‘দিন শেষে আরো দিন আসে’ (পর্ব-১)
ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
আমার আর্ট স্কুলের নতুন ছাত্রী টিনটিন। ভালো নাম হুমাইরা নাজ, বয়স পাঁচ হবে। তাকে সবাই টিনটিনই ডাকে। কেউ কেউ আদর করে ডাকে তো কেউ আবার একটু মজা করার জন্য এই নামে ডাকে। টিনটিন রাগ করে না তাতে। মেয়েটা ভীষণ চুপচাপ থাকে সবসময়। কথা বলে খুব মেপে মেপে। এই বয়সের বাচ্চারা সাধারণত এমন হয় না। এই বয়সের চঞ্চলতা, নতুন কিছু জানার আগ্রহ, কৌতূহলী মনোভাব কিছুই টিনটিনের মধ্যে দেখা যায় না। ছোট একটা বাচ্চা অথচ সে যেন এখনই সব কিছুতে আগ্রহ হারিয়ে বসে আছে। আমি বেশ কিছুদিন নোটিস করেছিলাম। মেয়েটার হাব ভাব অন্য বাচ্চাদের মতো নয়। আমি একদিন তাকে ডেকে কথাও বলেছি। যা যা প্রশ্ন করেছি সবকিছুরই মিনমিন করে জবাব দিয়েছে। একবার মনে হচ্ছিল সে ভয় পাচ্ছে আবার মনে হলো ভয় না! মন খুলে কথা বলতে পারে না সে। আমার কাছে একটু অদ্ভুত লাগল ব্যাপারটা। তাই আমি তার প্যারেন্টস্ কল করলাম পরদিন। একজন বয়স্ক মহিলা কল রিসিভ করেছিল। পরিচয় জানতে চাইলে জানান তিনি টিনটিনের দাদু। তিনি জানালেন টিনটিনের বাবা বাসায় নেই। তবে আমার কল করার কথা তিনি তাঁর ছেলেকে জানিয়ে দেবেন।
সেই সপ্তাহে আর কোনো ক্লাস ছিল না। তাই টিনটিন আর আসেনি। আমার মাথা থেকেও এক মুহূর্তের জন্য ওর কথা বেরিয়ে পড়ে। এত কাজের চাপে মনেই ছিল না আসলে। এরপর এলো শনিবার। টিনটিনের ক্লাস ছিল সেদিন। আমার খেয়াল ছিল না। আমি রোজকার মতোই অফিস রুমে বসে তখন কাগজ পত্র ঘাটাঘাটি করছি। দরজায় নক হলো। আমি ভেতরে আসার অনুমতি দিলাম। অনুমতি পেয়ে দরজা খুলে এক সৌম্যদর্শন পুরুষ ভেতরে ঢুকল। সত্যি বলতে আমি একটু ভড়কে গিয়েছিলাম এক মুহূর্তের জন্য। লোকটা নিজের পরিচয় দিলো।
-‘হ্যালো মিস! আমি ওয়াসিফ আহমেদ। হুমাইরার বাবা।’
একটু চমকে উঠেই যেন বললাম,
-‘টিনটিনের বাবা?’
লোকটা আমার কথা শুনে চমৎকার করে হাসলেন। মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বললেন,
-‘জ্বি, টিনটিনের বাবা।’
আমি খেয়াল করলাম আমি তখনও তাকে বসতে বলিনি। তাই হন্তদন্ত হয়ে বললাম,
-‘প্লিজ হ্যাভ আ সিট মি. আহমেদ।’
ভদ্রলোক বসলেন চেয়ার টেনে। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম চা, কফি কি নিতে চান? তিনি জানালেন কিছুই নিবেন না এখন। তার খুব দরকারি কাজ আছে। টিনটিনের ব্যাপারে আমি কি বলতে চেয়েছিলাম সেটাই জানতে চাইলেন তিনি। আমি তাকে জানালাম তার সন্তানের আচার আচরণ সম্পর্কে। এবং জিজ্ঞেস করলাম,
-‘ছোট বাচ্চাটা কি এমন কারণে এত উদাস থাকে? আপনি কিংবা আপনার স্ত্রী কেউই এটা লক্ষ্য করেননি?’
সব শুনে কিছু সময় নিরব ছিলেন তিনি। একটু পরই বেশ ঠান্ডা গলায় বললেন,
-‘টিনটিনের মা নেই। ওর জন্মের সময় কিছু প্রতিকূলতার কারণে আমার স্ত্রী মারা গেছেন।’
এমন জবাব আমি আশা করিনি। এত ছোট্ট একটা বাচ্চা মা ছাড়া বড় হচ্ছে? সব হিসেব যেন মুহূর্তেই মিলে গেল। তবুও চুপ থেকে শুনছিলাম লোকটার সব কথা।
-‘আমার যে পেশা তার কারণে আমাকে বছরে এদিক সেদিক যেতেই হয়। মেয়েকে সত্যি বলতে খুব কম সময়ই দেই আমি। তারপরেও যতটুকু পারি চেষ্টা করি। টিনটিন আমার মায়ের সাথেই থাকে সবসময়। মা ওর খেয়াল রাখেন। তারপরেও ও সবসময় নিজের মায়ের অভাব বোধ করে। আমি সেটা বুঝি। প্রথম প্রথম ও বায়না ধরতো যে মায়ের সাথে স্কুলে যাবে। কেননা সব বাচ্চারাই মায়ের সাথে আসে। অফ পিরিওডে মায়েরা বাচ্চাদের খাইয়ে দেয়। টিনটিন ন্যানির কাছেই থাকে। আগে ও এত জেদ করত না, স্কুলে যাওয়ার পর থেকেই মা নিয়ে ওর একটু মন খারাপ ভাব, জেদ এসব এসেছে। কিছুদিন আগে তার এসব জেদের জন্য আমি..
কথাটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন তিনি। আমি অপলক তাকিয়ে রইলাম। কি করেছিলেন তিনি? মেয়েটাকে মেরেছেন? একটু সময় নিয়ে তিনি বললেন,
-‘আই স্কোলডেড হার। এরপর থেকে সে আর আবদার করেনি এমন কিছুর। কথা বলাও কমিয়ে দিয়েছে। আমি বুঝিয়েও বলেছি অনেক। লাভ হচ্ছে না।’
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
-‘আমি বুঝতে পেরেছি মি. আহমেদ। তবে ভালো হতো আপনি ওকে না বকে ধীরে সুস্থে বুঝিয়ে বললে।’
-‘আই থিঙ্ক সো।’
-‘ওর বন্ধু বান্ধব নেই কোনো?’
-‘না। ও মিশতে চায় না কারো সাথে।’
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মেয়েটার জন্য আমার মায়া হলো ভীষণ। আমি টিনটিনের বাবাকে আশ্বস্ত করলাম আমাদের আর্ট স্কুল থেকে আমরা সবাই যথাসাধ্য চেষ্টা করব টিনটিনের এই মন খারাপ দূর করে ওকে হাসি খুশি রাখার। উনি শুনে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলেন বোধ হয়। আমাকে তার ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বললেন,
-‘কোনো সমস্যা হলে আমার নাম্বারে কল করবেন মিস।’
এরপর থেকে আমি সবসময় টিনটিনের খেয়াল রাখতাম। সবসময় চেষ্টা করতাম ও যেন একটু ফ্রী হতে পারে সবার সাথে। ক্লাসের সবার সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দিলাম। একটা সময় ওর সাথে আমারই সখ্যতা বেড়ে গেল। টিনটিন বন্ধুদের থেকেও আমার সাথেই থাকতে পছন্দ করত খুব। যেদিন ক্লাস থাকত সেদিন সে সবার আগে চলে আসত। এসেই গল্পের ঝুড়ি খুলে বসত। আমি তখন অবাক হয়ে ভাবতাম, আশ্চর্য! এটা সেই মেয়েটা? যে চুপ করে ক্লাসের এক কোণে বসে জানালার দিকে মুখ করে তাকিয়ে থেকে আকাশ দেখত?
একদিন ক্লাস শেষে টিনটিন আবদার করল ওর সাথে আমাকে বরফ পানি খেলতে হবে। আমি বললাম দুজনে খেললে তো মজা নেই। ও চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল ও ছুটবে আর আমাকে ওর পিছু নিতে হবে, ওকে পাকড়াও করতে হবে। আমি প্রথমে রাজি হইনি। ও খুব অনুরোধ করতে লাগল যে আমি রাজি না হয়ে পারলাম না। আসলে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে না বলা সম্ভব নয়। আমি ওই নিষ্পাপ, ছোট্ট মা হারা বাচ্চাটাকে না বলিই বা কী করে? ওর কথা মতো ছুঁইছুঁই খেলা শুরু হলো। ওকে ছুঁতে পারলেই আমি জিতে যাবো। এটা আহামরি কঠিন ছিল না আমার জন্য। এক নিমিষেই ওকে ধরে ফেলা আমার বা হাতের কাজ। কিন্তু তাতে বাচ্চাটার আনন্দটা অল্পতেই শেষ হয়ে যাবে। তাই মিছেমিছি ছুটছিলাম আর বারবার বলছিলাম,
-‘টিনটিন দাঁড়াও, আমাকে ধরতে দাও।’
ও হাসছিল আর দৌঁড়াচ্ছিল। আমি যখন শেষবার ডাকলাম তখন সে পেছন ফিরে বলল,
-‘আমাকে ধরতে পারবে না।’
সাথে সাথেই হোঁচট খেয়ে ও পড়ে গেল। আমি দৌঁড়ে গিয়ে ওকে তুললাম। গায়ের মাটি ঝেড়ে দিয়ে ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইলাম কোথায় আঘাত পেয়েছে? সে নিজের হাঁটু দেখাতেই আমি দেখলাম কিছুটা ছিলে গেছে জায়গাটা। ওকে কোলে তুলে নিয়ে যখন আমি যখন অফিস রুমের দিকে রওনা দিব তখনই খেয়াল করলাম একজন আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছেন। ডার্ক ব্লু শার্ট আর ব্ল্যাক প্যান্ট পরিহিত এক যুবা পুরুষ, যার এক হাতে পরনের ব্ল্যাক কোর্টটা ঝুলছে। একটু ক্লান্ত আর অগোছালোও লাগছে বটে মানুষটাকে। অবাক করা বিষয় এতেও তার সেই চার্মিং ভাবটা কাটেনি বরং আরো কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। লোকটা তখন আমাদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। টিনটিন তাকে দেখেই ‘বাবা’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। মি. আহমেদ একটু এগিয়ে এসে আমার কোল থেকে টিনটিনকে নিয়ে নিলেন। আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। কি না কি ভাবছেন লোকটা? আমি থাকতেও তার মেয়েটা পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে। নিশ্চয়ই খুব রেগে গেছেন উনি। আমি তাই দ্রুত বলে উঠলাম,
-‘আই আম সো স্যরি মি. আহমেদ। আমার গাফিলতির কারণেই টিনটিন ব্যথা পেয়েছে। রিয়েলি আম স্যরি!’
তিনি টিনটিনের গালে চুমু খেয়ে বললেন,
-‘ইটস্ ওকে মিস। এটা খুব স্বাভাবিক। বাচ্চারা খেলতে গিয়ে একটু আধটু আঘাত পাবেই। বড় কেউ বাচ্চাদের সাথে খেলতে গিয়ে আঘাত পেল কিনা সেটাই দেখার বিষয়।’
টিটকিরি করল কিনা বুঝলাম না। তবে আমি ভীষণ লজ্জা পেলাম। উনি বললেন,
-‘ওর খেয়াল রাখার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ মিস। আজ তবে আসছি। পরে কখনো দেখা হবে আবার।’
আমি ইতস্তত করে বললাম,
-‘ওর পায়ে একটু স্যাভলন লাগিয়ে দেই? ইনফেকশন হতে পারে! আমার কাছে আছে ফার্স্ট এইড বক্স।’
-‘শিওর!’
আমরা দুজন পাশাপাশি হাঁটতে লাগলাম। টিনটিন তার বাবার কানে ফিসফিস করে কি যেন বলছিল বারবার। আমার জানার আগ্রহ জাগলেও জানতে চাইলাম না। বাবা মেয়ের ব্যাপারে আমার না ঢোকাই উত্তম। রুমে এসে আমি যখন স্যাভলন হাতে নিলাম টিনটিন চেঁচিয়ে উঠল। আমি অবাক হয়ে গেলাম। ওর বাবা বললেন,
-‘ও স্যাভলন লাগাতে ভয় পায়। একটু জ্বা’লা করে তো, সহ্য করতে পারে না।’
আমি টিনটিনকে বুঝিয়ে বললাম এখন একটু জ্ব’ললেও পরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এখন না দিলে পরে দেখা গেল ইনফেকশন হবে। তখন ইনজেকশন দেওয়া লাগে যদি? টিনটিন ইনজেকশনের কথা শুনে আরো ঘাবড়ে গেল। ওর বাবার দিকে তাকালো আতঙ্কিত হয়ে। ওর বাবাও মাথা নেড়ে সায় জানালো আমার কথার। টিনটিন রাজি হলো। আমি খুব সাবধানে কাঁ’টা স্থান স্যাভলন দিয়ে ওয়াশ করে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলাম। ওরা যাওয়ার আগে আমি আদর করে ওর কপালে চুমু খেয়ে বললাম,
-‘ভালো থেকো। নিজের খেয়াল রেখো।’
ও চমকে উঠে বলল,
-‘কেন? তুমি থাকবে না আমার খেয়াল রাখার জন্য?’
মি. আহমেদের সামনে ওর করা এমন প্রশ্নে আমি একটু বিব্রতবোধ করলাম। বললাম,
-‘আমার সাথে তো তোমার আবার নেক্সট উইক দেখা হবে। আমি তো সবসময় তোমার সাথে থাকব না। এই কয়দিন নিজের যত্ন নিও।’
-‘উফ! সেটা তো অনেক দিন।’
আমি হেসে ফেললাম ওর কথা শুনে। ওদেরকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। মি. আহমেদ যাওয়ার আগে আরেকবার ধন্যবাদ জানাতে ভুললেন না।
পরের সপ্তাহের শনিবারে আমার জরুরী কাজ থাকায় আমি সেদিন স্কুলে আর যেতে পারিনি। পরদিন রবিবারেও যাওয়া হয়নি। সেই দুই দিনই আবার টিনটিনের ক্লাস ছিল। রবিবার মাঝ রাতে একটা অচেনা নাম্বার থেকে আমার ফোনে কল আসে। আমি রিসিভ করলে ওপাশে ব্যক্তি পরিচয় দিলেন তিনি টিনটিনের বাবা। আমি ভীষণ চমকে গেলাম। পরমুহূর্তেই মনে হলো টিনটিনের কিছু হলো নাকি? তিনি জানালেন তেমন কিছুই না। টিনটিন দুই দিন আমার দেখা পায়নি। মিস করছিল আমায়। কথা বলতে চায়। আমি টিনটিনের সাথে কথা বললাম বেশ কিছুক্ষণ। ও রাগ করেছে খুব। আমি স্যরি বলে মাফ চাইলাম। ও বলল পরদিন ওর জন্মদিন। আমি যেন যাই। তাহলেই ও আর রাগ করে থাকবে না। ওর কথা শেষ হলে মি. আহমেদ ও আমায় অনুরোধ করলেন আমি যেন টিনটিনের জন্মদিনে যাই। সরাসরি না বলতে পারলাম না। বললাম সময় বের করতে পারলে যাব।
পরদিন সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই এমন সময়ে আমি তাদের বনানীর বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। গিয়ে তো আমি রীতিমত তব্দা খেয়ে গেলাম। এত বড় বাড়িতে, দুই তিনটে কাজের লোক আর একজন বৃদ্ধা আর টিনটিন ছাড়া কেউই নেই। টিনটিন আমাকে দেখে ছুটে এলো। আমি কোলে তুলে নিলাম ওকে। হাতের টেডি বিয়ারটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
-‘হ্যাপি বার্থডে লিটেল পাম্পকিন।’
টিনটিন টেডি বিয়ার দেখে খুশি হয়ে গেল। আমার কোল থেকে নেমে টেডি নিয়ে সোফায় গিয়ে বসল। বয়স্ক ভদ্র মহিলা এগিয়ে এলেন আমার দিকে। আমি বুঝতে পারলাম উনি টিনটিনের দাদু। সালাম দিতেই তিনি আমাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরলেন। তার ভীষণ অমায়িক ব্যবহারে আমি মুগ্ধ হলাম। কথায় কথায় জানতে পারলাম টিনটিনের জন্মদিন হলেও দিনটা টিনটিনের মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীও তাই কখনোই অনুষ্ঠান করে কিছু করা হয় না। এতিম খানায় বাচ্চাদের খাওয়ানো হয়, গরীব দুঃখীদের দান খয়রাত করা হয় ব্যাস এটুকুই। আর বাসায় টিনটিন একটা কেক কাটে ওর বাবা আর দাদুর সাথে। আমার মনেই ছিল না কথাটা। আমি টিনটিনের দিকে তাকালেম। সে আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল। আমার ওর জন্য সহমর্মিতা জাগল। ছোট আয়োজন যদিও মুখেই ছিল আদৌতে তেমনটা ছিল না। খাওয়া দাওয়ার এলাহি কান্ড দেখে আমার মাথায় হাত। সব নাকি আমায় খেতে হবে। টিনটিনের দাদু নিজ হাতে রান্না করেছেন সব। এত এত আইটেম দেখে আমার ক্ষুধা মিটে গেল। আমি এত খেতে পারলাম না। উনি জোর করলেন খুব তবুও আর খেতে পারিনি। আমি আসলে রাতে এত খাই না। দুইটা রুটি আর সবজি বা ডিম ভাজা দিয়েই আমি ডিনার করি। আর আটটার মধ্যেই খেয়ে নেওয়ার অভ্যাস আমার। তারপর দশটায় বেডে গিয়ে এগারোটায় ঘুম। ওই এক ঘন্টা আমি মুভি দেখি অথবা বই পড়ি।
নয়টার দিকে টিনটিনের বাবা ফিরলেন। আমি তখন চলে আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সবাই আমাকে কেক কাটার সময় পর্যন্ত থাকার জন্য অপেক্ষা করতে বললেন। টিনটিন বলল আমি চলে গেলে সে কেক কাটবে না। অতঃপর আরো কিছুক্ষণ থাকলাম। কেক কাটার পর আমি যখন ফিরব তখন আন্টি তথা মি. আহমেদের মা বললেন,
-‘লিয়া? তুমি কি বলো! ওয়াসিফের এখন একটা বিয়ে করা উচিত না?’
আমি কি বলব? আমার এখানে বলারই বা আছে কী? তবে গুরুজনের প্রশ্ন এড়িয়ে যেতেও পারলাম না। আর তাছাড়া ওনার ছেলের এখনও সামনের একটা বড় অধ্যায় পড়ে আছে। মা হিসেবে উনি নিশ্চয়ই চান তাঁর ছেলে নতুন করে শুরু করুক সবটা। আমি তাই বললাম,
-‘জ্বি। উচিত নিশ্চয়ই।’
মি. আহমেদ আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন তখনই। আমি বুঝতে পারলাম না এভাবে কেন তাকালেন? রেগে গেছেন নাকি? ধুর! কারো পারিবারিক মা’মলায় আমার যাওয়ার কাজ নেই। আমি দ্রুত বিদায় নিয়ে নিজের বাড়ি ফিরলাম।
তিন দিনই পরই সেই আশ্চর্যজনক ঘটনাটা ঘটল। বাবা আমাকে জানালেন পাত্র পক্ষ দেখতে আসবেন। আমি প্রস্তুত ছিলাম না এমন কিছু শোনার জন্য। বাসায় এক দফা রাগারাগি হলো। বাবা বললেন বিয়ে তো বললেই হয়ে যাচ্ছে না। একটু দেখা সাক্ষাৎ হোক। ভাবিও বোঝালেন। বয়স বেড়ে যাচ্ছে আমার। আমি বুঝলাম, আমার বয়স বেড়ে যাওয়াতে ভাবির সমস্যাও বেড়ে যাচ্ছে। কি ভেবে রাজি হলাম। বিকেলে পাত্র পক্ষ এলো। আমি তখন আমার রুমেই শাড়ি পরে তৈরি হয়ে বসেছিলাম। হঠাৎ করেই টিনটিন দৌঁড়ে এলো। তাকে দেখে আমি চমকে উঠলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
-‘কার সাথে এসেছ টিনটিন?’
-‘দাদুর সাথে।’
একটু পরেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো। আমার মা সব শুনে রাজি হলেন না। বাবাও হ্যাঁ বলতে পারলেন না তখনই। একটু সময় নিলেন। যাওয়ার আগে আন্টি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
-‘একটু ভেবে দেখো মা। আমার নাতনিটা মা ছাড়া বড় হয়েছে। তুমি ফিরিয়ে দিলে বাকি জীবনটাও মা ছাড়া থাকবে। আমি হয়তো ছেলের জন্য অন্য কাউকে বউ করে আনতে পারব, কিন্তু নাতিনের জন্য মা আনতে পারব না।’
আমার যে কি হলো! এই একটা কথা আমাকে গভীরে গিয়ে স্পর্শ করল। আমি ভাবুক হয়ে পড়ে রইলাম। রাতে ভাইয়া আর ভাবি, মা বাবাকে বোঝাতে লাগলেন প্রস্তাবটা ফেলে দেওয়ার মতো না। বিরাট বড় ধনকুবের ওয়াসিফ আহমেদ। খানদানি এবং অভিজাত বংশ তাদের। তাদের দশ বার বাজারে বেঁচতে পারবেন। ভাইয়ার কথা শুনতে আমার ভালো লাগছিল না। ভাইয়া কি নিজের মা বাবা কিংবা বোনকে এই চিনেকে? কারো নাম, যশ, খ্যাতি, সম্পদ এসবে কি আমাদের কোনো লো’ভ আছে? কোনো দিন ছিল কী?
মায়ের এক কথা একটা বিপত্নীক এবং এক বাচ্চার বাবা এমন ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিবেন না। তাদের মেয়ের তো কোনো ত্রুটি নেই। তবে কেন দিবেন এমন ঘরে বিয়ে? যদি বাচ্চা না থাকত তবুও হতো। একটা বাচ্চা আছে। এটা সম্ভব না। ভাইয়া রাগারাগি করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন। তার এক কথা দিলে এই ঘরেই বোনকে বিয়ে দিবেন। ভাইয়ার উদ্দেশ্য কি জানি না। তবে আমার মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিল।
সেই রাতে বারোটায় ও আমার ঘুম এলো না। আমি ঘরময় পায়চারি করছিলাম। বারোটার পর আমার ফোন বেজে উঠল। মি. আহমেদ কল করেছেন। আমি নার্ভাস হয়ে পড়লাম। এত রাতে কল করেছেন কেন তিনি? কি বলতে চান? আমি রিসিভ করলাম।
-‘মিস! আই আম এক্সট্রিমলি স্যরি। আমার পরিবারের কাজের জন্য আমি সত্যিই লজ্জিত। আমি জানতাম না মা এমন কিছু করবেন। ট্রাস্ট মি।’
#চলবে।