#দুঃখগুলো_নির্বাসিত_হোক(০৮)
#সুমাইয়া_ইসলাম_জান্নাতি(লেখনীতে)
_________________________
“এই মেয়ে তোমার সমস্যা কি? রুমের মধ্যে কি হয়েছে কি হয়নি সেসব কথা বাহিরে বলতে হবে? কথা কি পেটে জায়গা হয় না? এত মুখ পাতলা স্বভাবের কেন হ্যাঁ?”
রুমে ঢুকতেই জাওয়াদের রাশভারী কন্ঠের কতগুলো প্রশ্নের সম্মুখীন হলো মালিহা। পা যুগল ওখানেই থেমে যায়। সামনে অগ্রসর হওয়ার সাহস তার হয় না।
মালিহাকে নিশ্চুপ দেখে রেগে গেল জাওয়াদ। কর্কশ কন্ঠে বলল, “কানে শুনতে পাও না? এতগুলো প্রশ্ন করলাম অথচ উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছো না?”
“কি জানতে চান? এত এত প্রশ্নই বা কেন করছেন? আপনাকে কখনও কোন বিষয় নিয়ে আমি জেরা করেছি? সব সময় অন্যদেরকেও নিজের মত ভাবেন কেন?”
”ভাবির কাছে কি বলেছো?”
“কিছু বলিনি। আর কি বলেছি না বলেছি তার থেকে শুনে নিলেই পারেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন?”
“নিজেদের মধ্যে কি হয়েছে কি হয়নি এসব বাইরের মানুষ কেন জানবে? এসব আমার পছন্দ না।”
“সবকিছু কেন আপনার পছন্দে হতে হবে? কিনে নিয়েছেন নাকি? তাছাড়া আপনার সাথে কিছু হয়নি তো আমার।”
মালিহার তেজস্বী কন্ঠের সাথে জাওয়াদ পরিচিত না। কখনও মুখের ওপর কথা বলেনি মেয়েটা। তবে কি আজ মেয়েটির এমন ব্যবহারের জন্য সে দায়ী? তবুও মুখে ফুটে বলল, “ভাবি যে বলল তোমার মন খারাপ? আমি কেন জানলাম না?”
“আপনাকে ডেকে বুঝিয়ে বলতে হবে আমার মন খারাপ? চোখ নেই দেখতে পান না? তাছাড়া এত অবান্তর প্রশ্ন কেনই বা করছেন? আপনি নিজে ঠিক হোন। পরবর্তীতে অন্যকে সুধরাতে আসবেন।”
“ইবনাত তুমি কিন্তু বেশি বেশি করছো!”
“তাই নাকি? এখন বেশি বেশি হয়ে গেল? কাল থেকে আপনি কি করছেন? মুখে যেন আমাবশ্যার আধার নেমেছে। আমি কি জানতে চেয়েছি কিছু? কথাও বলছেন না। শুধু কিছু জিজ্ঞাসা করলে অল্প কথায় উত্তর দিচ্ছেন। আমি কি মানুষ না! কৌতূহল নেই? আপনার কোন কথায় বা কাজে কখনও দেখেছেন হস্তক্ষেপ করতে আসি?”
প্রতিত্তোরে জাওয়াদ কাতর কন্ঠে বলল, আমি ভালো নেই। একটুও না।”
“ঘরে যে আপনার একজন বউ আছে কখনও মনে করেছেন তার সাথে শেয়ার করতে? অন্তত কারো সাথে কথা শেয়ার করলেও হালকা লাগে।”
“শেয়ার করার মত কিছু নেই। আমি বলতে আগ্রহী না। তাছাড়া আমাকে বিরক্ত করবে না। একা থাকতে দাও।”
মালিহার নেত্রযুগল ছলছল করে উঠলো। তার স্বামী নামক মানুষটা এমন কেন? তাদের কি কখনও স্বাভাবিক সম্পর্ক হবে না! ধরা গলাই বলল, “বেশ তাই হোক। আপনার চোখের সামনে আসব না।”
“যা চলে যা। সব চলে যা। এখান থেকে যা।”
“আপনি স্বামী বলে যা তা ব্যবহার করবেন এমন রাইট নেই আপনার। আপনার ঘরের রাখা দাসী-বাদি না আমি। বহু উপেক্ষা সহ্য করেছি তাই বলে এই না এবারও তা করবো। ভদ্র ভাষায় কথা বলবেন।”
“বলব না। কি করবি?”
“মালিহা কাজে করে দেখাই। মুখে না। যাইহোক আপনার সম্মুখে আমি আর আসব না।”
দৌড়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে মালিহা। চোখ জুরে আজ অশ্রুর ঢল নেমেছে। জাওয়াদ আটকানোর সামান্য চেষ্টা টুকুও করলো না। সে বেলকনিতে গিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে। তার মনে কি চলছে শুধু আল্লাহ্ আর সে ব্যতীত কেউই জানে না।
রিপ্তির রুমের দরজা খোলা। মালিহা অনুমতি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। রিপ্তি মেয়েকে খাওয়াচ্ছে। একটু অবাক হলো। মালিহা এ সময়ে তার রুমে কখনও আসে না। আজ হঠাৎ!
“আজ রাতটা আপনার রুমে থাকব। আপত্তি আছে?”
“না। থাকবি সমস্যা কিসের। বেশ তো। কিছু হয়েছে মালিহা? চোখ মুখের কি অবস্থা করেছিস?”
“কিছু হয়নি ভাবি। ঠিক আছি আমি। আজান তো হয়ে গেছে। আমি নামাজ পড়েই ঘুমিয়ে পড়বো। শরীর খুব ক্লান্ত।”
“আচ্ছা।”
রিপ্তি মুখে ‘আচ্ছা’ বললেও মনে চলছে প্রশ্নের আন্দোলন। নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। সহজ সরল মেয়েটার কি অবস্থা। নিজ থেকেও কিছু জিজ্ঞাসা করলো না। সময় হলে বলার মত কিছু হলে মালিহা নিজেই তাকে বলবে। বরং এখন সে কিছু জিজ্ঞাসা করতে গেলে মালিহার খারাপ লাগাটা বাড়বে ছাড়া কমবে না। অগ্যতা কৌতূহলকে ধামাচাপা দিয়ে আপন কর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মালিহা গিয়েছে ওয়াশরুমে ওজু করতে।
পুরো একটা রাত গেল জাওয়াদের থেকে মালিহা দুরে। সে একটাবারের জন্যও মালিহাকে মানাতে যাইনি। প্রতিদিনকার নিয়মনুযায়ী অফিসে চলে গিয়েছে সকাল সকাল।
“আসসালামু আলাইকুম। আম্মা আসবো?”
শিরিন বেগম কোরআন পড়ছিলেন। মালিহা কন্ঠ পেয়ে পড়া বন্ধ রেখে জবাবে বলল, “এসো।”
“আম্মা! আমার বাড়ি যেতে মন চাচ্ছে। মাকে দেখতে মন চাইছে খুব। আপনি যদি অনুমতি দেন তবে যেতে চাই।”
প্রথমে কঠোরভাবে না করার ইচ্ছে থাকলেও মালিহার কন্ঠ আর মুখোভঙ্গি দেখে মত পাল্টালেন শিরিন বেগম। বললেন, “বেশ যাও তবে। তা তোমার মা-বাবা ভালো আছেন তো?”
“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছেন।”
“একা যাবে না জাওয়াদ নিয়ে যাবে?”
“তিনি অফিসে চলে গিয়েছেন। ফিরতে অনেক সময়। বলছি আব্বাকে বলে দিন আমাকে বাস স্টান্ড পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে আসতে। ওদিক থেকে আমার আব্বু বা ভাইয়া এসে এগিয়ে নিয়ে যাবে।”
“আচ্ছা আমি বলে রাখছি। তুমি রেডি হয়ে থেকো।”
“ঠিক আছে আম্মা। আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম।”
_______________
বাড়ির উদ্দেশ্য মালিহা বেরিয়ে পড়েছে। সঙ্গে শশুর বাবা আছেন। মালিহা রিপ্তিকে না বলেই চলে এসেছে। কারন মালিহা জানে, রিপ্তি জানতে পারলে কিছুতেই যেতে দিবেন না। না হলে মানুষটা কষ্ট পাবে। অগ্যতা তাকে না জানিয়ে যেতে হচ্ছে। কেউ না জানুক রিপ্তি জানে কেন সে এত তাড়াহুড়ো করে বাড়ি যাচ্ছে। যাওয়ার আগে দুচোখ ভরে বাড়িটা দেখে নিল মালিহা। হয়তো এটাই তার শেষ যাত্রা।
বাস ছেড়ে দেওয়ার কিছু পরেই একটা ছোট্ট বার্তা রিপ্তির উদ্দেশ্য পাঠিয়ে দিল ওয়াটস এ্যাপে। যাক এবার ঠিক আছে।
রাস্তার পাশে উচুনিচু ভবন, গাছপালা, সুবিশাল ধানের ক্ষেত পেছনে ফেলে বাস এগিয়ে চলছে তার গন্তব্যে। বাসের একটা সিট দখল করে যাচ্ছে দুঃখি মেয়ে মালিহা। সেও অবহেলা, অনাদর আর সল্প কিছুদের আদর সোহাগ পেছনে ফেলে চলে যাচ্ছে নির্দিষ্ট গন্তব্যে।
মালিহার বাবার বাড়িতে পৌছাতে প্রায় দুপুর ছুঁই ছুঁই। কলিং বেলের শব্দে দরজা খুললেন মধ্যবয়াস্কা একজন মহিলা। তিনি মালিহার মা মনোয়ারা বেগম। দরজা খুলতেই হিজাব নিকাবে আবৃত বিধ্বস্ত মেয়েকে আবিষ্কার করলেন তিনি। অবাকের শীর্ষে আছেন তিনি। হুট করে না বলে আসার মত মেয়ে তার না। এতটা পথ একা কি করে আসলো!
“ভেতরে ঢুকতে দিবে না। নাকি তাড়িয়ে দেওয়ার প্ল্যান করছো?”
“একি কথা মালিহা। তাড়িয়ে দিব কেন? তোর বাড়ি যখন খুশি আসবি। আয় মা। ভেতরে আয়।”
দ্রুত পায়ে গিয়ে ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে মেয়েকে সোফায় বসালেন। যেন হাটার মত শক্তি পাচ্ছে না মালিহা। মনোয়ারা বেগম যত্নের সাথে হিজাব নিকাব খুলে দিলেন। মালিহা চোখ বন্ধ করে সোফার হাতরে মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে আছে। পরম যত্নে মালিহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন মনোয়ারা বেগম। আরাম পেয়ে মিনিট খানিক পরেই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেল মালিহা। এই তো শান্তি। মায়ের মমতাময়ী স্পর্শে দুঃখগুলো পানি হয়ে যায়।
অনিয়ম করে অফিস থেকে ফিরেছে জাওয়াদ। ইফতারের কিছু পূর্বে। বাড়িতে আসার পর থেকে একরাশ শূন্যতা গ্রাস করে নিয়েছে তাকে। যেদিকে তাকায় সেদিকেই কেমন খালি খালি লাগছে। বুকের পাশটাও কেমন চিনচিন ব্যাথা। ইফতারের টেবিলে মালিহা নেই। মিনিট পার হয়ে ঘন্টা পেড়িয়ে যায় কিন্তু মালিহার দেখা নেই। প্রথমবারের মত চিন্তা হলো জাওয়াদের। কোথায় গেল! অন্যদিকে রিপ্তির মুখও থমথমে ভাব।
টেবিলে সবাই অথচ মালিহা নেই। এ নিয়ে কেউ কিছু বলছে না। আশ্চর্য হলো জাওয়াদ। আস্ত একটা মানুষ বাড়িতে নেই অথচ এ নিয়ে কারো কোন হেলদোল নেই। শিরিন বেগম এক ফাঁকে বললেন, “জাওয়াদ মালিহা তোকে ফোন করেছিল বা তুই করেছিলি?”
“কেন মা?”
“কি বলে ছেলে! ও যে বাপের বাড়ি গেল পৌঁছেছে কি না সেটা জানা প্রয়োজন না!”
রিপ্তি বলল, “আমাকে টেক্সট দিয়েছিল। পৌঁছে গিয়েছিল দুপুরের মধ্যে। তাকে নিয়ে কারো চিন্তা না করলেও চলবে।”
বিনা মেঘে বজ্রপাত জাওয়াদের ওপর পড়লো। তার এমনটাই অনুভব হলো। তার মানে মেয়েটা সত্যি!
রুমে ফিরে কিছুক্ষণ পাগলের মত পায়চারি করলো জাওয়াদ। মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে গেছে। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। এমন সময় রিপ্তির আগমন। জাওয়াদকে উদ্দেশ্যে করে বলল, “বলেছিলাম তোমায়। সুযোগ বারবার আসে না। আবারও আগের ভুল করলে!”
জাওয়াদ অসহায় কন্ঠে বলল, “কি করবো ভাবি?”
“মেয়েটা যাওয়ার আগে আমাকেও জানিয়ে যাইনি। আম্মার থেকে অনুমতি নিয়েছে শুধু। তারপর আব্বা গিয়ে বাসে উঠিয়ে দিয়ে আসছে। আমাকে টেক্সট পাঠিয়েছে শুধু । তারপর বাড়ির সব জায়গাই খুজলাম। পেলাম না। হয়তো বেশ দুরে যাওয়ার পর জানিয়েছে। বড্ড ভুল করলে ভাই। বড্ড ভুল। এর খেসারত দিতে দেখো কত জনম লাগে!”
“ওকে গিয়ে নিয়ে আসবো ভাবি?”
“না। মোটেও না। এখন যাবে না। দুটো দিন যাক তারপর যেও। তখন রাগ কিছুটা হলেও কমবে।”
হতাশার শ্বাস ফেললো জাওয়াদ। দুটো দিন কি করে থাকবে প্রয়সীকে না দেখে! ভাবতেই শ্বাসরোধ হয়ে আসছে। অসহায় কন্ঠে বলল, “দুই দিন বেশি দেরি হয়ে যায় না?”
“কিচ্ছু দেরি হয় না। কাল যখন আমার রুমে গেল শুতে কোথায় ছিলে? রাগ ভাঙিয়ে আনলে না কেন?”
“আমি বুঝতে পারিনি ও সত্যি চলে যাবে ভাবি।”
“বুঝতে পারোনি এখন বুঝ। কতবার বলার পরেও খেয়াল আসলো না তোমার। মেয়ে মানুষের মন যেখানে নরম সেখানে মোমের মত গলে যায়। আর যেখানে কঠিন সেখাতে লোহার চেয়েও শক্ত। মালিহার নম্রতা দেখেছো। কাঠিন্যতা দেখোনি। যা ইচ্ছা করো। কিছু বলার নেই।”
রিপ্তি চলে গিয়েছে। মিনিট পেরোতেই মোবাইলের রিংটোন ভেজে উঠলো। জাওয়াদ রিসিভ করছে না। তবুও নাছোড়বান্দা ফোন দিয়েই যাচ্ছে। অবশেষে জাওয়াদ কল ধরলো। কর্কশ গলাই বলল, “প্রস্টি’টিউড! কোন সাহসে কল কলেছিস? শান্তি হয়নি তোর? কি চাস?”
ওপাশ থেকে এক নারীকন্ঠ ভেসে আসলো। বলল, জাওয়াদ ঠিক মতো কথা বলো। প্রস্টি’টিউড মানে কি?”
“চুপ কর বেয়াদব। যারা তোর মত একশ ছেলের পেছনে পরে থাকে তাদের তো ওটাই বলে। তবে তোর থেকে একটা প্রস্টি’টি’উড ও ভালো। অন্তত সে কারো মন বা সংসার ভাঙে না।”
“বেশি বাড়াবাড়ি করো না। সব স্কিন সট নেওয়া আছে। তোমার বউয়ের ফোন চলে যাবে যেকোনো সময়।”
“দিয়ে দেখ। তারপর দেখবি তোর কি হয়। তোর আর তোর বয়’ফ্রে’ন্ডের অ’ন্তর’ঙ্গ ভিডিও আমি ইন্টারনেটে ছেড়ে দিব। দেখি কি করে বাঁচিস। তোর সাথে আমার এমন কোন মুহূর্ত নাই যা দেখে আমার বউ আমাকে ভুল বুঝবে।”
ফোনের ওপাশের রমনী ভিষন ভয় পেয়ে গেল। কাঁপা কাঁপা গলাই বলল, “কি বলছো জাওয়াদ। তুমি ছাড়া কেউ ছিল না আমার। বিশ্বাস করো।”
“আমাকে রাগাস না। খবরদার আমাকে ফোন বা টেক্সট কোনোটাই করবি না। তোর সাথে আমার যে নরমালি কথোপকথন হয়েছে তা দেখে বড়জোর আমার বউ আমার ওপর রেগে থাকতে পারে। ভেবে দেখ তোর ভিডিও ভাইরাল হলে দুনিয়ার বুকে বেঁচে থাকতে পারবি কিনা।”
ক্রন্দোনরত কন্ঠে রমনী বলল, “দোহায় তোমার। এমন কিছু করো না। সব স্কিনসট ডিলিট করে দিব। আর তোমার মুখো হবো না।”
কট করে ফোনটা কে’টে দিল ওপাশ থেকে। স্বার্থসিদ্ধি তো হলোই তা উল্টা আরও আতঙ্ক নিয়ে ফিরলো রমনী। এ মুখো আর হবে না সে। মনে মনে পণ করলো।
জাওয়াদ ননস্টপ কল করে যাচ্ছে। কিন্তু মালিহার ফোন নাম্বার বারবার বন্ধ বলছে।
ইনশাআল্লাহ চলবে…..