শাড়ি পড়া মেয়েদের আমার ভালো লাগে। তা লাল হোক, নীল, সাদা বা হলুদই হোক। আমার কাছে শাড়ি শাড়িই।
আমার এই কথাটা মনে হয় সামনের বাসার মেয়েটা জানে। রোজ রোজ নতুন পুরান শাড়ি পড়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসে!
নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে যায়। তাঁর শাড়ির আঁচল ধরে বসে থাকতে মন চায়।
সেদিন ভোরে উঠে শুনছি আমার ছোট ভাইটা পড়ছে, “ মাই হবি ইজ গার্ডেনিং! ”
স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। শোবার ঘর থেকে ভাবছি, ও আল্লাহ্ আজকে ওর জ্বর-ট্বর আসলো নাকি? নাহলে যে ছেলের একমাত্র কাজ ভাঙ্গাচোরা করা। তাঁর “হবি” নাকি “ গার্ডেনিং! ”
লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে দেখলাম ভাইটার সামনে সেই শাড়িওয়ালী বসে আছে! ওহ, কাহিনী জটিল! কাহিনী কঠিন!
আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম, “ এইটা কী করলেন আপনে? একটা বিবাহতুল্য মেয়ের হাতে ছোট মিঞাকে তুলে দিলেন! ”
আম্মা যেন আকাশ থেকে পড়লো!
“ তুলে দিছি মানে? সে আজ থেকে ওকে পড়াবে। ”
“ পড়াবে মানে? আপনে আমার ব্যাপারটা দেখলেন না! সবসময় ছোট মিঞাকে এগিয়ে রাখেন। এটা ঠিক নয়। ”
“ হাতের কাছে বেলুন আছে আমার, দেখতে পাচ্ছিস? তুই কী চাস ও পরীক্ষায় ফেল করুক? ”
আমার আম্মা আবার কাজে কথায় এক। একটু দূরে গিয়ে বললাম।
“ সবই ঠিক আছে। তবে মেয়েটাকে বলে দিয়েন শাড়ি পড়ে না আসতে। তাহলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আপনি ঠেকাতে পারবেন না। ”
মা জননী মনে হয় তাঁকে মানা করেনি। কারণ রোজ রোজ শাড়ি পড়ে আসে তাঁর বন্ধ হয়নি!
ছোট ভাই একটু সুসু করতে যাওয়ায় তাঁর সাথে আমার কথা বলার সুযোগ হলো।
না জানি আমার মুখে হাসির কী আছে। আমাকে দেখে যেন তাঁর হাসি উথলাইয়ে পড়ছে!
“ একটা কথা বলার ছিলো। ”
“ জ্বী বলুন। ”
রোজ রোজ শাড়ি আপনি পান কোথায়? ”
“ আলমারিতে থাকে। বাপজান দেয়, বড় ভাইয়া দেয়। ছোট ভাইয়া দেয়। বড় আপু দেয়। দুলাভাই দেয়। মামা দেয়, মামানি দেয়, ভাবী দেয়। বড় চাচা দেয়। ছোট চাচা দেয়। কাকীমা দেয়, তাঁদের ভাইয়েরা দেয়। নানাজান দেন। বান্ধবীদের থেকে কর্যা করে এনে আর দেই না। আর আম্মুর তো আছেই! ”
কিছুটা আশ্চর্য তো হলামই। তাঁকে এতো মানুষ শাড়ি দেয়।
“ আচ্ছা যাই হোক, আপনি আর শাড়ি পড়ে খাটাশটাকে পড়াতে আসবেন না৷ অনুরোধ রইলো। ”
সে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
“ কেনো? ”
“ আমার সমস্যা হয়। ”
এর মাঝে ছোট মিঞা চলে আসলো। সে একদম শৃঙ্খলা শিখে গিয়েছে! সময় করে খায়, সময় করে ঘুমায়। ভোর ভোর উঠে খাতা কলম নিয়ে বসে। কলম কামড়ায়। ভাবটা যেন আইনস্টাইন হতে যাচ্ছে!
মেয়েটার প্রতি খুব রাগ হচ্ছে। সে আমার কথা শুনছে না। আমার ঘুম, খাওয়া, অফিস সব হারাম করে দিয়ে সে খলখলে হাসে, একের পর এক শাড়ি পড়ে!
চোখে একটু তেল দিয়ে লাল করে তাঁর সামনে গিয়ে কিছুটা ধমক দেয়ার মতো করে বললাম।
“ আপনাকে আমি মানা করেছিলাম শাড়ি পড়তে? শুনেননি কেনো? ”
মেয়েটা হাসি চেপে বললো, “ কালকেও আম্মুর জন্মদিনে আন্টিরা প্রায় তেরোটা শাড়ি দিয়ে গিয়েছে, আমি কী করবো বলুন? ”
“ আপনি শড়ি পড়ুন, শাড়ি খান, শাড়ি মাথায় দেন৷ শাড়ি পুড়িয়ে পাস্তা বানান। যাচ্ছেতাই করুন। শুধু শাড়ি পড়ে এই বাড়িতে আসবেন না দয়া করে। ”
মেয়েটার আরেকটা অভ্যাস আছে। কেনো কেনো করার৷
“ কেনো? ”
“ এখন আপনাকে কীভাবে বুঝাবো? সাত দিন ধরে একটা কাজ পড়ে আছে৷ আপনার জন্য করতে পারি না। ”
“ আপনি কী করেন? আর্কিটেক্ট? বিল্ডিং এর নকশা আপনার দ্বারা হয়? নাকি সব রান্নাঘর বানান? ”
ওহ, মেয়েটা কথাও বলতে পারে! কঠিন কথা।
আমি কী বলবো বুঝতে পারলাম না।
“ দেখুন, কালকেও যদি শাড়ি পড়ে আসেন। আমি আঁচল ধরে বসে থাকবো তখন। সেটা নিশ্চয় চান না? ”
মেয়েটার মুখের জ্যামিতি কেমন করে বদলে গেলো!
খুব আস্তে করে বললো, “ আমার শাড়ির আঁচল শুধু জামাইকে ধরতে দেই। আর কাউকে না। ”
এতো সহজ বাংলা একটা বাক্য শুনে আমার বুকের ভেতরটা ফেটে গেলো!
ছোট্ট করে দুঃখিত বলে চলে এলাম। জীবনে একটা মেয়েকে পেয়েছিলাম মনে হচ্ছিলো। যার শাড়ির আঁচলে হাতটা বাঁধা যাবে ভাবতে শুরু করেছিলাম। তাঁরও জামাই আছে!
রান্না ঘরে গিয়ে আম্মাকে বললাম।
“ করল্লার ভাজি করিয়েন। ”
দুদিন ধরে রুম থেকে বের হই না। ছোট মিঞা বললো, “ ভাইয়া আমাকে সাজিয়ে দাও। ”
“ মেয়ে নাকি তুই? ”
“ ছেলেরা কী সাজে না? রাস্তায় বের হলেই দেখি পার্লার ফর বয়েস! ওখানে কারা যায়? ”
“ আচ্ছা, যাবি কোথায়? ”
“ ম্যামের সাথে, ম্যামের বরের আজকে জন্মদিন। গিফট কিনতে যাবো দুজনে। ”
সে নিজে নিজেই তৈরি হয়ে নিলো। আজ এতোই খুশি সে।
দুপুরের দিকে দুজন আবার ফিরে আসলো। মেয়েটা বললো, “ চলুন আমাদের সাথে৷ আমার জামাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবো। আমার বিশ্বাস, আপনি তাঁকে পছন্দ করবেন। ”
মেয়েটাকে কীভাবে বুঝাব যে তাঁর জামাই দুধে ধোয়া তুলসী পাতা হলেও আমার তাঁকে পছন্দ হবে না!
“ ধন্যবাদ, ভবিষ্যৎ এ একদিন। ”
“ আপনি গেলে আমি খুশি হতাম। ”
মেয়েটা বড় কঠিন, বুকে তীর মেরে আবার হাতুড়ি দিয়ে মারছে!
মানা করে দিয়েছি। দিন যাচ্ছে। আম্মাজানকে বলে দিয়েছি কদিনের মধ্যে আমি বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাবো।
আম্মা আমাকে দিচ্ছেন না। তাঁর একটা মেয়েও নেই। আমি গেলে নাকি ঘরটা ফাঁকা লাগে। তাইতো আজও ঘর ছাড়তে পারিনি।
ছোট ভাই আসার পরে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ম্যাডামের জামাই কেমন রে?
সে উত্তর দিয়েছে, “ দারুণ। আমাকে দেখে হেসেছে। খুবই খুশি হয়েছে। ”
পরশু মেয়েটা আমার শোবার ঘরেই চলে এলো। “ আপনি? ”
“ হ্যাঁ আমি, আপনি কী সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমান? একটু বেরও হোন না? ”
নাহ, বের হই তো। ”
“ আচ্ছা, চলুন না আজকে আমার সাথে। জামাইয়ের সাথে আপনাকে পরিচয় করিয়ে দিবো। আপনি তাঁকে পছন্দ করবেন। আমার বিশ্বাস। ”
তাঁর জামাইকে আমার পছন্দ অপছন্দ দিয়ে কী আসে যায়? এই কথাটাই তাঁকে বললাম। সে বুঝতে চায় না। আমাকে যেতেই হবে। আমাকে তাঁর জামাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়েই দিবে।
সে বুঝতে পারছে না।
লোকটাকে দেখলেই আমার মনে হবে খুন করি! সকালে চা হাতে নিয়ে চলে আসলো।
“ যাবেন এখন? আমার জামাই এখন ঘুমাচ্ছে। উঠলেই আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবো। ”
আমি বরাবরের মতো মানা করলাম।
রাত বারোটায় হঠাৎ এক নাম্বার থেকে ফোন আসলো। ধরতেই সে পরিচয় দিয়ে বললো, “ আসবেন এখন? জামাই আমার সাথেই আছে। শাড়ির আঁচল ধরে শুয়ে আছে। পরিচয় করিয়ে দিবো। আসেন না প্লীজ! ”
পরশু রান্নাঘরে গিয়ে আম্মাকে বললাম, “ আজকে খিচুড়ি পাকাইয়েন। ”
আম্মা বেশ নাখোশ হয়ে বললেন, “ একটা মেয়ে এতো করে বলছে তাঁর সাথে একটু গিয়ে জামাইয়ের সাথে পরিচিত হয়ে আসতে। যাচ্ছিস না কেনো? ”
আমি আম্মার কথার কী জবাব দিবো?
“ আচ্ছা, খিচুড়ি খাবো না। ”
বলে চলে এলাম।
ইদানীং মেয়েটা একটু বেশিই আসছে বাড়িতে। গাল মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে। অভিমানী মুখ। মাঝে মাঝে খুব আফসোস হয়। ইশ, মেয়েটা যদি এই অভিমানটা অন্য কারণে করতো। যদি কারো বৌ না হতো! তাহলে আমি কতো ভালোবাসতাম।
সন্ধা সন্ধা বারান্দায় বসে আছি। মেয়েটা এসে বললো, “ আমার না অস্বস্তি লাগছে। চলুন না, আমার জামাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবো। একটু গেলে কী হয়। সামনের বাসাটাই তো। দুমিনিট লাগবে। ”
মেয়েটাকে বলে দিলাম।
“ আমি কোনোদিন যাবো না আপনার জামাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে। ”
মেয়েটা মন খারাপ করে চলে গেলো। ভেবেছিলাম আর আসবে না। আসলেও এই কথাটা বলবে না।
চলুন, জামাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবো।
কিন্তু সে পরেরদিন এসে সোজা হাতটা ধরেই বললো, “ আজকে আপনাকে আমার সাথে যেতেই হবে। আমার জামাইয়ের সাথে পরিচিত হতেই হবে। ”
আমি হাতটা ছাড়িয়ে বললাম, “ জামাই ছাড়া অন্য কারো হাত ধরলে পাপ হয়। ”
মেয়েটে খুব রেগে বললো, “ তারমানে আপনি যাবেনই না? ”
“ নাহ। ”
“ আচ্ছা আমার জামাইকেই তাহলে এখানে নিয়ে আসবো। সে অনেক লক্ষ্মী ছেলে। একবার বললেই আমার সাথে চলে আসবে। আপনার মতো হিংসুটে না। ”
তাঁর জামাইয়ের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়ার যে কী প্রয়োজনীয়তা আছে তা সে নিজেই ভালো জানে!
সকালে আমার অভ্যাস। দাঁত মাজতে মাজতে আমি খবরেরকাগজ পড়ি। কিছু হাসির শিরোনাম পড়তে পড়তে দাঁত মাজা ভালো হয়।
এরকম ভোরেই একজন এসে বললো, “ চলুন। ”
“ এরকম ভোরে কোথায়? ”
“ কোথাও না, আপনি যা অলস। আমার জামাইকেই অবশেষে এই বাড়িতে আনতে হলো। ”
খুব দুঃখ লাগলো। লোকটাকে এখন দেখতেই হবে। বুকের ব্যথাটা আরো বেড়ে যাবে। যতটুকু স্বাভাবিক আছি৷ আর তাও থাকতে পারবো না।
তবুও আমি বেলকনি দিয়ে লাফ দেয়ার চিন্তা করলাম।
অহেতুক বুকের ব্যথা বাড়িয়ে লাভ নেই৷
“ তিনি কোথায়। ”
“ আপনার আম্মার সাথে। ”
“ আমি পরিচিত হতে যাবো না। বেলকনি দিয়ে লাফ দিবো। ”
মেয়েটা হাতজোড় করে বললো, “ প্লীজ, আপনি শুধু একবার উনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিন। তারপর আর আমি আপনাকে বিরক্ত করবো না। ”
এভাবে কোনো মেয়ে চোখ মুখ শীতল করে হাতজোড় করলে তা আর মানা করা যায় না। চোখটা বন্ধ করেও একবার লোকটার সাথে দেখা করা উচিৎ। বললাম, চলুন।
মেয়েটা আমার পিছন পিছন আসলো। আম্মার কাছে নিয়ে গেলো।
“ এটাই আমার জামাই, আমার গ্রেট জামাই! হাই জানু, টাটা দাও অলস লোকটাকে! ”
আমি কার্টুন হয়ে গেলাম সত্যিই! একটি কোলের বাচ্চা, ফুটফুটে বাচ্চা। যার পড়নে এখনো ডায়পার, দাঁত উঠেনি! সে নাকি তাঁর জামাই, ওহ খোদা!
ছেলেটাকে আমি চিনি। সামনের বাসাটাতেই থাকেন লাবিব ভাই। উনার ছেলে! লাবিব সাহেবদের উপরের তলাতেই থাকেন উনার হবু পুত্রবধূ!
দাঁত ক্যালিয়ে আমি হেসে দিলাম। চোখের কোণে এক ফোঁটা পানি এসে গেলো। আম্মা হাসলেন। তিনিও মনে হয় কথাটা এই প্রথমই শুনলেন।
ছেলেটা দেখতে একটু বেশি মাত্রায় কিউট তো! কোলে না নিয়ে থাকা গেলো নাহ। আম্মা চলে গেলে মেয়েটা বললো, “ বলেছিলাম না আমার জামাইকে আপনার পছন্দ হবেই! হলো তো? ”
“ হ্যাঁ, খুব। ”
“ এখন আমার জামাই আমার কাছে দিয়ে দিন। তাঁকে নিয়ে চলে যেতে হবে। নাহলে শ্বাশুড়ি আম্মা বকবেন। উনার নাশতা করার সময় হয়ে গিয়েছে। ”
আমি দিলাম না। মেয়েটা কাছে আসলো। বাচ্চাটা শাড়ির আঁচল ধরে একবার মুখে দিচ্ছে, একবার বের করছে। আমি হাসছি, মেয়েটা লজ্জা পাচ্ছে৷
“ যাও, নিয়ে যাও। নিয়ে যাও তোমার গ্রেট জামাইকে। সে আসলেই আমার মতো হিংসুটে না। আশা করি আমার মতো অলসও হবে না। ”
মেয়েটা আরো লজ্জা পেয়ে বললো, “ থাকুক আপনার কাছে। সুসু করে দিলে আমাকে ডাকবেন। আমি উনার আম্মাকে বলে আসি! ”
আমি মাথা নাড়ালাম। মেয়েটা চলে গেলো।
নাহ, কিছুটা পথ গিয়েও আবার ফিরে এসে বললো, “ আচ্ছা আপনার কোনো সমস্যা নেই তো? যদি আমার গ্রেট জামাই শাড়ির আঁচল ধরে বসে থাকে? ”
“ নাহ! ”