#দুঃখগুলো_নির্বাসিত_হোক(১০)
#সুমাইয়া_ইসলাম_জান্নাতি(লেখনীতে)
______________________
মালিহা দ্রুত গিয়ে দরজা খুলল। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত রূপি জাওয়াদকে আবিষ্কার করলো মালিহা। জাওয়াদ নিভু দৃষ্টিতে মালিহার দিকে তাকিয়ে আছে। মুখ ফুটে কিছু বলবে সেই শক্তিটুকু অবশিষ্ট নেই শরীরে। হাতে নুয়ে পড়া এক গোছা গোলাপের তোরা।
মালিহা মুখে কিছু না বলে দরজা থেকে সরে দাড়ালো। যাওয়ার পথ করে দিল জাওয়াদকে। হাতের ফুলের তোরাটা মালিহার দিকে এগিয়ে দিল। মালিহা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তা নিল। জাওয়াদ বাসার ভিতরে প্রবেশ করলো। মালিহা দরজা বন্ধ করলো। বলল, “আমার রুমে আসুন। ফ্রেশ হয়ে তারপর সবার সাথে দেখা করবেন।”
জাওয়াদ বাধ্য ছেলের মত মাথা নাড়িয়ে প্রতিত্তোরে বলল, “আচ্ছা।”
জাওয়াদকে রুমে নিয়ে ফ্যান ফুল ভলিউমে ছেড়ে দিল মালিহা। তারপর আলমারি থেকে একসেট কাপড় নিয়ে হাতে ধরিয়ে দিল জাওয়াদের। বলল, “ওদিকটাই ওয়াশরুম। ফ্রেশ হয়ে নিন ভালো লাগবে।”
জ্বর শরীর নিয়ে একটানা অফিস। তারপর বাড়িতে এসে কোনরকম তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। রাস্তার জ্যামে ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে থেকে প্রাণ যেন বেরিয়ে আসার উপক্রম। ঘামে শরীরের সাথে লেপ্টে গেছে শার্ট। নিজের দিকে তাকাতেই গা গিনগিন করে উঠলো জাওয়াদের। মনে হলো আগে ফ্রেশ হওয়া অতীব জরুরি। অগ্যতা সে সময় ব্যায় না করে মালিহার থেকে কাপড় সেট নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।
জাওয়াদ ওয়াশরুমে ঢোকার পরপরই মালিহা দ্রুতগতিতে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো। মায়ের রুমের সামনে কয়েকবার দরজায় করা নাড়তেই মনোয়ারা বেগম দরজা খুলে দিলেন। ঘুম ঘুম কন্ঠে বললেন, “কি হয়েছে মালিহা? ডাকছিস যে? কোন সমস্যা হয়েছে?”
“না। কিছু হয়নি। তোমার জামাই এসেছে একটু আগে।”
মনোয়ারা বেগমের চোখ থেকে ঘুম উরে গিয়েছে। কৌতূহলী কন্ঠে বলল, “সত্যিই এসেছে? কখন?”
“কেবলই। তোমরা কলিং বেলের শব্দ শোননি? যাইহোক আমি ওনার জন্য কিছু খাবার ব্যবস্থা করছি, তুমি এসো। আব্বু আর ভাইয়াকে ডেকে নিও। সম্ভবত অফিস করেই এদিকের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছেন। ইফতারে কি খেয়েছে না খেয়েছে জানিনা। আমি যাচ্ছি।”
মালিহা দ্রুতগতিতে বেরিয়ে পড়লো।
জাওয়াদ বেশ সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়েছে। এখন কিছুটা ভালো লাগছে। কিন্তু জ্বরের জন্য চোখ মুখ জ্বালাপোড়া করছে। রুমে মালিহা নেই। সারারুম বেলকনি কোথাও নেই। জাওয়াদের কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো। এই মেয়ে আবার কোথায় উধাও হলো?
এরমধ্যেই নাস্তার ট্রে নিয়ে মালিহা হাজির। টি টেবিলের উপর একে একে নাস্তা গুলো সাজিয়ে দিয়ে জাওয়াদকে উদ্দেশ্যে করে বলল, “নিন শুরু করুন!”
জাওয়াদ অপ্রস্তুত হাসলো। বলল, “এত ব্যস্ত হওয়ার দরকার ছিল না। আমি তো…..”
কথার মধ্যেই মালিহা থামিয়ে দিয়ে বলল, “থাক আর বলতে হবে না। পুরোটা শেষ করবেন। তারপর ড্রয়িং রুমে আসেন। আব্বু আর ভাইয়া আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।
জাওয়াদ বলল, “তাহলে এখনই যায়। দেখা করে আসি।”
“কোন দরকার নেই। আপনি অসুস্থ। আগে কিছু মুখে দিন পরে দেখা করা যাবে। সময় পালিয়ে যাচ্ছে না।”
“তুমি কি করে জানলে আমি অসুস্থ? আমিতো বলিনি। ফোনটাও ধরোনি। তবে?”
