#দুঃখগুলো_নির্বাসিত_হোক(০৪)
#সুমাইয়া_ইসলাম_জান্নাতি(লেখনীতে)
______________________________
প্রথমবারের মত স্বামী কোন আবদার করেছে আর মালিহা সেটা অমান্য করে মানবে না তা কি করে হয়? অকৃতজ্ঞের সাথে থেকে সে তো আর অকৃতজ্ঞ হতে পারে না। বারবার মনকে এটাই বোঝাচ্ছে মালিহা।
জাওয়াদ মসজিদে এশার সালাত আর তারাবির সালাত আদায় করতে গিয়েছে।
জাওয়াদ এখনো বাড়িতে ফিরেনি। অন্য দিকে রুমে এক অতীব সুন্দরী যুবতী কালো রঙা শাড়ি পড়ে দর্পণে নিজেকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে ব্যস্ত। গায়ে জড়িতেছে কালো জামদানি শাড়ি। গলায় কালো পাথরের কারুকাজ খচিত ছোট্ট চিক। কানে ম্যাচিং দুল, হাতে দুমুঠো কালো চুরি, আঙ্গুলে আংটি। আর কোমর সমান ঘন লম্বা কুচ বরণ চুলগুলো পিঠময় ছড়িয়ে দেওেয়া। ব্যাস শেষ! কিন্তু কোথাও একটা অপূর্ণতা রয়ে গেছে। শাড়ির সাথে হালকা মেকাপের ছোঁয়া যেন না দিলেই নয়। তাই কিছুটা ফেস পাউডার আর ঠোঁটে টকটকে লাল রঙা লিপস্টিক। এবার মনে হলো সব ঠিকঠাক আছে। পারফেক্ট।
দর্পণে নিজেকে দেখে একটু উচু আওয়াজেই বলল, “কি হবে এত ঘটা করে সেজেগুজে? লোকে বলতো আমায় নাকি স্বামী খুব ভালোবাসবে অথচ দেখো কি অবলিলায় সেই মানুষটা অবহেলায় না পেলাম। তাহলে এত রূপ দিয়ে কি হবে? ছমাস পরে আসছে দরদ দেখাতে। মন চাই তিনবেলা নিয়ম করে করলার জুস খাওয়ায়।”
“করলা আমি ভালো খাই। এখন বউ যদি সোহাগ করে বরকে করলার জুস খাওয়ায় তাহলে আমার কি উচিত না ভালো স্বামী হিসাবে তা খাওয়া?”
পরিচিত পুরুষালি কন্ঠে চমকে ওঠে মালিহা। ঘরে সে ছাড়া আর কারো থাকার কথা না। আয়না থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনে মুখ ঘুরিয়ে তাকাতেই দৃষ্টিতে ধরা দেয় শুভ্র পাঞ্জাবি, পায়জামা পরিহিত এক সুদর্শন যুবকে। মালিহা কোন কথা বলে না। এক দৃষ্টিতে সেদিক পানেই তাকিয়ে থাকে সে।
মালিহার অদ্ভুত দৃষ্টি দেখে জাওয়াদ ভ্রু কু’চকে তাকায়। ফের প্রশ্ন করে, “কি হলো সুন্দরী? কি দেখো?”
মালিহা নিজের অনুভূতি ধাতস্থ করে উত্তরে বলে, “কিছু নাহ্। কখন আসলেন?”
“কিছু মাত্রই। বলি, রমনী যেভাবে সেজেছো আমি তো কন্ট্রোললেস হয়ে পড়ছি। পরে কিন্তু চরিত্রহীন উপাধি দিতে পারবে না।”
লজ্জায় দৃষ্টি অবনত মালিহার। জাওয়াদ তা দেখে মুচকি হাসে। মালিহার লজ্জা রাঙা মুখশ্রী যেন জাওয়াদকে আরেকটু আশকারা দেয়। পুনরায় দুষ্টু হেসে বলল, “থাক লজ্জা টজ্জা পেতে হবে না। শাড়িতে তোমাকে এত সুন্দর লাগে আগে জানতাম না তো!”
“কোনদিন দেখেছেন? বুঝবেন কিভাবে?”
জাওয়াদ কথার উত্তর না দিয়ে এক পা দু পা করে মালিহার দিকে এগিয়ে যায়। তা দেখে মালিহা না পিছিয়ে সেখানেই স্থির দাঁড়িয়ে থাকে।
মালিহার সন্নিকটে এসে আলতো করে হাতখানা নিজের মুঠোয় পুরে নেয়। আয়নার মুখোমুখি মালিহাকে নিয়ে দাঁড়ায় জাওয়াদ। হাসি হাসি মুখ করে বলে, “তাকাও তো ইবনাত!”
মালিহা অবনত দৃষ্টি উঠিয়ে আয়নার দিকে একদফা মুগ্ধতা তাকে গ্রাস করে নেয়। মনে মনে বলে ‘মাশা আল্লাহ্’।
“তোমার দুঃখগুলো নির্বাসন করার সুযোগ দিবে এই অধম কে?”
মালিহার যেন স্বপ্ন মনে হচ্ছে। বিস্ময় নিয়ে শুধায়, “সত্যি বলছেন?”
“মিথ্যার কিছু নেই। চলোনা আমরা শুরু করি সবটা আবার নতুন করে, পুরোনো দুঃখগুলো ভুলে।”
“চাইলেই কি সব ভুলে থাকা যায়? আচ্ছা, আমার কিছু প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর দিবেন?”
“কি জানতে চাও?”
“এতদিন কি মনে পড়েছিল না আপনার ঘরে বউ আছে? তার সাথে সুখে সংসার করা উচিত?”
জাওয়াদের হাস্যজ্জ্বোল মুখশ্রীতে হাসি মিলিয়ে থমথমে ভাব বিরাজ করছে। বলল, “আজ এসব কথা কি না ওঠালেই নয়? আমি চাই অন্তত আজকের দিনটাতে কোন বিষাক্ত অতীত না থাকুক। শুধু তুমি আমি আর সুখময় কিছু মুহূর্ত জায়গা পাক। সবটাই তোমাকে বলব। তবে এখন না। আরেকটু ধৈর্য ধরো।”
“কবে বলবেন?”
“এত উতলা হচ্ছো কেন? বলেছি তো বলব।”
“উতলা হওয়ার মতো বিষয় দেখেই উতলা হচ্ছি। আজাইরা বিষয়ে মালিহা উতলা হয় না।”
“আচ্ছা, রেগে যেও না। আমি বলব তো। তোমার সব প্রশ্নের উত্তর পাবে তুমি। কথা দিচ্ছি।”
“বেশ অপেক্ষায় থাকলাম।”
“আমায় ক্ষমা করেছো তো ইবনাত?”
“কিসের ক্ষমা? ক্ষমা করার কেউ না আমি। আল্লাহর কাছে চান। বিয়ে করে সেই যে উধাও হলেন খবর নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি? স্বামীর অবহেলা, শাশুড়ি ননদের কটু বাক্য স্বদ্য বিবাহিত মেয়ের জন্য কতটা পীড়াদায়ক কখনও বোঝার চেষ্টা করেছেন?”
কৃতকর্মের জন্য ভিষন অনুতপ্ত জাওয়াদ। কি বলা উচিত তার? অপরাধি কন্ঠে বলল, “ভুল বল অন্যায় বলো যেটাই বল করেছি আমি। অস্বীকার করার কিছু নেই। সৃষ্টিকর্তা ওনার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া বান্দার অনুতপ্ততার এক ফোঁটা অশ্রুর বিনিময়ে যদি যাবতীয় গোনাহ ক্ষমা করে দিতে পারেন। তবে তুমি সেই দয়ালু প্রভুর বান্দা হয়ে পারবে না তোমার গোনাহগার স্বামীকে ক্ষমা করতে? জানোই তো ক্ষমা মহাৎ গুণ!”
জাওয়াদের অপরাধি মুখশ্রী দেখে মায়া হয় মালিহার। তবুও গম্ভীর স্বরে বলল, হয়েছে আর নিজের সাফাই গাইতে হবে না। রাত তো অনেক হলো। ঘুমাতে হবে না?”
হতাশার নিঃশ্বাস র্নিগত হলো মুখ থেকে। জাওয়াদ বুঝলো মেয়েদের মন বোঝা আসলেই নয় সোজা।
অগ্যতা ঘুমানোর জন্য বিছানার দিকে অগ্রসর হলো। বুঝলো এই মেয়ের মন পেতে তাকে বহু কাঁঠখর পোড়াতে হবে। তাও হোক। সমস্যা নেই। তবুও দুঃখগুলো নির্বাসনে যাক।
অন্যদিকে মালিহার অধরজুরে বিস্তৃত হাসি। এত সহজে জাওয়াদ নামক পুরুষটা যে পার পাবে না। সে সিনেমার নায়কা না। বাস্তব জীবন অতটাও সহজ না। তবে জাওয়াদের প্রতি তার যে দূর্বলতা আছে তা অস্বীকার করতে পারে না। সেও তো চাই পূর্বের দুঃখগুলো মুছে এক টুকরো সুখ আসুক।
________________________
পরদিন সকাল। প্রতিদিনকার মত আজও বাচ্চাদের আরবি পড়া শেখাচ্ছে মালিহা। তবে আজকে নতুন শিক্ষার্থীর আগমন ঘটেছে তাদের ছোট্ট পাঠশালায়। বাচ্চা মুখ চেপে আসছে জাওয়াদকে দেখে। এদিকে জাওয়াদেরও লজ্জা লাগছে। ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদের সাথে বুড়ো সে পড়বে? তাই মালিহাকে আস্তে করে বলল, “ইবনাত! আমি এখান পড়তে পারবো না। তুমি আমাকে পরে শিখিয়ে দিও।”
“এখানে কি সমস্যা?”
“আছে। আমি উঠছি।”
মালিহার পরবর্তী কথা শোনার প্রয়োজন বোধ করলো না। তড়িঘড়ি করে ড্রয়িং রুম ছাড়লো। সে দেখেছে বাচ্চাদের পাশাপাশি মালিহাও হাসছিল। আশ্চর্য এখানে হাসির কি ছিল? শিখার আবার ছোট বড় কিসের? সব বয়সেই শেখা যায়। একবার এই মালিহা ইবনাত নামক সুন্দরীকে ধারেকাছে পাক সেও দেখাবে জাওয়াদ কি জিনিস।
ইনশাআল্লাহ,চলবে….