দুঃখগুলো নির্বাসিত হোক পর্ব-০২

0
3332

#দুঃখগুলো_নির্বাসিত_হোক(০২)
#সুমাইয়া_ইসলাম_জান্নাতি(লেখনীতে)
__________________________________

ঘড়ির কাটায় সময় এখন সকাল সাতটা বেজে পত্রিশ মিনিট। তীব্র এলার্মের শব্দে নিদ্রা বিচ‍্যুত হলো মালিহার। মস্তিষ্ক সজাগ হতেই দ্রুত এলার্ম বন্ধ করলো। পাছে না মানুষটার ঘুম ভেঙ্গে যায়। দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষের সাথে থেকে সে তো আর দায়িত্বহীন হতে পারে না।

বেশ বেলা হয়ে গেছে। বাহিরে চকচকে রোদ উঠেছে। আন্দাজ করা যাচ্ছে আজ আবহওয়া রৌদ্রজ্জ্বল ঝকঝকে হবে। বাড়ির বাকি সদস্যরা ঘুমে কাতর। হয়তো শশুর, শাশুড়ি উঠে পড়েছেন। রমজান মাসে এ বাড়িতে সবাই বেশ দেরি করে ঘুম থেকে উঠে। তারমধ‍্যে মালিহা’ই ছোটদের মধ্যে আগে উঠে। রাতে এটো থালা-বাসন, বাসি ঘরদোড় ঝাড়ু দেওেয়া সব তো তারই করতে হয়। অগ‍্যতা তাকে তাড়াতাড়ি উঠতেই হবে। কিন্তু বাপের বাড়িতে মেয়েটি কি আদরেই না কাটিয়েছে।

ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে কাজে লেগে পড়লো। তারপর ওজু করে এসে কোরআন নিয়ে বসলো। উদ্দেশ্য তেলওয়াত করা। মাশা-আল্লাহ। মালিহার রুমের বেলকনিটা বেশ বড়সর। পাশে কয়েকটা ফুলে টব রাখা বাকিটা ফাঁকা। মালিহার এখানে বসেই কোরআন পড়তে ভালো লাগে। কোরআন খোলার আগে জাওয়াদের ঘুমন্ত মুখশ্রী কল্পনার দর্পণে ভেসে উঠলো। ঘুমন্ত মানবটাকে কি মোহনীয়’ই না লাগছে! যেন নিষ্পাপ শিশু। কে জানতো মালিহা নামক সুন্দর রমনীটি শশুর বাড়িতে এসে স্বামীর অবহেলা অনাদরে দিন পার করবে? সৌভাগ্য কখনও সৌন্দর্যের ওপর নির্ভর করে না। যার নিয়তিতে সুখ লেখা থাকে সে কুৎসিত হলেও সুখি হবে। পৃথিবীর কি অদ্ভুত নিয়ম তাই না? জটিল সব নিয়মের মাঝে আমরা মানবজাতি বড্ড বাজে ভাবে আটকে আছি। কেউ সুখে নতুবা কেউ দুঃখের সাগর পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা। মালিহার বুকচিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয় আসলো। বরাবরের মতোই নিয়তিকে আল্লাহ্ ওপর ছেড়ে আপন কার্যে ব‍্যস্ত হয়ে পড়লো। যেন এ দীর্ঘশ্বাসের সাথে বহু দিনের চেনাজানা সুন্দর রমনীটির। হায়!

জাওয়াদের কর্ণগোচর ভেদ করে এক সুমিষ্ট কন্ঠ তার মস্তিষ্কে প্রবেশ করছে। নিদ্রা ভঙ্গ হয়েছে কিছু পূর্বেই। সে নেত্রযুগল বন্ধ করে সুমিষ্ট কন্ঠের কোরআন তেলওয়াত শুনছে। মুগ্ধতায় ছেয়ে যাচ্ছে মুখশ্রী। এত সুন্দর তেলওয়াত সে ইতিপূর্বে শুনেনি।

বেশ কিছু সময় পর কোরআন পাঠ বন্ধ হলো। মালিহা বেলকনি থেকে জায়নামাজ গুটিয়ে কোরআন নিয়ে রুমে এলো। দেখলো জাওয়াদ এখনো ঘুমিয়ে। মনের মধ্যে প্রশ্নের উদয় হলো, ‘কিভাবে পারে মানুষ এত ঘুমাতে? পরক্ষণেই আবার মনে হলো মাঝ রাত্তিরে বাড়ি ফেরায় অপূর্ণ ঘুম হয়তো এখন পুষিয়ে নিচ্ছে।

“গুড মর্নিং!”

জাওয়াদের ঘুমঘুম কন্ঠস্বর। মালিহা অবাক হলো কিছুটা। এইতো কিছুক্ষণ আগেই না লোকটা গভীর ঘুরে বিভোর ছিল? তাহলে? সে কাল থেকে অবাকের পর অবাকই হচ্ছে। যেন রমজানের মাসের খুশির আমেজের সাথে তার অবাক হওযাটাও ফ্রি প‍্যাকেজ হিসাবে এসেছে। নিজেকে ধাতস্ত করে বলল, “মর্নিং।”

ছোট উত্তরে জাওয়াদ অসন্তুষ্ট হলো। সে বেশি কিছু আশা করেছিল। নিজ থেকেই জিজ্ঞাসা করলো, “কখন উঠেছো? বাকিরা উঠেছে?”

“সাড়ে সাতটার দিকে উঠেছি। বাকিদের খবর জানিনা। আপনার কিছু লাগবে?”

“নাহ্।”

”আচ্ছা।”

মালিহা রুম থেকে বেড়িয়ে পড়েছে। জাওয়াদ সেদিক পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে মেয়েটার সবকিছুতেই মুগ্ধতা খুজে পাচ্ছে। এইযে হেঁটে হেঁটে রুমের বাহিরে গেল সেটাও দেখতে সুন্দর লাগছে তার কাছে। সফেদ রঙা সালোয়ার কামিজটাইও দারুণ সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। ফর্সা গায়ে মানিয়েছে ভালো। আচ্ছা সে এত ভাবছে কেন? কি লাভ? গত ছমাসে মেয়েটাকে পাত্তায় দেয়নি সে। এখন কেন এত মুগ্ধতা তার চোখে আটছে? জাওয়াদের আছে আদোও এত প্রশ্নের উত্তর আছে?
মালিহার শূন্যতা সে গত দুমাস আগে থেকেই অনুভব করছে। তাকে নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছে। হঠাৎই ভয়ংকর প্রশ্নের সঞ্চার হলো মন। মালিহা যদি তাকে ছেড়ে চলে যায় তবে?
নাহ্! সে ভাবনার সেখানেই ইতি টানলো জাওয়াদ। সৃষ্টিকর্তা না করুক এমন কিছু কখনও না হোক।
______________________________

মালিহার শশুর বাড়ি মোটামুটি যৌথ পরিবার। মালিহার শশুর জাফরুল্লাহ মোল্লা। পেশায় ছিলেন আর্মি অফিসার। বছর পাঁচেক আগেই অবসর নিয়েছেন। ভদ্রলোকের মেজাজ সবসময় আম গাছের মাথায় উঠে থাকে। কন্ঠস্বর তো না যেন বারুদ। কথা বললেই বিকট আওয়াজে ফুটে। বাড়ির ছোটরা একপ্রকার এড়িয়েই চলে। তার ধারালো মেজাজকে সবাই ভয় পাই। কিন্তু মালিহাকে তিনি বিশেষ স্নেহ করেন। মালিহার ক্ষেত্রে ভদ্রলোকের কন্ঠস্বর মিষ্টতা আসে। দুই ছেলে আর দুই মেয়ে নিয়ে মাঝারী পরিবার। মালিহার বড় ননদ শশুর বাড়িতে থাকেন। ভাসুর সে নিজেও আর্মিতে আছেন। আর মালিহার সম্মানিত, প্রাণপ্রিয় স্বামী কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। ছোট ননদ গতবার এইসএসসি দিয়ে সবে ভার্সিটিতে এডমিশন নিয়েছে।

ড্রয়িং রুমে বাচ্চাদের আনাগোনা। কিন্তু বাড়িতে আপাতত বাচ্চা তো নেই। বড় আপা শশুর বাড়ি আর ভাবি বাপের বাড়ি। তাহলে বাচ্চা এলো কোথায় থেকে? ছোট ছোট কদম ফেলে দোতলার সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলো জাওয়াদ। আবিস্কার করলো এক নতুন দৃশ্য। যা ইতিপূর্বে এ বাড়িতে দেখেনি।

মালিহা ছোট্ট ছোট্ট কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের কোরআন পড়ছে। পাশে অবশ‍্য একজন বুড়ো শিক্ষার্থীও আছে। সেও মন দিয়ে শিখছে।

জাওয়াদ কোরআন পড়া শিখেছিল ছোট বেলায়। কিন্তু তার বাবা যে কোরআন পড়তে পারে না এ কথা সে আগে জানতো না। কি সুন্দর সুবোধ বালকের ন‍্যায় পড়ছে তার শিক্ষিকা রুমি বউমার কাছে। বড়ই সুন্দর দৃশ্য। জাওয়াদ তুষ্ট হলো। মেয়েটার প্রতি তার মুগ্ধতা দিন কে দিন যেন বৃদ্ধিই পাচ্ছে। মাশা-আল্লাহ।

