গিয়ে হাইডেন কন্টাক্টে গিয়ে আইডি বের করে মেয়েটার।নিকনেম ‘মায়াবতী’ দেওয়া।তবে হয়তো মায়াবতীর রেস্ট্রিকশনের লিস্টে আছে সে আদৌ।শেষ ম্যাসেজটা আওড়ায় সে।

—ভালোবাসা নাকি কষ্ট দেয়!তবে আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা আমায় মুক্তির পথ দেখালো।আপনার থেকে,পরিবার থেকে, এককথায় সবার থেকে আড়ালে মিলিয়ে যাবো আত্মগোপনে।তবে ফিরবো নিশ্চিত নিজেকে সুখী করে!আমি স্বার্থপরতা করবো ঠিকই তবে তা নিজেকে বাঁচাতে।

কুহেলিকার কথাগুলো ছিলো তার প্রেমিক পুরুষের জন্য।হ্যা সেই প্রেমিক পুরুষ আর কেউ নয় বরং সাফিন।হায়রে ভাগ্য দু’জনকে দেখা তো করালো তবে একজন চিনলেও অপরজন আর চিনতে পারলো না!

—কুহু…

সাফিন চোখ খুলে কুহেলিকাকে দেখেই নিরব কন্ঠে বলে ওঠে।কুহেলিকা শান্ত দৃষ্টিতে তাকায়।ডাকনামে বহুদিন কেউ ডাকে না তাকে। খোলা মুখশ্রী।গোলাপী ঠোঁট একপাশে কামড়ে দাঁড়িয়ে সে।সাফিন বেরিয়ে জায়গা দিতেই কুহেলিকা ঢুকে যায় সিটে।গা এলিয়ে দেয়।সাফিন যেন এখনো স্তব্ধ দাঁড়িয়ে।

—স্যার বসুন…

কুহেলিকার কন্ঠে অনুভূতিশূন্যভাবে বসে পড়ে সে।কি বলবে,কোথা থেকে বলবে কিছুই যেন মস্তিষ্কের শিরদাঁড়ায় পৌঁছাচ্ছে না। অবাঞ্ছিত প্রশ্ন করে সাফিন।

—কেমন আছো?

—জ্বি আলহামদুলিল্লাহ স্যার।আপনি কেমন আছেন?

—আলহামদুলিল্লাহ।এতবছর কোথায় নিরুদ্দেশ ছিলে?

কুহেলিকা চোখ তুলে তাকায়।কারো তো তার নিরুদ্দেশ হওয়ার ব্যাপারে মতায়ন করার কথা নয়।আর সেখানে নাকি কেউ মনে রেখেছে তার নিরুদ্দেশ হওয়ার ঘটনা।কুহেলিকা মুচকি হাসি উপহার দিয়ে তাকায় তার দিকে।চোখ যেন তার নিরব কথাগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলে যাচ্ছে অনায়াসে।

সাফিন বাক্যহীন ঘুরে বসে থাকে।কুহেলিকার সাথে তার বর্তমান সম্পর্কের ভিত যে অন্যরকম।পছন্দ সে কুহেলিকাকে করলেও ভালো তো বাসতো নিজের পছন্দের রমনীকে।

—সবচেয়ে কষ্টদায়ক আনন্দক্ষণ মুহূর্ত তো সেইটা যখন ভালোবাসার ব্যক্তির অন্য আরেক ভালোবাসার মানুষ থাকে।

সাফিনের বারবার মনে পড়ছে কুহেলিকার পূর্বে বলা কথাগুলো।বড্ড আবেগী ছিলো যে সেই মেয়েটা।তবে বর্তমান কুহেলিকার মাঝে আগের আবেগ আর দেখতে পাচ্ছে না সাফিন।কেন জানি তার বড্ড কষ্ট লাগছে!

বাস আবারো চলতে শুরু করেছে। এতক্ষণ অস্বস্তি নামক কোনো কিছু না থাকলেও পরিচয় মেলার পর থেকে যেন দুজনের মাঝেই সমান অস্বস্তি।কুহেলিকার মাঝে প্রশান্তি ছিলো সাফিন ওকে চিনতে পারেনি তবে পাশাপাশি বসতে পেরেছি দু’জনে।তবে এখন সেই ভাবনা বদলে অস্বস্তিরা বিব্রত করছে তাকে।সাফিনের মাঝে আনন্দ থাকলেও জট পেকেছে হাজারো বর্তমানের চিন্তা!

অন্ধকারে আবৃত রাত।বাসের লাইটগুলোও নিভানো। যাত্রীদের মাঝে শুধু দুই জোড়া চোখ জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। প্রাপ্ত বয়স্ক নরনারীর মাঝেকার আবেগ যেন ফুটে বেরিয়ে আসতে চাইছে।তবে বাঁধ মানতে বাধ্য তারা উভয়েই।চোখ জোড়া বন্ধ করতেই সাফিনের ফোনে টুং করে আওয়াজ হয়।মোবাইল বের করে ধরতেই দেখে ‘বিবি সাহেবা’ থেকে ম্যাসেজ এসেছে।

—আপনার জন্য আপনার বিবি,পুত্র অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।দ্রুত আসুন। আপনার অনুপস্থিতিতে যে বড্ড পোড়াচ্ছে আমাদেরকে।জলদি আসুন না…

ম্যাসেজটা চোখ এড়ায়নি কুহেলিকারও।চোখের অশ্রুরা বাঁধ ভেঙে গড়িয়ে পড়েছে নিঃশব্দে।জানালার দিকে ঝুঁকে প্রিয় মানুষটির বউয়ের ম্যাসেজের কথা ভেবেই অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে সে।যদিওবা সে ধারণা করেই রেখেছিলো তার প্রিয় মানুষটা হয়তো এতদিনে বিবাহিত।তবুও তকদিরে এই ঘটনা লেখার খুব কি দরকার ছিলো!খুব কি দরকার ছিলো সাফিনের সাথে কুহেলিকার আবার দেখা হওয়ার!খুব কি দরকার ছিলো তারা দু’জন পাশাপাশি বসে যাত্রা করবে এমনটা হওয়ার!কুহেলিকা বিড়বিড় করে বলে ওঠে,

—যার দ্বিধায় বাঁচতে চেয়ে আমি হয়েছিলাম ছারখার,সে আজ বাঁচে তাঁর প্রেয়সীর দ্বিধায়!

চলবে কি?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে