#দুঃখগুলো_নির্বাসিত_হোক(০৫)
#সুমাইয়া_ইসলাম_জান্নাতি(লেখনীতে)
____________________________
বিপত্তি বাধলো দুদিন পরে। ঠিক বিপত্তি বলা চলে না তবে মালিহার নিকট অনেকটা বিপত্তির মতোই। শাশুড়ি আর ছোট ননদ যাবেন মালিহার বড় ননাসের বাড়িতে। সঙ্গে বিপুল আয়োজিত ইফতারের সমাহার নিয়ে। বড় জা রিপ্তি তার মেয়ের অসুস্থতার জন্য সে মেয়ে নিয়ে খুবই ব্যস্ত। মানবিক দৃষ্টি দিয়ে দেখতে গেলে বলাও যাচ্ছে না। আবার নিজ থেকে কাজ করতে আসলে করতে দেওয়াটাও ঠিক না। আপাতত মেয়ে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত মেয়ের দেখাশোনা করাটাই উচিত। এদিকে বাড়িতে স্থায়ী কোন হেল্পিং হ্যান্ড নেই। যে আছে ছুটা বুয়া অর্থাৎ দিনের নির্দিষ্ট কিছু সময় পর্যন্ত সে কোনরকম কাজ সমাধা করে চলে যায়।
শাশুড়ি মায়ের আদেশ। প্রায় সাত প্রকারের ভাজাপোড়া, বিরিয়ানি , কাবাব, সেমাই , পায়েস, রোস্ট, চিংড়িসহ, হালিম আরও ব্যপাক খাবার তালিকা ধরিয়ে দিয়েছেন হাতে। কড়া কন্ঠে বলে দিয়েছেন, দোকান থেকে একটা খাবারও যেন না আনা হয়। সব বাড়ির তৈরি। শুনে মালিহার ঘাম ছুটে গিয়েছে। তার ভাবতেই গলা শুকিয়ে আসছে। না জানি রোজা অবস্থায় সে এতকিছুর আয়োজন করবে কি করে!
বারবার দুঃখ প্রকাশ করছে রিপ্তি। সাথে শাশুড়ির প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করতেও বাদ রাখছে না। ঠিক কতটা অমানবিক হলে এতগুলো কাজের দায়িত্ব দিতে পারলো। তবুও বলল, ”শোন, এত চিন্তা করিস না। আল্লাহ্ ভরসা। ভাজা পোড়ার সব পদ গুলো দোকান থেকে কিনে আনলেই হবে। কেননা বাড়ি আর দোকানের কেনা স্বাদ একই। এতে কিছুটা সময় বাঁচবে। বিরিয়ানির জন্য মেরিনেট করা মাংস আগেই রান্না করে ফ্রিজে রেখে দিলেই হবে। পেয়াজ বেড়েস্তা এসব খাবারে লাগে বেশি। ওটাও আগে ভেজে রাখলে হবে। সবজি ফলমূল সব আগে কেটে রেখে দিলে হবে। আর রইলো বাকি একা হাতে করার কথা! বাবু ঘুমিয়ে গেলেই আমি কিচেনে চলে আসবো। আমি মানুষ দেখেছি কিন্তু আমার শাশুড়ির মত অমানুষ দুটো দেখিনি। রমজানের এই পবিত্র মাসেও সামান্য পরিবর্তন নেই মহিলার।”
রিপ্তির পরামর্শে কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেল মালিহা। বলল, “বাঁচালেন ভাবি। কি যে চিন্তাই ছিলাম।”
“শাশুড়ির মত হয়েছে ছোট মেয়েটাও।”
“কার কথা বলছেন ভাবি?”
“কে আবার জাকিয়া!”
“ওহ্।”
“ও কি ছোট আছে? ভাবিদের একটু সাহায্য করলে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে? ভাবিরা কাজ করে মরলো না বাঁচলো ধার ধারেনা একটুও। অথচ আবদার ঝুলি ঝুলি।”
“বাদ দেন ভাবি। এসব আমার ভালো লাগে না। তাছাড়া ওর থেকে কোন সাহায্য আমি আশা করি না। যে আমাকে সামান্য সম্মান টুকুও দেয় না তার থেকে কিছু আশা রাখা বৃথা। তবে আপনাকে তো বেশ মানে!”
“মানবে না কেন? জাওয়াদের মত তোর ভাইয়া ওমন ভিজে বিড়াল না। আমার সাথেও এমন করতো। তারপর সাহস করে একদিন তোর ভাইয়াকে বলে দিলাম। সে কড়া কন্ঠে নিষেধ করে দিয়েছে পরবর্তীতে যেন এমন কিছু না হয়। এমন না যে সে মা বোনকে ভালোবাসে না। সেও খুব ভালোবাসে। কিন্তু মা-বোনের ভুলগুলো ধরিয়ে দিতে দোষ কোথায়!”
মালিহা দমে গেল। নিজের ওপর আবারও খুব আফসোস হলো। কেন সে এমন কাউকে পেল না যে তার সব খারাপ সময়ে ঢাল হয়ে রুখে দাড়াবে।
রিপ্তি হয়তো মালিহার নিভে যাওয়া মুখশ্রী দেখে আন্দাজ করতে পারলো। বলল, “ধুর মেয়ে। সামান্য কথায় মন খারাপ করতে আছে? জাওয়াদ যে বলে না এমন কিছু না। দেখলি তো সেদিন ইফতারের সময় কিভাবে জাকিয়াকে ঝাড়লো। সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। আল্লাহ্ ভরসা। এখন রুমে যা রাত তো অনেক হলো।”
মালিহা রিপ্তির কথায় সম্মতি জানিয়ে রুমে দিকে পা বাড়ালো। কিন্তু মনে বয়ে চলেছে প্রশ্নের আন্দোলন। এ আন্দোলন কে থামায়। অগ্যতা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে রুমে ঢুকলো।
ল্যাপটপ নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে খুবই মনোযোগী ভঙ্গিতে জাওয়াদ। দেখে বেশ সিরিয়াস মনে হচ্ছে। কিন্তু মালিহার মন চাইছে জাওয়াদ তাকে দেখুক। কিছুক্ষণ একান্তে গল্পগুজব করুক। কিন্তু ব্যক্তি যে সিরিয়াস মুডে আছে কথা বলার মত সাহস পাচ্ছে না মালিহা। অগ্যতা তার মুড ঠিকঠাক করতে বেলকনির দিকে পা বাড়ালো। রাতের মেঘমুক্ত আকাশ দেখা এর থেকে ভালো। যদি মুড ভালো হয়!
দীর্ঘক্ষণ মালিহার সাড়াশব্দ না পেয়ে ল্যাপটপ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চারপাশে নজর বুলিয়ে দেখলো রুমজুরে মালিহার কোন অস্তিত্ব নেই। জাওয়াদের বুকটা ধ্বক করে উঠলো। রুম থেকে বাহিরেও যাইনি। তবে কোথায়? উদভ্রান্তের মত বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুম, রুমের আনাচকানাচে খোজাখুজি করেও ব্যার্থ সে। বেলকনিতে গিয়ে দেখলো মালিহা সেখানে। স্বস্তি ফিরে পেল সে। কিঞ্চিৎ সময়ের জন্য মনে হয়েছিল যেন প্রাণটাই দেহ থেকে বেড়িয়ে গেছে। কি অসহ্য যন্ত্রণায় পড়লো সে। সব দোষ এই মালিহা ইবনাত নামক সুন্দরী রমনীটির।
ঘাড়ে কারো উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়তেই চমকে ওঠে মালিহা। এধরনের স্পর্শের সম্মুখীন সে ইতিপূর্বে কখনও হয়নি। পরবর্তীতে চেনা মানুষটার অচেনা স্পর্শে স্বস্তি ফিরে পেল। শুধালো, “কি হয়েছে?”
“হয়েছে তো অনেক কিছু। আমার একলা আকাশ থমকে গেছে তোমায় ভালোবেসে, শুধু তোমায় ভালোবেসে!”
মালিহার বিস্ময়ের সীমা রইলো না। অত্যন্ত বিস্ময় নিয়ে শুধালো, “গান বললেন না মনের কথা?”
“তুমি যেটা মনে করো।”
ততক্ষণে জাওয়াদে প্রবল স্পর্শে কুপোকাত মালিহা। আড়ষ্ট কন্ঠে বলল, “রুমে যায়। চলুন?”
“আকাশ দেখা শেষ?”
“আকাশ দেখার কোন শেষ থাকে না। আল্লাহর এই অপরূপ সৃষ্টিকে বারবার দেখলেও দেখতে মন চাই। কিন্তু আপনি যা শুরু করেছেন তাতে আমার আকাশ দেখার ব্যাঘাত ঘটছে। রুমে গিয়ে শুয়ে পড়া শ্রেয়।”
“কি শুরু করেছি ইবনাত?”
মালিহার বড্ড লজ্জা লাগছে। লোকটা জেনে বুঝে তাকে লজ্জায় ফেলতে চাইছে। খুবই খারাপ লোক।
লজ্জা রঙা মুখখানা দিনের আলোয় দেখলে হয়তো আরেকদফা মুগ্ধ হতো জাওয়াদ। কিন্তু বেলকণির হালকা আলোয় প্রেয়সীর লজ্জা রাঙা টুকটুকে মুখখানা তার নজরে আসছে না। রিনরিনে স্বরে বলল, “লুচু একটা!”
“লুচু কি করে হলাম মেয়ে? বিয়ে করা বউ তুমি। রোমান্স বল রোমান্স। আচ্ছা শোন? রুমে যায়। মূল্যবান সময়টা এভাবে ব্যায় করা ঠিক হচ্ছে না।”
মালিহা নিরুত্তর। জাওয়াদ প্রেয়সীর চুপ থাকা সম্মতির লক্ষণ ভেবে নিল। কোলে তুলে নিয়ে রুমের উদ্দেশ্য পা বাড়ালো। মালিহা তার নরম হাত দুখানা দিয়ে আকড়ে ধরলো প্রিয় মানুষটার গলা। মিশে রইলো প্রসস্ত বুকখানায়। সেখানে একমাত্র ঠাঁই তার হোক। এবং শুধু তারই।
_______________________
জাওয়াদের অফিস ছুটি হয় বিকাল তিনটায়। বাড়িতে পৌছাতে প্রায় সাড়ে তিনটা বেজে যায়। কিন্তু আজকে সে দুপুরের পর পরই বাড়িতে চলে এসেছে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবারও গুটি গুটি পায়ে কিচেনে হাজির হলো। আবিষ্কার করলো এক ব্যস্ত রমনীকে। ছোটাছুটি করে রান্না করছে। ঘেমে নেয়ে একাকার।
“আম্মা আপার বাড়ি কখন যাবে?”
“আম্মা বলেছেন আসরের পর পরই যাবেন।”
“তুমি তো ঘেমে গেছো। যাও ফ্যানের নিচে বসো।”
“আরেহ্ না। সে সময় কি আছে। আপনার কিছু লাগবে?”
“না। আমি চাইছি একটু সওয়াব কুড়াতে।”
জাওয়াদের অদ্ভূত কথায় থমকে দাড়ায় মালিহা। রান্নাঘরে কেউ সোয়াব কুড়াতে আসে? বোধগম্য হলো না। কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো, “বুঝলাম না। কি?”
“তোমার কাজে সাহায্য করতে চাই। স্ত্রীর কাজে সাহায্য করাতেও সোয়াব আছে। রমজানের এই পবিত্র মাসে কি করে বঞ্চিত হই এই সুযোগ থেকে তুমিই বলো?”
জাওয়াদের ইনিবিনিয়ে বলা সুন্দর আবদারে মালিহার ওষ্ঠদ্বয়ে এক নজরকাড়া হাসি ফুঠে উঠলো। জাওয়াদও হেসে ফেলল। পুনরায় আবার বলল, “দিবে না সেই সুযোগ?”
“কেন নয়। অবশ্যই। কিন্তু আম্মা বা বাড়ির কেউ যদি কিছু বলে?”
“কি বলবে? আমার বউকে আমি সাহায্য করবো। তাতে কার কি। এখন বলো কি করতে হবে?”
“দুরে না। কাছে আসুন। ডিম সিদ্ধ বসিয়েছিলাম। খোসা ছাড়িয়ে ফেলুন তো!”
জাওয়াদ মুচকি হেসে বলল, “যথাজ্ঞা মহারানি।”
মায়ের রুমে যেতে হলে কিচেন রুম পার করতে হয় জাকিয়ার। এই সময়টা সে ভয়ে থাকে। কখন না জানি কোন ভাবি কাজে লাগিয়ে দেয়। এজন্য সে খুব প্রয়োজন ছাড়া রুম থেকে খুব একটা বের হয় না। আজকে কিচেন রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলো তার ভাই ভাবিকে রান্নায় সাহায্য করছে।
ভাইকে দেখে আরও দ্রুত পা চালিয়ে মায়ের রুমে ঢুকলো।
“মা দেখেছো তোমার ছেলে কেমন বউ পাগল হয়েছে?”
তাসবিহ্ পাঠ করছিলেন শিরিন বেগম। মেয়ের কথায় শোয়া থেকে উঠে বসলেন। ভ্রু কুচকে তাকালো মেয়ের দিকে। বলল, “তো কি হয়েছে? বউয়ের কাজে সাহায্য করলে কি হয়?”
মায়ের কথায় পাত্তা না পেয়ে মনক্ষুন্ন হলো জাকিয়ার। ফের বলল, “এজন্যই তো আমাদের ভুলে যাচ্ছে ভাইয়া। ওই মেয়ের সাথে না বিয়ে হলেই ভালো হতো।”
“বেয়াদপের মত কথা বলবি না। ভাই যখন অন্য মেয়ের পাগল ছিল তখন কোথায় ছিলি? ছোট বউয়ের পা ধুয়ে পানি খাবি। কোন দিন শুনেছিস স্বামীর অবহেলায় কোন মেয়ে শশুর বাড়ি পড়ে থাকে। খবরদার কারো নামে বিষ ঢালতে আসবি না। বউদের কিভাবে ঠিক রাখতে হয় আমার জানা আছে। এখন দুর হ। রেডি থাকবি আসরের পরে বের হবো।”
গটগট শব্দ তুলে বেরিয়ে গেল রুম থেকে জাকিয়া। সুবিধা করতে পারলো না মায়ের কানে বিষ বার্তা ঢেলে।
মেয়ের রাগে কিছু যায় আসে না শিরিন বেগমের। সে ভেবে পায় না ছোট মেয়েটা এমন কু’চু’টে স্বভাবের কি করে হলো।
ইনশাআল্লাহ, চলবে…..