জাওয়াদের এহেন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল মালিহা। অপ্রস্তুত কন্ঠে বলল, “জানার প্রয়োজন হয় না। আপনাকে দেখেই অসুস্থ লাগছিল। এখন সময় ব্যায় না করে কিছু মুখে দিন।”
অন্যদিকে মনোয়ারা বেগম রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বিয়ের পরে প্রথমবারের মত জামাই এলো। অথচ তিনি কিছু করতে পারছেন না। মেয়েটা আগে কেন বলল না? এখন জামাইয়ের সামনে তো ডাল ভাত দেওেয়া যায় না। এরমধ্যে মালিহার আগমন। মাকে উদ্দেশ্যে করে বললো, “কি করছো আম্মু?”
“কি আর করবো। আগে বলবি তো জামাই আসছে। এতটুকু সময়ের মধ্যে কি করি?”
“এত ব্যস্ত হতে হবে না। যা রান্না আছে তা দিয়ে দিলেই হবে। সাহরীর বেশ সময় আছে।”
“চুপ থাক মেয়ে। প্রথমবারের মত জামাই বাবা আমার বাড়িতে এলো আর তাকে এসব খেতে দিব? তা কি করে হয়! আমি মাংস, মাছ পানিতে ভিজিয়ে রেখেছি। বরফ ছাড়িয়ে গেলে রান্নায় উঠিয়ে দিব। তুই যা জামায়ের কাছে যা।”
মালিহার কোন সাহায্য নিলেন না মনোয়ারা বেগম। এক প্রকার ঠেলেই কিচেন থেকে পাঠিয়ে দিলেন। তার মতে মেয়ে এখন জামাইয়ের সাথে থাকবে। ছেলেটার কখন কি লাগবে। বলা যায়!
ড্রয়িং রুমে আড্ডায় মেতে উঠেছে তিন পুরুষ। মালিহার আব্বু, ভাই আর স্বামী।
দুর থেকে এ দৃশ্য মন ভরে দেখছে মালিহা। তার জীবনের শ্রেষ্ট তিন পুরুষ আজ পাশাপাশি একসাথে। এ দৃশ্য যেকোনো রমনীকে শান্তি দিবে। হুট করেই মনে হলো মালিহার সব একটা একটা করে। যেমন; একটা আব্বু, একটা ভাই, আবার একটা স্বামী। ফিক করে হেসে ফেললো মালিহা। কিসব অবান্তর ভাবনা চিন্তা তার মাথায় আসে।
সবার সাথে আড্ডা গল্প খাওয়া দাওয়া শেষ করে রুমে আসতে প্রায় দুইটা বেজে গিয়েছে। সাহরীর সময় বেশি নেই। আজ সাহরীর শেষ সময় চারটা বেজে সাতাশ মিনিট। মালিহা ঘুমাবে কি ঘুমাবে না এ নিয়ে দ্বিধায় ভুগছিল। কিছুক্ষণ পর আবার উঠতে হবে। আবার ঘুমানো ও যায়। কিন্তু জাওয়াদকে উদ্দেশ্যে করে বলল, “আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি সাহরীর সময় ডেকে দিব।”
“তুমি ঘুমাবে না?”
“বুঝতে পারছি না। ঘুমাবো কি না। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।”
“না। একেবারে সাহরী শেষে ঘুমালেই হবে। তোমার সাথে অনেক কথা জমে আছে আমার।”
“আমি কোন কথা বলতে চাই না।”
“তোমার কিছু বলতে হবে না। তুমি শুধু এই অধমের কথা শুনবে।”
মালিহা অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাড়িয়ে থাকে। মুখে কিছু বলল না।
জাওয়াদ অনুতপ্ত স্বরে বলল, “তুমি আমাকে ফেলে চলে আসলে একটিবার মনে হলো না তুমি ছাড়া কিভাবে থাকবো আমি। তিনটা দিন কিভাবে কেটেছে বোঝাতে পারবো না। আমার ওপর রেগে থেকো না। প্লিজ! আমি একটুও ভালো নেই। তুমি ছাড়া আরও ভালো নেই ইবনাত। আমার সাথে ফিরে চলো! আমি চাইলেও মনের কথাগুলো অন্যদের মত গুছিয়ে বলতে পারি না। অনুভূতি ঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারি না। ফিরে চলো ইবনাত!”
“আমি কোথাও যাব না। যাওয়ার জন্য তো আসিনি। তাছাড়া নিজেই তো বলেছেন চোখের সামনে না থাকতে। তাহলে!”
“রেগে গিয়ে বলেছিলাম ইবনাত। রেগে গিয়ে কিছু বললে সেটা সিরিয়াসলি নিতে নেই তুমি জানো না?”
“রাখেন আপনার রাগ। ভাবির রুমে ছিলাম সেদিন রাতে একটাবার খোঁজ নিয়েছিলেন?”
“বিশ্বাস করো ইবনাত আমি অবশ্যই খোঁজ নিয়েছিলাম। কিন্তু রুমে ঢোকার সাহস হয়নি। তুমি রুম থেকে বেরিয়ে আসার পর অনেকক্ষণ ছাদে কাটিয়েছি। পরে দেখি তুমি নেই। ভাবির রুম ভেতর থেকে লক করা। তাই ভেবেছি দিনের আলোয় তোমার অভিমান ভাঙাবো। কিন্তু কোথায় কি! পরে জানতে পারলাম তুমি এ বাড়িতে চলে এসেছো। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল, পায়ের নিচে জমিন নেই এমন বাজে অনুভব হচ্ছিলো। তুমি বুঝবে না মেয়ে। আবার সেদিনই অফিসে অনেক কাজের প্রেশার ছিল। সবমিলিয়ে আমার অবস্থা নাজেহাল। তুমি তো চলে এলে বাপের বাড়ি। রেখে এলে ভাঙাচোরা জাওয়াদকে। একটা বার মনে পড়েনি আমার কথা?”
“না। আমি অপমান অবহেলা এত সহজে ভুলে যেতে পারি না।”
জাওয়াদ বুঝলো তার প্রেয়সী কঠিন রেগে আছে। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো মালিহাকে। মালিহা কিছুক্ষণ ছোটার চেষ্টা করলেও পরক্ষণে জাওয়াদের বুকের সাথে লেপ্টে রইলো। অনেক সময় হাজার কথা ব্যায় করা লাগে না। শুধু প্রেয়সীকে এভাবে একটু জড়িয়ে ধরলেই হয়। কিছুক্ষণ পর জাওয়াদ অনুভব করলো টিশার্ট ভেজা। বলল, ”ইবনাত তুমি কাঁদছো কেন? বোকা মেয়ে!”
জাওয়াদের কোমল কন্ঠে মালিহার কান্নার বেগ বাড়লো। শব্দ করে কেঁদে উঠলো সে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো জাওয়াদকে। যেন ছুটে যেতে না পারে। কান্নাভেজা গলাই বলল, ” এমন যদি করেন এরপর শুধু ও বাড়ি থেকে না পৃথিবী থেকেই চলে যাবো। খুজে পাবেন না কোথাও। মানুষের ইমোশন নিয়ে খেলতে ভালো লাগে বুঝি? আমি কি মানুষ না? নাকি আমার অনুভূতি নেই? কেন এমন করেন? আমি যদি সবটুকু দিয়ে আপনাকে ভালোবাসতে পারি তবে আপনি কেন এক ফোঁটা ভালোবাসা দিতে পারেন না? কেন কেন?”
জাওয়াদের বুক ধ্বক করে উঠলো। বুঝে না বুঝে মেয়েটাকে কতটা আঘাত করেছে সে। না জানি কত কষ্ট পেয়েছে! তবুও ভালোবাসতে কার্পণ্য করেনি মালিহা। এটা ভেবে এত কষ্টের মধ্যেও জাওয়াদের সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে। পৃথিবীতে কজন মানুষ মালিহার মত জীবনসঙ্গী পাই? জাওয়াদ পেয়েছে। সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি পুরুষ।
জাওয়াদের নেত্র যুগল ছলছল করে উঠলো। ধরা গলাই বলল, “আল্লাহর দোহাই ইবনাত। এমন কথা মুখেও আনবেনা। তোমাকে এক ফোঁটা না এক সমুদ্র ভালোবাসি। আর এ ভালোবাসার পরিমাপ করা যায় না। আছে শুধু বিশালতা আর গভীরতা। তোমার দুঃখগুলো নির্বাসনের শেষ সুযোগটা একবার দিয়েই দেখো। ইনশাআল্লাহ ইনশাআল্লাহ কোন অভিযোগ করার সুযোগ দিব না। একটা বার ইবনাত। দিবে কি?”
মালিহা প্রতিত্তোরে নিরব থাকে। সে তার মানুষটার বুক থেকে দুঃখগুলো নির্বাসনে দিয়ে সুখ খুজেঁ নিতে ব্যস্ত। এই তো শান্তি। আহ্!
ইনশাআল্লাহ চলবে…..