জাওয়াদ গিয়ে নিঃশব্দে সিঙ্গেল সোফার একটিতে দখল করে বসলো।
জাওয়াদের উপস্থিতি লক্ষ্য করে ভদ্রলোক বলে উঠলেন, “তা জাওয়াদ! দিনকাল কেমন যাচ্ছে? শুনলাম তুমি নাকি বাড়িতে একেবারে শিফট করেছো? বাহ্ ভালো।”

“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো বাবা। এখন থেকে বাড়ি থেকেই অফিস করবো।”______শেষের কথাটা মালিহার দিকে তাকিয়েই বলল। সে দেখতে চাই তার একেবারে আগমনে মালিহার কেমন প্রতিক্রিয়া হয়।

এদিকে মালিহা যেন প্রস্তুত ছিল না এমন কথা শোনার। সে বাচ্চাদের পড়ানো বাদ দিয়ে ভরকানো দৃষ্টিতে তার র্দুসম্পর্কের স্বামীর পানে তাকালো। চোখে হাজারো প্রশ্ন!

মালিহার ভরকানো মুখশ্রী জাওয়াদকে বেশ নিশ্চিন্ত করলো। তার অবচেতন মন আশার আলো বাধছে। বাকিটা আল্লাহ্ ভরসা।

“হঠাৎ বাড়িতে যে? ওখানে কোন সমস্যা হয়েছে? আগে তো হাজার বলেও বাড়িমুখো করা যাইনি তোমায়।”

জাওয়াদের সহজ স্বীকারোক্তি, “আজকাল বাড়ি ছাড়া কিছুই ভালো লাগে না বাবা।”

“বাহ্ তা ভালো। বাড়ির মত সুখ তুমি পাবে কোথায়? দেরিতে হলেও সুবুদ্ধি হয়েছে এটাই বা কম কিসে। যাইহোক, তা রোজা তো রাখো কোরআন পড়ো? নামাজ ঠিকমতো পড়া হচ্ছে?”

“জ্বি বাবা। তবে কোরআন না।”

“কেন কেন? তোমাদের চার ভাইবোনকেই বাড়িতে শিক্ষক রেখে শেখানো হয়েছে। না পড়ার জন্য কি?”

“না বাবা। সেরকম কিছু না। আসলে অনেক দিন পড়া হয় না তাই কেমন ভুলে গেছি।”

“তোমার বউ এত ভালো পড়ে তার থেকে শিখে নিলেও তো পারো। জীবনে করলেটা কি? হাওয়াই গা ভাসিয়ে চললে হবে? বাস্তবে আসো। ইসলামের সাথে জীবনকে উপভোগ কর দেখবা জীবন সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহে কতই না সুন্দর।”

“বাবা? আমি একটু বাহিরে গেলাম। কাল থেকে পড়বো। বন্ধুরা দেখা করতে বলেছে। আজ গেলাম। তোমরা পড়। কথা বলার ডিস্ট্রাব হচ্ছে ওদের।”

“বেশ, যাও।”

মালিহার দিকে এক পলক তাকিয়ে প্রস্থান করে জাওয়াদ। অন‍্য সময় হলে বাবার বিশাল বক্তিতায় মাথা ধরে যেত। ভালো লাগতোনা। কিন্তু আজ বড় ভালো লেগেছে। প্রথমবার হয়তো বাবার কথাগুলো মন দিয়ে শ্রবন করেছে।
কাল থেকে সেও পড়বে? বাহ্। অত সুন্দর রমনীর কাছে রাত-দিন পার করে পড়া যায়। আপাতত সে নিজেকে সৌভাগ্যবানের কাতারে ফেলছে। কি সুন্দর একটা সুযোগ তার জন্য অপেক্ষা করছে। হয়তো সম্পর্কের আরও কয়েক ধাপ উন্নতি হলেও হতে পারে।

মালিহাকে আজ পর্যন্ত জাওয়াদ কোন উপহার দেয়নি। আইডিয়াও নেই কি দেওেয়া যায়। মস্তিষ্ক জানান দিল বড় আপার থেকে পরামর্শ নেওয়া যায়।
চট করেই ফোন লাগালো বড় বোনের কাছে। ওপাশ থেকে কল ধরতেই কুশল বিনিময় করে জিজ্ঞাসা করলো, “আপা ইবনাতকে কিছু উপহার দিতে চাই। কি দেওেয়া যায় বল তো?”

ভাইয়ের অবশেষে সুবুদ্ধি হলো। খুব খুশি হলো। বলল, “শাড়ি দিতে পারিস। মেয়েরা শাড়ি খুব পছন্দ করে।”

“আচ্ছা, দেখা যাক। কবে আসছো তোমরা?”

“তোরা আই? প্রতিবারই তো আমারা যায়।”

“আমার ছুটি কম। সময় করে যাব কখনও। তোমরা চলে এসো। রাখছি তবে। ভালো থেকো।”

“আচ্ছা রাখ। ইনশাআল্লাহ চেষ্টা করবো আসার। ভালো থাকিস।”

ইনশাআল্লাহ, চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে