‘দিন শেষে আরো দিন আসে’ (শেষ পর্ব)
ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
আমাদের জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা প্রায় সময়ই ঘটে থাকে। তাই বলে সবসময় সেটা নিয়ে পড়ে থাকলে তো আর চলবে না। আমি যখন জানতে পারলাম যে মি. আহমেদ নয় এই ব্যাপারটা নিয়ে কেবল তার মা-ই ভেবেছেন তখন আমার একটু খারাপ লেগেছিল। আমি ভেবেছিলাম হয়তো ওনার সম্মতিতেই এমন একটা প্রস্তাব নিয়ে আন্টি হাজির হয়েছিলেন। আমার তখন মিশ্র অনুভূতি হওয়ার কারণ এটা ছিল কেউ আমাকে স্ত্রী হিসেবে চাইছে। আমার ধারণা ভুল ছিল। অনুভূতি আছে কি নেই সেটা বলতে পারছি না। তবে আমি একটু নড়বড়ে হয়ে পড়েছিলাম এই ঘটনার পর। কাজ কর্মে আমার মনোযোগ কমই বসতো এরপর থেকে। আন্টি আমাকে কয়েকবার কল করেছিলেন। আমি কেবল দুই বারই রিসিভ করেছি। আসলে তার কথা যখন শুনি তখন আমি আসলে দুর্বল হয়ে পড়ি। আমি তাই এড়িয়ে যাচ্ছি টিনটিনকেও। ব্যাপারটা সে সইতে পারছে না। আমারও খারাপ যে লাগছে না তা নয়। তবে এটাই আমার কাছে আপাতত সঠিক মনে হচ্ছে। বাস্তবিক চিন্তা করলে এমন একটা প্রস্তাব আমার গ্রহণ করা অনুচিত। আমাকে কারো মা হতে হলে আগে অবশ্যই কারো স্ত্রী হতে হবে। এবং স্ত্রী এর যথাযথ মর্যাদা আমি আশা করি। যা মি. আহমেদ আমায় দিতে পারবেন না আমি জানি। যে মানুষটা স্ত্রীর মৃ’ত্যুর এত বছর পরও বিয়ে করেনি সে হঠাৎ করে আমাকে বিয়ে করতে যাবেই বা কেন? অবশ্যই নিজের স্ত্রীকে তিনি অসম্ভব ভালোবাসেন। নয়তো আরো আগেই কেউ আসতো তাঁর জীবনে। আমি যদি এখন তাঁর স্ত্রী হয়ে যাইও আমাকে যে তিনি ভালোবাসবেন তার কি গ্যারান্টি আছে?
আমার পরিবার সাদামাটা পরিবার। ভাই আর ভাবির ব্যাপারটা একটু আলাদা। তবে আমার বাবা-মা সাধারণ জীবনটাই প্রেফার করেন। মা কিংবা বাবা কেউই চান না আমি এমন কোনো পরিবারে যাই। মায়ের কথা আমাকে একজন ন্যানি হিসেবেই থাকতে হবে। বাচ্চাটার দেখভালের জন্যেই আমাকে তাঁরা নিতে চান। নইলে এত বড় বাড়ির ছেলের জন্য আমাকেই কেন নিবে? আরো কত মেয়েই তো আছে। আমি জানি মি. আহমেদ এর পরিবার ওই চিন্তা ভাবনা করেনি তবে পরের কথাটাও তো সত্যি।
স্কুল থেকে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। আজ বেলা তিনটায় সবাইকে উপস্থিত থাকতে হবে। সাড়ে তিনটা থেকে প্রতিযোগিতা শুরু হবে। প্রতি বছর এটা কয়েকবারই হয়। মূলত এক পার্ট থেকে অন্য পার্টে কে কে যাওয়ার যোগ্য সেটাই পরীক্ষা করা হয়। ছোট বাচ্চাদের জন্য আমরা সেটা প্রতিযোগিতা বলেই চালিয়ে দেই। পরীক্ষায় তাদের একটু ভী’তি কাজ করে তো তাই।
আমি স্কুলে পৌঁছে দেখলাম টিনটিনের সাথে তার বাবাও এসেছে। টিনটিন আমার কাছে ছুঁটে এসেছিল। পেছনে ওর বাবাও এলো। আমি তাকে এড়িয়ে যেতে পারলাম না ভদ্রতার খাতিরে।
-‘কেমন আছেন?’
-‘আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো। আপনি?’
-‘এই তো বেশ আছি। আপনাদের আয়োজনটা চমৎকার হয়েছে।’
-‘ধন্যবাদ।’
মাইকিং হতেই আমি বিদায় নিয়ে এলাম তাদের থেকে। প্রতিযোগিতা শুরু হলো কিছুক্ষণ পরেই। আমি সিঁড়িতে গিয়ে বসলাম। পাশেই হল রুমে ছাত্র ছাত্রীরা সব ছবি আঁকছে। হঠাৎ আমার পাশে একজন এসে বসল। আমি চমকে উঠলাম। মি. আহমেদ হাসলেন। বললেন,
-‘ভ’য় পেলেন?’
-‘না না, ভ’য় পাইনি।’
-‘মিস লিয়া! আমি আপনার কাছে একটা বিষয়ে কথা বলতে এসেছি।’
আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। বললাম,
-‘জ্বি বলুন!’
উনি আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন কিছু সময়। এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
-‘আমি আমার স্ত্রীকে ভালোবাসি।’
-‘জানি।’
উনি একটু অবাক হলেন বোধহয়। পরক্ষণেই হাসলেন। বললেন,
-‘আপনি বুদ্ধিমতী।’
-‘এটা বোঝার কথা।’
-‘তা অবশ্য ঠিক। তবে অনেকের ধারণা আমার ক্যারেক্টার ভালো না। তাই বিয়ে করছি না। কিন্তু … বুঝতেই পারছেন।’
-‘জ্বি।’
-‘চয়নিকা আমার ক্লাসমেট ছিল। আমরা টেনথ্ ক্লাসেই রিলেশনে জড়াই। অনার্স কমপ্লিট হতেই বিয়ে। তার দু বছর পর এসে যায় আমার টিনটিন আর চলে যায় চয়নিকা। আমি চাইলেই বিয়ে করতে পারি। ভালো লাইফ লিড করতে পারি। কিন্তু আমার সেই ইচ্ছেটাই ম’রে গেছে। আমার টিনটিনকে নিয়েই আমার দুনিয়া। আমি সবসময় চাই আমার টিনটিন ভালো থাকুক। তবে সেটা অবশ্যই কাউকে দুঃখ দিয়ে না।’
আমি তার কথা গুলো মন দিয়ে শুনলাম। আমি ঠিক এমন কিছুই আশা করেছিলাম। আমার ধারণা মিলে গেছে। উনি বললেন,
-‘আপনি প্লিজ এই ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে হতাশ হবেন না। আসলে পুরোটাই আমার মায়ের ইচ্ছেতেই হয়েছে। মায়ের মন তো! বোঝেনই! মায়েরা চায় আমরা ভালো থাকি। তবে এখানে আরেকটা ব্যাপারও আছে, মা চান টিনটিন ভালো থাকুক। অন্য কেউ এসে টিনটিনকে ভালোবাসবে না মা এটাই মানেন। তাই আপনার কাছে একটা আবদার নিয়ে চলে গেছেন। তবে এটা তিনি খেয়াল করেননি যে তার চাওয়াটা অপরজনের প্রতি অ’ন্যায় হয়ে যায়। আমি বলছি না আপনি ব্যাপারটা ভুলে যান। আমি শুধু চাই আপনি প্লিজ, এই ব্যাপারটা নিয়ে টিনটিনের থেকে দূরত্ব রাখবেন না। আপনি তার সাথে ততটুকুই থাকুন যতটুকু একজন টিচার হিসেবে থাকার কথা। আপনার এড়িয়ে চলাটা আমার টিনটিনের উপর প্রভাব ফেলছে। ও মাঝে প্রাণোচ্ছল হলেও এখন আবার আগের মতো হয়ে যাচ্ছে। আমি আপনাকে কিন্তু ইউজ করছি না মিস। আপনিই বলেছিলেন আপনি দেখবেন যতটা সম্ভব হয় আপনাদের পক্ষে। আপনারা চেষ্টা করবেন ওর মুখে হাসি ফোঁটাতে।’
আমি ভেবে দেখলাম। ইশ! আমি কি বোকার মতো কাজ করেছি? টিনটিনের এসব নিয়ে কোনো লেনাদেনা নেই। আমি অথচ ওকেই বড় পুঁজি করে ফেলেছিলাম এই এড়িয়ে চলার যু’দ্ধে। ও তো আমার ছাত্রী, আমার কাছে বাকিদের মতোই। আমি কেন ওকে অন্য চোখে দেখতে গেলাম? দো’ষটা তো এখানে আমারই বেশি!
-‘আমি মন থেকে ক্ষমা চাইছি মি. আহমেদ। এমনটা করা আমার আসলেই উচিত হয়নি।’
-‘ইটস্ ওকে। আপনি নিশ্চয়ই এমনি এমনি তো এমনটা করেননি। এই তো আর বেশি দিন নেই, আর কয়টা দিন একটু সহ্য করুন দয়া করে।’
-‘মানে?’
-‘টিনটিনের ফুপির কাছে টিনটিনকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমার বড় বোন সারা। অনেক আগে থেকেই টিনটিনকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছে। আমি দেইনি। সন্তানকে চোখের আড়াল করতে ভালো লাগে না যে তাই।’
-‘আশ্চর্য! আপনি এটা করবেন কেন?’
-‘এটা করতেই হবে। টিনটিন এই বয়সটা যখন মা ছাড়া বড় হয়েছে পরের বয়সটুকুও পারবে আমি আশা রাখি। এই পরিবেশে ওর মা নেই। ওই পরিবেশে ওর সেই সমস্যা হবে না। আমার বোনের মা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ওর একটা বাচ্চার খুব শখ। নিজের ভাইয়ের মেয়েকে ও নিজের সন্তানের মতোই লালন করবে আমি আশা করি।’
-‘এখন এতো উঠে পড়ে লাগছেন কেন টিনটিনকে ওদের কাছে দিতে?’
উনি এই প্রশ্নে কিছুক্ষণ চুপ ছিলেন। এক সময় মাঠের ঘাস গুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন,
-‘টিনটিন আজকাল একটা অ’ন্যা’য় আবদার করছে। তাই।’
-‘যেমন?’
-‘সেদিন যখন আপনি ওকে বলেছিলেন আপনি সবসময় ওর সাথে থাকবেন না তারপর থেকেই প্রতিনিয়ত ও আবদার করে যাচ্ছে যে কেন আপনি ওর সাথে সারাদিন থাকতে পারেন না? ওর আপনাকে সবসময় চাই। সবসময়ের জন্য আপনাকে ওর কাছে এনে দিতে হবে। আর যেটা আমার পক্ষে সম্ভব না।’
আমি হল রুমের দিকে তাকালাম। জানালার পাশেই টিনটিন বসেছে। খুব মনোযোগ দিয়ে আর্ট করছে সে। আমার এক রাশ ভালোবাসা তাকে গিয়ে ছুঁলো। সেই সাথে বেশ কিছু সহানুভূতি। আমরা সবসময় যা চাই তা হয় না। আমাদের বাস্তব সম্মত চিন্তা করতে হয়। আমি যে সমাজে আছি সেই সমাজ এমন বিয়ে সহজভাবে গ্রহণ করে না। আমার পরিবারই গ্রহণ করবে না। আর পরিবারের বাইরে গিয়ে কিছু করার আমার নেই। যদি এখানে অন্য কিছু থাকত তবে হয়তো আমি যেতাম। সেই অন্য কিছুটাই নেই।
আমার ফোন রিং করছে। হাতে নিয়ে দেখলাম মায়ের কল। আমার মন যাতে অন্য দিকে না ঘুরে যায় তাই আমার মা বাবা আমাকে যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে দিয়ে দিতে চান। তাদের ধারণা আমি টিনটিনের দাদুর কথায় গলে গিয়ে হয়তো ভুল স্টেপ নিয়ে ফেলব। তাই আমাকে এই মাসেই বিয়ে দিয়ে চিন্তার বোঝাটা মাথা থেকে নামাতে চাইছেন। আজ সন্ধ্যায় পাত্রপক্ষ আসবে। আমার বড় খালামণির পরিচিত। শুনেছি পছন্দ আমাকে আগেই করেছে। আজ আংটি পরিয়েই যাবে। মি. আহমেদ আমার পাশ থেকে উঠে চলে গেলেন। আমি তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। না! কোনো অনুভূতি কাজ করছে না আমার তার জন্য। দিন শেষে নতুন দিন আসে, আসবেই। তবে হারিয়ে যাওয়া মানুষ গুলো আর আসবে না। এক্ষেত্রে উনার এবং টিনটিনের জন্য আমি কেবলই সমবেদনা বোধ করছি। এছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা এখানে কখনোই কিছু ছিল না। টিনটিন একদিন বড় হবে, খুব বড় হবে। এই কঠিন দিন গুলো একদিন শেষ হবে, সে একা চলতে শিখবে। সে বুঝতে পারবে সবাই আমাদের সাথে সবসময় থাকে না এটা জগতের নিয়ম। তখন আর সে কাঁদবে না, বায়না ধরবে না। আমার দোয়া রইল তার জন্য। মা হারা মেয়েটা হয়তো মায়ের আদর পায়নি তবে তার যদি কখনো গর্ব করার মতো কিছু থেকে থাকে তবে সেটা তার বাবা। কেননা সে একজন চমৎকার বাবা পেয়েছে। একদিন তাই টিনটিনের মা হারানোর দুঃখের থেকেও এমন বাবা পাওয়ার আনন্দ বেশি হবে।
(সমাপ্ত।)