দুঃখগুলো নির্বাসিত হোক পর্ব-০৩

0
2803

#দুঃখগুলো_নির্বাসিত_হোক(০৩)
#সুমাইয়া_ইসলাম_জান্নাতি(লেখনীতে)
_____________________________

জাওয়াদের এখনো বাড়ি ফেরার নাম নেই। সকালে বেড়িয়েছে এখনো বাড়ি ফেরেনি সে। অন‍্য কেউ হলে হয়তো এতক্ষণ স্বামী বাহিরে থাকায় চিন্তাই, উদ্বিগ্নতার শেষ থাকতো না। কিন্তু মালিহা এ ব‍্যপারে মোটেও উদ্বিগ্ন না। সে অবলিলায় তার কজকর্ম সমাধা করছে। কি হবে এত চিন্তা, উদ্বিগ্নতার যে মানুষটা নাকি গত ছয়টা মাস ইগনোর করে গেছে। তুচ্ছতাচ্ছিল্যর ও কি শেষ ছিল? এসব ভেবেই মালিহা মনটা বিষিয়ে ওঠে। স্বামী নামক মানুষটার প্রতি জমে আছে হাজারো রাগ-অভিমান, অভিযোগ-অনুরাগ। জাওয়াদ কি আদোও সেই বিষাদে মোরা দেওয়াল ভেঙ্গে মালিহার কোমলতার সান্নিধ্য পাবে?

জোহরের নামাজ শেষে কিছুক্ষণ মা-বাবার সাথে কথা বলে কিচেনের উদ্দেশ্য পা বাড়ায়। রমজান মাসে ইফতার সহ রাতের ও সাহরীর খাবার সব একসাথে করতে অনেক সময় লাগে। তাই দুপুরের দিকেই রান্নার আয়োজনে নেমে পড়তে হয়।

মালিহার শাশুড়ি শিরিন বেগম কোন কাজে হস্তক্ষেপ করেন না। কি কি রান্না হবে এটুকু বলেই শেষ। দেখা যায় প্রায়শই তাসবীহ্ পাঠে নিয়োজিত থাকেন। মাঝেমধ্যে তদারকি করে যান রান্না কতদুর! আর বউয়ের ক্ষুদ ধরতে সামান্য ত্রুটি রাখেন না মহিলা। সে নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে কটু কথা বলতেও বাধে না তার। এটুকু ভাবেন না যে মেয়েগুলো তার বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে তারাও রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। বিশ্রাম খানিকটা আরাম তারাও আশা করে। মালিহার জা বাপের বাড়িতে গিয়েছে আজ এক সপ্তাহ। এ কদিন সব রান্নাবান্নার কাজ মালিহাকেই সামলাতে হয়েছে। তাতে বিন্দুমাত্র হাত লাগাইনি শাশুড়ি ও ননদ। এসব ভেবেই মালিহার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। গত রমজানে মা-বাবার সাথে কত আরামে’ই না কাটিয়েছে মেয়েটা। অথচ এক বছরের ব‍্যবধানে কত পরিবর্তন এসেছে জীবনে।

প্রেসার কুকারে ছোলা, আলুর চপের জন্য আলু সিদ্ধ বসিয়ে দিয়ে সিল পা’টায় মসলা বা’টতে বসেছে মালিহা। তার শাশুড়ির মুখে রোচে না ব্ল‍্যান্ডারের পেস্ট হওয়া মসলা। পা’টায় বাটা মসলায় নাকি যে স্বাদ সেটা ওই যন্ত্রে পাওয়া যায় না। অথচ মালিহা দেখেছে বড় বউ যখন ওতে মসলা পেস্ট করে রান্না করে শাশুড়ি চুপচাপ খেয়ে ওঠে। কোন উচ্চবাচ্য করেন না। তাহলে সব অবহেলা, অনাদর কি শুধু তার ভাগ‍্যে লেখা ছিল?
_________________________

আসরের কিছু পূর্বেই মালিহার জা’য়ের আগমন। তিনি এসেই রান্নায় লেগে পড়েছে। এ বাড়িতে এই একটি মহিলা তাকে কিছুটা হলেও বুঝে। পাটায় মসলা বাটা শেষে যখন মালিহা উঠতে নিবে তখনই ওনার আগমন। মালিহার ঘামে ভেজা শরীর দেখে দুঃখ প্রকাশ করলো কিছুক্ষণ।

আসরের পর জাওয়াদ এসেছে। সাথে একগাদা শপিং নিয়ে। হঠাৎ এত শপিং কি জন্য জানার আগ্রহ জন্মালেও কিছুই জিজ্ঞেস করেনি মালিহা। একসময় এই মেয়েটি কিনা অতি কৌতূহলপ্রবন ছিল। ছোট খাটো বিষয়েও তার দারুণ কৌতূহল। আর এখন!

সবাই টেবিলে বসে পড়েছে। শুধু মালিহা বাদে। সে কিচেন থেকে খাবারের পদগুলো এনে টেবিলে সাজিয়ে রাখছে। বড় ভাবি জার্নি করে এসে বেশ ক্লান্ত ছিল। তারমধ‍্যে আবার এসেই রান্নায় লেগে পড়েছেন। তাই মালিহা তাকে অনুরোধ করে কিচেন থেকে পাঠিয়ে দিয়েছে। আপাতত একা হাতেই সবটা করতে হচ্ছে তাকে। আজান দিবে দিবে ভাব কিন্তু এখনো মালিহা বসতে পারলো না।

“ভাবি নুডলস বানাওনি? তোমাকে না বললাম নুডলস খেতে ইচ্ছে করছে।”____মালিহার ছোট ননদ জাকিয়ার করা প্রশ্নে অসহায় দৃষ্টিতে জাওয়াদের দিকে তাকায় মালিহা। প্রায় বিশ প্রকারের খাবারে টেবিল ভরপুর।

“কি হলো কথা বলছো না কেন? কোন একটা কাজ দিলে পারো না। বলেছি একটু নুডলস রান্না করে দিতে সেটুকুও পারলে না। বলি, পারোটা কি? যত্তসব!”

মালিহার চোখ ছলছল করে ওঠে। বয়সে ছোট অথচ মেয়েটা তাকে বড়দের সম্মানটা কখনও দেয় না। বিশ প্রকারের আইটেম করতে নিশ্চয়ই কষ্ট হয়নি। মেয়েটা কি করে এভাবে বলতে পারলো? মালিহার জবাব দেওয়ার আগেই গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠ ভেসে আসলো। বলল, “টেবিল ভর্তি খাবার বানাতে নিশ্চয়ই ইবনাতের কম সময় লাগেনি? তোর নুডলস খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে নিজেই তো বানিয়ে খেতে পারতি।”

“দেখলে মা? ভাইয়া কি বলল। নুডুলস টাও আমার রান্না করে খেতে হবে।”

“তুই কি ছোট? এটুকু করে নিতে পারিস না? দেখতেই তো পাচ্ছিস এতগুলো খাবার ও আর ভাবি মিলেই বানিয়েছে। রোজা রেখে এতকিছু করা কি মুখের কথা?”

“তোমার বউকে কিছু বলা যাবে না। বুঝেছি সব!”

“না বলবি না। আমার বউ কেন এ বাড়ির কোন বউকেই এভাবে ফরমায়েশ করতে পারিস না তুই। কখনও যেন এমন না দেখি।”

মেয়ের ন‍্যাকা কান্না দেখে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে মালিহার দিকে তাকায় শিরিন বেগম। দৃষ্টিতে বুঝিয়ে দিচ্ছে, সব দোষ তোমার। তোমার জন্য মেয়েটা ভাইয়ের কাছে বেশি শুনছে। কন্ঠে মিষ্টতা এনে ছেলের উদ্দেশ্য বললেন, “হয়েছে থাক এবার। বস চেয়ারে।
আর বউমা তুমিও বসো। জাকিয়া ভাই ভাবির সাথে আদবের সাথে কথা বলবে। এমন যেন কখনও না দেখি।”

জাকিয়া শক্ত মুখ করে বসে আছে। মা এবং ভাইয়ের কারো নীতিবাক‍্য তার বোধগম্য হয়নি। আর হলেও সে কতটা মানবে তা নিয়ে ঘোর সন্দেহ আছে।

মেয়েকে রুমে ঘুম পাড়াতে গেছিল রিপ্তি। বড্ড জ্বালাচ্ছিল মেয়েটা। হয়তো ঘুমের জন‍্যই। ডাইনিংয়ে ফিরে এসে দেখেন ছোট খাটো গোল বেধেছে। অতঃপর নিজে একটি চেয়ার টেনে বসে আরেকটি চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল, “মালিহা বস এখানে। আর দাড়িয়ে থাকিস না। সারাদিন শুয়ে বসে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে চললে বুঝবে কিভাবে? কিচেনে উত্তাপে ঘন্টার পর ঘন্টা রান্না করা কত কঠিন। বস!”

প্রতিত্তোরে একটা প্রাণিও কিছু বলল না। মাঝেমধ্যে মালিহার ও ইচ্ছে হয় বড় ভাবির মত চটপটে জবাব দিতে। কিন্তু তার যে ভিতটাই নড়বড়ে।

এতকিছুর পরে মালিহার গলা দিয়ে খাবার নামছে না। নিজে নিজেকে ধিক্কার জানালো। কি জন্য পড়ে আছে এ বাড়িতে? তুচ্ছতাচ্ছিল্য পেতে?

মালিহার বিধ্বস্ত মুখশ্রী দেখে বড্ড দুঃখ হলো রিপ্তির। নিচু আওয়াজে বলল, “চিন্তা করিস না বোন। মন খারাপ করিস না। তোর দিন ফিরছে ইনশাআল্লাহ। এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি বলেছিলাম না? ধৈর্যের ফল মিষ্টি হয়। বহু তিক্ততা পার করেছিস। সুখ আসবে। খাওয়ায় মন দে।”

মালিহা ক্লান্ত গলায় ছোট্ট করে জবাব দিল, “হুম।”

জাওয়াদ থমথমে মুখে ইফতার করছে। শিরিন বেগম চিন্তিত সে মুখ দেখে। পাছে না ছেলেটা হাত ছাড়া হয়ে যায়। বিড়বিড়িয়ে বলে, “কি জ্বালা! নিজে হাতে কি পছন্দ করলাম রে বা’বা! এ মেয়ের জন্য দেখি ছেলে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে!”

মাগরিবের নামাজ শেষে এটো বাসন ধুতে গেছে মালিহা। গিয়ে দেখলো রিপ্তি আগে থেকেই ধুয়ে রেখেছে। বলল, “কি দরকার ছিল ভাবি ধোয়ার? বাবুর ঠান্ডা লেগে যায় যদি। আর করবেন না।”

“বাবুর কিছু হবে না। এখন রুমে যা। জাওয়াদের কাছে কাছে থাকবি। সাহরীতেও আমি উঠে ভাত রান্না করে রাখবো। তুই উঠিস না। এখন যা!”

“সে কি! না দরকার নেই। আমিই রান্না করতে পারবো।”

“বাবু ঠিকমতো রাতে ঘুমাতে দেয় না। জেগেই থাকা লাগে। তাছাড়া আমার রুম তো নিচ তলায়। এক সময় রান্না করে রেখে যাব। তোর চিন্তা করতে হবে না। এখন যা তুই!”

মালিহা রুমে ঢুকতেই দেখলো জাওয়াদ কতগুলো কাপড়, অর্নামেন্টেস এর প‍্যাকেট নিয়ে বসে আছে। কাছে এগুতেই জাওয়াদ বলল, “ইবনাত প‍্যাকেটগুলো নাও। খুলে দেখো। পছন্দ হয়েছে কি না জানাবে!”

“এ সবের কি দরকার ছিল?”

“নো টক। দেখতে বলেছি দেখবে।”

অগ‍্যতা মালিহা একে একে প‍্যাকেটগুলো খুলে দেখছে। একটা কালো জামাদানী শাড়ি, কয়েকটা কুর্তি, দু জোড়া জুতা, কসমেটিকসসহ আরও অনেক কিছু। অবাক কন্ঠে শুধালো, “এত কিছু?”

“তোমার জন্য। পছন্দ হয়নি?”

“হয়েছে। মাশা-আল্লাহ্ অনেক সুন্দর।”

“শুকরিয়া। যাক তোমার পছন্দ হলো। চিন্তাই ছিলাম। একটা অন‍্যায় আবদার করবো। রাখবে?”

মালিহার হৃদপিণ্ড ধ্ব’ক করে উঠলো। কি আবদার থাকতে পারে তার র্দুসম্পর্কের স্বামীর তার নিকট?

ইনশাআল্লাহ,চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে